#প্রিয়_বিকালফুল(১১)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
উৎসর বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত দশটা। ফরিনা বেগম খাওয়া দাওয়া করে সবে নিজের রুমে গিয়েছেন। নিতু খাবার টেবিলে সব গোছগাছ করে রাখছে। শাশুড়িকে খাবার খাইয়ে, ঠিকঠাক ওষুধ খাওয়ালেও নিজে উৎসর সাথে একসাথে বসে খাবে বলে কিছুই খায়নি। খাবার ঠিক করে রেখে রুমের দিকে অগ্রসর হবে তখনই উৎস বাসায় প্রবেশ করল। হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছে সে। নিতু সিঁড়িতে মাত্রই পা রেখেছিল উৎসর ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেল। পিছনে ফিরে তাকালো সে।
“আপনার এতক্ষণে সময় হলো বাসায় ফেরার? ফোন নম্বরটিও দেননি যে বাসায় কোন প্রয়োজন হলে কল করব।”
উৎস এগিয়ে এসে শুধালো,“কেন কিছু হয়েছে?”
“আজ হয়নি৷ আগামীতে হতে তো পারে।”
“আজ নিয়ে রেখো। আমারই ভুল হয়েছে। নম্বরটা অন্তত দিয়ে রাখা উচিত ছিল।”
নিতু সরলভাবে বলে উঠল,“খেয়ে ওপরে যাবেন নাকি ফ্রেশ হয়ে এসে খাবেন?”
উৎস জবাবে বলল,“ফ্রেশ হয়ে এসে খাই। এই ব্যাগটা ধরো৷ এখানে তোমার জন্য শাড়ি আছে। আগামীকাল বউভাতের অনুষ্ঠান আছে বলেছিলাম না? তুমিও যাবে আমার সাথে।”
নিতু প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। এই প্রথম প্রিয় মানুষের কাছে থেকে উপহার পেল সে। এটা কি পরে পুরোনো করতে মন চাইবে কোনভাবে? প্রিয় মানুষের দেওয়া জিনিস তো যত্ন করে রেখে দিতে হয়। নিতু চিন্তা করল, কালকে যদি কোনভাবে শাড়িটা নষ্ট হয়ে যায়! উৎস আরও ডজনখানেক শাড়ি কিনে দিলেও তো এই প্রথম উপহারটার মতো হবে না। সে বলল,
“আমি তো ওয়েস্টার্ন পরতে চাচ্ছিলাম।”
নিতুর কথা শুনে উৎস কোমলস্বরে শুধালো,“বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে তুমি ওয়েস্টার্ন পরবে?”
নিতু ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসলো।
“ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরব বলেছি, অশ্লী*ল ড্রেস পরব বলিনি।”
উৎস নিতুর হাতে থেকে শাড়ির প্যাকেটটা কেড়ে নিল। মুখ গম্ভীর দেখাল তার।
“তাহলে শাড়ি দোকানে ফিরিয়ে দিয়ে আসি। তোমার শাড়িও পরতে হবে না আর ওখানে যেতেও হবে না।”
নিতু সাথে সাথে শাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে উৎসর কাছাকাছি এসে বলে উঠল,“অনুষ্ঠানেও যাব আর শাড়িও পরব। আপনি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন৷ নিজের চরিত্রের দিকেও খেয়াল রাখবেন, মেজর সাহেব। চরিত্রের কোন নাট যেন ঢিলে না হয়ে যায়।”
__
সকালে নাশতা করে উৎস বেরিয়েছে। পরিচিত কাছের ছোট ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা। কাজ তো হাতে কম থাকতে পারে না। নিজেকে কিছু করতে না হলেও বিভিন্ন কাজে তদারকি তো করতেই হবে। উৎস নিতুকে বারোটার দিকেই তৈরি হয়ে নিতে বলে গিয়েছে। সে শুধু বাসায় ফিরবে আর নিজের তৈরি হতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময়ই বাসায় থাকবে। উৎস এবং নিতু দুজনই ফরিনা বেগমকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিল কিন্তু উনি যেতে রাজি হননি। বাড়িতেই তিনি ঠিক আছেন আর তাছাড়া আজ নতুন আরেকটা মেয়ের আসার কথা। আগে যে এই বাড়িতে কর্মরত ছিল সে নিজেই পাঠাবে। তাকে সবরকম কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে।
নিতু সকালের নাশতা শেষ করে ফরিনা বেগমের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে রান্নাঘর থেকে বের হলো। বাসার সবরকম কাজ প্রায় শেষ। এখন নিজের রেডি হওয়া বাকি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেশি সময়ও হাতে নেই। সে দ্রুত পায়ে ফরিনা বেগমের রুমে প্রবেশ করল। ফরিনা বেগম খাটের বালিশ ঠেকিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে বই পড়ছিলেন। নিতুকে দেখে বই বন্ধ করে শুধালেন,
“তুমি এখনো রেডি হতে যাওনি?”
নিতু কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দিল,
“আপনার জন্য খাবার তৈরি করে রাখলাম। আমরা বাহিরে খাব আর আপনি? কাজ মোটামুটি সব শেষ এখন গিয়ে একদম শাওয়ার নিব তারপর রেডি হব।”
নিতু মুচকি হেসে ফরিনা বেগমের পাশে গিয়ে বসল। লজ্জায় মাথানিচু করে বলল,“আম্মা, আপনার ছেলে আমার জন্য শাড়ি এনেছে। ওটা পরে যেতে বলেছে।”
ফরিনা বেগম মৃদু হেসে বই পাশে রেখে বললেন, “সুন্দর করে সাজবি৷ আর শোন মা, গহনা পরতে ভুলবি না একদম। শাড়ির সাথে যেগুলো মানাবে সব পরবি। স্বর্ণ কিন্তু মেয়েদের রূপ-লাবণ্য আরও বাড়িয়ে দেয়। তুই এসব বিষয়ে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানিস, বুঝিস। মোট কথা, আমার ছেলে যেন তোকে নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল করে। তবেই না খুঁটিহীন সংসারটা টিকবে!”
নিতু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ফরিনা বেগম আর সময় নষ্ট করতে না দিয়ে ঠেলে নিজের রুমে পাঠিয়ে দিলেন নিতুকে। মনে মনে কত করে দোয়া করেলেন! এবার ছেলেটা সঠিক মানুষ পেয়েছে, সংসারটা যেন টিকে যায়।
_____
নিতু রুমে এলো। রুমে প্রবেশ করতেই বিছানার ওপর রাখা উৎসের দেওয়া শাড়ির প্যাকেটের দিকে চোখ গেল তার। এখনো ভেতরটা খুলে দেখা হয়নি তার। বিছানা থেকে প্যাকেটটা নিয়ে ছিঁড়ে শাড়িখানা বের করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গাঢ় গোল্ডেন এবং চকলেট কালারের কম্বিনেশনের জরজেট একটা শাড়ি। নিজের গায়ে মেলে ধরে মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“আপনার পছন্দের তারিফ করতে হয়, মেজর সাহেব। এত সুন্দর শাড়ি আমার জন্য নিয়ে এসে ভুল করলেন। নিজেই এবার নিজেকে কতক্ষণ আমার থেকে আটকান দেখি। এমন করে নিজেকে ফুঁটিয়ে তুলব, আপনি আমাকে অসভ্যের মতো দেখতে থাকবেন। সভ্য পুরুষ থেকে অসভ্য বর হতে আর বেশি দেরি নেই আপনার। তাছাড়া আমি তো আছি। ঘরের বরকে যেভাবে ইচ্ছে ঘায়েল করা জায়েজ আছে।”
নিতু শাওয়ার নিতে যাওয়ার আগেই শাড়ির সাথে কী কী পরবে সব বেছে বেছে সাজিয়ে রেখে দিল যেন পরে খুঁজে সময় নষ্ট না করতে হয়। শাড়ির সাথে কোন ব্লাউজ, কোন জুয়েলারি, কেমন মেকআপ ইত্যাদি সবকিছু ঠিক করে রাখল।
নিতু গোসল দিয়ে বের হয়ে প্রথমে চুল শুকিয়ে নিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গেল সাজতে। পুরো মেকআপটা যেন ‘নো মেকআপ লুক’ হিসেবেই করবে ভেবে রেখেছিল সে। সম্পূর্ণ সাজ কমপ্লিট করে নিজেকে একবার দেখে নিল। পুরো মুখটা পরিষ্কার লাগছে, গাল দুটো শুধু একটু লাল লাল, চোখে বড্ড হালকা কাজল, চোখের পাতায় চোখে খুব ভালোভাবেই পড়ার মতো লাইনার দিয়েছে। পুরো সাজে তেমন চোখে পড়ার মতো কিছু না থাকলে চোখজোড়া লাল টকটকে ঠোঁটজোড়ায় আটকে যাচ্ছে। নিতু সিম্পল মেকআপে অসম্ভব সুন্দর রূপে আবিষ্কার করল নিজেকে। চুলটা ভালোভাবে আঁচড়ানোর কাজটাও সেরে নিল। এবার শাড়িটা পরে ফেলার পালা। সেটা পরতেও বেশিক্ষণ সময় লাগল না নিতুর৷ গোল্ডেন ভারি কাজের ব্লাউজের সাথে গোল্ডেন আর চকলেট কালারের কম্বিনেশনের শাড়িটা দারুণ মিলেছে। গুছিয়ে রাখা হালকা গহনাগুলো নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে পুনরায় দাঁড়াল নিতু। হালকা একটা গলার নেকলেস আর কানের দুলজোড়া পরে নিল।
বাম হাতে নিজের পছন্দের ঘড়ি আর ডান হাতে চুড়িগুলো পরে নিতে ভুললো না। আয়নায় নিজেকে দেখে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মৃদু হাসল সে। মনে মনে ভাবলো, এই সাজটা শাশুড়িকে না দেখানো অবধি ভালো লাগবে না তার। ঘড়িতে সময় দেখল নিতু। উৎসের আসারও সময় হয়ে গিয়েছে। জলদি শাশুড়ির রুম থেকে ঘুরে আসবে বলে সিদ্ধান্ত নিল সে।
মনের কথা শুনতে বেশি দেরি করল না নিতু। সিড়ি বেয়ে নিচে নামনে শুরু করল শাশুড়ির রুমের উদ্দেশ্যে। নেমে এলো নিচে।
নিতু যেই না ফরিনা বেগমের রুমে ঢুকবে তখনই পিছন দিকে থেকে কারো পায়ের আওয়াজ এলো। থেমে গেল নিতু। পরিচিত পুরুষ কন্ঠস্বরে ডাক ভেসে এলো,
“নিতু।”
ঘুরে তাকালো নিতু। চলন থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল উৎস। সামনে দাঁড়ানো নারীটিকে মাথা থেকে পা অবধি ধীর চাহনিতে দেখল একবার৷
উৎসের পছন্দ করে নিয়ে আসা শাড়িটায় নিতুর সৌন্দর্য যেন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎসের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে নিতু ঠোঁট টিপে মৃদু হাসলো। উৎস কিছু না বলে শুধু দেখে যাচ্ছে তাই নিতুই শুধালো,
“কেমন লাগছে আমাকে? আপনার উপহার দেওয়া শাড়িতে?”
উৎস আনমনে জবাব দিল,“সুন্দর। অসম্ভব সুন্দর লাগছে।”
নিতু হেসে জবাব দিল,“ধন্যবাদ, মেজর সাহেব। মনে ধরল তবে আমায় একটু।”
নিতুর প্রশ্নে গলা খাঁকারি দিয়ে কেশে উঠল উৎস। কোমল গলায় বলল,“একটু বেশি সাজ হয়ে গেল না? সবাই বউ না দেখে তোমাকেই দেখবে।”
“যেমন আপনি দেখছেন?” নিতুর সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।
উৎস থতমত খেয়ে নজর নামিয়ে নিল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই নিতু ফের বলল,
“ এই সাজেই যদি সবাই বউকে রেখে আমাকে দেখে তাহলে আপনি লাকি। আপনি জিতে গেছেন। সবাই অন্যের বউকে না দেখে আপনার বউকে দেখবে। প্রশংসা করবে। ভাল্লাগবে না বিষয়টা?”
উৎস নিতুর কথার জবাব না দিয়ে বলল,“যাচ্ছিলে কোথায়? আম্মার রুমে? যাও। আমি রেডি হয়ে নিই।”
নিতু হেসে বলল,“আপনাকে সুন্দর দেখা লাগবে না। আপনি বাহিরে সবচেয়ে কুৎসিত সেজে গেলেও আপত্তি নেই। আপনাকে শুধু আমি দেখব। ইয়্যু আ’র অনলি মাই’ন, মেজর সাহেব।”
#চলবে….