হৃদয়দহন পর্ব-০৩

0
61

#হৃদয়দহন (৩)

অঘ’টন ঘটে গেল। অপরা আর কথা গিয়েছিল রুবিনাবুদের বাড়িতে। তাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে বলে পাড়ার অনেকেই ভীড় জমিয়েছিল। সমস্যা সেটা না। সমস্যা হলো ছেলে পক্ষ রুবিনার বদলে অপরাকে পছন্দ করে নিয়েছে। এই নিয়ে রুবিনাবু’র মা চ্যাঁচামেচি করছেন। দু এক কথা শুনিয়েও দিলেন। অপরার যে কি খারাপ লাগল। ও চলেই আসছিল, ঠিক তখনই তিক্ত কথা গুলো কানে এল। রুবিনাব’র মা বললেন,”কপাল, সব ই কপাল। ছোট সময়ে বাপ মা রে মা’রছে। তারপর এত বছর ধরে পরের বাড়িতে পড়ে আছে। খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন অন্য বাড়ির জামাই নিয়ে টানাটানি শুরু করছে।”

কথা গুলো শুনে অপরার দু চোখ বেয়ে জল নেমে এল। ও শুধু বলল,”আমি বাবা-মা কে মা’রি নি চাচি। আমি মা’রি নি।”

এইটুকু বলেই দৌড় লাগাল অপরা। কথা সে দিকে তাকিয়ে বলল,”কাজটা ঠিক করলে না চাচি। রুবিনাবু কে দেখতে আসায় এমন অবস্থায় পড়ব যদি জানতাম,জীবনেও আসতাম না। তবে কাজটা তুমি ভালো করলা না।”

কথা আক্রোশ নিয়ে ফিরে এল। এসে দেখল অপুবু ছাদে গিয়েছে। সেখানে বসে বসেই কান্নাকাটি করছে। ও গিয়ে পাশে বসল।
“অপুবু, তুমি মন খারাপ করবে না।”

অপরার কি যে খারাপ লাগছে। এত বছরের মধ্যে প্রথমবার তার মন হলো,ও এই বাড়ির কেউ না। কেউ না মানে কেউ না।

অপরা রাতের খাবার খেল না। অজুহাত দিল মাথা ব্যথার। কথা কিছু বলতেও পারছে না। অপুবু’র কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ও শুধু মন খারাপ করে বসে আছে। অয়ন একটু পরে বাড়ি ফিরেছে। সোলাইমান এর বিষয় নিয়ে আজ আসর বসেছিল। ছেলেটা আস্ত এক বেয়া’দব। এভাবে প্রভাব খাটিয়ে পাড়ায় অশান্তি তৈরি করবে, এটা হতে পারে না। এসে শুনল অপরা’র নাকি মাথা ব্যথা। ও আমলে নিল না। তবে এক পর্যায়ে দেখল কথা অন্যমনস্ক। ডাক পড়তেই চমকে ওঠল।

“কী রে, কথাকলি। তোর আবার কী হলো? ঐ বাঁদরটার সাথে সাথে তোর ও মাথা ধরল নাকি?”

আমতা আমতা করে কথা বলল,”না ভাইয়া। কিছু হয় নি আমার।”

খাবার খেতে লাগল কথা। তবে অয়ন দৃষ্টি ফেরাতে পারল না। ওর মনে হলো কিছু যেন লুকাচ্ছে এই কিশোরী।

খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে, অয়ন বলল,”কথাকলি, আমার রুমে এসো।”

কথা চুপচাপ অয়নের রুমে গেল। কোনো কথা বলল না। অয়ন সরাসরি শুধাল,”কী হয়েছে? চোখ,মুখ শুকনো লাগছে যে।”

“কিছু হয় নি ভাইয়া।”

“মিথ্যে বলছ কেন? অপরার মিথ্যে ধরা যায় না। তবে তুমি কিন্তু একদমই মিথ্যে বলতে পারো না। সত্যি টা বলো।”

শেষটা একদম ধমকের সুরে বলল অয়ন। এতেই কেঁপে ওঠল কথা। তারপর আমতা আমতা করে বলল,”বিকেলে রুবিনাবুদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছেলে পক্ষ অপুবুকে পছন্দ করেছে। সেই নিয়ে চাচি কথা শুনিয়েছে।”

অয়ন ভ্রু কুঞ্চিত করে চাইল। তারপর বলল,”কী বলেছে?”

“বলেছে, অপুবু ছোট বেলায় বাবা,মা কে মে’রেছে। তারপর পরের বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুরছে। এখন আবার অন্য বাড়ির জামাই ধরে টানাটানি করছে।”

ক্রমেই অয়নের মেজাজ গরম হয়ে গেল। অপরাকে কথা শোনানোর সাহস হয় কী রে?

রাত তখন এগারোটা। রুবিনাদের বাড়িতে অয়ন এসে দাঁড়াল। দরজায় ঠকঠক করতেই ভেতর থেকে জবাব এল,”কে?”

“চাচি, আমি অয়ন। দরজা খুলেন।”

দরজা খুলে গেল। রুবিনা জেগেই ছিল। ও ছুটে এসে দাঁড়াল। অয়নের মুখশ্রী ফ্যাকাশে। একটু দূরে অপরা দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা নত করা।

“অয়ন ভাইয়া,তুমি শোনো কথাটা….’

রুবিনাকে থামিয়ে দিল অয়ন। তারপর শক্ত করে বলল,”তোর কিছু বলতে হবে না। আমি চাচির সাথে কথা বলব।”

রুবিনার মায়ের মুখটা গোমড়া করে রাখা। তিনি থমথমে কণ্ঠে বললেন,”দেখো অয়ন, এই রাত বিরেতে ঝগড়া করার মানে দেখি না। এত ভালো পাত্র ছিল। অথচ অপু’র জন্য গেল ভেস্তে।”

অয়নের মেজাজ গরম হয়ে আছে। ও পাশ ফিরে দেখল অপরার মাথাটা নত করে রাখা।

“অপরা, কি সেধে বলেছে আমাকে পছন্দ করেন? বলে নি তাই তো। তাহলে ওকে কেন দোষ দিচ্ছেন? আর চাচি ও আমাদের বাড়িতে থাকে। আমাদের বাড়িতে খায়। আপনার সমস্যা কেন হয়? অপরা দাদিজানের প্রিয় হয়ে এসেছে। আমাদের বাড়ির মেয়ে ও। আশা করছি, ভেবে চিন্তে কথা বলবেন।”

রুবিনা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মায়ের দিকে চেয়ে বলল,”তোমাকে বলেছিলাম মা। তুমি শুধু শুধু কথা শোনালে। ভালো লাগে না আমার।”

রুবিনা নিজ ঘরের দিকে এগোল। ওর মায়ের মুখটা আঁধারে ডুবে গেছে। এই অপয়া মেয়েটার জন্য অয়ন এসে হুমকি ধমকি দিয়ে গেল। তিক্ততায় ওনার অন্তর ভরে ওঠল যেন।

দাদিজান নিচতলায় থাকেন। একদম সদর দরজার কাছে। তাই গেইট খোলার আওয়াজ তিনি পেয়েছেন।

“অপু, কী হয়েছে রে?”

অপরা চুপ। তার গলা থেকে কথা আসছে না। অয়ন জবাব দিল।

“কিছু হয় নি দাদিজান। তুমি কেন ঘুমাও নি এখনো?”

“ঘুমিয়েছিলাম ভাই। তবে ঘুম ভেঙে গেছে। অপু সাথে আছে? এদিকে আয় তো তোরা।”

অপরার মাথা তখনো নত করা। অয়নের রাগ হলো। ও চুল টেনে বলল,”কী রে,শুনতে পাস নি?”

সহসাই মেয়েটির চোখ থেকে এক বিন্দু জল নেমে এল। অয়ন রেগে গেল এবার।

“কান্নাকাটি করে লাভ হবে? জবাব দিতে পারলি না কেন?”

নাক টেনে অপরা বলল‍,”কী বলতাম আমি?”

“কী বলতাম মানে, যেটা আমি বলে এলাম।”

“ওনি তো মিথ্যে বলে নি।”

“কী মিথ্যে বলে নি?”

পাল্টা প্রশ্ন করে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল অয়ন। অপরা জবাব দিতে পারল না।

“দুটো চড় বসিয়ে দিব। জবাব দিতে পারে না। এখন আবার ন্যাকামি করছে।”

অপরার কান্না যেন গলায় এসে আটকেছে। ওর মাথায় হাত রাখল অয়ন।

“চুল এমন ফ্যাকাশে কেন?”

অপরা কিছু বলার আগেই দাদিজান ফের ডেকে ওঠলেন,”ও অপু, অয়ন। ঘরে আয় তোরা।”

“আসছি দাদিজান।”

অপরাকে নিয়ে দাদিজানের ঘরে এল অয়ন। দাদিজান কিছুটা অসুস্থ। বয়সের ভাড়ে একা চলতে কষ্ট হয়। ওরা দুজন আসতেই হাতের ইশারায় বসতে বললেন।

“বাইরে গিয়েছিলি কেন?”

দাদিজান শুনলে রাগান্বিত হবেন। তিনি ভীষণ স্নেহ করেন অপরাকে। অয়ন বানিয়ে বলল,”তোমার নাতনি গোসা করেছিল।”

“কেন?”

“দুপুরে কথাকলিকে চকলেট দিয়েছি। ওকে দেই নি, তাই।”

“তা কেন দাও নি? আমার অপু তো বেশি বেশি চকলেট পাবে।”

“কি করব দাদিজান। তোমার অপু তো আমার যত্নই করে না।”

এত সময় অপরা চুপ ছিল। এবার চাইল। তারপর বলল,”আমি কেন যত্ন করব?”

অয়ন মন খারাপের মতন করে বলল,”দাদিজান,নামে তোমার অপু আমার বউ হয়। কাজে কিচ্ছু না। কোনো কথাই শুনে না।”

অপরা ফ্যাল ফ্যাল করে চায়। সেই ছোট বেলার কথা এখনো কেন শোনাতে হবে? আশ্চর্য লাগে ওর। দাদিজান হাসলেন। কিছু কথা বলার আগেই অয়নের ফোন এল। ও চলে গেল। অপরা দাদিজানকে জড়িয়ে ধরে বলল,”তুমি ঘুমাও দাদি, আমি ঘরে যাই।”

“ঠিক আছে। যা তুই। আর আমার নাতির যত্ন করিস। কেমন?”

জবাবে অপরা বলল,”পারব না। তাকে বিয়ে করাও বুড়ি। আমাকে দিয়ে বুয়ার মতন খাটাতে থাকে। ভারী বদলোক।”

দাদিজান হাসতে লাগলেন। অপরা বের হয়ে দেখল অয়ন কথা বলছে। ভিডিও কলে। আর মানুষটি নীলা। সে প্রায় অর্ধেক ঘুমন্ত সুরে, ভালোবাসার চুমু পাঠাচ্ছে। যা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অপরা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রেম করছে অয়ন আর নীলা। এদিকে লজ্জা লাগছে অপরা!

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি