অন্য বসন্ত পর্ব-১১

0
89

#অন্য_বসন্ত ( একাদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
এরপর আরো কটা দিন কেটে গেছে | সেদিন দীপ্তি সকাল আটটার মধ্যে অফিস চলে এসেছিলো | একটা ব্যালেন্স চার্ট রেডি করতে হবে ওকে | আসলে এতো কম সময় , আর এতো কাজ হাতে ! এই সময়ে অফিসটা একদম ফাঁকা থাকে | শান্তিতে বসে হিসেব করতে পারবে | এইসব ভেবেই নিজের ডেস্ক এ বসে বিশুদাকে ডেকেছিল | এই কোম্পনীর পিয়ন | এদিক ওদিক ফাইল পৌঁছে দেয়ার সঙ্গে খুব ভালো কফি , স্যান্ডউইচ এইসবও বানাতে পারে লোকটা | ওদের অফিসের ওই ছোট ক্যান্টিনে বিশুদা তাই ভীষণভাবে একটিভ | যাইহোক , সেই মুহূর্তে বিশুদা ওর সামনে আসতেই দীপ্তি আলতো হেসে বলে উঠলো , ———- ” প্লিজ এক কাপ কফি দেবে গো ? এখন অনেক কাজ | কফিটা না হলে চলবে না তাই |”
দীপ্তির কথাটা শুনে বিশুদা অল্প হাসি ফেরত দিয়ে বললো , ———- ” আচ্ছা, তোমার জন্যও এক কাপ কফি ! আনছি এক্ষুণি |”
দীপ্তি এটা শুনে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো , ———— ” আমার জন্যও মানে ? আর কে আছে অফিসে ! এতো সকাল সকাল !”
বিশুদা এর উত্তরে একটু অন্ধকার মুখেই বললো , ——————- ” কে আবার ! কৃষ্ণেন্দু স্যার | কাল বাড়ি ফেরেনি রাতে | সারা রাত জেগে কাজ করছিলো | এরকম তো মাঝে মাঝেই হয় | কতদিন যে বাড়ি ফেরে না ! এমন কি রাতের খাবারটাও খায় না ! কিছু বললেও শোনে না | আসলে সেই ওর বাবার আমল থেকে আছি তো ! ছেলেটাকে এইভাবে দেখলে চিন্তা হয় খুব | যাইহোক কফি করে আনছি| কাজ করো তুমি |”

কথাটা শেষ করেই বিশুদা চলে গেলো এই মুহূর্তে | তবে দীপ্তি থমকে গেলো হঠাৎ | কদিন ধরেই ও খেয়াল করছিলো যদিও আনমনে , কৃষ্ণেন্দুর চোখগুলো আজকাল ভীষণ ক্লান্ত লাগে ! মুখটা কিরকম ফ্যাকাসে লাগে ওর | কিন্তু এইভাবে যে বাড়ি না ফিরে রাত জেগে জেগে কাজ করে ! তাও আবার কিছু না খেয়ে , সেটা জানতো না এতদিন | কথাটা ভেবে না চাইতেও অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা এসে ভিড় করলো মনে | সেদিন এরপর ব্যালেন্স চার্ট তৈরী করে কৃষ্ণেন্দুর কেবিনে জমা দিতে গিয়ে ও কিছুতেই আর না জিজ্ঞেস করে পারলো না থাকতে ! সমস্ত কাজের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দীপ্তি চলে যাওয়ার সময় আরেকবার কৃষ্ণেন্দুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠলো হঠাৎ , একটু আস্তে গলায় , ———- ” তুমি বাড়ি ফেরো না কেন রোজ ? সারা রাত জেগে কাজ করো এইভাবে একা একা অফিসে ! কেন ? ডেড লাইন সামনে আমি জানি | কিন্তু তার জন্য এতটা চাপ নেয়ার দরকার নেই | আমরা তো সবাই কাজ করছি | হয়ে যাবে কমপ্লিট অর্ডার |”
দীপ্তির এই একসঙ্গে বলা অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণেন্দু কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে এক কথায় উত্তর দিলো , ওর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে ,
—————– ” আমার আর ওই বাড়িতে ফিরতে ভালো লাগে না | একা একা নিজেকে কিরকম যেন একটা ফার্নিচারের মতনই লাগে ওখানে | তাই যাই না রোজ | আমার জন্য কাজটাই ভালো | কাজটাই আমার নিজের |”
দীপ্তি কথাগুলো শুনে কিরকম নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো এখন | কোনো কথা বলতে পারলো না ঠিক | কৃষ্ণেন্দু যে ভালো নেই , এটা মন থেকে এই মুহূর্তে বুঝতে পারলো ও | ওই স্থির দুটো চোখ , ফ্যাকাসে মুখটাই যেন বুঝিয়ে দিলো সব কিছু | কিন্তু এইসব বুঝেও যে ওর কিছু করার নেই আর ! একটা সময় যখন ও মন থেকে কৃষ্ণেন্দুর পাশে থাকতে চেয়েছিলো , রোজ , প্রত্যেকটা দিন , তখন তো ছেলেটা ধরা ছোঁয়ারই বাইরে ছিল | ওই বাড়িতে কত রাত জেগে জেগে শুধু অপেক্ষা করেছে দীপ্তি , কৃষ্ণেন্দুর ফেরত আসার অপেক্ষা | একবার ওর কাছ থেকে কিছু সময় পাওয়ার অপেক্ষা | কিন্তু সেইদিনগুলোতে তো ওর থাকা না থাকার দাম কেউ দেয়নি | ওর অপেক্ষার দামও ছিল না কারোর কাছে | তাহলে আজ , এতদিন বাদে ওরও কাউকে দেয়ার মতন কিছুই নেই | আর তাছাড়াও, মাত্র সাতদিন বাকি | এই প্রজেক্টের কাজটা শেষ হয়ে যাবে তারপর | আর এই কাজটা শেষ হলেই দীপ্তিরও এই অফিসে আসার দিন শেষ | ব্যাঙ্গালোরের চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চলে এসেছে কদিন আগে বাড়িতে | এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার দিনটাও তাই খুব কাছে চলে আসছে ধীরে ধীরে | এখন পুরোনো কোনো ফিলিংস এর সাথেই আর নিজেকে জড়ালে চলবে না | আর কোনো ভুল মানুষের জন্য ভাববে না দীপ্তি | কথাগুলো ভেবে ও আর সেদিন দাঁড়ালো না কৃষ্ণেন্দুর সামনে | চলে গেলো কিছু না বলে |

তবে একটা অদ্ভুত খারাপ লাগার রেশ রয়েই গেলো মনে কেমন ! আসলে এই ছেলেটা খারাপ থাকুক , এটা তো দীপ্তি কখনোই চায়নি | তাই হয়তো এরকম মনে হচ্ছে ! জানে না | আর বেশি জানতেও চায় না | কারোর জন্য বেশি ভাবা মানেই বেশি জরিয়ে পরা | আর দীপ্তি সেই ভুলটা করবে না কখনো | কথাগুলো ভেবেই সেদিন বাড়ি ফিরলো ও | ক্লান্ত লাগছে খুব আজ | সারাদিন অফিসে চাপ ছিল প্রচুর | না কি মনে চাপ বাড়ছে ওর ! কৃষ্ণেন্দুকে দিনের পর দিন সামনে দেখে ! কথাটা মনে আসতেই ঘরের টেবিলে পরে থাকা এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চোখে পড়লো| আরেকবার খুলে সেটাকে চোখ বুলিয়ে নিলো দীপ্তি | এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়ার ইনভিটেশন কার্ড যেন এই কাগজটা ! যেখানে আর ওই মুখটাকে দেখতে হবে না কখনো | আর পুরোনো স্মৃতির ভিড় আঁকড়ে ধরবে না ওকে | আর একবার যেন নিজের মনেই বলে উঠলো কথাগুলো এই মুহূর্তে |
এরপর ধীরে ধীরে সাতটা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল | আজ দু লাখ শার্টের অর্ডার কমপ্লিট হয়েছে অবশেষে | অনেক লড়াই , অনেক পরিশ্রমের পর আজ সবার মুখেই একটা খুশির ঝলক | তিন লরি শার্ট যখন ফ্যাক্টরি থেকে রওনা, হলো আজ তখন যেন কোম্পানির প্রত্যেকটা এমপ্লয়ি , প্রত্যেকটা ওয়ার্কার্স এর মনে স্বস্তি ফিরে এলো | ডাবল শিফ্ট এ কাজ করেছে ওরা , শুধুমাত্র এই কোম্পানিটাকে বাঁচানোর জন্য | এতো পরিশ্রমের পর এই হাসিটার খুব দরকার ছিল সবার | এইসবই ভাবছিলো ফ্যাক্টারীর গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | তখনই খেয়াল করলো , ওয়ার্কার্সদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণেন্দু যেন হঠাৎ একটু টাল খেয়ে গেলো | মাথায় হাত দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েছিল ও | তারপরেই যেন টাল সামলাতে পারলো না | পাশের দেয়ালটা ধরে ফেললো | মনে হয় শরীর ঠিক নেই ওর | চোখ মুখটা তো অনেকদিন ধরেই ফ্যাকাসে কেমন ! তাহলে কি মাথা ঘুরছে ! যদিও দীপ্তি ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউই খেয়াল করেনি | কৃষ্ণেন্দু যেন জোর করেই হাসার চেষ্টা করছিলো সবার সামনে | দেখানোর চেষ্টা করছিলো ও ঠিক আছে | কথাগুলো আনমনে মনে হলো দীপ্তির এখন | আসলে এতদিন এতো রাত জেগে কাজ করেছে বলেই হয়তো ! যাইহোক , এখন তো আর চাপ নেই | অর্ডার কমপ্লিট হয়ে গেছে আজ | এরপর রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে | কথাটা ভেবেই দীপ্তি চোখটা ঘুরিয়ে নিলো নিজের | না , এতো বেশি এই ছেলেটাকে নিয়ে ভাবলে আর চলবে না | আজ তো রেজিগনেশনটা জমা দিয়ে সব শেষ করে দেয়ার দিন | আর কৃষ্ণেন্দুও কথা দিয়েছে , এরপর আর কখনো কোনো রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না ওর আর মায়ের সাথে | যদিও যোগাযোগ করার সুযোগও পাবে না | দীপ্তিরা সামনের সপ্তাহেই ব্যাঙ্গালোর চলে যাচ্ছে | নতুন চাকরির কথাটা ও বলে দিয়েছে মা কে | দুদিন ধরে সেই জন্য মায়ের মুখটা অন্ধকার হলেও কিছু বলেনি ওকে | বরং ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিয়েছে দুজনের | এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সেদিন ও এসে হাজির হয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর কেবিনের সামনে | রেজিগনেশন লেটারটা ওর হাতেই আছে এখন | সেটা সমেতই ও দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকলো |

কৃষ্ণেন্দু কিছুটা দূরে নিজের চেয়ারে বসেছিল এখন | এই মুহূর্তে আবার দীপ্তি যেন খেয়াল করলো , কৃষ্ণেন্দুকে ভীষণ উইক লাগছে আজ | অন্য দিনের থেকেও বেশি ফ্যাকাসে অন্ধকার লাগছে মুখটা | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও এগিয়ে গেলো | তারপর কৃষ্ণেন্দুর কাছে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললো , —————– ” আমার রিজাইনটা | এন্ড কংগ্রাচুলেসন্স | আজকের অর্ডারটা কমপ্লিট হওয়ার জন্য | আমি যেখানেই থাকি , সব সময় এটাই চাইবো , তোমার ব্যবসা , তোমার কেরিয়ার যেন আরো এগিয়ে যায় | অল দ্যা বেস্ট … আসলাম |”
কথাটা শেষ হতেই কৃষ্ণেন্দু এবার একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো হঠাৎ , ————– ” তুই যেখানেই থাকিস মানে ! কোথাও যাচ্ছিস ? ”
দীপ্তি কথাটা শুনে দু সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলো , ———– ” ব্যাঙ্গালোর | চাকরি নিয়ে | কিন্তু এর বেশি কিছু জিজ্ঞেস কোরো না | এড্রেস আমি দিতে পারবো না | যাইহোক আসলাম |”
কথাগুলো বলেই দীপ্তি এবার দরজার দিকে ফিরে তাকালো , এগিয়ে যাওয়ার জন্য | কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর একটা কথায় হঠাৎ থমকে গেলো | কৃষ্ণেন্দু যেন কিরকম ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলো আজ ,
————- ” আমার জন্য এই শহরটা ছাড়ছিস ! যাতে কোনোদিনও আর দেখা না করতে পারি ! চিন্তা করিস না | আমি আর যাবো না দীপ্তি | আর কোনোদিনও দেখা হবে না আমাদের | ডিস্টার্ব করবো না তোকে , প্রমিস |”
কথাগুলো যেন কানে এসে লাগলো এখন দীপ্তির | কৃষ্ণেন্দুর গলার আওয়াজের মধ্যে আজ কিরকম একটা ক্লান্তি ছিল | শুনে মনে হচ্ছিলো কিছু একটা শেষ হয়ে যাচ্ছে | আর কৃষ্ণেন্দু যেন সেই শেষটা জানিয়ে দিলো ওকে | কথাগুলো মনে হতেই দীপ্তি একবার ফিরে তাকালো কৃষ্ণেন্দুর দিকে | ওই ফ্যাকাসে মুখটাকে এক পলক দেখে মনে হলো আর বেশিক্ষন থাকলে ও জরিয়ে পরবে আবার | এই ছেলেটার জন্য টান তৈরী হয়ে যাবে আগের মতন | যেটা দীপ্তি আর কখনোই হতে দেবে না | পুরোনো ভুলটা আর করবে না ও | কথাটা ভেবেই মনটাকে শক্ত করলো যেন আজ| তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে জোরে পা চালালো , ঘরটা থেকে আর কৃষ্ণেন্দুর জীবন থেকে সারা জীবনের মতন বেরিয়ে আসার জন্য |

কিছু শেষ হয়ত এইভাবেই লেখা থাকে । একটা অসমাপ্ত বইয়ের গল্পের মতন । দীপ্তি আর কৃষ্ণেন্দু র গল্পটাও তাই । একটা অসমাপ্ত পরিণতি হীন গল্প । যার শেষের কাছে ফিরে যাওয়া যায় না । মাঝ পথেই বইটাকে বন্ধ করে দিতে হয় । সেইদিন রাতে দীপ্তি একলা ঘরে বসে বসে এই কথাগুলোই ভাবছিল । আর মাঝে মাঝে না চাইতেও যেন শুনতে পাচ্ছিল ওই ক্লান্ত গলার স্বরটা । ওই ফ্যাকাসে থমকে থাকা মুখটা যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও বলে মনে হচ্ছিল হঠাৎ । কিন্তু দীপ্তির যে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই আর । একবার এই ছেলেটাকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট দিয়েছে নিজেকে । কিন্তু একই ভুল তো বার বার করতে পারে না । তাই চোখটা ভিজে এলেও দীপ্তি স্থির ছিল মনে । বোঝানোর চেষ্টা করছিল নিজেকে , যে নতুন শহরে গেলে সব ভুলে যাবে ও । নতুন অনেক অচেনা মুখের ভিরে আর মনে পড়বে সেই চেনা মুখটাকে । কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন আলতো করে চোখের পাতায় ঘুম এসে জড়ো হয়ে ছিল ওর । কিন্তু স্বপ্নেও ওই কৃষ্ণেন্দু ই ভেসে এলো আজ । ছেলেটা যেন খুব কাছে ওর এসে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ । দীপ্তি স্পষ্ট শুনতে পেল কৃষ্ণেন্দু র নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর আওয়াজ । তারপর কিছু না জানিয়েই ভীষণ অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিকে । দীপ্তি বুঝতে পারলো না ছেলেটা কোথাও হারিয়ে গেল আচমকা । দীপ্তি ওই অন্ধকারের মধ্যে অনেক হাত্রালো , অনেক খোঁজার চেষ্টা করলো । কিন্তু তা ও কৃষ্ণেন্দু কে দেখতে পেলো না কোথাও ! এই মুহুর্তেই হঠাৎ চোখে একটা আলোর রেশ এসে পরলো । দীপ্তি যেন দম বন্ধ করা অন্ধকার পেরিয়ে চোখ মেলে তাকালো হঠাৎ । কি দেখছিল এতক্ষণ ও ! স্বপ্ন ! কথাটা ভেবেই মাথায় হাত দিল । বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমেছে কপালে ! কি অদ্ভুত স্বপ্নটা ছিল ! সত্যি । কথাটা ভাবতে ভাবতেই আবারও না চাইতেই কৃষ্ণেন্দু র কথা মনে এলো কেমন । ও ঠিক আছে তো ! ভাবনা টা কিরকম এসে ধাক্কা দিলো মনে । দীপ্তি আবার এই মুহূর্তে নিজের মনকে শাসন করলো । না , বেশি ভাবছে ও । ঠিক কেন থাকবে না কৃষ্ণেন্দু । আজ থেকে তো ওর আবার ভালো থাকার দিন শুরু । ওর জীবনের সব থেকে কাছের ব্যবসাটা বেঁচে গেল ! আবার আস্তে আস্তে সাকসেস , টাকা পয়সা , নাম সব ফিরে আসবে ওর । আজ তো খুশির দিন । আজকের দিনে কৃষ্ণেন্দু র মনে পুরনো কারোর জন্য ভাবনা আসতেই পারে না ! সেই সময়ই পাবে না হয়ত । কথাটা যেন জোর করেই ভাবার চেষ্টা করলো দীপ্তি । তারপর নিজের চোখটা বন্ধ করে আরেকবার নতুন করে ঘুমনোর চেষ্টা করলো ও ।
যাইহোক , সেদিন এরপর বেলার দিকে দীপ্তি গিয়েছিল একটু ব্যাঙ্কে । ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার আগে কিছু টাকা তোলার ছিল ওর। কিন্তু সেদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে থমকে গেল হঠাৎ ! পরিতোষ জেঠুকে সামনে দেখে !ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরোচ্ছে এখন | হঠাৎ এই সময় ব্যাংকে ! অফিস টাইমে ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি এগিয়ে গেলো সামনে | পরিতোষ জেঠু যেন একটু ইতঃস্তত হয়ে গেলো দীপ্তিকে দেখে এই মুহূর্তে | দীপ্তি ব্যাপারটা খেয়াল করেই জিজ্ঞেস করে উঠলো , ——– ” কি হলো পরিতোষ জেঠু ? তুমি ব্যাঙ্কে ? আজ অফিস যাওনি ?”

কথাটা শুনে উনি যেন একটু কথা সাজিয়ে বলে উঠলো , ———- ” হ্যাঁ , আসলে কাজ ছিল কিছু , তাই |”

কি হলো হঠাৎ ! পরিতোষ জেঠু এইরকম এলোমেলো ব্যবহার করছে কেন হঠাৎ ! আর হাতে ঐসব কিসের ফাইল ! কথাটা দীপ্তি ভাবতেই ব্যাংকের ভিড়ে একটা লোক পরিতোষ জেঠুকে একটু যেন ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেলো ভেতরে , আর আচমকা ওর হাতে ধরা ফাইল দুটো পরে গেলো মাটিতে | কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চারিদিকে | দীপ্তি সেই মুহূর্তেই মাটিতে কাগজগুলো তোলার জন্য এগিয়ে গেলো | কিন্তু একটা পেপারের ওপর চোখ যেতেই কিরকম অবাক হয়ে গেলো ও ! কৃষ্ণেন্দুর বাড়ির দলিলের কপি ! এটা পরিতোষ জেঠুর কাছে কি করছে ! কথাটা ভেবেই ও অনেক প্রশ্ন নিয়ে তাকালো লোকটার দিকে | পরিতোষ জেঠুও যেন এই মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য উত্তরহীন হয়ে রইলো দীপ্তির কাছে | তারপর নিজেই বলে উঠলো আস্তে গলায় ,

————– ” আসলে কৃষ্ণেন্দু কাউকে জানাতে বারণ করেছিল বলে বলিনি | ও এক মাস আগে বাড়িটা মর্গেজ রেখে লোন নিয়েছিল কোম্পানির জন্য | নইলে এতজনের স্যালারি , মেটেরিয়ালস এর জন্য এডভান্সের টাকা , সব জোগাড় করতে পারতো না ! তাই | আমি কিন্তু তখন বারণ করেছিলাম ওকে জানিস | কিন্তু শোনেনি | কি বলি বল !”

কথাটা শুনে দীপ্তি এই সময়ে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | কৃষ্ণেন্দু বাড়িটাকে বন্দক রেখে লোন নিয়েছিল ! আর এই ব্যাপারটা কাউকে জানতে দেয়নি ! ওই বাড়িটা ওর কাছে কতটা দামি ছিল দীপ্তি অন্তত সেটা জানতো প্রথম দিন থেকে | তাও এতো বড়ো একটা রিস্ক নিলো ! যদি প্রজেক্টা ঠিক মতন কমপ্লিট না হতো , তাহলে তো মাথার ওপর থেকে ছাদটাই চলে যেত ওর | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দীপ্তির যেন খুব অদ্ভুত লাগছিলো এবার | কৃষ্ণেন্দু তাহলে এতটাই বদলে গেছে এই ক মাসে ! যেই ছেলেটা আগে নিজের লাভ ক্ষতি ছাড়া এক পার্সেন্টও বেশি কিছু ভাবতে পারতো না , সে অন্যদের যাতে এক মাসও মাইনে বন্ধ না হয় , এডভান্সের টাকা আটকে না যায় , তার জন্য নিজের বাড়িটা অব্দি ব্যাংকের কাছে জমা রেখে দিলো ! কথাটা ভেবেই ওর সেই থমকে থাকা ফ্যাকাসে মুখটা যেন আরেকবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো , আর আজ সত্যি কষ্ট হলো ওর , মন থেকে ছেলেটার জন্য | তার মানে কৃষ্ণেন্দু এই এক মাস কতটা মেন্টাল স্ট্রেসের মধ্যে ছিল | কতটা চাপ ছিল ওর ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই পরিতোষ জেঠু এবার বলে উঠলো , ———— ” কি জানি কি হয়েছে ! আজ কৃষ্ণেন্দু অফিসে আসেনি জানিস | ফোনটাও সুইচ অফ | সেই জন্যই তো ওকে ছাড়াই ব্যাংক এ আসতে হলো | তবে ওর সাইন ছাড়া তো কাজ কিছুই হবে না | ছেলেটা সত্যি কিরকম অদ্ভুত হয়ে গেছে অনেকদিন ধরে ! যেদিন থেকে আরেকবার অফিসে জয়েন করেছি , খেয়াল করছি | কৃষ্ণেন্দু কিরকম যন্ত্রের মতন কাজ করে যায় যেন | কোনো হাসি নেই , কোনো কথা নেই ! আর লাস্ট কদিন তো ওকে দেখে আমার ভীষণ উইক লাগছিলো ! জানি না শরীর টোরির ঠিক আছে কি না ! দেখি , এরপর একবার যাবো ওর বাড়ি দেখা করতে | ”

কথাগুলো বলেই পরিতোষ জেঠু আর দাঁড়ালো না বেশিক্ষণ দীপ্তির সামনে | তবে দীপ্তি ভেতরে ভেতরে কিরকম থমকে গেলো হঠাৎ ! মনে পরে গেলো এই এক মাসে দিপ্তিও তো কৃষ্ণেন্দুর সাথে কোনো কথা বলেনি | একই অফিসে কাজ করে সারাক্ষণ অচেনা থেকেছে ! ওর কি উচিত ছিল কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলার ! তাহলে কি কৃষ্ণেন্দু একটু হালকা হতো মন থেকে ! একটু ভালো থাকতো ও ! সেদিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই এরপর দীপ্তি বাড়ি ফিরেছিল | তবে বাড়ি আসার দু মিনিটের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো , যেটা সব কিছু এলোমেলো করে দিলো ওর | সেদিন বাড়ি ফেরার পর একটা পোস্ট এসেছিলো দীপ্তির নামে | দীপ্তি সাইন করে খামটা খোলার আগের মুহূর্ত অব্দি জানতো না যে এটা শেষ চিঠি | সেদিন আনমনে খামটা খুলে কাগজগুলো বার করেই ও স্তব্ধ হয়ে গেছিলো হঠাৎ | এইসব কি ! দানপত্র ! কৃষ্ণেন্দুর বিজনেসের পেপার ! কৃষ্ণেন্দু নিজের সমস্ত ব্যবসা , সেন টেক্সটাইল সব কিছু দীপ্তির নামে করে দিয়েছে ! আর সঙ্গে একটা চিঠি পাঠিয়েছে ওকে | দীপ্তি কিছু বুঝতে না পেরে খুলে দেখলো তখনই চিঠিটা | কতগুলো শব্দ হয়ে সেই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো হঠাৎ ,

———– ” আমার ব্যবসাটা আমি তোকে দিলাম দীপ্তি | কারণ আমি জানি , তুই আমার থেকে অনেক বেশি ভালো করে , সবার কথা ভেবে এই ব্যবসাটা চালাতে পারবি | এছাড়া আর কোনোভাবে দূরে যেতে পারতাম না | তাই নিজেকে সরিয়ে নিলাম | আর তুই নিশ্চিন্তে কলকাতাতে থাকতে পারিস | কোনো চিন্তা করিস না | দেখা হবে না আর আমার সঙ্গে | যাইহোক , ভালো থাকিস | ”

কথাগুলো যেন ধাক্কা দিলো দীপ্তিকে এখন | কি লিখেছে কৃষ্ণেন্দু এইসব ! আর সরিয়ে নিলাম মানেটা কি ! কথাটা মনে হতেই আলো এসে হাজির হলো ড্রইং রুমে | দীপ্তিকে ঐভাবে কতগুলো কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলোও অবাক | কি হলো হঠাৎ ! কথাটা ভেবে আলো সেই মুহূর্তে এগিয়ে গেলো দীপ্তির কাছে | তারপর জিজ্ঞেস করে উঠলো ওকে ,

———– ” কি হয়েছে তোর ? এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? আর এইগুলো কিসের কাগজ তোর হাতে ?”

দীপ্তি এতগুলো প্রশ্নের যেন কোনো উত্তর দিতে পারলো না এখন | কোনো কথা সাজিয়ে উঠতে পারলো না মনে | শুধু কাগজগুলো ওর মার্ হাতে ধরিয়ে দিলো | আলো কিছু বুঝতে না পেরেই কাগজের লেখাগুলোতে চোখ মেলালো | তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে ও নিজেও থমকে গেলো যেন | কৃষ্ণেন্দু নিজের পুরো ব্যবসাটা দীপ্তির নামে লিখে দিয়ে চলে গেছে ! শেষে এইভাবে শেষ করলো ছেলেটা ! আলোর কথাগুলো ভেবে চোখ দুটো ভিজে এলো হঠাৎ | দীপ্তির তবে এই সময়ের মধ্যে যেন সম্ভিত ফিরেছে | ও তাড়াতাড়ি নিজের মোবাইল থেকে কৃষ্ণেন্দুর নাম্বারটা ডায়েল করলো | এখন ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে দীপ্তিকে | কিন্তু এই মুহূর্তে কল করতেই উল্টো দিক থেকে শুধু নিঃস্তব্ধতাই ভেসে এলো আজ দীপ্তির কাছে | কৃষ্ণেন্দুর মোবাইলটা সুইচ অফ | দীপ্তি কি করবে এবার বুঝতে না পেরে পরিতোষ জেঠুর নাম্বারটা ডায়েল করলো | ব্যাংক এ বলছিলো না উনি , যে কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি যাবে এরপর দেখা করতে ! পরিতোষ জেঠু ঠিক তাহলে কৃষ্ণেন্দুর খবর দিতে পারবে | কথাটা মনে হতেই কয়েকটা রিং বেজে পরিতোষ জেঠু ফোনটা তুললো নিজের | দীপ্তি এই সময় একটু এলোমেলো হয়েই জিজ্ঞেস করলো ,

————– ” হ্যালো , পরিতোষ জেঠু ,তুমি গেছিলে কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি ? দেখা হলো ওর সাথে ? ঠিক আছে তো ও ?”

দীপ্তির এতগুলো প্রশ্নের কোনো মানে খুঁজে না পেয়ে উনি অবাক হয়েই উত্তর দিলো যেন , ———– ” না রে | কৃষ্ণেন্দু তো কাল রাত থেকেই বাড়ি ফেরেনি শুনলাম | ওর বাড়ির সব স্টাফরা বললো আমাকে | কিন্তু তোর গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন ? সব ঠিক আছে তো?”

দীপ্তি এর উত্তরে কিরকম স্তব্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ | ফোনটা কান থেকে সরিয়ে দিলো নিজের | শরীরটা যেন কিরকম হালকা মনে হতে শুরু করেছে এই মুহূর্তে | পাশের চেয়ারটা ধরে কোনো রকমে সামলালো নিজেকে | তার মানে কৃষ্ণেন্দু ওর বাড়িতেও যায়নি ! ফোনটা সুইচ অফ | অফিসে আসেনি ! তাহলে কি সত্যি চলে গেলো ছেলেটা ! সব ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো ! কালকে কি তাহলে সেই জন্যই ওকে বলেছিলো , আর দেখা হবে না ! দীপ্তি যেন আর কিছু ভাবতে পারলো না এখন | কি করবে ও এরপর ! কোথায় খুঁজবে কৃষ্ণেন্দুকে ! আর কাল তো সত্যি দেখে মনে হচ্ছিলো কৃষ্ণেন্দুর শরীর ঠিক নেই | শুধু দীপ্তি কেন , পরিতোষ জেঠু অব্দি খেয়াল করেছে ব্যাপারটা |

এই রকম শরীর নিয়ে কোথায় গেলো ছেলেটা !