হৃদয়দহন পর্ব-১১

0
140

#হৃদয়দহন (১১)

গাড়ি ভরাট করে মিষ্টির বাক্স ওঠানো হয়েছে। সমস্ত রাত জেগে এই মিষ্টি গুলো তৈরি করা। বিশাল অর্ডার। কিয়ান প্রথম বারের মতন এত বড়ো দায়িত্ব নিজে সামাল দিল। এখন পৌঁছে দেওয়ার পালা। বেশি দূরে নয়। কাছের ই পথ। ওদের দোকানের বেশ সুনাম থাকায়, বড়ো ছোট সমস্ত অনুষ্ঠানেই চোখ বন্ধ করে অর্ডার হয়। কিয়ানের বাবা একটু চিন্তিত। তার ছেলেকে একটুও ভরসা করেন না তিনি। তাই বড়ো ভাইকে বললেন,”ভাইজান, এভাবে রিস্ক হয়ে যায় না? কিয়ানের খবর তো জানেন। ছেলেটা আঁকা আঁকি ছাড়া আর কিছুই তো মন দিয়ে করে না।”

কথাটা কিঞ্চিৎ সত্য। তবু কিয়ানের ওপর ভরসা রাখা দরকার। হাজার হোক, পরিবারের বড়ো ছেলে সে। তাকে অবশ্যই দায়িত্ব নেওয়া শিখতে হবে। বড়ো কর্তা কিছু বল‍ার পূর্বেই কিয়ানের বাবা ফের বললেন,”আমি বল‍ছিলাম কি, সাথে অয়ন গেলে হয় না? ও গেলে ভরসা পেতাম।”

কথাটা শেষ হওয়ার পূর্বেই কক্ষে কিয়ানের আগমন ঘটেছে। তাই বাবার বলা কথা গুলো সে শুনেছে। একই সাথে লজ্জিত ও কষ্ট পেয়েছে বটে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বাবার নিকট, এতটা অযোগ্য হয়ে গেছে সে! বিষয়টা মোটেও, মধুর নয়। আহারে, সোনালী দিন গুলো কোথায় হারাল, সে তো দারুণ সব রেজাল্ট করত। সকলে কতটা ভরসা করত। অথচ, চাকরি না পেয়ে, আজ তার অবস্থান কোথায় এসে ঠেকেছে। লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে রাখল সে। বড়ো চাচা সেটি দেখলেন, বুঝলেন। ছোট ভাইয়ের কথায় তিনি সায় জানাতেন, যদি না কিয়ান কথা গুলো না শুনে ফেলত। তাই তিনি ঠিক করলেন, অয়নকে সাথে পাঠাবেন না। বর‍ং কিয়ানকেই ভরসা করবেন। তিনি এগিয়ে এসে কিয়ানের বাহুতে হাত রাখলেন।

“অর্ডার বিশাল, তবে আহারি কিছু না। পরিবারের বড়ো সন্তান তুমি, দায়িত্ব বেশি হলেও সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।”

কিয়ান মনে মনে চোখ ভিজিয়ে ফেলল। বড়ো চাচ্চু, এতটা ভরসা করে তাকে? ও জবাব দিল না। তবে কথাটা বললেন ওর ই বাবা।

“একটু বেশিই রিস্ক হয়ে যায় না ভাইজান? সাথে অয়নকে….’

কথাটা পুরো না করতে দিয়ে, বড়ো কর্তা বললেন,”আমি যা বলেছি, সেটাই হবে। কিয়ান পারবে। এটা অনেক কঠিন কিছু না। তাছাড়া অয়ন ভার্সিটি গিয়েছে।”

কথা ওখানেই থামল। কিয়ান মিষ্টির গাড়ি নিয়ে রওনা হলো। সেদিকে তাকিয়ে বাবার হৃদয়খানা কম্পন হলো। ইচ্ছে করেই কথা গুলো বলেছেন তিনি। ছেলের এমন দশা, দেখতে বড়ো কষ্ট হয়। তিনি চান না, কিয়ানের মতন নম্র, প্রতিভাবান ছেলেটা এভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলুক।

দুপুরের অসহ্য গরম। ক্লাসের পর পর ই দেখা করতে এসেছে অয়ন আর নীলা। একই পাড়া থাকা সত্ত্বেও রোজ দেখা হয় না তাদের। যদিও মাঝে মধ্যে নানান বাহানায় নীলাদের বাড়ির কাছে চলে আসে অয়ন। আর তাকে সায় জানাতে বাড়ি থেকে বের হতে হয় মেয়েটিকেও। দুজন এখন পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। সূর্যের তেজ একটু বেশি হলেও, একে অপরের সঙ্গ দুজনকেই আনন্দিত করছে। নীলার হাতে সেদিনের ব্রেসলেট। যা সব সময় পরে থাকে সে। ব্রেসলেটের দিকে তাকিয়ে সহসাই হেসে ফেলল ও। অয়ন শুধাল,”হাসছ কেন?”

“একটা ঘটনা মনে পড়ল।”

“কী ঘটনা।”

“ব্রেসলেটটা দেখে মা আমায় জেড়া করেছিল।”

“তারপর, কী বললে?”

“বললাম, বান্ধবী গিফট করেছে। কিন্তু মা এমন ভাবে তাকাল যে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম।”

“সত্যিটা বলে দিয়েছ?”

“আরে পাগল নাকি? সত্যি বললে আমাকে আস্ত রাখবে?”

“কেন রাখবে না? রাখতেই হবে। একটা সময় পর তো জানবেই।”

এ কথায় নীলা একটু মন খারাপ করল। তারপর অয়নের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”অয়ন, তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। সেই ছোট থেকে পছন্দ করি। হারাতে চাই না আমি।”

অয়ন জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল। এলাকায় নীলা’রা যখন এল, তখন বেশ একটা হিড়কি পড়ে গেল। সকলের মুখে মুখে নীলার প্রশংসা। সবাই বলল, আরে ডাক্তারের মেয়ে তো আগুন সুন্দরী। বড়ো হয়ে তো ছেলেপুলের মাথা নষ্ট করে দিবে। আর সেই আগুন সুন্দরীকে দেখার জন্য তিনদিন বড়ো গাছের ওপর ওঠতে হয়েছিল অয়নকে। অথচ সে দেখতে পায় নি। তারপর হুট করেই, একদিন খেলার সাথী হলো। সম বয়সী না হলেও বন্ধুত্বের সেই দিন গুলো দারুণ ছিল। তারপর আবার দূরত্ব, মাঝে তো মেয়েটিকে ভুলেই বসেছিল অয়ন। সময় তাদের আবার এক করেছে। শুধু বন্ধু নয়, ভালোবাসার মানুষ হিসেবে এক করেছে। অয়ন নিজেও অসম্ভব ভালোবাসে মেয়েটিকে। ওর হাতটা তখনো নীলার হাতে। ঘেমে অবস্থা খারাপ। ও হেসে বলল,”তুমি ভরসা দিলে, কিছুই হারাবে না।”

সে সময়েই অদূরে নুহাশকে দেখা গেল। দুদিন সে অসুস্থ ছিল। তাই পড়াতে আসে নি। অয়ন ডেকে ওঠল।

“নুহাশ।”

দুজন এগিয়ে এসে দূরত্ব কমিয়ে নিল। অয়ন শুধাল,”কী খবর তোমার? শরীর ঠিক হয়েছে?”

“হয়েছে ভাইয়া।”

“পড়াতে যাবে কবে?”

“আজ থেকেই যাব। যদি সমস্যা না হয়।”

“সমস্যা কীসের? চলে এসো। সন্ধ্যায় তো?”

“হুম।”

“তবে দেখা হচ্ছে।’

“একদম।”

কথা শেষ করে নুহাশ চলে এল। তার মন দুদিন বিক্ষিপ্ত ছিল। এর পেছনে বড়ো একটি কারণ অপরা। মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করেছে কী না।

কিয়ান সমস্ত কাজ শেষ করে ফিরছিল। পথে শুনতে পেল রুবিনা’র মায়ের গলা। মেয়েকে গালাগাল করছে সে। এত মাস ধরে চেষ্টা করেও মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। ফলস্বরূপ মেয়েটির ত্বকের রঙ নিয়েও খোঁটা দিয়ে বসলেন। অপরা বের হয়েছিল দোকানে যাওয়ার জন্য। সে সময়ই কথা গুলো শুনল সে। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। গলায় তেজ রেখে বলল,”চাচি কাজটা ঠিক করল না। এভাবে রুবিনাবুকে ত্বকের রঙ নিয়ে কথা শোনাল!”

কথাটা বলে তার নিজের ও মন খারাপ হয়ে গেল। কিয়ানের দিকে তাকাল। অয়ন, কিয়ান কিংবা কথা, তিনজনের ত্বকের রঙ ই ফর্সা। অথচ সে একটু শ্যাম রঙা। অবশ্য কখনো সখনো তাকে ও ফর্সা মনে হয়। কিন্তু এটা সত্য বাড়ির বাকি তিনজনের তুলনায় তার ত্বকের রঙ কম উজ্জ্বল। কিয়ান নরম গলায় বলল,”চলো বাসায় যাই।”

“রুবিনাবুকে কথা শোনাচ্ছে। ভালো লাগছে না।”

“তাদের নিজেদের বিষয়। আমরা কী করতে পারি?”

“তবু।”

“অপু, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ও লাভ নেই।”

অপরা মন খারাপ করে বাড়ির দিকে রওনা হলো। তবে যাওয়ার পূর্বে একবার রুবিনাদের বাড়ির দিকে তাকাল। মায়ের বকুনি খেয়ে তার চোখ দুটি ছলছল করছে। মেয়েটির জীবনে এত দুঃখ কেন এসেছে?

সমস্ত দিন অপরার মন খারাপ। কথা এসে বলল,”অপুবু, চলো। নুহাশ ভাইয়া পড়াতে এসেছে।”

অপরার ধ্যান নেই। কথা এবার ধাক্কাল। এতে নজর ফিরল তার।

“কী?”

“নুহাশ ভাইয়া পড়াতে এসেছেন।”

“ভাই কেন বলছিস? স্যার বলবি।”

“ওমা, অয়ন ভাইয়ার জুনিয়র তো। আর স্যার ডাকতে ভালো লাগে না।”

অপরা কথা না বলে বই পত্র নিয়ে এগিয়ে গেল। ঘরে প্রবেশের পূর্বে বড়ো করে সালাম দিল। সেই সাথে, সালামের শেষে লাগাল “স্যার” শব্দটি। নুহাশ লজ্জা পেল যেন। তারপর বলল,”অপু, আমাকে স্যার ডেকো না।”

অপরা জানে, স্যার শব্দটি নুহাশকে লজ্জায় ফেলে। তাই সে একটু হেসে বলল,”কেন স্যার?”

ফের স্যার! নুহাশ নড়েচড়ে বসল। মেয়েটি ভীষণ দুষ্টু। এত সহজে মানবে না।

অপরা পেন্সিল কামড়াচ্ছিল। হুট করেই মাথায় একটা থা’প্প’ড় পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। ও চোখ মুখ অন্ধকার করে ফেলল। অয়ন যেন পাত্তাই দিল না। সে নুহাশ কে বলল,”পড়ানো শেষ?”

“অলমোস্ট।”

“তাহলে চলো, চা খাওয়া যাক।”

নুহাশ সায় জানাল। তারপর অপরা আর কথাকে কালকের জন্য পড়া দিয়ে দিল। অপরা অবশ্য তাকাচ্ছে না। সে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে আছে অয়নের দিকে। অয়ন এসেই তাকে থা’প্প’ড় দিয়েছে। অথচ লোকটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি