#হৃদয়দহন (৩১)
অপরা বাংলাদেশে এসেছে ছয় দিন হতে চলল। এই ছয়দিনে প্রতিটা মানুষ’কে একটু একটু করে উপলব্ধি করেছে সে। ধীরে ধীরে সবার সাথে মিশে গিয়েছে। তবে ছয় বছরের দূরত্ব ছয় দিনে কি শেষ হয়? হয় না তো। সবার সাথে মিশে গেলেও অয়নের সাথে ঠিক ঠাক মিশতে পারে নি। মানুষ’টার জন্য অপরা’র মায়া হয়। ভীষণ ভায়া। তবে যখন ওপাশের ব্যক্তিটি নীরব থাকতে চায়, তখন আর কিছু বলার থাকে না। কথা’কে নিয়ে ছাদে বসে ছিল ও। হঠাৎ একটা গর্জনে ঘোর ভাঙল। কথা চট করেই ওঠে দাঁড়াল।
“বৃষ্টি আসবে।”
অপরা আকাশের দিকে চায়। আকাশ আরো একবার গর্জে ওঠে। অপরার হেলদোল না দেখে কথা বলে,”কি হলো। ভিজবে নাকি?”
ভেজার কথা শুনে সত্যিই ভিজতে ইচ্ছে করল অপরা’র। ও বলল,”ভিজি একটু। তুই যা। আমি আসছি।”
“বেশি ভিজো না কিন্তু।”
যেতে যেতে বলল কথা। তবে অপরা জবাব দিল না। ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ ক্ষণে ক্ষণে গর্জে ওঠে। অপরা বসে থাকে। বসে ভাবে জীবন নিয়ে। জেসমিন সেদিন বলেছিল, জাপানে সে ভালো থাকলেও কোথাও একটা একাকিত্ব রয়ে গেছে। এই একাকিত্বের ঔষধ বোধহয় এই পরিবার’কে ঘিরে। তবে কথায় আছে মাত্রার অতিরিক্ত ঔষধ পান করলে তা বি ষ রূপে ধরা হয়। এই পরিবারের ভালোবাসাটা অপরা’র কাছে ঔষধের অনুরূপ ই লাগে। ও চোখ বন্ধ করে। তার পর ভাবতে থাকে এই বাড়ির মানুষ গুলোর কথা। এই মানুষ গুলো’কে চাইলেও ভুলতে পারবে না সে। অনেকটা নেশার মতন শরীরে মিশে গিয়েছে।
বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার অপরা। শরীরে পোশাক লেপ্টে আছে। ইষৎ ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে। এর ই মধ্যে কয়েকবার হাঁচি দিল। ঠাণ্ডাটা লেগেই গিয়েছে। অপরা নাক টানতে টানতে ছাদ থেকে নামছিল। ওমন সময় অয়ন’কে দেখা গেল। অয়ন সিঁড়ি দিয়ে ওঠে বাবা-মায়ের কক্ষের পথে অগ্রসর হয়। অপরা কিয়ৎকাল চেয়ে থেকে নিজের কক্ষের দিকে প্রস্থান করে।
অয়ন কক্ষে প্রবেশ করতেই মায়ের গলাটা শোনা গেল। তিনি স্বামী’কে বলছেন।
“অপু’কে নিয়ে ভাবলে?”
বড়ো কর্তা কেমন ক্লান্ত ভাবে বললেন,”স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি না?”
“তা কেন হবে? ও তো আমাদের ই মেয়ে। অয়নের সাথে…..’
মাঝে আটকে গেলেন তিনি। কারণ অয়ন এসেছে। ওকে দেখে দুজনেই নড়েচড়ে বসলেন।
“কী ব্যাপার? কখন ফিরেছ?”
“মাত্রই। বলতে এসেছিলাম, মিষ্টির দোকান’টা আবার চালু করতে চাই। দায়িত্ব আমার।”
বলা বাহুল্য ব্যবসায় ধসের পর মিষ্টির ব্যবসাটা আর করা হয়ে ওঠেনি। সবাই কেমন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। হঠাৎ কথাটা ওঠায় বড়ো কর্তাকে দ্বিধান্বিত দেখাল।
“ঠিক আছে। কোরো না হয়।”
জবাব পেয়ে বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিল অয়ন। ওমন সময় আবার ডাক পড়ল। ফলে দরজার কাছ থেকে ফিরে আসতে হলো তাকে।
“বোসো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব।”
অয়ন বসল। তবে নিজ থেকে প্রশ্ন করল না। বড়ো কর্তা স্ত্রী’র পানে তাকালেন। তিনি সায় দিতেই ছেলের দিকে নজর ঘোরালেন।
“অপু’কে নিয়ে তোমার কোনো ভাবনা আছে?”
অয়নের মাঝে বেশ পরিপক্কতা এসেছে। ও বুঝতে পারছিল। তবু না বোঝার মতন করে বলল,”কোন বিষয়ে?”
“যে কোনো বিষয়ে।”
অয়ন’কে মৌন থাকতে দেখা গেল। এবার বড়ো গিন্নি এগিয়ে এলেন। ছেলের বাহু স্পর্শ করে বললেন,”বয়স হচ্ছে তো বাবা।”
“এখানে আমি কি করতে পারি মা? বয়স তো ধরে রাখার জিনিস না।”
“সেটাই তো। বয়স ধরে রাখার বিষয় না। নিজের জীবন’কে সুযোগ দিতে হবে না?”
অয়ন নিজ থেকে শব্দ গুলো উচ্চারণ করতে চাচ্ছে না। তাই শক্ত ভাবে বলল,”সরাসরি বলো। এভাবে শুনতে ভালো লাগছে না।”
এবার বড়ো কর্তা বললেন,”তোমার মা বলতে চাচ্ছে, বিয়ে নিয়ে আগাও। কম তো হলো না।”
অয়ন চুপ। একটা শব্দ ও বলল না। বড়ো গিন্নি ফের ছেলের বাহুতে স্পর্শ করলেন।
“একটা কথা ভেবেছিস? অপু, অনেক গুলো বছর তোর ওপর নির্ভর করে ছিল। তুই ওকে শাসনে রাখতি। আদরে রাখতি। ও পুরোটাই কিন্তু তুই নির্ভর ছিল। আমাদের আগে ওর কথা তুই চিন্তা করতি।”
এই পর্যায়ে থামলেন তিনি। অয়ন তখনো নির্বিকার।
“আমি বলতে চাচ্ছি, জীবনে যা হবার তো হয়েছেই। তুই কি অপু’কে নিয়ে ভাবতে পারিস না?”
এবার অয়ন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। চেহারার রং ও বেশ অনেকটা বদলে গেছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ভেতরটা এখনো ভালো নেই।
“দাদিজান ঠিক ই বলেন। আমরা সত্যিই স্বার্থপর। কোন মুখে অপরা’র কাছে যাবে তোমরা? আমি কি ওর যোগ্য?”
এবার পুরো ঘরটা নীরবতায় ছেয়ে গেল। থমথমে পরিবেশে অয়নের ভাঙা, দুঃখে মেশা কণ্ঠটা।
“শেষ দিকে, অপরার সাথে আমার ভীষণ দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আমি জানি ছোট থেকেই তোমরা চাইতে ওর সাথে আমার বিয়ে হোক। তবে আমি ওভাবে পাত্তা দেই নি। আমার কাছে ও ছিল আদরের। যে আমার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব ডিঙিয়ে আমি ভালোবাসার কথা চিন্তা ও করি নি। যদি করতাম, তাহলে আজকের ঘটনা ভিন্ন হতে। মাঝে আমার জীবনে একজন ছিল। আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ অপরা’র জানা ছিল। ও লক্ষ্য করত। ভালো চাইত। এখন আমি ভাঙাচোরা হয়ে গেছি। অপরা কিন্তু নিজেকে গড়ে নিয়েছে। স্বার্থপরের মতন ওর হাত চাইতে পারব না। ও ভালো থাকুক। আমি ওর যোগ্য না মা।”
এ কথা বলেই অয়ন বেরিয়ে যায়। বের হতে গিয়ে চোখ যায় অপরা’র কক্ষে। মেয়েটা টানা কয়েকবার হাঁচি দিল। টিসু দিয়ে নাক মুছে নিচ্ছে। তার মানে বেশ ভালোই রোগ বাঁধিয়েছে।
অনেকটা রাতে কথা ঔষধ নিয়ে অপরা’র কক্ষে প্রবেশ করে। এদিকে অপরা টিসু নিয়ে তখনো নাক মুছে চলেছে। ফলে তার নাকের অগ্রভাব লালচে হয়ে আছে।
“অবস্থা দেখি খুব খারাপ।”
“বেশি ভিজি নি। তাও ঠাণ্ডাটা লেগে গেল। এই শীত শুরুর মৌসুমে বৃষ্টি দেখে লোভ সামলাতে পারি নি।”
“বোধহয় এটাই ছিল বছরের শেষ বৃষ্টি।”
“হতে পারে।”
অপরা ফের নাক টানতে লাগল। কথা ঔষধ গুলো টেবিলে রেখে বলল,”তোমাকে খেতে বলেছে।”
নাক টানতে টানতে অপরা বলে,”কে?”
“অয়ন ভাইয়া।”
অপরা জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। তারপর কয়েক সেকেন্ড সময় যায়। কথা বলে,”খেয়ে নিও। আমি যাই।”
অপু সম্মতি জানাতেই কথা চলে যায়। এদিকে অপরা নাক টানতে টানতে টেবিল থেকে ঔষধ গুলো তুলে নেয়। সত্যিই এটার খুব দরকার ছিল।
পরের দুটো দিন, অপরা কক্ষ থেকেই বের হয় নি। তার খাবার ও কক্ষে দিয়ে গিয়েছে। ঔষধ খাওয়া হয়েছে বিধায় দুদিনেই ঠাণ্ডাটা কমে গেল। অপরা সুস্থ হয়ে সবার আগে দাদিজানের কক্ষে এসেছে। দাদিজান বসে আছেন। তাসবিহ পাঠ করছেন। অপরা গিয়ে বসল মেঝেতে। কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,”দুদিন তোমাকে দেখতে আসতে পারি নি।”
“আমিও তো যেতে পারি নি। শরীর ভালো হয়েছে?”
“হয়েছে। এখন একদম ফিট।”
“তাহলে তো ঘুরে আসতে পারিস।”
“কোথায় ঘুরব?”
“কোথাও যা। এত বছর পর এসেছিস। আশেপাশে ঘুরে আয়।”
অপরা একটু ভাবল। তারপর বলল,”যাব না হয়। কথার সাথে কথা বলতে হবে। তার আগে তুমি বলো, শরীর এখন কেমন আছে?”
দাদিজান একটু হাসলেন। অপরা’র মাথায় হাত রেখে বললেন,”আছি ভালোই। তবে মনে হচ্ছে তোর জন্য একটা শক্ত হাত যদি জোগাড় করে দিতে পারতাম।”
অপরা কথার মানে বুঝে। ও দাদিজানের হাত খানা মুঠোয় নিয়ে বলে,”এসব ভাবছো কেন?”
“ভাবতে হবে না? বড়ো হয়েছিস তো? তোর কি কোথাও পছন্দ আছে?”
“না তো। এসব নিয়ে এখনো ভাবি নি।”
এ কথা বলে পুনরায় দাদিজানের কোলে মাথা এলিয়ে দিল অপরা। দাদিজান ও যত্নের সাথে অপরা’র মাথায় হাত রাখল।
পরেরদিন দুপুর বেলায়। অপরা বসে বসে সিরিজ দেখছিল। কথা এসে হাজির। অপরা’র হাতে চিপস ছিল। এগিয়ে দিল। সেখান থেকে দুটো চিপস তুলল কথা। মুখে দিয়ে বলল,”অপুবু, ঘুরতে যাব। দাদিজান বলেছে, তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে।”
“যাবি? কোথায় যাওয়া যায় বল তো।”
কথা একটু ভেবে বলল,”ফুল গ্রামে যাবে?”
ফুল গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে অপরা একটু হতাশ হলো। বলল,”অনেকটা দূর।”
“তাতে কি? আমরা তো অয়ন ভাইয়ার সাথে যাব।”
এ কথায় যারপরনাই অবাক হলো অপরা। মুখটা হা হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড।
“সে যাবে?”
“বলেছে যাবে।”
মনে মনে খুশিই হলো অপরা। অয়ন ভাই’কে স্বাভাবিক দেখলে তার ও ভালো লাগত। ওরা তখুনি তৈরি হয়ে গেল। অয়ন আগে থেকেই বসে ছিল। অপরা এসে বলল,”আমি পেছনে বসি।”
কথা বলল,”তুমি সামনে বোসো।”
“না তুই সামনে বোস।”
“না তুমি।”
“উহু তুই।”
“তুমি।”
ওদের দুজনের কথা চলতেই লাগল। এবার অয়ন মুখ খুলল। বলল,”একজন আসলেই তো হয়।”
এই ফাঁকে কথা টুপ করে পেছনে বসে পড়ল। মেকি হাসি দিয়ে বলল,”সামনে বোসো।”
অপরা উপায় না পেয়ে সামনে গিয়ে বসল। মুখে বলল,”তুই সেই দুষ্টুটিই রয়ে গিয়েছিস।”
তারপর প্রায় অনেকটা সময় ধরে গল্প চলল অপরা আর কথার। তবে কথা বের হলো না অয়নের মুখ থেকে। এক পর্যায়ে বিষয়টি খেয়াল করল অপরা। একটু কেশে বলল,”এবার আমি বেশ খুশি।”
“কেন?”
শুধাল কথা। অপরা নজর ফেরাল অয়নের দিকে। মুখে বলল,”আগে তো যখন তখন আমার চুল টেনে দিত। এখন আর সেসব সহ্য করতে হচ্ছে না।”
এ কথা স্পষ্ট শুনল অয়ন। ওর ঠোঁটটা কেমন প্রসারিত হয়ে গেল। এতে অপরা’র ভালো লাগল। এতদিনে প্রথমবারের মতন মানুষটার মুখে হাসি দেখল ও।
গোলাপ গ্রামে ঢুকেছে কথা আর অপরা। অয়ন বাইরেই দাঁড়িয়ে। ওর নাকি যেতে ইচ্ছে করছে না। আঁধা ঘন্টার মাথায় গোলাপ গ্রামের ভেতর থেকে ফিরে এল অপরা। তার কানের পিঠে একটা গোলাপ লাগানো। ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। অয়ন দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,”কথা এলো না?”
“ও নাকি অনেক গুলো গোলাপ নিবে।”
“তুমি নিবে না?”
“নিলাম তো। এই যে একটা।”
কানের পিঠ থেকে গোলাপ খানা খুলে আনল ও। জবাবে অয়ন বলল,”কানের পিঠেই তো সুন্দর লাগছিল।”
এই ছোট্ট কথাটাই অপরা’র হৃদয়ে এক টুকরো মিষ্টি বাতাসের মতন লাগল। ও পুনরায় গোলাপ খানা কানের পিঠে গুজে দিল। তারপর চাইল অয়নের দিকে। ভাবতে লাগল, সেই অতীতের দিন গুলোর কথা। যেই দিন গুলো’তে অপরা একটু একটু করে বুঝেছিল, আসলে ও কিয়ান কে নয়, বরং অয়নকে ভালোবাসে। অথচ মানুষটা তখন অন্য কারো নামে দলিল হয়েছিল। আর অপরা’র হৃদয়ে দহন চলছিল। অথচ কেউ সেটি জানতেও পারল না।
অপরা’র কেমন কান্না পাচ্ছে। কান্না লুকাতে ও আড়াল হয়ে যায়। কথা আসতেই ওরা গোলাপ গ্রাম থেকে ফিরে আসে। পুরো রাস্তায় একবার ও অয়নের দিকে দৃষ্টি ফেরায় নি ও।অয়ন ও তাকায় নি। অপরা তাকায় নি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। আর অয়ন তাকায় নি অপরাধবোধ থেকে।
এই ঘটনার পর আরো তিনটে দিন পেরিয়ে গিয়েছে। অপরা নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছে ভালো থাকার। তবে কোথাও একটা কষ্টের দল হানা দিয়েছে। ওর মনে হয়েছে, এ থেকে নিস্তার দরকার। তাই তো আরো দু সপ্তাহ থাকার কথা থাকলেও, আজ ই চলে যাচ্ছে। বাড়ির সবার সাথে দেখা করেছে। সবাই আগের মতই ভালোবাসা দিয়েছে। আর বরাবরের মতনই কথা ছিল পাশে। মেয়েটা তো একবার কেঁদেই ফেলল। ওর বাহু টেনে ধরে অপরা তখন বলল,”এভাবে কাঁদলে আর আসব না।”
“অপুবু, এভাবে চলে যাচ্ছ, আমার কষ্ট লাগছে।”
“কাজ পড়ে গিয়েছে রে। জানিস তো, রেস্তোরাঁয় জয়েন করেছিলাম। আমার জন্য একজন ওয়ার্কার ও কম নেওয়া হয়েছিল। এখন আর উপায় নেই রে।”
কথা নিজের আবেগ লুকাতে ব্যর্থ হলো। তাই তো দু হাতে অপু’কে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটার এমন ভালোবাসায় চোখ থেকে এক বিন্দু অশ্রু গড়াল অপরা’র ও। ও কথাকে রেখে দাদিজানের কাছে এল। তিনি হেলান দিয়ে আছেন। না চাইতেও অপরার চোখ থেকে জল নেমে এল। দাদিজান হাতের সাহায্যে কাছে ডাকলেন। অপরা মাথা নামিয়ে রেখে বলল,”অনেকটা মায়া নিয়ে ফিরতে যাচ্ছি। তুমি বলেছিলে সমস্ত মায়া যেন কাটিয়ে ওঠি। তবে পারি নি। সেদিন ও পারি নি। আজ ও পারছি না।”
বলতে বলতে অপরা ডুকরে ওঠল। দাদিজানের ভেতরটা হু হু করে ওঠছে। শেষ দিকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই পাগলি মেয়েটার মনে অয়নের জন্য অনুভূতি আছে। অথচ কখনোই সেটির প্রকাশ করতে চায় নি।সবার ভালোর কথা ভেবে, নিজের অনুভূতিকে আড়াল করে রেখেছে। এবার ও তার ব্যতিক্রম নয়।
দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ হতেই অয়নকে ডেকে পাঠালেন দাদিজান। একটু বাদেই অপরা রওনা হবে। রওনা হবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে সোজা জাপানে। তারপর কবে আসবে তার কোনো ঠিক নেই। এদিকে কত বছর হয় দাদিজানের চোখের দিকে তাকায় না অয়ন। ওর লজ্জা হয়। লজ্জা হয় কারণ, নিজ দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করেছিল সে। সেটা বুঝেও দাদিজান এতদিন চুপ ছিলেন। তবে আজ বললেন,”কাছে এসে বোসো দাদুভাই।”
অয়ন কাছে তো বসল। তবে ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠল। দাদিজান নাতির মাথায় হাত রাখলেন। স্নেহের সাথে বললেন,”কত বড়ো হয়ে গেলে তোমরা। আমার ও সময় শেষ। হয়তো আর বেশি দিন নেই।”
যেন ছোট্ট একটা বুলেট এসে লাগে অয়নের বুকে। হারানোর ভয়ে দাদিজানের হাত খানা স্পর্শ করে।
“এমনটা বলতে নেই।”
“সময় সত্যিই শেষ। হয়তো আর কিছু দিন।”
অয়ন মাথা নত করে থাকে। দাদিজান নাতির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,”পারলে অপুর কাছে যাও। তাকে আটকাও।”
অয়ন একটু দ্বিধার মধ্যে পড়ে। দাদিজান পুনরায় বলেন,”এখনই সময়। হয়তো এবারের পর আর কখনো সুযোগ পাবে না। যদি তোমার হৃদয়ে কিঞ্চিৎ ভালোবাসাও থাকে, তবু অপুকে আটকাও। কে বলতে পারে, হয়তো সে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে।”
শেষ বাক্যে অয়নের হৃদয় কেঁপে ওঠে। ও ছটফটে নয়নে তাকায়। অপরা তার জন্য অপেক্ষায় আছে? এ কথা কি সত্যি হতে পারে। এক আকাশ সম দ্বিধা নিয়ে দাদিজানের কক্ষ থেকে বের হয় ও। অপরা তখন ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়েছে। অয়নের হৃদয়ে দ্বিধার দল তখনো হানা দিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, এই দ্বিধা কাটিয়ে অয়ন কি আটকাবে অপরাকে? নাকি ছয় বছর পূর্বের মতন এবার ও হৃদয়ের দহন নিয়ে দূরে সরে যাবে অপরা।
~সমাপ্ত~