হৃদয়দহন পর্ব-১৭

0
58

#হৃদয়দহন (১৭)

এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা দর্শনে অপরা”র পা দুটো থমকে গেল। সে এসেছিল লেবু নিতে। মাঝে এমন দর্শনে একটু পিছিয়ে গেল সে। কিয়ানের বাহুডোরে আটকে আছে এক যুবতী। আর সেই যুবতীটি স্বয়ং রুবিনাবু! অপরা এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করে নি, বাগান থেকে সরে এসেছে। এসেই সরাসরি চলে গিয়েছে কিয়ানের ঘরে। একের পর এক ক্যানভাস উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে সে। সব গুলো ক্যানভাস দেখার পর ও সেই ছবিটা খুঁজে পেল না। অতঃপর ক্লান্ত হয়ে বসল মেঝেতে। মাথাটা তখনো খালি খালি লাগছে। দৃশ্যটি বাস্তব? অপরা জানে না। ওর শুধু ভেতরটা কেমন করছে। ছবির জায়গায় সে কি নিজেকে ভেবে বসেছিল? এমনটা ভাবা কি উচিত? সে কি কিয়ান ভাইকে পছন্দ করে? সহসাই মেয়েটি উত্তর খুঁজে পায় না। ভাবতে পারে না কিছু। যখন মেঝে থেকে ওঠে যাবে তখনই চোখ যায় খাটের নিচটায়, সেখানে কিছু একটা রয়েছে। অপরা’র মন বলে ছবিটা এখানেই লুকিয়েছে কিয়ান ভাই। হলো ও তাই। অপরা যখন ছবি খানা টেনে বের করল, তখন ইষৎ ধুলো ও জমা হয়েছে। হাতের তালুতে সেই ধুলো মুছে নিয়ে ছবিখানা দেখল অপরা। একই শাড়ি, একই সাজ। শুধু মুখটা ভিন্ন। অপরা’র খেয়াল হলো। গত বছর পাড়ার ই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে একই রকম সেজেছিল তারা। স্মরণ করে কিছুটা মৌনতা অনুভব করল অপরা। তার চিত্তের বেদনা কিছুটা বাড়তে লাগল। অনুভব হলো, হৃদয়ের দহন। তবে কি অপ্রত্যাশিত ভাবে, কিয়ানের প্রতি মন গলেছিল তার? অপরা বুঝতে পারছে না। তার মন কোনো যুতসই উত্তর পাচ্ছে না। সারাটা জীবন অয়নের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। অথচ শান্ত, নম্র কিয়ান ভাইয়ের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধা অনুভব করত। শ্রদ্ধা ডিঙিয়ে, হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম হতে পারে কী? এবার ও উত্তর আসে না। অপরা কিছুটা দ্বিধায় ভুগে। ছবি খানা আগের জায়গায় রেখে কক্ষ প্রস্থান করে। আনমনা সে সহসাই কারো স্পর্শ পায়। সেই সাথে, ফিসফিস আওয়াজ।

“অপুবু, এই অপুবু। কোথায় মন তোমার?”

অপু ঘুরে তাকায়। দেখতে পায় কথা দাঁড়িয়ে। তার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস।

“কী?”

“খবর আছে।”

“শুনতে ইচ্ছে করছে না।”

এই প্রথম কথা অবাক হলো। তার অপুবু তো এমন কেউ নয়। তবে,আজ কী হলো তার?

স্বীয় কক্ষে এসে আরেক দফায় চিন্তায় পড়ল অপরা। এই বাড়িতে ও যখন আসে, তখন বয়স তিন-চার মাস হবে। বাবা-মায়ের প্রণয়ের বিয়ে ছিল। দু বাড়ির কেউ ই মেনে নেন নি। দীর্ঘ‍দিন কষ্ট করে থেকেছেন। সন্তান হওয়ার পর মাথায় আরো দায়িত্ব বেড়েছিল। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন স্টুডেন্ট। কারোই গ্রাজুয়েশন শেষ হয় নি। শেষে বাবা অনেক কষ্ট করে প্রাইমেরি স্কুলে চাকরি জোগাড় করলেন। মা ও চেয়েছিলেন চাকরি করতে। তবে বাবা সেটায় সায় দেন নি। দিবেন ই বা কেমন করে? ছোট্ট অপরা কে দেখবে কে? এই পাড়ায় অয়নদের বাড়ির পাশেই ভাড়া বাড়িতে অপরাদের ছোট্ট সংসার চলতে থাকে। একটা সময় পর মায়ের ও চাকরি জুটে। অয়নদের বাড়িতে। অভাগা দুটো ছেলে-মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসতেন দাদিজান। তিনিই মূলত মায়ের চাকরিটা দেন। অয়ন আর কিয়ানকে পড়াতে হবে। এই পড়ানোর সুবাদে, দারুণ এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের। ছোট্ট অপরা ছোট থেকেই যাকে সবথেকে বেশি পছন্দ করত,সে হলো অয়ন। আর কিয়ান তো বরাবর ই শান্ত। তার সাথে সেভাবে ভাব ছিল না অবশ্য। অপরা দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলে। ভয়াবহ সেই দিনটার কথা স্মরণ ঘটে। সে রাতে ওদের ঘরে আগুন লেগে গিয়েছিল। অয়ন তখন,নিজেদের গাছ থেকেই ডাব চুরিতে ব্যস্ত। আগুন দেখে ছুটে আসে সে। বাবার শরীর খারাপ ছিল। বিছানা থেকে ওঠতে পারছিলেন না। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মা অপরাকে অয়নের হাতে তুলে তো দেন, তবে নিজেরা বের হতে পারেন না। পাড়ার বাকিরা আগুন নেভানোর চেষ্টা তো করেন, তবে লাভ হয় না। ছোট্ট ঘর ও মানুষ দুটো মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। সেই করুণ স্মৃতি অপরা আজ ও ভুলতে পারে না। তার শুধুই দুঃখ হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়,সেই আগুনে সে ও যদি ম’রে যেত। খুব ক্ষতি হতো কী? হতো না। উল্টো পৃথিবী থেকে অক্সিজেন শুষে নেওয়ার একজন মানুষ কমে যেত।

“অপু, লেবু গুলো এনেছিস?”

ছোট গিন্নি কক্ষে প্রবেশ করতে করতে কথাটি বললেন। তিনি ঘেমে নেমে একাকার। আঁচল খানা দিয়ে গলা,মুখের ঘাম মুছতে মুছতে মেঝেতে বসলেন। অপরা ও মেঝেতেই বসা ছিল।

“কী রে? তোর শরীর খারাপ নাকি?”

কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন ছোট গিন্নি। অপরা কেঁপে ওঠল।

“না, শরীর খারাপ কেন হতে যাবে।”

“আচ্ছা, লেবু গুলো কোথায় রেখেছিস?”

“ইস, আমি না একদম ভুলে গেছি।”

বলতে বলতে ওঠতে চাইল অপরা। ছোট গিন্নি ফোঁস করে দম ফেললেন।

“থাক, দরকার নেই। রুবিনাকেই ছিঁড়ে নিতে বলছি।”

অপু কথা বলল না। মেঝেতেই বসে পড়ল। ছোট গিন্নি ওঠতে ওঠতে বললেন,”বুঝলি, এতদিনে একটা কাজ হলো।”

“কী?”

“রুবিনা’র বিয়ে ঠিক হয়েছে। কদিন আগে দেখে গেল না? তারা পছন্দ করেছে। আসবে আজ, পাঁকা কথা বলতে। সেই জন্যই তো তাজা লেবু নিতে এসেছে।”

“সত্যিই বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

“ওমা, আমি মিথ্যে বলব কেন?”

“আমি ওঠি ছোট মা।”

অপু ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে পা থমকে গেল কিয়ান ভাইয়ের কক্ষের দিকে। তারপর চাইল বসার ঘরে। রুবিনা বসে আছে। চোখ মুখ অন্ধকার।

কিয়ান তখনো শান্ত দৃষ্টিতে মেঝেতে চেয়ে রইল। সহসাই অপরা কক্ষটিতে প্রবেশ করল। সেই শব্দে দাঁড়িয়ে গেল কিয়ান।

“অপু।”

পেছন ঘুরে বলল। অপরা এগিয়ে আসছে। কিয়ান ঠোঁটের হাসি দীঘল করল।

“কী ব্যাপার? মন খারাপ নাকি?”

একদম বরাবর হয়ে চাইল অপরা। কিয়ানের সাথে এভাবে দর্শন হয় নি তার। কিয়ান যেন কিছুটা ভরকাল। শুধাল,”কী?”

“একটা সত্যি কথা বলবেন?”

“সত্যি কথা? কী হয়েছে তোমার? এমন শুকনো কেন মুখ?”

কথা বলতে বলতে অপরা”র মাথায় স্নেহের হাতটা ঠেকাল কিয়ান। অপরা চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই স্পর্শ তার নিকট ভীষণ শ্রদ্ধার ঠেকল। ও কিছু বলতে পারল না। যেমন করে ঘরে প্রবেশ করেছিল, তেমনভাবেই চলে গেল। আর সেদিকে তাকিয়ে রইল কিয়ান।

কথা বলল,”তোমার সাথে কথা বলব না অপুবু।”

“কেন রে?”

“তুমি আমাকে পাত্তা দাও নি।”

“সেই নিয়ে রাগ হয়েছে? ঘুষ দিলে চলবে?”

“উহু। চলবে না।”

“এত রাগ?”

“হুম। অনেক রাগ।”

অপরা মৌন হয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই কথা বলল,”রাগ ভেঙেছে। এখন জবাব দিব।”

অপরা হেসে ফেলল। কথা এবার সোজা হয়ে বলল,”শোনো একটা গোপন নিউজ পেয়েছি।”

“গোপন নিউজ?”

“হুম।”

“বল তাহলে।”

“বলছি তো। আগে দেখতে দাও।”

কথা চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। কেউ নেই। এই সুযোগে বলা যাবে।

“বড়ো চাচ্চু আর অয়ন ভাইয়া কথা বলছিল।”

“কোন ব্যাপারে?”

“নীলাপুর বিষয়ে।”

“কী, কী বলছিল?”

“সবটা তো শুনি নি। তবে অয়ন ভাই বলছিল, তার আর নীলাপু’র সম্পর্ক রয়েছে।”

অপরা ঠোঁট কামড়ে ধরল। এই ছেলেটা ভীষণ দূরন্ত। ঠিক ই নিজের সম্পর্কের কথা চালান করেছে বাবার কানে। কথা সহসাই অপরার বাহু চেপে ধরল,”পু ড় ল।”

“কী?”

“তোমার কপাল।”

“মা’র’ব একটা চ’ড়। আমার কপাল কেন পু ড় বে?”

“বাহ রে, ছোট থেকে অয়ন ভাই তোমায় বউ বউ করল। আর এখন নীলাপুকে বিয়ে করবে!”

অপরা ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল। বয়ে গেছে, ঐ দুষ্টু ছেলের বউ হওয়ার। এ জন্মে অয়নের সাথে তার কিছু হওয়া সম্ভব নয়। বড়োজোর তারা দুজন মা’রামা’রি করতে পারবে। সেটাও অবশ্য ভুল। সে তো মা’রতে পারে না। বরং অয়ন ভাই শুঢ় শুধু মে’রে যান! আর বোকা অপরা কেঁদে যায়। সেই ছোট বেলার মতনই।

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি