হৃদয়দহন পর্ব-২৭

0
58

#হৃদয়দহন (২৭)

একদিনের ট্যুর শেষ করার পর ছয়টা দিন গত হয়েছে। অপরা গত দুদিন ধরে জেসমিনের সাথে রেস্তোরাঁয় জয়েন করেছে। মেয়েটা’র প্রায়শই এখানে আসা হতো। তাই সব কিছু চেনা। খুব কম সময়েই নিজের কাজটুকু বুঝে নিয়েছে সে। রাত তখন এগারোটা প্রায়। রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হবে। অপরা সব কিছু হিসাব করে নিচ্ছে। জেসমিন নিজের ব্যাগ খানা তুলে নিয়ে তাগাদা দিল।

“অনেকটা রাত হলো। চলো অপরা। লেট হয়ে গিয়েছে।”

“আর একটু।”

বলে অপরা প্রায় দশ মিনিট সময় নিল। সবটা শেষ করে তারপরই এল সে। ততক্ষণে এক কাপ কফি খেয়ে নিয়েছে জেসমিন। ওরা রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে চলতে শুরু করেছে। শীত বাড়তি। অপরা উলের জ্যাকেট পরলেও বেশ অনেকটা কাঁপছে। তাই দু হাত ঘঁষে শরীরে তাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে।

“অপরা।”

“হ্যাঁ?”

“তুমি কি খেয়াল করেছ, আমরা এক সাথে ছয়টা বছর কাটিয়ে ফেললাম।”

এ কথায় জবাব না দিয়ে অপরা মৌন রইল। জেসমিন ই বলল,”সব কিছু সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়।”

“তোমাকে এ জন্মে কৃতজ্ঞতা দেওয়ার মতন সাধ্য আমার নেই। সত্যিই তুমি আমাকে অন্য ভাবে গড়ে তুললে।”

এ কথায় জেসমিন ফোঁস করে দম ফেলল। বলল,”ঠিক সেটা না। তবে, সত্যি বলতে এখানে তুমি অনেকটাই একা। একাকিত্ব’কে সঙ্গে নিয়ে, বাঁচা মুশকিল।”

“তুমি ঠিক কি বোঝালে, আমি বুঝতে পারছি না।”

“তেমন কিছুই না। চলো আরেকটু সামনে যাই।”

ওরা মৌন হয়ে চলতে লাগল। কিছুটা দূরে এসে গাড়ি পেল। ওঠে বসল দুজনেই। তারপর আরো নীরবতা। চারপাশ শুনশান। কেবল দু একটা গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে।

পরেরদিন সকাল’টা শুরু হলো ফোনের রিংটোনে। অপরা ঘুমু ঘুমু অবস্থাতেই কল রিসিভ করল।
“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে জবাব নেই। অপরা এবার চোখ মেলে চাইল। দুচোখে এখনো ঘুম।

“হ্যালো, কে বলছেন?”

“অপুবু, আমি কথা।”

কয়েক সেকেন্ড থম ধরে রইল অপরা। তারপর ওঠে বসল। দ্রুত ঘুমের ভাব সরিয়ে নিয়ে বলল,”কথা, কেমন আছিস রে? কত গুলো বছর….’

বলেই থেমে গেল অপরা। হ্যাঁ, প্রায় ছয় বছর হতে চলল, এই মানুষ গুলোর সাথে যোগাযোগ নেই। তবে এমন না, এই মানুষ গুলো’কে ভুলে বসেছে সে।

“অপুবু, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

অপরা’র ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে গেল। কতদিন, মাস পর কেউ একজন জিঙ্গেস করল সে কেমন আছে।

“ঠিক ঠাক। বাসার সবাই কেমন আছে? দাদিজান…ঠিক আছেন?”

এ কথা সত্য অপরা দেশ, পরিবার ছেড়ে এসেছে প্রায় ছয় বছর। তবে নির্দিষ্ট মানুষের কাছ থেকে দাদিজানের খোঁজ খবর পায় সে। মাঝে মাঝে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। তবে হয়ে ওঠে না। কিংবা চাইলেই পারে না।

“অপুবু….’

অপরা’র ঘোর ভাঙে। কথা মিনমিনে সুরে বলে,”দাদিজান ঠিক ই আছেন। তবে….’

বলে থামে কথা। অপরা’র কেমন একটা অনুভূতি হয়। হয় অনুসূচনা।

“সব ঠিক আছে কথা?”

“হ্যাঁ। ঠিক আছে সব। দাদিজান তোমাকে দেখতে চায় অপুবু। এই ছয় বছরে প্রথম বার এমন বায়না করছে। খুব করে চায়, তোমাকে দেখতে।”

এ কথায় অপরা’র বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠল। চোখ ভিজে ওঠল নোনা জলে।

“একটু দেওয়া যাবে? কথা বলতাম।”

দু হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে অপরা বলে। ওপাশ থেকে কথার জবাব।

“দাদিজান বলেছেন, চোখে না দেখে কথা বলবেন না।”

এটা শোনার পর অপরা’র ভেতরটা কান্নায় মিশে যায়। ও কাঁদতে পারে না শব্দ করে। তবে চোখ থেকে জল ঠিক ই গড়ায়।

“অপুবু, তুমি আসবে তো?”

অপরা কী জবাব দিবে জানে না। এই ছয় বছরে জাপান থেকে এক পা ও নড়ে নি সে। হুট করে বাংলাদেশে ‍যাওয়া’র কথা শুনে, ভেতরটা কেমন করছে। ও মৌনতা ধরে রাখে। এদিকে কথা পুনরায় শুধায়,”কী হলো? কিছু বল‍ো….?”

টুপ করে এক বিন্দু জল গড়ায় চোখ থেকে। অপরা ভাঙা গলায় বলে,”আমি চেষ্টা করব।”

তারপর দুজনেই কল রেখে দেয়। অপরা বসে পড়ে বেডের ওপর। দাদিজানের কথা স্মরণ করে ওর ভেতরটা মোচড় দিতে শুরু করেছে। এই ছয় বছরে, প্রতিটা দিন দাদিজানের জন্য প্রার্থনা করেছে অপরা। প্রার্থনা করেছে মানুষটা যেন বেঁচে থাকে। অপরা’র দুনিয়া’য় দাদিজানের ওপর আর কেউ কী আছে? নেই তো। এই মানুষ’টার কথাতেই তো দেশ ছাড়ল সে। অতীতে’র সেই দিন গুলো, অপরা’র ভেতরে এক টুকরো হাহাকার এনে দেয়।

অপরা’র আজ অফ ডে ছিল। তবে বাসায় থেকে ভালো লাগছে না। জেসমিন আগে ভাগেই রেস্তোরাঁয় চলে গিয়েছে। ও নিজের জন্য খাবার বানালো তো ঠিকই, তবে সে খাবার খেতে পারল না। ভেতরটা কেমন হু হু করছে। ও খাবারে বিরতি দিল। তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে বের হলো। বাসা থেকে বের হতেই ওদের প্রতিবেশি এক বৃদ্ধা ডেকে ওঠলেন।
“অপরা, তুমি কোথায় যাও?”

বৃদ্ধা বাগানের গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছিলেন। অপরা দাঁড়িয়ে গেল। বৃদ্ধা আসতেই জাপানিজ নিয়মে শ্রদ্ধা জানাল।

“তোমার তো আজ কাজ নেই। জেসমিন তো সেটাই বলেছিল।”

“আসলে, বাসায় ভালো লাগছিল না। তাই রেস্তোরাঁয় যাচ্ছি।”

“শোনো, তোমাদের বয়সটা ভালো লাগার। অথচ তুমি আর জেসমিন দুজনেই বলো ভালো লাগছে না। দুজন’কেই বলি সঙ্গী খুঁজে নাও। অথচ তোমরা নির্বিকার।”

এ কথা বলে বৃদ্ধা ছোট করে নিশ্বাস ফেললেন। ওরা এই এলাকায় আছে চার বছর হতে চলল। জেসমিন প্রথম দু বছরের টাকা জমিয়ে এই বাড়িটা করেছে। সেই থেকেই বৃদ্ধার সাথে ওদের পরিচয়। দারুণ ভালো মানুষ।

অপরা বৃদ্ধার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল। যাওয়ার পথে আরো একবার দাদিজানের কথা মনে পড়ল ওর। মনে পড়ল ঐ বাড়িটার কথা। যেখানে অপরা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় গুলো কাটিয়েছে।

জেসমিন এক প্রকার লুকিয়ে ছিল। তোমো নামের ছেলেটা অতিরিক্ত কথা বলে। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, এই ছেলেটা তার নিয়মিত কাস্টোমার না হলেও পারত। দরজা দিয়ে অপরা’কে প্রবেশ করতে দেখে, লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে এল জেসমিন। এসেই আলিঙ্গন করল।

“তুমি ঠিক আছো অপরা?”

“ঠিক আছি।”

“তোমার ছুটি ছিল আজ।”

“ভালো লাগছিল না বিধায় এলাম।”

“রেস্ট না নিলে, অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

“চিন্তা কোরো না। আমি সামলাতে পারব।”

এ কথা বলেই এগিয়ে গেল অপরা। তার কাজ হিসাব গুলো দেখা। কতক্ষণ এটা সেটা হিসাব করল ও। তবু ভেতরটা ভালো লাগছে না। কিছু সময় পর জেসমিন এল। পাশে দাঁড়াল।

“তোমার মন খারাপ, তাই না?”

অপরা জবাব দিতে গিয়েও পারল না। জেসমিন ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলল,”মন খারাপ হলে, শেয়ার করো। ভালো লাগবে।”

যদিও কিছুটা দ্বিধা কাজ করছে, তবু অপরা বলল,”কথা আজ কল করেছিল। দাদিজান আমাকে দেখতে চেয়েছেন।”

জেসমিন একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল,”তুমি কি বললে?”

“আমি পুরো আশা দিতে পারি নি।”

জেসমিন দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর অপরার দু বাহু টেনে ধরে বলল,”ঘুরে এসো। ভালো লাগবে।”

“তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

এ কথা বলেই কেঁদে ফেলল অপরা। জেসমিন’কে জড়িয়ে ধরে। জেসমিনের চোখ টাও কেমন ঘোলা হয়ে এসেছে। অপরা’র পিঠে হাত ঠেকিয়ে ও বলে,”এভাবে কাঁদছো, যেন জাপানে আর ফিরবে না। এমনটা হলে, আমি কিন্তু কষ্ট পাব অপরা। কান্নাকাটি মানায় না তোমায়। তুমি তো সাহসী মেয়ে।”

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি