#প্রিয়_বিকালফুল(১৩)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
“আপনি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছেন, উৎস? আপনি ডিভোর্সি নন, আমাকে বিয়ে করার আগে থেকেই বিবাহিত!”
নিতু থেমে ধরা গলায় ফের বলল,“আপনি আগে বিয়ে করেছিলেন, সম্পর্ক টিকেনি, ডিভোর্স হয়েছে সেটা জেনেই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি আপনাকে আমার আচরণ, কাজকর্ম দিয়ে সবই বুঝিয়েছি। ধীরে ধীরে আমার প্রতি আপনিও হয়তো দূর্বল হচ্ছেন বা আমাকে নিয়ে ভাবছেন এটাই চিন্তা করেছিলাম। আমি আমাদের সম্পর্কে কোন জোরজবরদস্তি নিয়ে আসিনি। সবকিছু স্মুথলি চলছিল। আপনি আমাকে শেষ পর্যন্ত ঠকালেন! ”
উৎস হাতের কাগজটা টেনে ছিঁড়ে দুইভাগ করে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলল। আঙুল উঁচিয়ে নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার ব্যক্তিগত জীবনে কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটা আমার পছন্দ না। তুমি সেই অপছন্দের কাজটাই করে ফেলেছ। মানুষের সাথে সহজ হতে আমার অনেক সময় লাগে, হতেই পারি না সেক্ষেত্রে তোমার সাথে সমস্যা হচ্ছিল না তেমন। শেষ সময়ে এসে সেই তুমিও অন্যদের মতো ধরা দিলে।”
নিতু বলল,“আপনি সত্যিটা লুকিয়েছেন কেন? আপনি সত্যিটা বললে আমি নিজেই বিয়েতে রাজি হতাম না। সতীন নিয়ে সংসার করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আপনার মতো মানুষ আমি আমার জীবনে দুটো দেখিনি৷ কীভাবে পারলেন বিবাহিত থেকেও আমাকে বিয়ে করতে?”
উৎস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিতুর দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বলল,“আমি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে? আমি বিয়ে করব না বলেই আম্মাকে সব জানিয়েছিলাম। পরে তুমিই আমাকে এটা ওটা বুঝিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করেছ।”
নিতু চিৎকার করে বলে উঠল,“আপনি বাচ্চা? আপনাকে এটা ওটা বুঝিয়ে বিয়ে করেছি মানে? অমানুষ আপনি। ”
উৎস দরজার দিকে ফিরে গেল। নিতুর দিকে না ফিরেই বলল,“কী বলেছিলে সতীন নিয়ে সংসার করার ইচ্ছে তোমার নেই? শোনো, তোমার সাথেই সংসার করার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আমি তোমাকে বিয়ের আগে সব বলেছি। এটাও বলেছি যে, আমি সহজে ভালোবাসার মতো সম্পর্কে আর জড়াতে চাই না। আমি ঠকতে ভয় পাই।”
নিতু কান্না করে ফেলল। বারবার নাক টেনে বলল,“ঠকিয়েছেন তো আপনি আমাকে। আপনি আমার ইমোশন নিয়ে খেলেছেন।”
“এক কথা বারবার শুনতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমি কারও ইমোশন নিয়ে খেলিনি। আমি তো এই দেড়, দুই মাসে স্পর্শ অবধি করিনি। তুমি যেহেতু নিজের মুখে বলেই দিয়েছ সংসার করবে না সুতরাং আগামীকাল তৈরি থাকো আমি তোমাকে বাসায় রেখে আসব।”
নিতু হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ মুছে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল,“আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমার চিন্তা আমি করে নেব৷ আপনি আপনার প্রথম বউকে নিয়েই ভাবেন।”
“আমি কাকে নিয়ে ভাববো বা ভাববো না সেটা তোমার ভাবতে হবে না।”
“তার মানে আপনি আমাকে পুরোপুরি ঠকিয়েছেন? তাকে নিয়েই যদি ভাববেন তাহলে বিয়ে করলেন কেন?”
“নিতু, এসব নিয়ে কথা বলার আর কোন ইচ্ছে আমার নেই। তুমি ভালোভাবেই জানো বিয়ে আমি শখে করিনি। নারীঘটিত এসব বিপদে পড়ব না বলেই বিয়ে করতে চাইনি। আমার মা জোর করে আমার জীবনটা শেষ করে দিল। আমার বাড়ি আসাই ভুল হয়েছে।”
নিতু পুনরায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,“আপনি মিথ্যে বলেছেন।”
“তোমার যদি সেটাই মনে হয় তাহলে তাই।”
“এখানে মনে হওয়ার কী আছে? আমি তো নিজ চোখে দেখলাম। আপনি কী ভেবেছেন ঘরে একটা বউ রেখে বাহিরে আরেকটা বউয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করবেন? একটা দিয়ে চলছিল না? চরিত্রহীন পুরুষ মানুষ! ”
উৎস প্রচন্ড রাগে নিতুর দিকে তেড়ে এলো। নিতুর গায়ে হাত তুলতে গিয়েও নিজেকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিল৷ নিজেকে ধাতস্থ করার বড্ড চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে, চোখের পাতা নড়ছে, বুক প্রচন্ড বেগে ওঠানামা করছে।
অতঃপর নিতুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,“আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি তোমাকে দেইনি, আমি আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ঘাটাঘাটির অধিকার তোমাকে দেইনি। সব সম্পর্কে একটা সীমাবদ্ধতা থাকা জরুরি।”
নিতু দাঁতে দাঁত চেপে উৎসের দিকে ঘৃণাভরা নয়নে চেয়ে বলল,“আপনি চরিত্রহীন পুরুষমানুষ।”
উৎস এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হাতের ডান দিকে থাকা ফুলের টবখানা হাতে তুলে নিল। নিতুর দিকে তাকিয়ে সেটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে চোয়াল শক্ত করে,
”ইচ্ছে করছে এভাবে তুলে ছুঁড়ে ফেলি। অসহ্য লাগছে তোমার কথাবার্তা আর তোমাকে। ”
উৎস আচমকা নিতুর থুতনি শক্ত হাতে চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে বলল,“চরিত্র খারাপ হলে দুটো মাস আস্ত থাকতে না। চিল শকুনের মতো খুবলে খুবলে খেতাম। বিয়ে ছাড়াই প্রতিদিন বিছানায় নিতাম। শরীরে দাগ ফেলতাম। পুরুষত্বের জোর দেখাতাম। খুব ভুল করলে উল্টাপাল্টা কথা বলে। এর দাম তোমাকে দিতে হবে, দিতেই হবে।”
নিতুকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল উৎস। নিতু উৎসর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পরক্ষণেই কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। ধরা গলায় বলে উঠল,
“সব খারাপ কেন আমার সাথেই হয়? ফিরে তো এলেন কিন্তু সেটা এভাবে? আমাকে ঠকালেন আপনি? আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না, কখনো না।”
__
নিতু সারাদিন ফরিনা বেগমের সাথে ভালোভাবে কথা বলেনি। সে খেয়াল করেছে সেই একটা মুহূর্তের জন্য তার পুরো মন বিষিয়ে গেছে উৎস আর তার মায়ের ওপর। দুজনই তাকে মিথ্যে বলেছে। উৎস প্রথম স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও সেটা ডিভোর্স বলে নিতুকে বিয়ে করেছে। বিয়ের মতো একটা সম্পর্ককে নষ্ট করেছে তারা।
বেশ কিছুটা সময় চুপচাপ, মনোমালিন্যের সাথে গত হওয়ার পর ফরিনা বেগমের মনে হলো নিতুর কী হয়েছে সেটা এবার জানা প্রয়োজন। অন্য সময় কিছু হলে নিতু নিজেই সোজা ফরিনা বেগমের রুমে চলে যেত এবং সব কথা উনাকে বলত কিন্তু এবার নিতুর ব্যবহারের পরিবর্তন দেখে ফরিনা বেগম নিজেই গেলেন ছেলের রুমে। উৎস বাসায় নেই। নিতু একা একা জানালার পাশে বসে কারও সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত। ফরিনা বেগম দরজায় নক করতেই নিতু ফোন রেখে পূর্বের মতোই বাহিরে তাকিয়ে বসে রইল।
ফরিনা বেগম পাশে এসে বসলেন। নিতুর মুখে যেন নিমিষেই আঁধার নামল। গতকাল থেকে সবাইকে তার বিরক্ত লাগছে। কাউকে সহ্য হচ্ছে না। ব্যবহার খারাপ করতে আর চাইছে না বিধায় চুপচাপ একা ঘরে সময় কাটাচ্ছে।
ফরিনা বেগম নিজেও আজ নিতুর সাথে কথা বলতে একটু ইতস্তত করছেন। কেমন যেন দূরের লাগছে মেয়েটাকে। বারবার নিতুর দিকে তাকাচ্ছেন তিনি। কীভাবে কী শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। নিতু হয়তো বিষয়টা একটু সহজ করে দিতেই বলে উঠল,
“কিছু বলবেন, আম্মা?”
ফরিনা বেগম মৃদু গলায় জবাবে উল্টো শুধালেন, “তোমাদের কিছু হয়েছে?”
“কী হবে?”
“উৎস গেছে কাজের মেয়েটাকে আবার আনতে।”
“ভালোই তো করেছে। আগে থেকে ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে। আমি চলে গেলে উনি নিজে তো আর হাত পুড়ি*য়ে খেতে যাবেন না।”
“চলে গেলে মানে? কী হয়েছে তোমাদের? দুজনের মুখে কোন কথা নেই কেন? কেমন ঝড়ের আভাস পাচ্ছি।”
নিতু নড়েচড়ে ফরিনা বেগমের দিকে ফিরে বসল। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“ঝড় অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। এখন শুধু ফলাফল বাকি। আপনার ছেলে আমাকে বাড়ি দিয়ে আসবে। আমারও এখানে আর থাকার ইচ্ছে নেই৷ ওরকম একটা মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে, এক রুমে থাকতে আমার রুচিতে বাধছে।”
ফরিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,“কী করেছে উৎস যে তুমি একেবারে চলে যেতে রাজি হয়ে গেলে? আমাকে বলো। সব সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই আছে।”
নিতু উঠে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,“আমার কোন সমাধান লাগবে না, আম্মা। আপনারা আমাকে ঠকিয়েছেন। শুধুমাত্র ভালোবাসি বলে ওই মানুষটাকে আর হারাতে চাইনি আমি অথচ উনি কী করল আমার সাথে? উনি ডিভোর্সি নন সেটা আমার থেকে লুকালো। আমাদের সম্পর্ক তো কখনো না কখনো গভীর হতো আর তখন যদি তার প্রথম স্ত্রী এসে অধিকার ফলায় তখন আমি কী করব? আপনারা কীভাবে পারলেন আমার সাথে এমনটা করতে? সবচেয়ে বড় কথা, অন্য কারো বরকে আমি নিজের বর ভাববো কীভাবে?”
ফরিনা বেগম নিজেও উঠে নিতুর কাছাকাছি এলেন। একবুক হতাশা নিয়ে বললেন, “এসব তুমি কী বলছ, নিতু? কোন সত্য লুকোনো হয়নি তোমার কাছে। তোমাকে ঠকিয়ে আমার ছেলের কী লাভ বলো তো? তুমি ভুল বুঝছ ওকে।”
নিতু ফের বলে উঠল, “আম্মা, প্লিজ আপনি এখান থেকে যান। আমার আর কোন কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমি জাস্ট আর নিতে পারছি না। নিজের চোখে নিজের নষ্ট জীবন দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার আসলেই এখন মনে হচ্ছে, সেদিন আমি আঠারো বছরের মেয়ের মতোই আবেগ দেখিয়েছিলাম এই বয়সে এসেও। আমি ভালোবাসার মোহে কীভাবে এত অন্ধ হয়েছিলাম কে জানে! নিজের বোকামিতে আজ নিজের এই অবস্থা।”
“আমি তোমাকে আবারও বলছি আমার ছেলে বা আমি তোমার কাছে থেকে কিছুই লুকোয়নি। মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখো একবার।”
“শুনুন আম্মা, আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার চোখ তো আর ভুল দেখতে পারে না। আপনি প্লিজ আমাকে একা থাকতে দিন। আমি নিতে পারছি না এসব। আপনি না গেলে আমিই না হয় চলে যাচ্ছি।”
নিতুর এমন আচরণে অবাক হলেন ফরিনা বেগম। এতগুলো দিনে তিনি নিতুকে যেমন দেখেছেন আজ যেন তার উলটো কোন চরিত্রকে দেখছেন তিনি। বুঝতেও পারছেন বড়সড় কিছু একটা হয়েছে বিধায় নিতু এমন করছে কিন্তু তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন সেটা বুঝতে পারছেন না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিতুকে দেখে তিনিই বললেন,
“তোমার যেতে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি। তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করো।”
ফরিনা বেগম দরজার দিকে আসতেই উৎসকে দেখতে পেলেন৷
“আমার রুমে এসো একবার।” গম্ভীর গলায় বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
মা চলে যেতেই উৎস রুমে প্রবেশ করল। ধীরপায়ে নিতুর কাছে এসে বলল,
“আমি আমার রুম থেকে আমার আম্মাকে কখনো যেতে বলা তো দূর আমার কাছে থেকে কখনো সরে বসতেও বলি না আর আজ তুমি আম্মার সাথে এমন আচরণ করলে? অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলছ গতকাল থেকে। আজ রাতই এ বাড়িতে তোমার শেষ দিন, মাথায় রেখো।”
নিতু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,“কোন চরিত্রহীন, মিথ্যুক পুরুষের সাথে থাকতে আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি যেকোন সময় মা*রা যেতে পারি তার চেয়ে ভালো এখান থেকে চলে যাব। আপনার কিছু করতে হবে না। আমি নিজেই নিজের গন্তব্যে চলে যেতে পারব।”
উৎস চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,“মেয়েদের সম্মান করি মানে তার সুযোগে বারবার উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমি নিজেকে আর বেশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না বলে দিলাম। আর মিথ্যা কথা আমি বলেছি? সেটাই যদি তোমার মনে হয় তাহলে জেনে রাখো তোমার মতো মেয়েকে সত্য বিশ্লেষণ করে বোঝাতে আমি বসে নেই।”
নিতু ভ্রু কুঁচকে বলল, “সত্য কথা খুব গায়ে লাগছে? আমারও সত্য দেখে গায়ে লেগেছিল।”
“গায়ে লবণ মরিচ মাখিয়ে বসে থাকো। আমাকে নিয়ে, আমার চরিত্র নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আর হ্যাঁ ভালোমানুষির সুযোগ বারবার নিও না, ভালো হবে না।”
“কী করবেন আপনি? মেরে ফেলবেন? ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে?”
উৎস চোখ বড়বড় করে নিতুর দিকে তাকিয়ে শাসানো গলায় বলল,“গু*ম করে দেব। কাক পক্ষিতেও টের পাবে না। ধৈর্য্যের পরিক্ষা নিও না।”
#চলবে…..