রঙ বেরঙে প্রণয় পর্ব-০৩

0
83

#রঙ_বেরঙে_প্রণয়
#পর্ব_৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

ঘড়ির কাঁটায় এখন সময় বেলা এগারোটা ছুঁইছুঁই। স্কুলের টিচার্স লাইব্রেরিতে বসে বসে ফোন টিপছে সহন। পরনে সাদা রঙের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। চুলগুলো বেশ ফ্রিজি ওর, ক্লাসিক কাট দেওয়া। এগারোটা বিশ থেকে ক্লাস সহনের। এখন অফ পিরিয়ড চলছে। লাইব্রেরির বাইরে স্কুলের বারান্দায় দুই দশম শ্রেনী পড়ুয়া কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক দাঁড়িয়ে আছে বলা যায় না, একটু হাঁটছে আবারো দাঁড়াচ্ছে। দুজনেই ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। কী এক বিষয় নিয়ে দু’জনের মধ্যে দোনোমোনো চলছে।
” আহা চল না আগে! গিয়ে বলে তো দেখি স্যার রাজি হোন কিনা। ”
শায়লা একটু জোর দিয়েই বললো কথাটা। আতিকা সাহস পাচ্ছে না। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী আতিকা। বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে। তবে মেয়েটা ভীষণ ভীতু। সামান্য বিড়াল দেখলেও ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। শায়লা আবার অন্য রকম। শ্যামবতী শায়লা ভীষণ চঞ্চল। কথার খৈ ফোটে তার মুখে।
” না রে শায়লা। আম্মু নিজেই কল দিয়ে কথা বলবেন স্যারের সাথে। ”
আতিকার কথায় শায়লা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতেই যাবে তার আগে সহন দু’জনকে ডাক দেয়।

” শায়লা! তোমরা কী নিয়ে আলোচনা করছো? ক্লাস রেখে এখানে কী? ”

স্যারের ডাকে আঁতকে উঠল আতিকা। শায়লা আতিকার হাত ধরে লাইব্রেরির দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললো,
” স্যার একটু আসি? জরুরী কথা ছিলো। ”
জরুরী কথা? সহন একটু ভেবে দু’জনকে ভেতরে ঢুকতে বললো। আতিকা চুপ করেই রইলো, শায়লা বললো যা বলার। শায়লার বলা কথার সারমর্ম হলো, ওরা দু’জন এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত সহনের কাছে প্রাইভেট পড়বে। মূলত সহন বায়োলজির টিচার হলেও ইংলিশ সাবজেক্টও প্রাইভেট পড়ায়। দু’টো ব্যাচ আছে। একটা ছুটির পর পড়ে আরেকটা সন্ধ্যায়। তবে বাসায় কাউকে পড়তে আসতে বলে না। শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে পড়ায়। সহনের হাতে এখন অতিরিক্ত ব্যাচ তৈরি করে স্টুডেন্ট পড়ানোর মতো সময় নেই। আর শায়লা আর আতিকা চাচ্ছে ওদের দু’জনকে বাসায় গিয়ে যাতে আলাদা পড়ানো হয়।

” দেখো শায়লা আমার হাতে আসলে সময় নেই। অলরেডি দু’টো দল পড়ছে। তাই নতুনভাবে সময় বের করে তোমাদের বাসায় গিয়ে পড়াতে পারবোনা। ”
সহনের উত্তরে বেজায় মন খারাপ লাগছে আতিকার। এতকিছু করেও কি স্যারকে কিছুক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পারবে না! শায়লা হাল ছাড়ার পাত্রী না। সে হেসে হেসে পুরো উদ্যমে আবারো বলে,
” স্যার তাহলে আমরা আপনার বাসায় যাবো! রাতে, বিকেলে যখন বলবেন যাবো। আমাদের বাসা থেকে সমস্যা নেই। এতে আপনারও সুবিধা হবে স্যার। কারণ কোথাও যেতে হবে না। হুহ?”

সহন ফোনের দিক থেকে নজর সরিয়ে ওদের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। সামনে পরীক্ষা তবে ওদেরকে দেখে কখনোই মনে হয়নি লেখাপড়া নিয়ে এতে চিন্তা করে। তবে এখন যে ভাবছে সেটাও কম কীসে? সহন মুচকি হেসে বললো,
” ঠিক আছে। বাসায় গিয়ে আমার সাথে তোমাদের অভিভাবকদের কথা বলতে বলবে। তারপর কাল থেকে রাত আটটায় পড়তে আসবে। ”

” অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমরা আসছি। ”

শায়লা প্রফুল্লচিত্তে কথাগুলো বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দুই বান্ধবী খুশি খুশি মনে বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরি থেকে। সহন যদি জানতো এই প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে কী দূর্গতি পোহাতে হবে ওকে তবে কখনোই রাজি হতোনা।

” বড়ো আম্মু কী রান্না করছো? ”
হাতের আস্ত আপেলটা মুখে পুড়ে এক কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতে শুধালো তাহমি। চুলোর উপরে বসানো কড়াইয়ের উপর নজর ওর। সময়টা এখন সন্ধ্যাবেলা। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। সহনের মা আইমান রাতের জন্য রান্না করছেন। ফাইজা নিজের ঘরে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। সহন এখনো বাসায় ফেরেনি।
” ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছি রে। বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে খিচুড়ি হলে জমে যাবে বল?”

খিচুড়িতে পানি দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে দিলেন আইমান খান। তাহমিও খিচুড়ি পছন্দ করে খুব।
” পুরো জমে যাবে গো। ফাইজা কই? আর তোমার ছেলেটা? ”
” ফাইজা পড়ছে। সহন তো বাসায় ফেরেনি এখনো। ”
দু’জনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে সোফায় বসলো। হাতের আপেলটা অর্ধেক খেয়ে টেবিলের উপর ফলের ঝুড়িতে রাখলো তাহমি। ভ্রু কুঞ্চিত করে একবার দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো,
” তোমার ছেলে এসে পড়েছে। দরজা খুলে আসছি। ”
আইমান থ হয়ে বসে আছে। হাঁটার শব্দ শুনেই বুঝে গেলো? অবশ্য বুঝবে না কেনো? ছোটো থেকে তো একসাথে আছে সবাই। ফাইজা আর সহনের সবকিছুই খুব খেয়াল করে তাহমি। মেয়েটাই আসলে এমন কাছের মানুষদের খুব খেয়াল রাখে, আগলে রাখে। তাছাড়া তাহমির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব সজাগ যাকে বলে সিক্স সেন্স।
” কী রে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো লাফাতে লাফাতে এসে দরজা খুললি কেন?”
ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো সহন। তাহমির হাসি হাসি মুখখানা মুহুর্তেই চুপসে গেলো। সহন ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজা আঁটকে দিয়েছে। আইমান গেছেন রান্নাঘরে খিচুড়ি কতদূর হলো সেটা দেখতে।
” তুই একটা গরু। সারাদিন পর এসে হাম্বা হাম্বা না করে ঘরে যা। শয়তান ছেলে একটা! ”
সহন কিছু বললো না। এমনিতেই ইচ্ছে করে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করেছে তাহমিকে। তার উপর আর কিছু বললে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না মেয়েটাকে। সারাদিন পর শরীর যথেষ্ট ক্লান্ত সহনের।
” আহা রাগ করিস না। মজা করেছি। আচ্ছা চল রুমে চল তোকে একটা জিনিস দিচ্ছি। ”
” জিনিস! ”
পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো তাহমি। সহন মুচকি হেসে ঘরের দিকে এগোলো। সাথে তাহমিও গেলো পিছুপিছু। ঘরে ঢুকে বিছানায় ধপাস করে বসলো তাহমি। সহন শার্ট খুলে কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ডার্ক চকলেট বের করলো। তাহমি বসে বসে পা দোলাচ্ছে। খিচুড়ি খাবে ভেবে মনটা বেশ ফুরফুরে তার।
” ধর। ”
” আয় ধরি।”
” আরে চকলেট! ”
তাহমি সহনের মুখাবয়বের দিক থেকে নজর সরিয়ে নিচে হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। চকলেটটা হাত থেকে নিয়ে হেসে বললো,
” এত্তগুলা ধন্যবাদ ভাইয়া। তুই খুব ভালো। ”
সহন তোয়ালে দিয়ে আস্তে একটা মুখে বাড়ি মেরে অন্য দিকে ফিরে বললো,
” তুই একটা খারাপ মার্কা মেয়ে। তুই রুদ্রর বিয়েতে বাগড়া দিয়েছিস কেন? ”
একহাতে চকলেট খেতে খেতে অন্য হাত দিয়ে সহনের কোমর ধরে নিজের দিকে ফেরাল তাহমি।
” এখন বল। ”
” বললাম তুই রুদ্রর হবু স্ত্রীকে কী বলেছিস? তাহমি তুই এমন কেন ভাই? তোর কি লাজলজ্জা হবে না? রুমডেটের কথা বলে তুই ব্লাকমেইল করছিস রুদ্রকে! আরে এটা ছেলেরা করে মেয়েরা না।”
সহন একটু জোরে জোরে বললো কথাগুলো। তাহমি নড়াচড়া করলোনা। চুপচাপ বসে সহনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকলেট খাওয়া শেষ করলো। সহন জানে এই মেয়েটা এমনই। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ওর উত্তরের অপেক্ষায়।
” রুদ্র তোর কাছে এসেছিল ভাইয়া? ”
” না আসলে জানলাম কীভাবে বল!”
” ঠিক, ঠিক। ”
” শোন তাহমি, জোর করে সম্পর্ক হয় না। তাছাড়া ও যখন বিয়ে করে নিতে চাচ্ছে তুই এরকম করছিস কেন? এমন তো না যে তুই ওকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসিস।”
” সময়, আবেগ এসব দিয়ে তো ভালোবাসতাম বল?”
সহন বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। সরে যেতে চাইলো ওখান থেকে। তাহমি হাত ধরে থামাল।
” সর গোসল করতে যাবো। ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
” আমি আর সুনয়নাকে কিচ্ছু বলবো না তবে ওদের বিয়ের পর রিসিপশনে অবশ্যই যাবো। ওকে? আমি ফাইজার কাছে গেলাম।”
তাহমি বসা থেকে উঠে হেলেদুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সহন সেই দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাকে কী বললো এতক্ষণ? বেচারা রুদ্রর রিসিপশনে অবশ্যই ইউনিক কিছু হবে।

সকালের নাস্তা খেতে খেতে স্ত্রী’র সাথে মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনায় মশগুল ফাহিম খান। যেহেতু লেখাপড়ার দিকে মন নেই তাই যেন-তেন পড়ালেখা করে তো ভালো চাকরি করতেও পারবে না! আর বিয়েও করবে না এখন। তাহলে কী করবে সে?
” আমিও তো সেটাই ভাবছি গো। তোমার মেয়ের সাথে আমি কিছুতেই পারি না। ”
হতাশাগ্রস্ত হয়েই বললেন জাহানারা। ফাহিম কিছুটা আস্বস্ত করতে বলে,
” আমি কথা বলবো তাহমির সাথে। নিশ্চয়ই আমাকে হতাশ করবে না আমাকে। ”
” হতাশ না হতাশার চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিবে তোমার গুনধর মেয়ে, হুহ্! ”

চলবে,