প্রিয় বিকালফুল পর্ব-১০

0
180

#প্রিয়_বিকালফুল(১০)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

উৎস এসে খাবার টেবিলে বসলো। ফরিনা বেগম এতক্ষণে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছেন। কাজের মেয়ে শাহেলা এখনো বাড়ি ফিরেনি। নিজের বাড়ি গিয়ে এখন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। উৎস গতরাতেই কিছু টাকা পাঠিয়েছে চিকিৎসার জন্য। বলে দিয়েছে, সুস্থ হলেই যেন ফিরে আসে।

নিতু খাবারগুলোর ওপর থেকে ঢাকনা সরাতেই মনের তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল উৎস। নিতু মৃদু হেসে প্লেটে খাবার তুলে দিল। প্লেটে একে একে জায়গা করে নিল উৎসের পছন্দের সব খাবার। উৎস দেরি না করে নিতুকে খেতে বসতে বলেই নিজে খেতে শুরু করে দিল। এক লোকমা মুখে দিতেই পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিল সে। বলে উঠল,

“উমমম, এত মজাদার খাবার! এটার লোভেই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছি। তোমার রান্নার জবাব নেই, নিতু।”

নিতু নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে নিতে নিতে বলল,
“আপনি এতগুলো দিন আমার যত্ন নিলেন। খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত নিজ হাতে যত্ন করে খাওয়ালেন। পছন্দের খাবারও বাদ দিলেন না। এতটুকু তো আপনার জন্য আমি করতেই পারি। তাছাড়া আমি তো আপনার বউ, সে যে কয়েক দিনেরই হই বা সারাজীবনের। আপনাকে রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব তো আমারই।”

উৎস কোন কথা না বলে পেট পুরে খেয়ে নিল। নিতুও তুলে তুলে খাওয়াতে কোনরকম কার্পন্য করল না। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল উৎস। নিতুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

“এত মজাদার খাবার খাইয়ে তো বদ-অভ্যাস বানিয়ে দিচ্ছ। অন্য কারও রান্না তো আর মুখেই তুলতে পারব না। কে জানে, যে রান্নার দায়িত্বে পরবর্তীতে আসবে তার কী কী দূর্ভোগ পোহাতে হবে!”

হঠাৎ নিতুর মুখটা মলিন হলো। সে মৃদু গলায় বলল,
“এই তো হাতে আর ক’দিনই বা আছে! বেশিদিন তো আর খেতে পারবেন না এই হাতের রান্না। আমাকে তো চলেই যেতে হবে। পরে নাহয় ধীরে ধীরে আমার মতো আমার গড়ে দেওয়া বদ-অভ্যাসও পরিবর্তন করে নেবেন। অন্যের হাতের রান্নাও তখন অভ্যেসে পরিণত হবে৷”

উৎস অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,“ভালো কোন মুহূর্তে চলে যাওয়ার কথা বলে ম্যুড খারাপ করে দেবে না তো!”

“ম্যুড খারাপ কেন হবে? আমি তো মিথ্যা বলিনি। আমাকে তো চলে যেতেই হবে।”

“সব সময় সত্য বলার দায়িত্বই বা কেন তোমার নিতে হবে? যেভাবে সময় যাচ্ছে সেভাবে যেতে দাও।”
“এই কথা আপনি বলছেন?”
“না বলার কী আছে?”
“এখন যদি আমি আপনাকে চেয়ে বসি?”

“খাবারের সাথে এসব কথা কেন আসছে? লজিক্যাল হও।” বলেই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল উৎস।

নিতু মৃদু হেসে বলল,“আপনি আমার সাথে থাকতে ভয় পান, উৎস। যদি আমাকে ভালোবেসে ফেলেন! একটুও যে বাসেননি তারই বা গ্যারান্টি কী?”

রাতে ফরিনা বেগম নিতুকে নিজের রুমে ডাকলেন৷ নিতু একা একাই রুমে ছিল। দুপুরের পর থেকে উৎস তার সাথে কোন কথা বলেনি। কিছু সময় বাসায় থেকে বাহিরে বেরিয়েছে সে। নিতু একা বসে বান্ধবীর সাথে ফোনালাপে সময় পার করছিল। ফরিনা বেগম ডাকতেই ফোন রেখে নিচে নেমে এলো।

ফরিনা বেগম সামনে কিছু গহনার বাক্স নিয়ে বসে আছেন। নিতু রুমে প্রবেশ করতেই হাত বাড়িয়ে ডেকে কাছে বসালেন তিনি৷ একে একে সবগুলো বাক্স খুলে নিতুকে দেখিয়ে বললেন,

“আমার খুব শখ, আমার ছেলের বউ শাড়ি পরে, আলতা পায়ে আর গা ভরতি গহনা পরে থাকবে সবসময়। অন্যান্য গহনার সাথে কোমরে বিছা আর পায়ে নুপুর থাকবেই। সারা বাড়িতে সে যখন হেঁটে বেড়াবে তখন নুপুর ছন্দ তুলবে আর আমি সেটা প্রাণভরে শুনব। এখানে সব রকমের গহনা আছে। এগুলো আজ থেকে সব তোমার। আমার ছেলে তোমাকে বিয়ে করে, আমাকে ছেলের বউ উপহার দিয়েছে। তোমাকে আমার কতটা পছন্দ সেটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না? তুমি আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে দাও।”

ফরিনা বেগমের কথা শুনে কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ল নিতুর। গহনাগুলো দেখে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিল সে। আমতা আমতা করে বলল,

“এখনই কেন এসব, আম্মা? আর কিছুদিন যাক।”

ফরিনা বেগম বাক্স থেকে এক জোড়া চুড়ি নিয়ে নিতুর হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,“নতুন বউ তুমি। এখন এসব না পরলে কখন পরবে? দুদিন পর যখন বাচ্চা হবে তখন আর ইচ্ছে করবে না।”

মুখ ভার হয়ে এলো নিতুর। যেখানে সংসারই সময়ের খুঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে, একটু ভালোবাসা নেই, সেখানে আবার বাচ্চা আসবে কোথা থেকে? মনের কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলল নিতু। ফরিনা বেগম ভালো করে শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিছু বললে?”

নিতু শাশুড়ির দিকে এগিয়ে এসে তার হাত দুইটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আম্মা, কখনো যদি আপনার ছেলে আমাকে মেনেই না নেয় তাহলে এতসব জিনিস, গহনা নিয়ে আমি কী করব বলুন তো?”

ফরিনা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “তোমাকে বলেছি না এসব কথা মুখে আনা দূরের কথা মনেও আনবে না। তোমাকে আমার পছন্দ মানে তুমি সবার পছন্দ হতে বাধ্য। একটু সময় দাও আমার ছেলেটাকে। ও ভীষণভাবে ঠকেছে। ওকে একটু সময় দাও, মা। তোমাদের মধ্যাকার দূরত্ব কমানোর জন্য, জড়তা কমানোর জন্য আমি এতগুলো দিন বাহিরে ছিলাম। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখবে তুমি।”

নিতু মাথা নিচু করে রইল। ফরিনা বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “সবটা আমাকে খুলে বলো, মা। উৎসের দিক থেকে কোন আশার আলো নেই? উৎস বিয়ের আগ মুহূর্তে আমাকে যা জানিয়েছিল সেসব তো সত্যিই তাই না? তা যদি সত্যি হয় একটু সময় তো লাগবেই।”

নিতু ভাঙা ভাঙা গলায় প্রথম থেকে আজ অবধি কী কী হয়েছে সবটা সত্যি বলল। ফরিনা বেগম চুপ করে নিতুর কথা আগাগোড়া শুনলেন। কথা শেষে নিতু মৃদু গলায় বলল,

“আমি আপনার ছেলেকে ভালোবাসি, আম্মা। এখানে কোন মিথ্যে নেই। একদিন, দুইদিন নয়। পুরো এগারো বছরের জিইয়ে রাখা ভালোবাসা উনি আমার। আল্লাহ এতগুলো বছর পর আবার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আমি উনার সঙ্গ আর হারাতে চাই না, আম্মা।”

নিতুর গাল বেয়ে অশ্রু ঝরলো। দশ, এগারো বছরের ভালোবাসার কথাটা ফরিনা বেগম বুঝলেন না। শুধালেন,

“দশ, এগারো বছর মানে? তুমি উৎসকে কীভাবে চেনো?”

নিতু গাল মুছে নিল। এতগুলো বছর লুকিয়ে রাখা নিজের সত্যিটা সে এখনই বলতে চায় না। সেই পুরোনো কথা তুলে উৎসের ভালোবাসা চায় না সে। নিতু চায়, উৎস তাকে নতুনভাবেই আগে ভালোবাসুক তারপর নাহয়, কখনো অতীত সামনে আনা যাবে। অতীতকে এখনই টেনে আনলে উৎস আরও হতাশ হবে। যতটুকু আশা আছে তাও যে এক নিমিষেই নিভে যাবে। হয়তো সে আগে নিতুকেই ভুল বুঝবে। ফরিনা বেগমকে কিছু বলতে পারল না সে।

শুধু বলল,“আমাকে একটু সময় দিন, আম্মা। আমি সব বলব।”

ফরিনা বেগম নিতুকে সাহস দিলেন। তবে একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, যা জানার কৌতুহল কিছুতেই দমাতে পারছেন না। তিনি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমাকে শুধু এইটুকু বলো, তুমি উৎসের বউকে চিনতে তাই না?”

নিতু ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো। ফরিনা বেগম কপাল চাপড়ে আফসোস করে বললেন,

“উৎস ওর প্রেমিকাকে বিয়ে করল। আড়াই, তিন বছরের মতো সম্পর্ক ছিল ওদের। ছেলের পছন্দ ভেবে আমিও অমত করলাম না। বিয়ে করে বউ নিয়ে এলো সে। আমিও মেয়ের মতো আদরে রাখলাম। উৎস তো জবে থাকত। মাঝেমধ্যে ফোনে শুধু কথা হতো ওদের৷ কয়েক মাস যাওয়ার পর মেয়েটা উশৃঙখল হয়ে গেল। বাহিরে যাওয়া বেড়ে গেল, বন্ধু বান্ধব বাড়ল। উৎসের থেকে অনেক অনেক বেশি বেশি টাকা নিয়ে উড়াতে শুরু করল। আমার দেওয়া গহনাগুলোও কী করল কে জানে! এভাবে আরও দুই বছর চলল। শেষে একটা বড়লোক ছেলেকে ধরে আমার ছেলেকে ঠকিয়ে চলে গেল। দুই মাস পর ডিভোর্স লেটার পাঠালো। ব্যস, আমার ছেলের সংসার জীবনের ইতি ঘটল। তারপর কেটে গেছে প্রায় ছয় বছর। আমার ছেলে আর সংসারে জড়াতে চায়নি। আমি উঠেপড়ে লাগলাম বিয়ে দিতে৷ তারপরের কাহিনী তো তুমি জানো।”

নিতু হঠাৎ বলে উঠল,“ওই শাকচুন্নির আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই তো, আম্মা? এসেই দেখুক না। এবার নিতু আছে। আমাকে পেরিয়ে উৎসের কাছে আসার সাহস ওর এবার কিছুতেই হবে না।”

ফরিনা বেগম মুচকি হেসে বললেন,“না। আর তাই তো, তুই-ই বা অন্যকাউকে ফিরে আসতে দিবি কেন? আমার ছেলেকে আঁচলে বেঁধে রাখবি। ভালোবাসার মানুষকে হারাতে দিস না। সে যত দূরত্ব চাইবে তুই তত চিপকে থাকবি।”

নিতু ফরিনা বেগমের কাধে মাথা রেখে বলল,“এমন শাশুড়ির লোভেই তো তার ছেলেকে ছাড়ব না আমি।”

ফরিনা বেগম নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,“সংসার গড়তে সব রকম সহযোগিতা আমার কাছে থেকে তুই পাবি। এখন এই গহনাগুলো নিজের কাছে রেখে দে। সেজে সেজে বরের সামনে ঘুরবি। পুরুষ মানুষ কতক্ষণ দূরে দূরে থাকবে!? ”

নিতু চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,“আম্মা, এবার কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি।”

নিতুর কথায় হেসে উঠলেন ফরিনা বেগম। তার হাসিতে গলা মেলালো নিতুও।

চলবে…..