তুলির সংসার পর্ব-০৬

0
80

#তুলির_সংসার
পর্ব-৬

তুলি কি আসলেই জহিরকে ভুলতে পেরেছে।শুভ্রকে ওর ভাল লাগে, অনেক ভাল লাগে কিন্তু ভালবাসা..? সেটা কি এত সহজে একজনকে ভুলে অন্যজনকে বাসা যায়..?
বহুদিন ধরে একটু একটু করে তুলির পুরো সত্ত্বা জুড়ে যে প্রেম দানা বেঁধেছে, আজ তাকে পায়নি বলে এক নিমিষেই সে প্রেম মিটে যাবে..! হারিয়ে যাবে বুকের মধ্যে লালিত তুলির এতোদিনের স্বপ্ন, কল্পনায় সাজানো ওর ভালবাসার প্রাসাদ।

নিজের উপর ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হলো। কি ভেবে বিয়ে করেছিলো ও সাধা সিধে ছেলে এই শুভ্রকে। ও কি তাহলে ওর মার মতোই লোভে পরেছিলো। বড়লোকের বউ হওয়ার লোভ। আজ শুভ্রর বউ হয়ে ওর ঘরে বসে নিজের পুরোনো প্রেমিকের কথাই ভেবে চলেছে।

শুভ্রর বাবাতো ঠিকই বলেছিলেন, আসলেই তো ও মজে আছে পর পুরুষের প্রেমে। শুভ্র ভীরু বলে মেনে নিয়েছে তা নয় শুভ্র উদার, সাহসী, কলুষতাহীন মনের অধিকারী তাই মেনে নিয়েছে।

তোয়ার কথাতে ওরা দুজনই বিব্রত হয়েছে।
শুভ্র বোকা নয় ও ঠিকই জানে তোয়া মিথ্যা বলেছে।
কিন্তু তুলি ওকে ভালবাসে কথাটা হাজার মিথ্যা অর্থহীন হলেও শুধু শব্দ গুলোতেই শুভ্রর চোখের যে অভিব্যাপ্তি আর খুশির ঝিলিক দেখেছে তুলি, ও কিছুতেই তা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেনা।

শুভ্র মুখে বলেনা কিন্তু ওর শান্ত ধীর স্বভাবে, তুলির ব্যর্থ প্রেমের কথা শোনার ধৈর্য্যে, ওর মিটিমিটি ভুবন ভোলানো হাসিতে, ভালবাসার উপস্থিতি উপলব্ধি করে তুলি।
তোয়া ভুল বলেনি। তুলি বুঝতে শুরু করেছে। যখন বিয়েটা হয়েছিলো। তুলিকে শুভ্রর ভালো লেগেছিলো। কিন্তু আজ বিয়ের বেশ কিছুদিন পর শুভ্র তুলিকে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু কেনো..? ওতো প্রথম থেকেই সব জানে। ও জানে তুলি কোনো দিনও ওকে ওর ভালবাসার বদলে কিছুই দিতে পারবেনা।

হঠাৎ খুব অসহায় মনে হতে লাগলো তুলির।এ কোন ঘেরাটোপে আটকে গেলো ও।
কিন্তু শুভ্রকে কোনো মিথ্যা আশ্বাসও দিতে চায়না তুলি

তোয়াদের বিদায় দিয়ে ঘরে এসে এসবই সাত পাঁচ ভাবছিলো তুলি। শুভ্র ওয়াশরুমে, ঘরে আসলে কি বলবে। এই প্রথম শুভ্রর মুখোমুখি হতে ভীষন লজ্জা লাগছিলো।

তুলি ঠিক করলো যতই কঠিন হোক সত্যি কথাই বলবে। শুভ্রকে পছন্দ করলেও ভালবাসতে ও জীবনেও পারবেনা। আর তোয়ার মিথ্যা কথার জন্যে মাফ ও চেয়ে নিবে।

আপনি এখোনো ঘুমান নি

শুভ্র

হুম

তোয়া

মিথ্যা বলছিলো আমি জানি

শুভ্রর মুখটা দেখে তুলির খুব… খুব মায়া হলো

পাশ ফেরে শুয়ে পরলো শুভ্র

তুলির ঘুম আসছে না।

অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো শেষে আর থাকতে না পেরে উঠে গেলো।ছাদে গিয়ে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অনেক অনেক ক্ষুদ্র মনে হলো।ছাদের দোলনাটা বাতাসে দুলছে।বিয়ের পর প্রথম যেদিন ছাদে এসেছিলো এতো সুন্দর ছাদ দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে এই দোলনায় এসে বসেছিলো তুলি।
আপনার বুঝি দোলনা পছন্দ।
শুভ্রর প্রশ্নে মাথা ঝাকিয়ে বলেছিলো, ‘খুব পছন্দ’
সেই থেকে তুলি দোলনায় বসলেই ওকে পেছন থেকে অল্প অল্প করে দোল দিয়ে দিতো শুভ্র…
দোলনায় দোল খেতে খেতে ছাদের কোণায় শুভ্রর হাতে লাগানো হাসনাহেনা ফুলের মাতাল করা গন্ধে মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো তুলির। হঠাৎ মনে হলো শুভ্রর বলা কথা, ‘জীবনটাকে কঠিন করে রাখলেই কঠিন… সহজে গ্রহন করতে পারলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়।’

ভোরের ঝিরিঝির ঠান্ডা বাতাসে শরীরে কাপুনি দিতেই একরকম দৌড়ে নিচে নেমে গেলো তুলি। বিছানায় উঠে দুজনের মাঝখানে রাখা পাশ বালিশটা সরিয়ে শুভ্রর বুকে মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজলো।

ততক্ষনে পুবাকাশে সূর্য্য মশাই গায়ে গাঢ় লাল রংয়ের চাদর জড়িয়ে নব দিবস সূচনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দিবসটা তুলি আর শুভ্রর জন্যেও নতুন আর গুরুত্বপূর্ণ ও বটে কারণ আজ থেকেই আক্ষরিক অর্থে তুলির সংসারের সূচনা হলো।

#
পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো তুলির। উঠে দেখে শুভ্র অফিসে চলে গিয়েছে। ভোর বেলার কথা মনে হয়ে লজ্জা পেয়ে গেলো। ছিঃ শুভ্র ঘুম থেকে উঠে কি ভেবেছে কে জানে।

সারাটা দিন শুধু একটা কথাই মনে খচ খচ করতে থাকলো তুলির।

শুভ্র অফিস থেকে ফেরার পরও পারতপক্ষে ওর সামনে গেলোনা।

শুভ্রকে ছাদে চা দিয়েই চলে যাচ্ছিলো। শুভ্র থামালো
কি ব্যাপার কখন থেকে দেখছি আপনি আমাকে এড়িয়ে চলছেন।

কই নাতো…

বাসায় অনেক কাজ সেজন্য আর কি
আপনি চা খান আমি আসছি

শুনুন আমি কিছুই মনে করিনি

তুলির লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো।

আমি…
তুলি ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেনো…

এই প্রথম দেখলাম আপনাকে মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে তোতলাতে, এমনিতেতো অবলীলায় সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারেন

আপনার কেনো মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা কথা বলছি

যেভাবে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছেন
শুভ্র হো হো করে হেসে উঠলো।

শুভ্রর হাসিতে তুলির গা জলে যাচ্ছে

ধপ করে ছাদের বেতের চেয়ারটায় বসে পরলো তুলি

ও ধরা পরে গেছে আর ঠিক ছোটবেলার মতন, যখন অপরাধ করে ধরা পরলে ওর নিজের কৈফিয়তে কিছু বলতে পারতোনা শুধু টপ টপ করে চোখের পানি ফেলতো ঠিক সেরকম করেই চোখের পানি ঝরতে লাগলো।

শুভ্র অস্থির হয়ে গেলো তুলির চোখের পানি দেখে। আপনি কাঁদছেন কেনো। আমার হাসিতে কষ্ট পেয়েছেন..?
আই এম সরি…
আমি বুঝতে পারিনি…
আমি কি আপনার পর..? আপনার কেনো মনে হচ্ছে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমালে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে বা লজ্জা পেতে হবে…

অন্জলি দেয়ার মতো তুলির মুখটা তুলে ধরলো শুভ্র।পরম যত্নে ওর চোখের পানি মুছে দিলো।

আজ অফিসে মজার একটা কান্ড ঘটেছে…
আমার পি এস মালতি আর আমাদের জুনিয়র একাউন্টেন্ট সাদেক দুজনেই স্বামী স্ত্রী কিন্তু আমার রুমে এসে চুপি চুপি দেখা করে এক সাথে লান্চ ও করে।

স্বামী স্ত্রী হলে চুপি চুপি দেখা করবে কেনো..?

কোম্পানীর রুলস একই অফিসে হাসবেন্ড ওয়াইফ চাকরি করতে পারবেনা।

তাহলে ওরা কি করে চাকরি করে

ওরা আগে স্বামী স্ত্রী ছিলোনা,
মালতি আমার আগে বাবারও পিএস ছিলো, সাদেক কিছুদিন আগে জয়েন করে। বয়সে মালতি সাদেকের থেকে বড় হবে। ওদের প্রেম হওয়াটা আমি চোখের সামনেই দেখলাম। তাইতো ওদের এক সাথে লান্চ করার জন্যে আমি আমার কেবিনটা ছেড়ে দেই।তার বদলে মালতির হাতের দারুন সব খাবারও খেতে পারি।

মজার ব্যাপার হলো বাবার বিশ্বস্ত কর্মচারী মতিন চাচা কিছুদিন আগে মালতিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ওনার আবার অফিসে অনেক ইনফর্মার ও আছে তাদের মধ্যেই কেউ বলে দিয়েছে লান্চের ব্যাপারটা। আজ দুপুরে হঠাৎ মতিন চাচা এসে হাজির জরুরি তলব তখুনি আমার সাথে দেখা করবেন। আমিতো ওদের কেবিনে বসিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। মালতি আমাকে ফোন দেয় স্যার এখন কি করবো উনিতো দরজায় দাড়িয়ে আছেন, আমি বললাম সাদেককে কোথাও লুকিয়ে ফেলো আমি আসছি। মালতি সাদেককে কাবার্ডে লুকিয়ে ফেলে। মতিন চাচা তো আসার পর আর যাওয়ার নামই নেয় না। টেবিল ভরা খাবার ছড়ানো পাশাপাশি দুটো প্লেটে খাবার বাড়া। উনি একবার আমাকে দেখছেন আরেকবার মালতিকে ওনার মনে হয় সন্দেহ হচ্ছে মালতি আর আমি প্রেম করছি। ওদিকে কাবর্ডের ভেতর থেকে সাদেক কু কু শব্দ করছে। মালতি কাঁদো কাঁদো হয়ে ফিস ফিস করে বললো স্যার দম না বন্ধ হয়ে যায়।

শেষে কি হলো..?

সাদেকই শ্বাস নিতে না পেরে লাফ দিয়ে কাবার্ড থেকে বেরোলো।

মতিন চাচার চোখ ছানা বড়া

শেষ পর্যন্ত ঘটনা হলো নিজের বউয়ের সাথে চুপি চুপি লান্চ করার দায়ে বেচারা সাদেকের চাকরি চলে গেলো

এটা মজার ঘটনা হলো আপনিতো আমার মনটা আরো খারাপ করে দিলেন।

সমস্যা নেই আমি বাবাকে বলে সাদেককে আবার রি এপয়েন্ট করে নিবো

কতদিন ধরে ওদের জন্যে আপনি নিজের কেবিনে বসে লান্চ করেন না।

প্রায় ছমাস

আপনি যে অকাতরে মানুষের উপকার করেন মানুষ তার প্রতিদান দেয়?

আমি প্রতিদান আশাই করি না।
কারো জন্যে কিছু করার সময় প্রতিদানের আশা না করলে যে মনের আনন্দে পাওয়া যায় তা অন্য কিছুতে নেই

……… বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো,
সারাদিন পৃথিবীকে আলোকিত করে ক্লান্ত সূর্য্যটা এই ডুবি ডুবি করছে। রাতের অন্ধকার আসার আগে শেষ বারের মতো গোধূলির বিদায় রংয়ে ছেয়ে গেছে পৃথিবী।

একেই কি বলে কনে দেখা আলো..?
সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে অদ্ভুত সুন্দর যে আলো এসে ভরিয়ে তোলে পৃথিবী। কেনো যুগ যুগ ধরে সে আলোতেই কনে দেখার রীতি প্রচলিত আছে আজ প্রথমবার উপলব্ধি করলো শুভ্র।

তুলি সুন্দরী কিন্তু ওর মায়াবী মুখখানি, তীক্ষ্ন চাহনি আর টোল পরা হাসির মিষ্টি মেয়েটাকে ছাপিয়ে কোথায় যেনো এক পরিপূর্ন যুবতী লুকিয়ে ছিলো। গোধূলীর এই কনে দেখা আলোতে তুলির সৌন্দর্য্যের অন্য এক রুপ দেখলো শুভ্র।

এ যেনো ভোরের আলোর আশায় মুখ লুকিয়ে থাকা পুষ্প কলি প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে অধীর আগ্রহে।
এ যেনো ঝর্নার সে লাজুক ধারা হাজার পথ পারি দিয়ে অনন্ত কাল ধরে ছুটে চলেছে সাগরের সাথে মিলিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
এ যেনো দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা মেঘ হঠাৎ বজ্রপাতে চূর্ণ বিচূর্ণ শীলা হয়ে ঝরে পরছে ধরনীর বুকে।

শুভ্র গুনগুন করে আবৃত্তি করতে লাগলো ওর প্রিয় কবিতা

কিছু বলছেন…

কথা নয় কবিতা…
কখনো ভাবিনি শখ করে যে কবিতা আবৃত্তি করতাম… আমার জীবনেও ঠিক তেমন কেউ আসবে।
তুলি আপনি ঠিক আমার প্রিয় কবিতার মতন

কার কবিতা

বায়রনের

একটু জোড়ে আবৃত্তি করেন আমিও শুনি

এতোক্ষনে সূর্য্য ডুবে গিয়ে চারিদিকে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে,

শুভ্র উঠে ছাদের কোনাটায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে আবৃত্তি করতে লাগলো,

“She walks in beauty like the night
Of cloudless climes and starry skies,
And all that’s best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes,
Thus mellowed to that tender light
Which heaven to gaudy day denies.”

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে তুলি

শুভ্রের ভরাট গলার আবৃত্তি ওর পিপাসার্ত হৃদয়কে ব্যাকুল করে তুললো।

শুভ্রর কাছে গেলো তুলি। একটু আড়ষ্টতা, একটু ভয় আর একটু লজ্জা নিয়ে।
কিন্তু ওর সমস্ত শরীরের প্রতিটা অনু পরমানুর মাঝে শুভ্রকে পাবার আকাঙ্ক্ষার কাছে, পরাজিত হলো ওর সব আড়ষ্টতা সব ভয় আর লজ্জা।

ঘুরে তুলিকে এতো কাছে দেখে সাহস পেলো শুভ্র। বুকে টেনে নিলো ওকে। সেকি তুলির বাঁধ ভাঙ্গা কান্না। আমি আপনার সাথে অনেক অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। এতো দিন হলো বিয়ে হয়েছে তবু আপনাকে কাছে আসতে দেইনি। অন্য লোকের কথা বলে গিয়েছি শুধু। নিজের কথাই চিন্তা করেছি একবার ভাবিনি আপনার কতো কষ্ট হতে পারে। আমাকে ক্ষমা করে দেন।

ভালবাসা কোনো অপরাধ নয় তুলি যে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে।

হঠাৎ তুলিকে এতো কাছে পেয়ে ওর চুলের গন্ধে, ওর উষ্ন দেহের ছোয়ায় শুভ্রর সমস্ত রক্তবিন্দুতে যেনো বিস্ফোরন হলো। পাগলের মতো চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো তুলিকে।
শুষে নিলো ওর সব কান্না, লজ্জা আর ভয়।

চলবে…