স্বপ্ন জুড়ে তুমি পর্ব-১৬+১৭

0
119

#স্বপ্ন_জুড়ে_তুমি
#পর্ব_১৬
#সামসুন_নাহার

“আমি খালেদের সাথে কথা বলেছি।বলেছি তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা।তারা রাজি হয়েছে।এই বৃহস্পতিবার গায়ে হলুদ আর শুক্রবার বিয়ে।”

সাইদুর রহমানের কথায় আতিফা বেগম বললেন,

“এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কি দরকার আছে।যাক না আরো কিছুদিন।”

সাইদুর রহমান নিজের স্ত্রীর দিকে চোখ রাঙিয়ে দেখে বলল,

“আমি যেটা বলব সেটাই হবে।তোমার কথায় কিছু হবে না।আর তোমার মেয়ে যা কীর্তি করেছে এসব শুনলে ওকে কেউ আর বিয়ে করতা চাবে না।আরহানের মত ভালো ছেলে আমরা পাব না।আরহানের সাথে প্রিয়শার বিয়ে হলে প্রিয়শা অনেক সুখে থাকবে।”

“আসলেই কি আমার মেয়ে সুখে থাকবে যেখানে ও বিয়ে করতেই রাজি হচ্ছে না।এভাবে জোর করে মেয়েটাকে বিয়ে দিবে।”

সাইদুর রহমান রাগান্বিত চোখে আতিফা বেগমের দিকে তাকিয়ে জোরে বলল,

“আমি যা করব আমার মেয়ের ভালোর জন্য করব।তোমাকে ভাবতে হবে না।বেশি কথা বলা শিখে গেছ।বোনকে দেখে এসব শিখছ।তবে লাভ হবে না।আমি যা বলব তাই হবে। বলে দিলাম।”

আতিফা বেগম আর কোনো কথা বললেন না।মাথা নিচু করে রাখলেন।আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা স্ত্রীদের সাথে উঁচু গলায় কথা বলে।আর স্ত্রীরা তা মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়।সাইদুর রহমান আবার বললেন,

“তোমার গুনধর মেয়ে কই।তাকে দেখছি না।”

আতিফা বেগম মলিন মুখে বললেন,

“প্রিয়শা গত দুইদিন থেকে ঘর থেকে বের হচ্ছে না।না কিছু খাচ্ছে।জোর করে যা খাওয়াচ্ছি। এভাবে থাকলে তো মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“তোমার মেয়ের খুব সাহস বেড়েছে।তবে এই সাহস কিভাবে ছুটাতে হয় তা আমার জানা আছে।ঘরে আছে ঘরেই থাক।বাড়ি থেকে বের হতে দিও না।যদি তোমার মেয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তাহলে তোমার অবস্থা খারাপ হবে।আমি সবাইকে দাওয়াত দিতে যাচ্ছি।সময় কম আবার সব দিক তো আমাকেই সামলাতে হবে।”

সাইদুর রহমান মেয়ের বিয়ের জন্য কাজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যাচ্ছে।তখন হঠাৎ করে প্রিয়শাকে দেখল। প্রিয়শা নিকের বাবাকে দেখে কিছু না বলে পাশ কেটে চলে গেল।সাইদুর রহমান প্রিয়শাকে শুনিয়ে আতিফা বেগমকে বললেন,

“আতিফা তোমার মেয়েকে বলে দাও কাল তার গায়ে হলুদ আর পরশু বিয়ে।ভালো হয়ে থাকে যেন।কোনো রকমের বেয়াদবি আমি সহ্য করব না।”

সাইদুর রহমানের কথা শুনে প্রিয়শা যেন থমকে গেল।ভাবতে লাগল কালকে তার হলুদ। তবে কি তার আর তাহমিদের ভালোবাসা অপূর্ণ থেকেই যাবে।না কিছুতেই হতে পারে না।হয় সে তাহমিদের হবে নাহলে এই প্রিয়শা কারো হবে না।প্রিয়শা নিজের বাবাকে শুনিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“মা বলে দাও।আমি তাহমিদকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না।কোনোদিনও না।”

প্রিয়শার এমন কথা শুনে সাইদুর রহমান তেড়ে এসে প্রিয়শাকে রাগান্বিত হয়ে বলল,

“আর একবার শুধু এই কথা বলে দেখ।”

প্রেমে পরলে নাকি মানুষ সব করতে পারে।তেমনিভাবে প্রিয়শা চেঁচিয়ে বলল,

“বলব একশবার বলব।”

সাইদুর রহমান রাগে লাল হলেন।যেই মেয়ে আজ পর্যন্ত মুখের উপর কথা বলেনি।তিনি যাই বলেছেন তাই করেছে।আজ সেই মেয়ে একটা ছেলের জন্য তার মুখে মুখে তর্ক করছে।সাইদুর রহমান চেঁচিয়ে বলল,

“প্রিয়শা।”

বলেই হাত উঠালেন তখন সামনে আতিফা বেগম সাইদুর রহমানের হাত ধরে নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল,

“কি করছ কি তুমি।এভাবে মেয়ের গায়ে হাত দিচ্ছ।”

“তোমার মেয়েকে ভালো করে থাকতে বলো।”

বলেই সাইদুর রহমান রাগে গিজগিজ করতে করতে চলে গেল।প্রিয়শাও সেই সঙ্গে তেজ দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।আতিফা বেগম অসহায়ের মত শুধু দেখে গেল সবকিছু। তিনি চান প্রিয়শা যেন সুখে থাক।কিন্তু তিনি এটা এটাও জানেন সাইদুর রহমান নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এসছে এবং দিবেই।তাকে যতই বোঝানো হবে ততই জেদ করবে।

………………………………….

“আঙ্কেল শুনুন।”

সাইদুর রহমান নিকটতম আত্মীয়দের প্রিয়শার বিয়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে বাসায় ফিরছেন।হঠাৎ করে পিছন থেকে এমন ডাক শুনে পিছনে ঘুরেন।পিছনে ঘুরে ব্যক্তিকে দেখ সাইদুর রহমানের ডাক তরতর করে বেড়ে গেল।আবার সামনে ঘুরে নিজের গন্তব্যে যেতে লাগল।ফাইয়াজ পিছন থেকে আবার ডাকল,

“আঙ্কেল শুনুন প্লিজ।”

কিন্তু সাইদুর রহমান আর পিছনে ঘুরলেন না।হাঁটতে লাগলেন নিজে গন্তব্যের দিকে। ফাইয়াজ দৌড়ে এসে সাইদুর রহমানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“এভাবে চলে যাবেন না প্লিজ।আমার কথা শুনুন।”

সাইদুর রহমান ফাইয়াজের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

“আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।”

“কেন শুনবেন না।আমার দোষ কি বলেন।শুধু আপনার মেয়েকেই ভালোবেসেছি।আমি আপনার মেয়েকে অনেক সুখে রাখব।একবার বিশ্বাস করে দেখুন। আমি প্রিয়শাকে অনেক সুখে রাখব।”

“চুপ করো থাকো।আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।আমি আর এসব শুনতে চাই না।আমি যার সাথে প্রিয়শার বিয়ে ঠিক করেছি সে প্রিয়শাকে তোমার চেয়ে অনেক ভালো রাখবে। অনেক সুখে রাখবে।আশা করি বুঝেছ।আমার পিছে পিছে আশার চেষ্টা করবে না।”

সাইদুর রহমান চলে গেলেন।পিছনে রেখে গেল এক ভালোবাসা হারানোর ব্যক্তিকে।যে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষের জন্য।ভালোবাসার মানুষেকে নিজের করে পাওয়ার জন্য।
ফাইয়াজ যে এতদিন মনে হয় পাচ্ছিল সব একে একে পূরণ হয়ে যাচ্ছে।তবে কেন তার আশা গুলো পূরণ হচ্ছে না।কেন অপূর্ণতায় তাদের আগলে ধরে আছে।কেন পূর্ণতা তাদের হচ্ছে না।তাদের অপেক্ষারা কি এভাবেই হারিয়ে যাবে অসীমে।

……………………….

“তাহমিদ তোমার চেহারা কি করেছ।আয়নায় দেখেছ একবারের জন্য।”

ফাইয়াজ অসহায়ের মত বলল,

“যার জন্য এতদিন আয়নায় দেখতাম সে অন্য কারো হতে যাচ্ছে।কিভাবে এখন নিজেকে আয়নায় দেখব।নিজের চেহারা দেখলে যে আমার প্রিয়শার কথা মনে পড়ে।”

ফাতেমা বেগম রেগে ফাইয়াজের উদ্দেশ্যে বললেন,

“ওই মেয়ের কথা আমার সামনে বলবে না।”

“আম্মু…”

“কই গেছিলে তুমি।আবার তুমি কি প্রিয়শার আব্বুর কাছে গিয়েছিলে।আর কতবার অপমানিত হতে যাবে তুমি।”

“প্রিয়শা যতদিন আমার হবে না ততদিন।”

“কেন।কেন তুমি একটা মেয়ের জন্য এভাবে ছোট হচ্ছো বারবার। কিন্তু ওই মেয়ে কিছুই করছে না।ঠিকই বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছে।”

“প্লিজ আম্মু প্রিয়শার নামে এভাবে বলিও না।আমি প্রিয়শাকে ভালোবাসি।”

বলেই ফাইয়াজ নিজের রুমে চলে গেল।ফাতেমা বেগম রাগলেন প্রিয়শার উপর। তার জন্য তার ছেলের আজ এই অবস্থা। প্রিয়শাকে তিনি কখনো ক্ষমা করবেন না।

…………………………

বিয়ে বাড়িতে চারদিকে কোলাহলে পরিপূর্ণ। সবাই ব্যস্ত আনন্দ করতে,মজা করতে।সবার চোখে মুখে হাসির ঝলক থাকলেও শুধু হাসি নেই প্রিয়শার মুখে।বিষন্ন হয়ে বসে আছে। চোখে মুখে বিষাদের চিহ্ন। নেই কোনো আনন্দের ঝিলিক।

প্রিয়শার আজ খুব করে মনে পরছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও কল করতে পারবে না তার তাহমিদকে কারন তার মোবাইল তার আব্বুর কাছে।সেদিন প্রিয়শা তাহমিদকে কল করতে ধরতেই সাইদুর রহমান এসে প্রিয়শার ফোন কেড়ে নিয়ে প্রিয়শাকে ঘরবন্দি করে।

প্রিয়শার কাজিনমহল হাসি মজা করতে করতে প্রিয়শার ঘরে আসল। সবাই এসে প্রিয়শাকে এসে বলল,

“আপু তাড়াতাড়ি রেডি হও।বিয়ের কনে এভাবে বসে থাকে না-কি। বরের বাড়ি থেকে মানুষ আসে যাচ্ছে প্রায় কিন্তু কনে এখনো রেডি হয়নি।চলো তোমাকে সুন্দর করে রেডি করে দেই।”

এদের সবার কথা যেন প্রিয়শার কাছে বিষের মত লাগল।প্রিয়শা নিজের রাগ এদের ঝেড়ে জোরে চেঁচিয়ে বলল,

“আমি সাজব না।তোরা সবাই এখন এখান চলে যা।

প্রিয়শার এমন কথায় সবাই ভয় পেয়ে গেল।কারন প্রিয়শা কোনোদিনও তাদের সাথে এভাবে কথা বলেনি।তখন সাইদুর রহমান এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” তোমরা সবাই একটু বাইরে যাও।প্রিয়শার সাথে আমার কথা আছে।আমার কথা শেষ হলে তোমরা এসে প্রিয়শাকে সাজিয়ে দিও।”

সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বেড়িয়ে গেল সবাই বেড়িয়ে যেতেই সাইদুর রহমান বললেন,

“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”

“আমি কোনো সাজব না।”

“তুমি যদি রেডি না হও তাহলে আমি ফাইয়াজকে পুলিশে দিব।আমাকে হয়রানি করার জন্য।প্রতিদিন আমার পিছনে ঘুরে।সাক্ষী আছে অনেক।কি করবে ভেবে বলো।”

প্রিয়শা অবিশ্বাস্য ভাবে তার বাবার দিকে তাকালো।তার তাহমিদ তার জন্য প্রতিদিন তার বাবার পিছনে ঘুরছে।কিন্তু তার বাবা প্রতিদিন তাহমিদকে অপমান করছে।প্রিয়শার আখিদ্বয়ে অশ্রু টলমল করে গড়িয়ে পরল।এই কান্না দেখে তার বাবা নামক মানুষের পাথর সমান হৃদয় গললো না। সাইদুর রহমান আবার বললেন,

“তোমাকে আধ ঘন্টা সময় দিলাম।হয় রেডি হবে নাহলে কি করব জানোই তো।”

সাইদুর রহমান চলে গেল।সাইদুর রহমান চিলে যেতেই প্রিয়শার কাজিনমহল এসে প্রিয়শাকে সাজিয়ে দিল।প্রিয়শাকে নিয়ে স্টেজে নিয়ে গিয়ে বসাল।সবাই কত মজা করে প্রিয়শাকে হলুদ লাগাচ্ছে। কিন্তু প্রিয়শার মুখে হাসি নেই।আজ যদি তার আর তাহমিদের বিয়ে হত তাহলে প্রিয়শার আনন্দের শেষ থাকত না।

কিছুক্ষণ পর বরের বাড়ি থেকে সবাই আসল।সবাই এসে প্রিয়শার সৌন্দর্যের প্রশংসা করছে।কিন্তু প্রিয়শার এই প্রশংসার কোনো দরকার নেই।যেখানে ওর ভালোবাসার মানুষ তার কাছে নেই।আনিসা এসে প্রিয়শাকে হলুদ লাগিয়ে বলল,

“ওয়াও আপু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।ভাইয়া তোমাকে দেখলে পুরোই পাগল হয়ে যাবে।দাঁড়াও ভাইয়াকে ভিডিও কল করি।”

প্রিয়শাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আনিসা আরহানকে ভিডিও কল দিয়ে প্রিয়শার সামনে মোবাইল রাখল।প্রিয়শা মাথানিচু করে আছে।ভালো লাগছে না এসব কিছু তার।

আরহান মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে আছে প্রিয়শার দিকে।আরহান মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলল,

“আমার স্বপ্নের চেয়ে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।তোমাকে এতদিন শুধু আমার স্বপ্নেই দেখেছি। এবার তোমাকে সরাসরি দেখছি।”

হঠাৎ করে প্রিয়শা সামনে থেকে মোবাইল সরিয়ে নিল।আনিসা এসে আরহানকে বলল,

“আপু মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে।তুমি রাখ এখন। ”

আনিসার কথা শুনে প্রিয়শা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।তার মনে এখন কোনো হাসি,লজ্জা, আনন্দ নেই।তার মন জুড়ে শুধু বিষাদ।

#চলবে……………….

#স্বপ্ন_জুড়ে_তুমি
#পর্ব_১৭
#সামসুন_নাহার

বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত।কাজের অন্ত নেই। কেউ কারো দিকে নজর দিচ্ছে না।সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত।কেউ কেউ সাজতে ব্যস্ত আবার কেউ খেতে আবার কেউ কেউ গল্প করতে ব্যস্ত। প্রিয়শার আপন মানুষ জনও কাজে ব্যস্ত। আজ যেন প্রিয়শা ফেলনা।কেউ তার দিকে নজর দিচ্ছে না।কেউ তার আজ মন খারাপের খোঁজ নিচ্ছে না।

প্রিয়শা তার রুমে বিষাদময় সময় কাটাচ্ছে।ভাবছে তার আর তার তাহমিদের কিছু সুন্দর মুহুর্ত। কল্পনা করছে ভবিষ্যতের কিছু সুন্দর মুহুর্ত। যা কখনো পূরণ হবে কি হবে না। জানে না প্রিয়শা।কিন্তু এসব ভাবতেই ভালো লাগছে।আবার চোখ দিয়ে পানিও বের হচ্ছে।আচ্ছা প্রিয়শা যদি এখন কিছু করে বসে তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে।প্রিয়শা ভেবে হাতে ব্লেড নিল।হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে হাতের নাড়ীর কাছে নিয়ে গেল।হাতে লাগালেও কিন্তু হঠাৎ করে ফেলে দিয়ে বলল,

“আমি মরব না।আমি মরলে আমার তাহমিদের কি হবে।আমি বাঁচব আমার তাহমিদের জন্য।”

আবার প্রিয়শা নিজের কান্নায় নিজের ভাবনায় মগ্ন হলো।হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হওয়ায় প্রিয়শা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল সুফিয়া।হয়তো তার বিয়ের অতিথি হয়ে এসছে।সুফিয়া প্রিয়শাকে দেখে দৌড়ে এসে প্রিয়শাকে জড়িয়ে ধরল।সুফিয়া জড়ুয়ে ধরতেই প্রিয়শা হুহু করে কেঁদে দিল। সুফিয়া প্রিয়শাকে বলল,

“কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।আঙ্কেল এত তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে দিচ্ছে হুট করে।”

প্রিয়শা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“দেখ সুফিয়া সবাই আমার কাছ থেকে তাহমিদকে কেড়ে নিচ্ছে।আমার থেকে তাহমিদকে দূরে সরাবে দেখে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”

“তুই বলিস নি তাহমিদ ভাইয়ার কথা।”

“বাড়ির সবাই জানে তারপরও আমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে।আমি তাহমিদকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারব না।না অন্য কাউকে মন দিতে পারব।”

প্রিয়শার এভাবে কান্না দেখে আর কথা শুনে সুফিয়ার কান্না পাচ্ছে।মেয়েটা এই কয়েকদিনের ব্যবধানে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।দেখে মনে হচ্ছে তার দেহটায় এখানে পড়ে আছে আর মন সে তো অন্য কোথাও।সুফিয়ার হাতে যদি কিছু করার থাকত তাহলে সুফিয়া করে দিত কিন্তু।

প্রিয়শা আবার কান্না করতে করতে বলল,

“আমার আর তাহমিদের কি হবে সুফিয়া।আমি থাকতে পারব না তাহমিদকে ছাড়া।এভবে আমাদের অপূর্ণতা আমাদের ঘিরে রাখছে।”

প্রিয়শার এমন কথায় সুফিয়া প্রিয়শাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“কাঁদিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার যদি কিছু করার থাকত তবে আমি করতাম।”

তখন আদিল ঘরে বোনের কান্নাময় চেহারা দেখল।বোনের কান্না দেখে তারও কান্না পাচ্ছে।তার বোনের কষ্ট মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।কিন্তু আদিল নিজেকে শক্ত রাখল।আদিল এসে সুফিয়াকে বলল,

“সুফিয়া আপু তোমাকে ডাকছে আঙ্কেল। ”

সুফিয়া প্রিয়শাকে ছেড়ে দাঁড়াল।নিজের চোখের পানি মুছে প্রিয়শার মাথায় হাত রেখে বলল,

“দেখবি সব ঠিক হবে।তোর ভালোবাসা তোর থাকবে।”

সুফিয়া চলে যেতেই আদিল বোনের কাছে বসল।আদিল আপাতত কোনো ভাষা পাচ্ছে না বোনের সাথে কথা বলার।কিছুক্ষণ পর আদিল প্রিয়শার মুখের দিকে তাকাল।তাকিয়ে দেখল তার বোনের চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে।তার মানে প্রিয়শা কান্না করছে।আদিল সন্তপর্ণে প্রিয়শার চোখের পানি মুছে দিয়ে প্রিয়শাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“বুবু এভাবে কাঁদিস না।সারাদিন রাত শুধু কেঁদেই যাচ্ছিস।এভাবে কাঁদলে তোর শরীর ঠিক থাকবে।তোর কান্না দেখলে আমারো কান্না পায়।কাঁদিস না আর।”

প্রিয়শা ভাইকে আগলে নিয়ে কেঁদে উঠল। সাথে আদিলও কেঁদে দিল।আদিল বোনকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

“আপু তুই কাঁদিস না।তাহমিদ ভাইয়া তোর হবে।তোদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।”

প্রিয়শা আদিলের দিকে তাকিয়ে করুণভাবে বলল,

“সেটা কিভাবে সম্ভব। তুই কি করবি।”

“সব সম্ভব। শুধু তুই আমার উপর ভরসা রাখিস।”

প্রিয়শা আদিলের দিকে তাকিয়ে আছে।তার ভাইয়া আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।তার বোনের কথা ভাবছে।এই বিষাদময় সময়ের মাঝে যেন একটু প্রশান্তি পেল।
তখন মায়া প্রিয়শার কাছে এসে বসল।প্রিয়শাকে দেখে বলল,

“আপি আজ না-কি তোমার বিয়ে।তকমার বিয়ে হলে তুমু শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে।তখন আমি থাকব কিভাবে।”

প্রিয়শা কোনো কথা না বলে মায়াকে দেখছে।ঝগড়ুটে মায়া তাকে এখন থেকে মিস করা শুরু করে দিছে।মায়া হাত বাঁড়িয়ে প্রিয়শার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

“আপি তুমি আমার মত কাঁদছ কেন।তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে।কাঁদিও না তোমার কান্না দেখে আমারও কান্না পাচ্ছে।”

প্রিয়শা মায়াকে জড়িয়ে ধরল।এই ছোট মেয়েটি তার কষ্ট বুঝছে অথচ তার বাবা তার কষ্ট বুঝছে।এখনো নিজের ভালো নিয়ে আছে।
তখন সাইদুর রহমান আসল সাথে নিয়ে এসেছে পার্লারের মেয়ে।প্রিয়শাকে কনে সাজে সাজানোর জন্য।সাইদুর রহমান এসে আদিলের উদ্দেশ্যে বলল,

“তোমার কাজ শেষ এখানে এসে বসে আছ।যাও তোমার কাজে যাও।”

আদিল কোনো কথা না বলে মায়াকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।আদিল বেড়িয়ে যেতেই সাইদুর রহমান পার্লারের মেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন,

“প্রিয়শাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দাও।যেন ওর থেকে কেউ চোখ ফেরাতে না পারে।”

সাইদুর রহমানের এই কথায় প্রিয়শা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।সাইদুর রহমান চলে যেতেই প্রিয়শাকে সুন্দর করে সাজাতে লাগল।

………………………..

লাল-সোনালী রেশমী সুতায় কাজ করা সুন্দর করে শাড়ি, গায়ে ভর্তি গহনা,মাথায় গোলাপ আর বেলিফুল,দুইহাতে মেহেদী, ঠোঁটে লালা লিপস্টিক দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রিয়শাকে। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে বাকি সব সৌন্দর্য প্রিয়শার কাছে ফিকে হয়ে যাবে।যে কেউ চোখ ফেরাতে পারবে না।প্রিয়শা দেখতে সুন্দর আর কনে সাজে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।

সব ঠিক থাকলেও একটা জিনিস ঠিক নাই।সেটা হলো মুখের হাসি।প্রিয়শার মুখের হাসি যেন হারিয়ে গেছে অসীমে। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।সাইদুর রহমান আয়শাকে প্রয়শার কাছে আসতে মানা করে দিয়েছেন। তার ধারণা আয়শা হয়তো প্রিয়শাকে বুদ্ধি দিবে তাই।

প্রিয়শার এই ভাবনার মাঝেই বাইরে সবার চিৎকার চেচামেচি শুনতে পেল।সবাই খুশি হয়ে বলছে,

“বর এসেছে। বর এসেছে।”

এই কথাটি শুনে প্রিয়শা কান্না করর দিল।শেষ তার আর তাহমিদের ঘর বাধার স্বপ্ন শেষ। একসাথে আর জ্যোৎস্না বিলাস করা হবে না।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয়শা অন্য কারো হয়ে যাবে।প্রিয়শা কিছুই করতে পারল না।

বাইরে চেঁচামেচি কমে গেল।হয়তো বরকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।প্রিয়শার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে নিতে আসনে আর সে তিন শব্দের মাধ্যমে অন্যের হয়ে যাবে।কান্নারা বেড়িয়ে আসল হুহু করে।”

প্রিয়শার ভাবনা আর কান্নার মাঝেই আদিল কোথা থেকে আসে প্রিয়শার কাছে এসে বসে বলল,

“আপু মনে আছে আব্বু যেদিন আমাকে মাছ খেতে দিল না।সেদিন আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল।কিন্তু আব্বু আমার কষ্ট বুঝেনি। বুঝেছে নিজের মনের শান্তি।তারপর আমরা কি করলাম আব্বু বাসায় না থাকায় আমরা অনেক খাবার খেয়েছি বিকল্প হয়ে।আব্বু থাকলে আমাদের কোনোদিনও খেতে দিত না।কিন্তু আমরা তো মনের শান্তি ও খুশি হয়েছিলাম তো।”

প্রিয়শা আদিলের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কি বলতে চাচ্ছিস তুই।”

“প্রথমে আব্বু শান্তি পেয়েছে যা আমার পাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু আব্বু বুঝেনি।দ্বিতীয়ত আমরা বিকল্প হিসেবে পরে মনের শান্তি করেছি।অর্থাৎ নিজ নিজ বুঝতে হবে।নিজের ভালো নিজে বুঝতে হবে।”

“মানে।”

“মানে একটায় আব্বু তোমাদের মানছে না।আজকে বিয়ে করলে কিন্তু তোমরা কেউ সুখে থাকবে না।তাই বিকল্প হিসেবে আজ তোর সাথে তাহমিদ ভাইয়ার বিয়ে হবে।তোরা পালিয়ে যা।সব ব্যাপার করা আছে।”

প্রিয়শা অবাক নয়নে আদিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল আবার বলল,

“এখন বেশি কথা বলার সময় নেই।তাহমিদ ভাইয়া গাড়িতে অপেক্ষা করছে।আমি একটু পর সব লাইট অফ করে দিব তখন তুই বেড়িয়ে যাবি।তারপর যা হবে আমি দেখে নিব।”

আদিল ঝড়ের বেগে চলে গেল।প্রিয়শা কিছু ভাবার সময় পেল না।তার আগেই কারেন্ট চলে গেল।প্রিয়শাও বেড়িয়ে গেল নিজ ঘর থেকে।একবারও ভাবল না এভাবে চলে যাওয়ার পরিণতি কি হবে বা এর ফল বা শাস্তি কি হবে।

প্রিয়শা অতি সাবধানে বাড়ি থেকে বের এগাড়িতে বসল।গাড়িতে বসে দুইজন দুইজনের দিকে শুধু দৃষ্টি বিনিময় করল।কিন্তু কোনো কথা বলল না।তার আগেই গাড়ি ছুটে গেল আপন গতিতে।

…………………………

প্রিয়শা আর তাহমিদ পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে।সামনে বসে আছে কাজি সাহেব।তাহমিদ দেরি না করে সোজা প্রিয়শাকে কাজি অফিস নিয়ে এসেছে।এই জায়গাটা তাদের এক করে তুলবে।

প্রিয়শা হাতে কলম নিয়ে রেজিস্ট্রি পেপার নিয়ে বসে আছে।কাজু সাহেব অনেকবার বলল সাইন করার জন্য কিন্তু প্রিয়শা করছে না।তাহমিদ বুঝল প্রিয়শা ভয় পাচ্ছে।তখন তাহমিদ প্রিয়শার হাত ধরে বলল,

“ভয় পেও না প্রিয়।তোমার তাহমিদ তোমার আজীবন থাকবে।তোমাকে আজীবন ভালোবেসে যাবে।কখনো ঠকাবে না।আমাদের ভালোবাসার জন্য আমরা এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি।আর এইটুকুই করতে পারব।তোমার ভালোবাসার উপর ভরসা করে সাইন করে দাও।”

প্রিয়শা তাহমিদের কথা শুনে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর তাহমিদের হাত ধরে সাইন করে দিল।তাহমিদের মুখে হাসি ফুটে এলো।এই হাসি যেন প্রশান্তির হাসি,ভালোবাসা নিজের করে পাওয়ার হাসি।এই হাসির যে ব্যাখ্যা নেই।

তারপর প্রিয়শা ও তাহমিদের ইসলামীক নিয়মে তিন কবুলের মাধ্যেম বিয়ে হলো।এখন তারা স্বামী-স্ত্রী।চাইলেও কেউ তাদের আলাদা করতে পারবে না।এখন থেকে তারা এক হয়ে গেল।

তাহমিদ এসে মিষ্টি হাসি দিয়ে প্রিয়শার দুই হাত ধরে বলল,

“প্রিয় আমরা এক হয়ে গেছি।আমাদের আর কেউ আলদা করতে পারবে না।আমাদের ভালোবাসার অপেক্ষারা এবার পূর্ণতা পেয়েছে।আমরা দুইজনে হাতে ধরে আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা দিয়েছি।ভালোবাসি প্রিয়।অসম্ভব ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তোমাকে।”

প্রিয়শা খুশির ভালোবাসা জয়ের আনন্দে তাহমিদ নামক তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরল।যে কিনা কিছুক্ষণ আগে তার স্বামী হয়েছে।প্রিয়শা খুশিতে এত কষ্টের পর ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দে কেঁদে দিল।এই কান্নায় শুধু সুখ।কোনো বিষাদ নেই।প্রিয়শা কেঁদেই বলল,

“ভালোবাসি।ভালোবাসি।ভালোবাসি।”

তাহমিদ হেসে প্রিয়শার মাথায় চুমু খেল।একজনের মুখে হাসি আর একজনের কান্না।কিন্তু এসব দুঃখের না অতিব সুখের।পূর্ণতা পাওয়ার হাসি।যেখানে মিশে আছে ভালোলাগা,ভালোবাসা,সুখ,হাসি, কান্না,পরিণতি ইত্যাদি।

#চলবে………………….