হৃদয়দহন পর্ব-০২

0
82

#হৃদয়দহন (২)

অপরা কলেজ থেকে ফিরল। পোশাকটি একদম ঘামে ভেজা। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ মাত্রই চ্যাঁচিয়ে ওঠল অয়ন। এতে চোখ ছোট ছোট করে চাইল ষোড়শী। অয়ন এগিয়ে এসে বলল,”একি রে, তুই কি কলেজ গিয়ে গোসল করে এসেছিস?”

মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। মানুষটা সর্বদা উল্টোপাল্টা কথা বলে।
“কলেজে কেউ গোসল করতে যায় না অয়ন ভাই।”

“তোকে দেখলে মনে হয় গোসল করতেই গিয়েছিস। এভাবে ভিজে একাকার।”

সরল চোখে তাকাল অপরা। রিকশা পায় নি। এতটা পথ তাই হেঁটে আসতে হয়েছে।

“পাড়ায় কি সব ঝামেলা হয়েছে। তাই রিকশা আসছে না।”

“কীসের ঝামেলা?”

“আমি তো জানি না।”

অপরা ব্যাগ নিয়ে নিজ রুমের দিক এগোল। অয়নের হাতে পেয়ারা ছিল। মাত্রই ছাদ বাগান থেকে পেরে এনেছে। সেটায় কামড় দিয়ে বলল,”মা, আমি বের হলাম।”

“এই ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?”

ভেতরের ঘর থেকে জবাব দিলেন মা। অয়ন বলল,”পাড়ায় নাকি রিকশা আসছে না। দেখি কি সমস্যা।”

অয়ন চলে গেল। অপরা নিজ ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল সেটা। সে মূলত একটু মিথ্যে বলেছে। রিকশা আসছিল না এটা ঠিকই। তবে গোপন কারণে ছুটে আসতে হয়েছে তাকে। সেই জন্যই ঘেমে গেছে। আর বিষয়টি আপাতত কাউকে বলা যাবে না।

ড্রেস বদল করে এল অপরা। তারপর রান্না ঘর থেকে খাবার নিতে নিতে শুধাল,”বড়ো মা, পুঁইশাক কেন রান্না করেছ? আমি তো খেতে পারি না।”

বড়ো মা ছোট ছোট চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক রান্না করেছেন। মোটামুটি বাড়ির সবাই এটি পছন্দ করে থাকেন। এই অপরা ই একমাত্র ব্যক্তি যে পুঁইশাক খায় না। তার নাকি ভালো লাগে না। কেমন গলা দিয়ে নামে না।

“মাঝে মধ্যে শাক খেতে হবে আম্মা। না হলে তো আপনার শরীর আরো শুকিয়ে যাবে। যেভাবে দিন কে দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস।”

অপরা কথা বলল না। সে আপন মনে ফ্লিজ থেকে ডিম নিয়ে ভাজতে লাগল। বড়ো মা ক্লান্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন,”গোসল করে নিতি।”

“ক্ষুধা লেগেছে খুব। ক্যান্টিনে কি সব বিক্রি করা হয়। একদমই খেতে পারি না।”

মেয়েটির কথা বার্তায় কেমন একটা মায়া মিশে আছে। দেখলেই ভেতরটা কেমন করে ওঠে। বড়ো মা অপরার কোমড় অবধি খোলা চুল গুলো খোঁপা করে দিলেন। তারপর পুঁইশাক থেকে কিছু চিংড়ি মাছ ওঠিয়ে প্লেটে দিলেন। অপরা প্লেট নিয়ে যেতে যেতে বলল‍,”দাদিজান খেয়েছে?”

“খেয়েছে, জোর করে খাওয়ালাম। তোকে ছাড়া খেতেই চায় না। শেষে বললাম, অপুকে তো বিয়ে দিতে হবে। তখন কী করবেন। এরপর কিছু সময় চুপ করে থেকে, খাবার খেল।”

অপরা হেসে ফেলল। এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ ওর ভীষণ আপন। তবে দাদিজান সবথেকে বেশি। এই মানুষটার জন্যই কী না সে বেঁচে আছে।

অয়ন পাড়ার ক্যারামের দোকানে এসে বলল,”কী রে, পাড়ায় রিকশা কেন আসছে না?”

একজন বলল‍,”আসছে তো। তবে সোলাইমান বড়ো ঝামেলা করছে। তাই একটু গণ্ডগোল লেগেছিল। তখন অফ ছিল।”

অয়ন বুঝল বিষয়টা মোটেও সহজ নয়। সোলাইমান, পাশের পাড়ার ছেলে। একদমই বিগড়ে যাওয়া যাকে বলে। প্রায় সময়ই এই পাড়ায় এসে ঝামেলা করে। এই নিয়ে দুই পাড়ায় কতবার যে বিচার বসল। তবু শোধরায় না সোলাইমান।

ক্যারাম খেলতে খেলতে হঠাৎ চোখ পড়ল দোকানে। নীলা এসেছে। জিনিসপত্র কিনবে বলে। দুজন ইশারায় কথা বলল। তারপর জিনিসপত্র কেনা হলে,একটু আগে পরে করে চলতে লাগল। দোকান থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে অয়ন বলল,”তোমায় না বলেছি, একা একা দোকানে আসবে না।”

ওর কথায় মুখ টিপে হাসল নীলা। তারপর বলল,”আসলে কী সমস্যা?”

“কী সমস্যা মানে, বিরাট সমস্যা। দোকানের পাশেই ক্যারাম খেলা হয়। কত ছেলে’রা এখানে বসে থাকে। ওরা তো চোখ দিয়ে গিলে খাবে।”

আরেক দফায় হাসল নীলা। তারপর বলল,”কতবছর ধরে এই পাড়ায় আছি। কেউ কিছু বলার সাহস পায় নি।”

অয়ন পুরো হতাশ হলো। মেয়েটাকে বোঝাতে পারছে না। ও খপ করেই যুবতীর হাত ধরে ফেলল। চোখে চোখ রেখে বলল,”তুমি বুঝতে পারছ না, হয়তো সবাই সামনে ভালো ব্যবহার করে,কিন্তু আড়ালে ওদের কথা বার্তার শেষ নেই।”

“আচ্ছা, বুঝেছি মশাই। এত চিন্তা কোরো না তো।”

“কেন চিন্তা করব না? চিন্তা তো করবই। পাড়ার সবথেকে সুন্দরী আমার গার্লফ্রেন্ড। চিন্তা তো করতেই হবে।”

ওর এহেন কথায় না হেসে পারল না নীলা। ও শব্দ করে হেসে ফেলল। আর সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল অয়ন। কোনো মানুষের হাসি এত সুন্দর কেন হবে?

ছোট চাচার মেয়ের নাম কথা। অপরার থেকেও দু বছরের ছোট। স্কুলে পড়ছে। ক্লাস এইট। মেয়েটির একটি স্বভাব রয়েছে। পুরো পাড়া ঘুরেফিরে খবর নিয়ে আসা। অপরা পেয়ারা মাখা করেছে। সেটা নিয়েই বসেছে ওরা। এক টুকরো পেয়ারা নিয়ে শুধাল,”বল, তোর কাছে আজকে কী খবর আছে।”

কথা সিরিয়াস হয়ে বসল। যেন সংবাদ পাঠ করবে। তারপর বলল,”খবর আছে গো অপুবু, খবর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।”

“তাই? বলে ফেল। দেরি করিস না।”

“সোলাইমান ভাই, পাড়ায় এসেছিল। এসে পাড়ার ছেলেদের সাথে ঝামেলা করেছে। আর সেই নিয়েই প্রায় মারামারি হতে গিয়েও হয় নি।”

এই খবর জানে অপরা। আসার পথেই দেখে এসেছে। তাই জমল না বিষয়টা। ও মুখ বাঁকিয়ে শুধাল,”ভালো কোনো খবর নেই? এটা তো জানি।”

“আরো আছে। পাশের বাসার রুবিনাবুকে বিকেলে দেখতে আসবে। ছেলে নাকি বিশাল ব্যবসায়ী। টাকা পয়সার কোনো কমতি নাই।”

এই খবরটা পছন্দ হলো অপরার। রুবিনাবু এবার এইচ এস সি দিয়েছে। মোটামুটি সুন্দরী এক মেয়ে। অনেক মাস ধরেই বিয়ের কথা বার্তা চলছে। তবে কোনো এক কারণে হচ্ছে না। আজ আবার ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। ভালোই হলো, বিকেলটা ঘুরে আসা যাবে। ওরা দুজনই পেয়ারা মাখা শেষ করে বের হচ্ছিল। অয়ন ডেকে ওঠল,”কোথায় যাচ্ছিস?”

অপরা চুপ। কথা বলল‍,”রুবিনাবুদের বাসায়।”

“ও, তার আগে আমাকে কিছু কাজ করে দে তো।”

কথার মুখ চুপসে গেল। অপরা নিজেও বিরক্ত। এই লোক সবাইকে দিয়ে কাজ করায়। নিজে কিচ্ছু করে না। যেন বাড়ির একমাত্র রাজপুত্র। অথচ ছোট চাচার ছেলে, কিয়ান ভাই। সে তো সবার বড়ো। সব কাজ নিজে করে। কাউকে দিয়ে করায় না।

কথা গেল চিলেকোঠার ঘরে। ওখানেই ভাইয়াদের খেলার জিনিসপত্র আছে। মার্বেল, লাটিম, ব্যাট বল, আরো কত কি। এসব নিজেই খুঁজে আনতে পারত অয়ন। অথচ সে গেল না। অন্যকে খাটাতে তার মজা লাগে। অপরা তো মুখ ফুটে বলেই ফেলল,”নিজে গিয়েই তো আনতে পারতেন।”

অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। মেয়েটা বড়ো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। তারপর ওঠে এসে একদম বর‍াবর দাঁড়াল।

“কথা কে না পাঠিয়ে,তোকে পাঠানো উচিত ছিল।”

মেয়েটার মুখ র’ক্তশূন্য হয়ে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল‍,”আমি কেন যাব?”

“তুই যাবি না মানে। তুই তো যাবি। সব কাজ তোকে করতে হবে। আমি না তোর বর হব? আর বরে‍র সেবা করা তো স্ত্রী’র ধর্ম।”

অয়নের কথায় অপরার চোয়াল ভাঙার উপক্রম। কোন ছোটবেলায় সে বলেছিল অয়ন ভাই তোমাকে বিয়ে করতে চাই। সে ঘটনা টেনে হিঁচড়ে লোকটা ওকে খাটাতে থাকে। অপরা হতাশ। তার বলার ভাষা নেই। এক বাক্স জিনিস নিয়ে নামল কথা। সে পুরো ঘেমে গেছে।

“গুড, কথাকলি তোর জন্য চকলেট আছে।”

চকলেটের কথা শুনে কথার মুখশ্রীতে আলো এসে ধরা দিল। হাসি হাসি মুখে চাইল সে। অয়ন চকলেট বের করে দিল। অপরা তাকিয়ে আছে দেখে ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,”কী? তোর জন্য আনি নি। এগুলো শুধু কথাকলির। তোর জন্য লবডংঙ্কা।”

বয়েই গেছে, ওনার চকলেটের। অপরা ভেংচি কেটে চলে গেল। কথা পেছন থেকে বলল,”আমার থেকে ভাগ দিব তোমায়। অপুবু রাগ কোরো না।”

অয়ন পেছন দিকে চেয়ে হেসে ফেলল। এই মেয়েটা আস্ত এক বোকা। অল্পতেই রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায়। তবে বলা বাহুল্য অপরা’র ভেতর মায়া একটু বেশি। তার রাগ যত দ্রুত ওঠে, তার প্রশমন হয় তার থেকেও বেশি দ্রুত।

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি