#হৃদয়দহন (৭)
লুকিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল অপরা আর কথা। দুজন কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরার মুখ ভোতা হয়ে গেছে। অয়ন ঠোঁট কামড়ে দেখছে দুজনকে। এই দুই বাঁদর কতদূর দেখেছে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। চারপাশ শুনশান। যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। অয়ন রগরগে কণ্ঠে শুধাল,”সন্ধ্যা বেলা কী করছিস তোরা?”
কথা চুপ। অয়নের একটি স্বভাস রয়েছে। সে বড়ো শাসন করে। অপুবু অবশ্য মাঝে মধ্যে বেশ জ্বলে ওঠে। তখন নাকাল হতে হয় অয়ন ভাইকে। কিন্তু আজ অপরাও চুপ। সম্ভবত ভয় পেয়েছে। অয়ন দুজনের চুল ই টেনে ধরল।
“বাঁদরের দল। এই সন্ধ্যায় কেন বের হয়েছিস?”
“সস কিনতে এসেছি।”
কথার জবাব। অয়ন অবশ্য সেটি বিশ্বাস করছে না। ও অপরার চুল আরো শক্ত করে টেনে ধরল।
“তুই চুপ কেন? এই বুদ্ধি তোর তাই না?”
অপরা ফ্যাল ফ্যাল করে চাইল। ওমা, সে কী দোষ করল! তাকে কেন বলা হচ্ছে?”
“দুটোকে আজ চড় লাগাব। সন্ধ্যায় বের হতে নিষেধ করা হয়েছে না?”
অপরার রাগ হলো। নিজে প্রেম করছে। সেটাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আর ওরা সস কিনতে এসেছে, সেই জন্য বকুনি দেওয়া হচ্ছে। মগের মুল্লুক নাকি? ও কিছু বলার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ওমন সময়ই কণ্ঠটি ভেসে এল।
“এই ভরা সন্ধ্যায় এখানে কী করা হচ্ছে?”
বাবার কণ্ঠ। অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। সাথে চাচ্চু ও আছেন। মিষ্টির দোকান থেকে ফিরলেন সবে।
“অয়ন, ওদের চুল টেনে ধরেছিস কেন?”
“ভরা সন্ধ্যায় সস কিনতে বের হয়েছে।”
“সেকি রে, তোদের না বলেছি সন্ধ্যায় বের হবি না।”
বললেন ছোট চাচ্চু। কথা তরতর করে বলে ওঠল,”এখনো তো আজান দেয় নি বাবা।”
এই যে তার মেয়ে কথাকলি। বড়ো বেশি কথা বলে। নামটা একেবারে স্বার্থক। সেই সাথে পাড়া বেড়ানো, সাংবাদিকের দায়িত্ব পালনেও অনবদ্য। তিনি কন্যার দিকে চাইলেন। থমথমে মুখ।
“আজান দেয় নি তো কী হয়েছে? এক্ষুনি তো দিবে। সন্ধ্যার আগে পরে একদম ই বের হবি না। রাস্তা – ঘাট ভালো এখন?”
কথা চুপ। অপরা মাথায় হাত দিয়ে আছে। অয়ন ভাই আচ্ছা করে চুল টেনে দিয়েছে। মাথাটা এখনো কেমন ব্যথা করছে।
সবাই যখন বাড়ি পৌঁছাল। তখন আজান শেষ হয়ে গেছে। যে যার মতন নামাজ পড়তে গেল। অপরার শরীর ভালো না। সে এসে বসল সদর দরজার সিঁড়ি তে। ওঠানের এক পাশে কবুতরের ঘর রয়েছে। তারা ডেকে চলেছে। মৃদু শব্দে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। সন্ধ্যার আকাশ, ইষৎ লালচে হয়ে আছে। মৃদু মন্দ হাওয়া। সব মিলিয়ে অপরার চোখ লেগে গিয়েছিল। ওর ঘুম ভাঙল, মৃদু কণ্ঠের আওয়াজে।
“অপু, এখানে ঘুমিয়ে আছ কেন?”
কিয়ানের গলা। অপু চোখ মেলে চাইল। এখানে কখন ঘুমাল, কে জানে। তবে মাত্রই চারপাশ আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছে। মানে বেশিক্ষণ হয় নি। স্টিলের গেইট খুলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল অয়ন। সবে নামাজ শেষ করে এল। দুজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধাল,”কী হয়েছে?”
“অপু সিঁড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।”
“বলদের কাজ, বলদের মতই তো হবে।”
কথাটি বলেই মেয়েটি মাথায় ইষৎ গাট্টা দিল অয়ন। তারপর বলল,”দ্রুত চা বানিয়ে দিয়ে যা।”
অপরা তড়িঘড়ি করে বলল,”আমি কেন দিব?”
“কেন দিবি না?”
অপরা চুপ হয়ে গেল। ছোট থেকেই অয়নের বেশ অনেক কাজ করে দেয় সে। তাই বিষয়টি একদম স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরা চা বানাতে গেল। কিয়ান আর অয়ন দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল।
“সারাদিন কোথায় ছিলে আজ?”
প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পূর্বে কিয়ান দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,”কিছু দিন পর আর্ট এক্সিবিশন হবে। সেটার জন্যই বের হয়েছিলাম।”
কিয়ান পড়ে আছে তার আঁকাআঁকি নিয়ে। অয়ন বুঝতে পারে না, অনিশ্চয়তার পেছনে কেন ছুটছে মানুষটা। ও কিছু বলল না আর। ভেতরে চলে এল। বসার ঘরে বসল কিয়ান। আর অয়ন গেল নিজের ঘরে। তার মাথা ব্যথা করছে।
চা নিয়ে এসেছে অপরা। দরজায় দাঁড়িয়ে ঠকঠক করল।
“ভেতরে আয়।”
চা বাড়িয়ে দিল মেয়েটি। অয়ন নিল। চুমুক বসিয়ে চাইল। মুখটা শুকনো হয়ে আছে।
“প্যাঁচা মুখ করে আছিস কেন?”
“বলব না।”
“বাপ্রে, রাগ হয়েছে নাকি?”
“আপনি ওভাবে চুল কেন টেনে ধরলেন? আমার মাথা এখনো ব্যথা করছে।”
“তাই?”
অপরা চুপ। এই লোকটা এত বেশি আ’ঘা’ত করে তাকে। অয়ন চা রেখে ওঠে এল। আলতো হাতে মাথায় স্পর্শ করল।
“আমার মিষ্টি অপরা। ব্যথা চলে যাবে।”
অপরা চুপ। অয়ন হেসে বলল,”তোকে মা’রতে আমার ভালোই লাগে।”
“কেন লাগে?”
“কেন, জানিস না, ছেলে’রা বউ মা’রতে পছন্দ করে।”
অপরা অসহ্য নয়নে তাকাল। এদিকে অয়ন হেসে যায় যায় অবস্থা।
“চা ভালো হয়েছে রে।”
মেয়েটি কথা বলল না। অয়ন চা শেষ করে বলল,”শোন, কথাকলিকে ভালো মতন সাবধান করবি। কোনো কিছু যেন ফাঁস না হয়।”
অপরার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এল। ও বাঁকা হেসে বলল,”ও কি বলবে, বলব তো আমি। এক্ষুনি বড়ো বাবা কে বলব। সব বলে দিব।”
কথাটা বলতে বলতে বের হতে নিচ্ছিল অপরা। ওমনি অয়ন তার হাতটি ধরে ফেলল। চোখ,মুখ অন্ধকার।
“বললে, আমি দাদিজানের কাছে যাব। বলব অপরাকে আমি বিয়ে করব। তখন ভালো হবে। সারা জীবন আমার হাতে মা’র খেতে হবে।”
“আপনাকে আমি বিয়ে করব নাকি? আমি কী পাগল? আপনাকে তো পাগলে বিয়ে করবে।”
অয়ন ভ্রু কুঞ্চিত করে চাইল। তারপর বলল,”পাগলে বিয়ে করবে, মানে নীলা পাগল?”
“পাগল ই তো। তার চোখ নেই। চোখ থাকলে আপনার সাথে প্রেম করে?”
কথাটা শেষ করেই পালিয়ে গেল অপরা। অয়ন আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। ফর্সা ত্বকের সুন্দর এক পুরুষ সে। অথচ অপরা তাকে অবজ্ঞা করে গেল! বিষয়টা কেমন অপমান হয়ে গেল না?
দাদিজানের ঘরে এসেছে অপরা। তার পায়ের কাছটায় মাথা ঠেকিয়ে আছে মেয়েটি। আর দাদিজান মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
“অপু, কী হয়েছে তোর?”
“ভালো লাগছে না। অয়ন ভাই মে’রে’ছেন।”
“মে’রে’ছে?”
“হুম। বজ্জাত লোক। চুল টেনে ধরেছে। মাথা ব্যথা করছে।”
“খুব খারাপ করেছে তো। আমি এক্ষুনি ডেকে বকে দিচ্ছি।”
দাদিজান অয়নের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। বসার ঘরে কিয়ান ছিল। সে ওঠে এসে বলল,”কিছু হয়েছে দাদিজান?”
“অয়ন কে ডেকে আন তো।”
“ও তো কিছু সময় আগেই বের হলো।”
“আসলে বলবি আমার কাছে আসতে। আমার অপু’র চুল টেনে ধরেছে। এত বড়ো সাহস ছেলের!”
কিয়ান অপরার দিকে চাইল। সে মেঝেতে বসে আছে। মাথা ঠেকানো দাদিজানের কোলে।
“অপু’র কী হয়েছে?”
“মাথা ব্যথা করছে।”
“ঔষধ খাবে? এনে দিব?”
“না। লাগবে না।”
দাদিজান এবার বিরোধ করলেন। বললেন,”কীসের লাগবে না। লাগবে অবশ্যই। কিয়ান, দাদুভাই যাও তো ঔষধ এনে দাও।”
কিয়ান মাথা দুলিয়ে চলে গেল। সেই সুযোগে অপরা বলল,”অয়ন ভাইকে বলে দিবে, আমাকে যেন বউ বউ না বলে। আমি কী তার বউ হই?”
দাদিজান হাসলেন। তারপর চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,”তুমিই তো বলেছিলে, অয়নকে বিয়ে করবে।”
“তখন তো ছোট ছিলাম। নীলা আপু আমাকে বলেছিল, এটা বললে আমাকে খেলায় নিবে। তাই তো বলেছিলাম।”
“নীলা, ডাক্তারের মেয়ে?”
“হুম। সেই জন্য কী এখনো এমন করতে হবে? সব সময় আমাকে দিয়ে কাজ করান তিনি। আমি এত কাজ করতে পারব না।”
দাদিজান কিছু বললেন না। অপরার প্রতি স্নেহ রয়েছে অয়নের। ছোট থেকেই দুটিতে এক সাথে বেশি সময় কাটিয়েছে। অপরাকে দিয়ে কাজ করানোটা, অয়নের স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। ঠিক একইভাবে অয়নের কাজ গুলো করে দেওয়া অপরার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিয়ান ততক্ষণে ঔষধ নিয়ে ফিরল। ঔষধ হাতে নিয়ে ওঠে গেল অপরা। কিয়ান কে ডেকে নিলেন দাদিজান। পাশে বসিয়ে বললেন,”বিয়ে করো ভাই। নাতি বউ দেখব না?”
কিয়ান হেসে বলল,”অপরা তো আছেই দাদিজান। অয়নের বউ। আমার বউ আসতে অনেক দেরি।”
চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি