হৃদয়দহন পর্ব-০৯

0
58

#হৃদয়দহন (৯)

নতুন এক মিশনে নেমেছে অপরা আর কথা। মিশনের নাম ‘কিয়ান ভাইয়ের পেইন্টিং রহস্য’। অপরা ঐ যে ছবি খানার একাংশ দেখতে পেল, তারপর থেকে তার ঘুম নেই। এর পেছনে বড়ো একটি কারণ, পেইন্টিং এ যেই ব্যক্তিটি ছিলেন, তিনি নারী। এর থেকেও বড়ো বিষয়, পেইন্টিং এর নারীটি যে শাড়ি পরেছে, সেই রকম একটা শাড়ি অপরার ও রয়েছে। আঁচল খানা দেখতে পেয়েই হৃদয়টা কেমন করে ওঠেছিল। না, এই রহস্য উন্মোচন না করা অবধি শান্তি নেই। অপরা আর কথা এখন চুপিসারে কিয়ান ভাইয়ের কক্ষে প্রবেশ করবে। তার আগে দেখে নেওয়া জরুরি, মানুষ গুলো ঘুমোলো কী না। কিয়ান ভাইয়া অবশ্য বাসা নেই। তিনি আজ দোকানে রয়েছেন। কাল বড়ো একটা অর্ডার আছে। সেটির সমস্ত দায়িত্ব তার ঘাড়ে। আর এই সুযোগটাই অপরার হৃদয়কে মিশনে নামতে বাধ্য করেছে। আর তার সঙ্গী হয়েছে কথাকলি। মেয়েটা ঘুমুঘুমু চোখে ওঠলেও এখন তার ঘুম পালিয়ে গেছে। এ রকম মিশনে ভীষণ আগ্রহ তার। যখন শুনল, ভাইয়ার ঘরে মিশন, তখন তো কথাই নেই। ওর বরাবরই ভাইয়ার রুমটা ঘেটে দেখার বড়ো ইচ্ছে। তবে হয়ে ওঠে না। মানুষটা তো আর অয়ন ভাই নয়। মানুষটা যে বড়ো শীতল প্রকৃতির। যার মাঝে আহামরি কিছু নেই। একদম ই নিস্তেজ। কিন্তু অপুবু যখন বলল, ভাইয়া বিশেষ এক পেইন্টিং করেছে, তখনই ওর মস্তিষ্ক থেকে ঘুমের দল পালিয়েছে। এমন মুখরোচক খবরটা সে জানে না, এই বিষয়টা বড়ো অবাক করেছে! তবে শেষমেশ সে মেনে নিয়েছে, পৃথিবীর সবাই তো সব জানবে না তাই না। সেই জন্যই তো কিয়ান ভাইয়ের পেইন্টিং রহস্যের খবর অপুবু’র থেকে জানতে হলো। আহারে কথা। এই দিন এল তার জীবনে! যেখানে সকল ঘটনা সবার আগে তার কানে আসে, সেখানে নিজ ভাইয়ের গোপন রহস্যই কী না অপুবু’র থেকে শুনতে হলো! মেজাজ কিছুটা খারাপ ই হলো বটে। তবে বেশি ভাবার সুযোগ হলো না। তার পূর্বেই মাথায় ইষৎ আঘা’ত পড়ল। আর সেটি দিল, অপুবু।

“কী রে, কোন ধ্যানে তুই?”

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলল,”এটা ঠিক হলো অপুবু?”

“কোনটা? তোকে মা’রলাম তাই?”

“না।”

“তাহলে?”

“সব খবর সবার আগে আমার কানে পৌঁছায়। অথচ ভাইয়ার এই রহস্যের কথা এখন জানলাম আমি!’

অপরা বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়াল। কোমরের দু পাশে হাত রেখে একটু কাশল। যেন গলা পরিষ্কার করে নেবার প্রয়াস।

“অপুবু, তুমি জানলে কেমন করে?”

“আরে আমি দেখেছি। চা দিতে এসে দেখেছিলাম। তাকিয়েছি বিধায় ঘর থেকে বের করে দিল!”

“ইস! ভারী অন্যায় তো।”

অপরা আড় চোখে তাকাল। কথা তাকে ইমোশনাল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু না, সে ইমোশনাল হবে না। ঘর থেকে বের করে দেওয়া অস্বাভাবিক না। ওটা ওর নিজের ঘর নয়। ও ফোঁস করে দম ফেলল। তারপর বলল,”তুই নিজের ঘর গুলো দেখে আয়। সবাই ঘুমিয়েছে কী না। আমি অয়ন ভাইয়ের ঘরটা দেখে আসি।”

“আচ্ছা।”

কথা চলল নিচের তলার ঘর গুলো চেইক করতে। আর অপরা এল অয়নের ঘরের কাছে। ছেলেটা অসম্ভব বে’য়াদ’ব। রাত – ভোর প্রেম করে। ফোনে কথা বলা যেন শেষ হয় না। এক ঘন্টা আগেও দেখে গিয়েছে, নীলাপুর সাথে রোমান্স চলছে। আ’স্ত বে’য়াদ’ব!

স্বাভাবিক ভাবেই এ বাড়ির প্রায় সকলের রুমের দরজা গুলো ই ভিড়ানো থাকে। তবে পুরোপুরি লক নয়। সেই জন্য সবার ঘর চেইক করা সহজ হয়ে গেল। অপরা বুক ভরে দম নিয়ে অয়নের রুমের দরজাটা খুলল। সমস্ত রুম অন্ধকার। সে ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। অয়ন উঁবু হয়ে শুয়ে আছে। বালিশ একদম চেপে ধরে। যেন ওটা বালিশ নয়, বউ হয়! অপরার মাথায় এমন বাজে একটা চিন্তা এসে যাওয়াতে ও নাউজুবিল্লাহ পড়ল। আজকাল মাথায় সারাক্ষণ দুষ্টুমি চলে। নিজ ভাবনায় হেসে ফেলল ও। একটু নিচু হয়ে অয়নকে ভালো মতন দেখতে লাগল। আহারে, কী এক নিষ্পাপ মুখখানি। কিন্তু এই ব্যক্তি যে মোটেও নিষ্পাপ নয়। বরং ভারী দুষ্টু লোক। এই তো সেদিন নীলাপুকে ফোনের এপাশ থেকে চুমু দিচ্ছিল। আর সেই দৃশ্যটি অপরা দেখে, লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছিল। যাক, সেসব পুরনো কথা। অপরার কাজ শেষ। অয়ন ভাই মোটামুটি ঘুমিয়ে জল। ও রুম থেকে যাওয়ার পূর্বে আরেকবার অয়ন কে দেখে নিল। তারপর ভেংচি কেটে বলল,”বে’দ্দপ ছেলে।”

অয়নের মুখোমুখি এ কথা অপরা বলতে পারবে না। তবে কখনো সখনো ছেলেটাকে ভারী সব কথা শুনিয়ে দেয় ও। যখন মাথা গরম থাকে। রাগ হয়, তখন কত কিছু যে বলে ফেলে। একবার তো অয়নের গাল কামড়ে দিয়েছিল। সেটার দাগ ছিল প্রায় তিন বছর! ওসব যদিও ছোট বেলার কাহিনী, তবে ভাবতেই অপরার হাসি পায়। ও হাসতে হাসতে করিডোরে চলে এল। এদিকে কথাও সবার ঘর চেইক করে এসেছে। দাদিজান তো আগে ভাগেই ঘুমিয়ে পড়েন। আর বাকি’রা ও ঘুমিয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে ময়দান ফাঁকা। অপরা আর কথা মিশনের প্রথম ধাপ সফল হওয়াতে হাত মেলালো। তারপর এগিয়ে গেল কিয়ানের ঘরের দিকে। যেতে যেতে কথা বলল,”অপুবু।”

“বল।”

“যদি কিয়ান ভাইয়ের ঘরে ছবিটা না পাই। তুমি যেহেতু ছবিটা দেখেছিলে, তাই সন্দেহ করেছে নিশ্চিত। ঘরে তো না ও রাখতে পারে।”

“তাহলে চিলেকোঠার ঘরে যাব।”

“ওখানে!”

“হু, হু। সেদিন কিয়ান ভাইকে সেখানে দেখেছি।”

কথাটা বলেই কিয়ানের ঘরের দরজা খুলল অপরা। সঙ্গে সঙ্গে রংয়ের দারুণ সুবাস নাকে এসে ধরা দিল। মেয়েটির বুকের ভেতরটা রহস্যময় হয়ে গেল। ঠোঁটে এল হাসি। ও আর কথা ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। লাইট জ্বালাতেই ঘরের চারপাশে অনেক গুলো পেইন্টিং দেখা গেল। ক্যানভাসে, রং তুলির সাহায্যে দারুণ সব কাজ। অপরা এগুলোর মর্ম বুঝলেও, বাড়ির অনেকেই এসেবের মূল্য বুঝে না। এর কারণ, এ থেকে আহামরি টাকা আসে না। সবার মতে, কিয়ান অনেক ভালো কিছু করতে পারত, যদি না রং তুলির পেছনে সময় নষ্ট না করত। কত বিচিত্র কথা সবার। অথচ কিয়ান, নীরবে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।

“অপুবু।”

কথার ডাকে ঘোর ভাঙল অপরার। ও দ্রুত এদিকটায় এল। কথা একটা ক্যানভাস দেখিয়ে বলল,”এটা?”

অপরা ক্যানভাস হাতে তুলে নিল। এখানেও একটা মেয়ের ছবি। শাড়ি পরা। তবে এটা সেই পেইন্টিংটা নয়। এটা অর্ডারের কাজ, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অপরা হতাশার সুরে বলল,’না।’

ফের ঘাটাঘাটি শুরু হলো। সমস্ত পেইন্টিং ঘেটে দুজন একে অপরের দিক তাকাল। উহু নেই। তার মানে পেইন্টিংটা চিলেকোঠার ঘরে রাখা।

“কথা, চিলোকোঠার ঘরে চল।”

ওরা দ্রুত সব আগের জায়গায় রেখে চিলেকোঠার ঘরে ছুটল। ঘরটা বেশ নোংরা হয়ে আছে। সেই সাথে লাইটটাও কাজ করছে না। সম্ভবত অনেক দিন পূর্বেই নষ্ট হয়েছে। সাধারণত এ ঘরে কারো আসা যাওয়া হয় না। সেই জন্যই খেয়াল করা হয় নি। সিঁড়ির লাইট থেকে যতটুকু আলো আসছে, তাতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অপরা ফিসফিসিয়ে বলল,”ফোন নিয়ে আয়। এভাবে দেখতে পারব না।”

কথা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। সে ভীষণ উল্লাসিত এই কাজে। বেশ মজাও লাগছে। কেমন একটা উত্তেজনা শরীর জুড়ে। কথা যেতেই অপরা একটু খোঁজার চেষ্টা করল। তবে লাভ হচ্ছে না। আলোর তেমন বিচরণ নেই। আঁধারে ডুবা সমস্ত ঘর। অপরা হাতের ময়লা পরিষ্কার করে যেই না ঘুরবে ওমনি একটি শক্তপোক্ত হাত তাকে জাপটে ধরল। শুরুতেই বলল,”চোর, চোর, চোর। বাড়িতে চোর ঢুকেছে।”

তারপর যখন বুঝল, হাতের বাঁধনে যে আটকে আছে, সে ছেলে নয়, বরং মেয়ে, তখন চোর শব্দটি পরিবর্তন করে ডাকল,”চুন্নি, চুন্নি। চোর না, চুন্নি। বাড়িতে চুন্নি ঢুকেছে। তোমরা কোথায় আছ, বাড়িতে চুন্নি ঢুকেছে। বাবা, চাচ্চু, দ্রুত আসো। চোর ঢুকেছে!”

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি