#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
[৩]
” দাদু অবেলায় এসব কি শুরু করলে তুমি? বন্ধ করো প্লিজ। ”
বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে ইফানা। হাতে জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র বইটি। মনোযোগের সহিত বইয়ে মগ্ন সে। শ্যাম মুখশ্রীতে গাম্ভীর্যের ছাপ। পড়ার সময় একটুও অমনোযোগীতা সহ্য নয় তার। পড়ছিল মেয়েটি। মাঝেমধ্যে বিছানায় রাখা খাতায় কিছু নোট করে নিচ্ছিল। খচখচ করে চলছিল কলম। ঠিক তখনই পড়ায় সর্বোচ্চ ব্যঘাত সৃষ্টি হলো। বসার ঘরে উঁচু আওয়াজে চলছে টেলিভিশন। দাদু দেখছেন। বিদেশীদের রেসলিং খেলা দেখছেন। অতিরিক্ত উত্তেজনায় একটু পরপর হৈ হৈ করে উঠছিলেন উনি। আর টিভির শব্দ এত বেশি দেয়া যে মা’রপিটের শব্দে কানে তব্দা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। ইফানা তো অবাক! এত জোরে শব্দ দিয়ে কে টিভি দেখে ভাই? পুরো কলোনীর লোকেদের ডিস্টার্ব হচ্ছে বুঝি।
” দাদু! দাদু! টিভির ভলিউম কমাও। ”
উঁচু কণ্ঠে ডেকে উঠলো ইফানা। ওপাশ হতে সাড়া মিললো না দাদুর। সে তো রেসলিংয়ে মত্ত।
” ও দাদু! কমাও না ভলিউম। ”
এবারো সাড়া নেই। অগত্যা বই রেখে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো মেয়েটা। এত অতিরিক্ত শব্দে পুরো বাড়ি যেন কাঁপছে। এখন তো আবার ডাবল এক্সপ্লোশন চলছে। আপাদমস্তক দুলছে, কাঁপছে ইফানার ছিপছিপে গড়নের শরীর। কোনোমতে দেয়াল ধরে হাতড়ে হাতড়ে বসার ঘর অবধি পৌঁছালো সে। দাদু মোতালেব সাহেব সোফায় বসে অদৃশ্য রেসলিংয়ে মগ্ন যেন। সোফাতেই বিপক্ষ দলের সঙ্গে মা`রামারি শুরু করে দিয়েছেন। ইফানা ঈষৎ অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,
” দাদু অবেলায় এসব কি শুরু করলে তুমি? বন্ধ করো প্লিজ। ”
” হা? ”
এতক্ষণে হুঁশ ফিরলো বুড়োর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর দিকে। ইফানা চোখমুখ কুঁচকে ফেললো,
” ভলিউম কমাও তো দাদু। তোমার শব্দের চোটে পুরো বাড়ি কাঁপছে। এই ভেঙে পড়লো বুঝি। ”
মোতালেব সাহেব একথায় পাত্তা না দিয়ে খেলা দেখতে দেখতে বললেন,
” আমি কিছুই করিনি। যা করছে ওই বাড়ির বুড়ো করছে। বাড়ি ভাঙলে দোষ ওর। সোজা কেস ঠুকে দেবো। ”
ও মা! বলতে না বলতেই ওই বাড়ির টিভির ভলিউম আরো বৃদ্ধি পেল। পুরনো দিনের জনপ্রিয় সঙ্গীতায়োজন চলছে টিভিতে। সেসবই শুনছে প্রতিবেশী কাম এনিমি অলিউল সাহেব। একদিকে রেসলিং আরেকদিকে সিংঙিং ( Singing )। তালে তালে তা তা থৈথৈ করে নাচছে দুই বাড়ি। আশপাশের গাছপালা, মাঠ ঘাট-ও যেন যুক্ত হয়েছে এই ধুম ধারাক্কা নৃত্যে। ইফানা শক্ত করে দুই হাতে চেপে ধরলো দুই কান। চিৎকার করে উঠলো উচ্চ কলতানে,
” আঃ…. ”
সে ক্ষণেই ওই বাড়ির শয়ন নামের ছেলেটা সে-ও চেঁচিয়ে উঠলো নিজের দাদুর ওপর,
” ভলিউমটা কমাবে বুড়ো নাকি টিভি ধরে আছাড় মা’রবো? ”
হে হে। এবার ডোজে কাম দিয়েছে। ন্যানো সেকেন্ডের তফাতে দুই বাড়ির টিভিই জন্ম বোবা হয়ে গেল যেন। চারদিকে শুনশান নীরবতা। কানে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান। পরিস্থিতি অনুধাবন করে আস্তে ধীরে কান হতে দু’হাত সরালো ইফানা। এতটুকু সময়ের মধ্যেই ঘেমেনেয়ে অস্থির সে। বড় বড় শ্বাস পড়ছে। উচ্চ শব্দের অ’ত্যাচারে কাহিল অবস্থা। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে দাদুর দিকে রাগী চোখে তাকালো ইফানা। দাদু মোতালেব সাহেব জোরপূর্বক ইনিয়ে বিনিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। হাসি এলো না বাপ। আগত বিপদের আশঙ্কায় চুপই রইলেন উনি। চোখ রাঙানি দিয়ে ইফানা পরিবারের বাকি সদস্যের খোঁজ করতে লাগলো। এত শব্দের ভীড়ে সব গিয়েছে কোথায়? দাদী সে কোথায়? এতক্ষণে তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাওয়ার কথা। বেশি খুঁজতে হলো না। রান্নাঘরে শাশুড়ি, বৌমা যুগল উপস্থিত। শব্দদূষণ এড়াতে কানে গুঁজে তুলো। বড় তুলো। দাদি ও আম্মুর এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডে ইফানা হাসবে না কাঁদবে, না কি প্রতিক্রিয়া দেবে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত। হাহ্!
‘ অ্যাই অ্যাই আমাকে দোষ দিচ্ছো কেন? আমি আগে চালিয়েছি নাকি? ওই বাড়ির বুড়ো, সে আগে চালিয়েছে। আমি তো শুধুমাত্র গান শুনছিলাম। অল্প ভলিউমে। ‘
পাশাপাশি, কলিজা লাগালাগি করে অবস্থিত দুই বাড়ি। সেহেতু এক জায়গার কথোপকথন আরেক বাড়িতে বিনা বাধায় সুড়সুড়িয়ে প্রবেশ করতে পারে। তাই তো ওই বাড়ির অলিউল সাহেবের কথাটা ঠিক শুনতে পেল ওরা। অলিউল পত্নী জোহরা খাতুন স্বামীকে বলছেন,
‘ শোনেন। নাটক কম করেন। আমি.. ‘
কথাটা সম্পূর্ণ করা হলো না। সুযোগ মিললো না। এরমধ্যে এপাশ হতে মোতালেব সাহেব উঁচু কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন,
” এই বুড়ো ভাম। নিজে আকাম করে আমাকে দোষ দেয়া হচ্ছে? প্রথমে তো নিজেই জোরে জোরে রাজ্জাক, কবরী গান শুনছিলে। ইচ্ছাকৃতভাবে বিরক্ত করছিলে। তাই তো আমিও সাউন্ড বাড়িয়েছি। ”
দুই বাড়ির বসার ঘরের জানলাও লাগালাগি করে অবস্থিত। এই বাড়ির জানলার পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলেন মোতালেব সাহেব। উপরোক্ত কথাটা বললেন। কথাটা ঠিক। তবুও মানতে নারাজ অলিউল সাহেব। ছুটে এলেন নিজেদের জানলায়। বিরোধীতা করে বললেন,
” বাজে কথা বলবে না বুড়ো। শুরুটা তুমিই করেছো ঢিসুম ঢিসুম দিয়ে। আমি শুধু ফলো করেছি। ”
” একদম মিথ্যা বলবে না। ”
জোহরা খাতুন জানেন ওনার স্বামীই এবেলার মূল অপরাধী। তবে ওই যে। কে আপন, কে পর। স্বামীর টান টেনে উনি এগিয়ে এলেন জানালায়। মোতালেব সাহেবকে বলে উঠলেন,
” ভাই সাহেব বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসব আর মানায় না। নিজের কানের বারোটা বাজাচ্ছেন, সাথে অন্যের। ”
মমতা বেগম কোথা থেকে শিকারী চিলের মতো ছুটে এলেন। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে ঝগড়ুটে কণ্ঠে বললেন,
” এই যে আপা। আমার ওনাকে জ্ঞান না দিয়ে, আগে নিজের স্বামীকে এসব বোধবুদ্ধি ডাউনলোড করে দাও। বয়স হয়েছে। কোথায় আল্লাহ্ বিল্লা তসবি গুনবেন তা না করে অবেলায় গান শোনা হচ্ছে? ”
জোহরা খাতুন পাল্টা আক্রমণাত্মক হয়ে বললেন,
” উনি কি করবেন না করবেন সে বলার তুমি কে? ”
” সেটাই তো। কে তুমি আউলা জ্ঞান দেয়ার? ”
কথায় কথা বাড়ছে। অলিউল সাহেব ভার্সেস মোতালেব সাহেব। জোহরা খাতুন ভার্সেস মমতা বেগম। রেহানা ভার্সেস মনিরা বেগম। মানে দুই মা জননী। সমানতালে লেগেছে দুই পক্ষের মধ্যে। ইফানা এসব থেকে আপাতত বিরতি নিয়েছে। কাল তার ক্লাস টেস্ট। ফ্যামিলির মান রক্ষা করার চেয়ে নিজের মান রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আফটার অল ক্লাস টপার সে। আলাদাই এক ইমেজ তার। তাই তো কানে তুলো গুঁজে, ঘরের দরজা জানালা সব আটকে পড়তে বসেছে ছোড়ি। ওদিকে শয়ন বাবু। এতক্ষণ চানাচুর চিবোতে চিবোতে সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে ঝগড়া এনজয় করছিলেন। আজকের জন্য এতটুকু যথেষ্ট। এখন ঝগড়া বোরিং লাইনে ঢুকে পড়ছে। তাই তো আলাদাই এক ভাবসাব নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চানাচুরের মধ্য হতে বাদাম বেছে খেতে খেতে হুমকিস্বরূপ বললো,
” এই যে দুই সুফি বুড়ো। এই মুহূর্তে চুপ না হলে কালই তাবলীগ পাঠিয়ে দেবো। ১২০ দিনের চিল্লা। সব চুলকানি জায়গামতো বন্ধ হয়ে যাবে। ”
নো মোর সাউন্ড। নো মোর তিড়িং বিড়িং। বাড়ি থেকে একশো বিশ দিন থাকতে হবে তা-ও চিল্লায়, ভেবেই চুপটি করে গেল দুই বুড়ো। ধর্মকর্মে তাদের আবার দুনিয়ার সমস্ত আলসেমি। মুসলিম হিসেবে বৃথা এ জীবন। তাদের দেখাদেখি বাকিরাও চুপ হয়ে গেল। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলো। শয়ন চানাচুর খেয়েদেয়ে পিরিচ সাফ করে নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালো। শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল ছোকড়া। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গুষ্টি একে অপরের দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখের ওপর টেনে দিলো পর্দা। হুহ্!
•
মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। সূর্যের তেজ কমে এসেছে বহুলাংশে। নিজ বাড়ির ছাদে এসেছে রুহান। ছাদের এক কিনারের রেলিং ঘেঁষে বেতের চেয়ারে বসে সে। হাতে স্মার্টফোন। গেম খেলায় মগ্ন কিশোর ছেলেটা। বয়স ১৭, পড়ে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। এ বয়সেই মোবাইলে প্রবল আসক্তি তার। পড়ালেখা চাঙ্গে তুলে দিনরাত মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে সে। হয় গেমস খেলবে। নয়তো রঙঢঙ করে টিকটক, লাইকি ভিডিও বানিয়ে বানিয়ে আপলোড দেবে। বয়স এতটুকুন হলে হবে কি? দেখতে সুদর্শন। চেহারায় আলাদাই এক আকর্ষণ। ফ্লার্টিং করতে ওস্তাদ আছে। সে যাই হোক। আপাতত বাবু গেম খেলায় লিপ্ত। একমনে খেলে চলেছে। ঠিক তখনই মাথার তালুতে এক জোরসে চাটি পড়লো।
‘ আহ্! ‘
ব্যথা পেয়ে ডানে ঘুরে তাকালো রুহান। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখেই তৎক্ষণাৎ ঘামে একদফা গোসল হয়ে গেল। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে সে। ঢোক গিলছে অবিরাম। শয়ন আরেকটা চাটি বসিয়ে বললো,
” মোবাইল গিলতে গিলতে বড়দের সম্মান দিতেও ভুলে গেছিস? ”
” ন্-না তো। ” তোতলাতে ব্যস্ত রুহান।
” তো? ওঠ। বড়দের দাঁড় করিয়ে মজা নেয়া হচ্ছে? ” ধমকে দিলো শয়ন।
রুহান শশব্যস্ত হয়ে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ওর স্থানে আয়েশ করে বসলো শয়ন। বড় বড় দু’টো পা জমিনে ছড়িয়ে দিলো লম্বা করে। দুই হাত চেয়ারের হাতলে রেখে একদম গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” কলেজ যাস না আজ কতদিন? ”
প্রশ্নটা কানে ঢুকতেই কেমন র’ক্তশূন্য হলো মুখ। মিনমিনে গলায় বলল রুহান,
” হু? ”
যেন শুনতেই পায়নি সে। শয়ন শাসনের সুরে বললো,
” কানের পিছে এমন এক দেবো না.. সব কথা কলকলিয়ে কানে ঢুকবে। ”
” ভ্- ভাইয়া আমি যাই তো। যাই। ”
” শেষ কবে গিয়েছিলি? ”
” শেষ? ”
” হু। শেষ কবে গিয়েছিলি? ”
গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা রুহানের। কি থেকে এবার কি বলবে সে? ডানে হাঙ্গর, বামে তিমি যে। সর্বত্র বিপদ।
” কি হলো? চুপ করে আছিস কেন? বল। ”
রুহান আমতা আমতা করে একদম চিকন কণ্ঠে বললো,
” থা-র্সডে গিয়েছিলাম ভাইয়া। ”
” আজ ফ্রাইডে। আজ থেকে কত বছর আগের থার্সডে গিয়েছিলেন শুনি? যার জন্য টিচার আমায় দেখে অভিযোগ জানালো। ”
” ওই গেছিলাম। ”
” সেটাই তো। কবে? ”
রুহান মাথা নিচু করে চুপ। মুখে বুলি নেই। শয়ন শুধালো,
” এই বৃহস্পতিবারের আগের বৃহস্পতিবার? ”
রুহান একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। শয়ন তো অবাক! নিশ্চিত হতে বললো,
” তারও আগের বৃহস্পতিবার? ”
ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে রুহান। শয়ন ঝেড়ে উঠলো ওকে,
” কি হলো? বল। নাকি এরও আগে? ”
” এই না না। এই বৃহস্পতিবারের আগের বৃহস্পতিবারের আগের বৃহস্পতিবার গিয়েছিলাম। ” ফরফরিয়ে বলে উঠলো রুহান।
শয়ন ছোট ভাইয়ের পাছায় চাপড় মে`রে অসন্তুষ্ট স্বরে বললো,
” শা লা বান্দর! কলেজে পড়তে যাস নাকি ফ্যাশন শো করতে? কয়েক সপ্তাহ বাদে একবার গিয়ে মুখ দর্শন দিস। বাবা জানলে না ভালোবেসে ব-লি দেবে তোমায়। ”
” আচার! ”
শয়ন দিচ্ছে ধমক। এরমধ্যে গুড়ি বান্দর বলে উঠলো ‘ আচার’। শয়ন তো একেলা একেলা বিস্ময়ের চূড়ায় উঠে গেল!
” হোয়াট? আচার কি? ”
ভয়াবহ বিপদ থেকে সাময়িক রক্ষা পেতে ফন্দি আঁটলো রুহান। মোবাইল জিন্সের প্যান্টের পকেটে পুরে বেশ নাটুকেপনা ভঙ্গিতে বললো,
” ভাইয়া। ওই যে দেখো। লোভনীয় জিনিস চোখের সামনে একদম লকলক করছে। টেস্ট করবে নাকি একবার? ”
ছোট ভাইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেথায় তাকালো শয়ন। ধীরে ধীরে অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হলো তার। রা’ক্ষুসে চোখে তাকিয়ে বাঁকা এক হাসি উদয় হলো ঠোঁটের সীমান্তে।
.
কলিজা লাগালাগি করে দাঁড়িয়ে বাড়ি দু’টো। একটা টপকে আরেকটায় যাওয়া কোনো দুষ্কর বিষয় নয়। চোখের পলকে এক লাফে শেষের কবিতা এবং বলাকা’র লোকের ঠিকানা বদলে গেল। দুই ভাই শয়ন এবং রুহান চুপিচুপি পায়ে হাঁটছে। সদ্য লাফ দিয়ে এই ছাদে আগমন হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল ওই বাড়ির ছাদের একাংশে। সেথায় রোদ পোহাতে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি বয়াম ভর্তি আচার। সুস্বাদু, মজাদার আচার। জিভে পানি চলে এলো ভ্রাতা’দ্বয়ের। একে অপরের দিকে লোভী চোখে তাকালো। শয়ন চোখের ইশারা করা মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরা। নিরীহ, সুস্বাদু আচার ছিঁড়ে-খুবলে খেতে লাগলো। রা’ক্ষুসে অবতার তাদের। ঠোঁটে লেগে যাচ্ছে আচারের তেল। তবুও থেমে নেই দু’জন। গাপুস, গুপুস করে খেয়ে চলেছে। দু’জন দু’টো বয়াম দখল করেছে। আমের আচার খাচ্ছে। আহ্! সে কি তৃপ্তিময় অভিব্যক্তি তাদের! আহা হা।
অলস দুপুর। ক্লান্ত তনু মন। গুটিগুটি পায়ে ছাদের দরজা খুলে প্রবেশ করলো ইফানা। মুখের সামনে রাখা হাতের তালু। হাই তুলছে মেয়েটা। ঘুম পাচ্ছে বেশ। তবে এখন ঘুমানো যাবে না। দিনে ঘুমালে রাতের ঘুমের চৌদ্দটা বেজে যায়। ভূতের মতো চেয়ে থাকতে হয় বহু বেলা। পরেরদিন মাথা টনটন, ভনভন করে। অসহ্য লাগে। এরচেয়ে একটু কষ্ট করে দিনের ঘুম ত্যাগ করাই উত্তম। হাই তুলতে তুলতে ইফানা যেই না সামনে তাকালো অমনি ফুরুৎ করে ঘুম পালালো দক্ষিণে। কালো পোশাক পরিহিত দু’টো দামড়া চোরের উদয় হয়েছে। চওড়া পিঠ দেখা যাচ্ছে এপাশ হতে। দুটিতে কিছু তো করছে। ফলস্বরূপ নড়ছে বা অল্প দুলছে শরীর। দিনদুপুরে তাদের বাড়ি চুরি করা হচ্ছে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। সে-ও কম বাহাদুর নয়। মোতালেব সাহেবের আদরের নাতনি। সে-ই মোতালেব সাহেব। যে কিনা মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ডাকাত চিহ্নিত করে সাহসিকতা পুরস্কার পেয়েছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে। সে-ই মোতালেব সাহেবের নাতনি ইফানা ইকবাল। নির্ভীক, সাহসী মনের অধিকারিণী। হার মানবে না সে। কিছুতেই না। প্রয়োজনে চোরকে জুতো পেটা করবে। হুম। বুক ফুলিয়ে সাহসী দম ভরে নিলো ইফানা। সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। অল্পতেই মিলে গেল ভয়াবহ অ#স্ত্র। দাঁত কেলিয়ে পৈ’শাচিক হাসলো লেডি কি`লার ইফু।
দুই দামড়া চোর অর্থাৎ শয়ন, রুহান ভাই দু’জন মিলেমিশে তৃপ্তি করে আচার লুটপাট করছিল। আকস্মিক…
‘ ও মা গোওওওও! ‘
অট্ট চিৎকার করে উঠলো শয়ন। সাথে সাথেই রুহান আহাজারি করে উঠলো। পিঠের ওপর ধপাধপ পড়ছে চ্যালা কাঠের আক্রমণ।
‘ চোওওর। চো—র। ‘
ইফানা দুইবার চোর বলে চিৎকার করতেই বাড়ির প্রতিটি সদস্য মুহূর্তের মধ্যে হাজির ছাদে। চোর শব্দটা শুনেই এদের মাথা আউলে গেছে। হ্যাঁ। দিনদুপুরে তাদের বাড়ি চুরি করা হচ্ছে! এত বড় কলিজা! নারী, পুরুষ সকলে মিলে একজোট হয়ে আক্রমণ আরম্ভ করলো। মা’রের চোটে শয়ন, রুহানের সে কি দুরবস্থা! ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে! হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো দুই ভাই। পিঠের ওপর চ্যালা কাঠের চ্যালচ্যালানি চলছে যে। ও মা গো! কি ব্যথা!
” আম্মুউউউউ! ”
আকাশ, বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো শয়ন। ততক্ষণে ওই বাড়ির ছাদে হাজির শয়নের পরিবার। এত লোকের মা”রের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে কোনোমতে কনুই ও হাঁটুতে ভর ছেড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে ভীড় থেকে বের হতে সক্ষম হলো শাফায়েত শাহরিয়ার শয়ন। সন অফ শাহরিয়ার সাহেব। আকস্মিক ছেলেকে দেখে তা-ও এমন মর্মান্তিক অবস্থায়, মা জননী মিসেস রেহানা আর্তনাদ করে উঠলেন,
‘ শ-য়-ন! ‘
এক আর্ত কণ্ঠেই পুরো অস্থির পরিবেশে পরিবর্তন এলো। মুহুর্তের মধ্যেই শান্ত হলো সব। ইফানার পরিবার বিস্মিত চোখে তাকিয়ে! হলোটা কি? এরইমধ্যে কিশোর রুহান ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো মায়ের আহ্লাদ পেতে,
” আম্মুউউউ। অ্যা অ্যা অ্যা… ”
ইফানার বাবা ইকবাল হোসেন অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন,
” শয়ন, রুহান! চো-র ! ”
…..
‘ আঃ! আস্তে। ‘
সোফায় উদোম শরীরে উল্টো হয়ে শুয়ে শয়ন। বুকের ধারে ধরে রয়েছে এক টুকরো গামছা। লজ্জা শরম বলে একটা বিষয় আছে না? পিঠের নীল নকশা বদলে দিয়েছে বলাকা’বাসী। চাপকে পিঠের ছাল বাকল তুলে নিয়েছে যেন। ওমাগো! ব্যথা করে তো। মা রেহানা অগ্নি চোখে তাকিয়ে। নম্রতা, কমনীয়তা ত্যাগ করে রুক্ষতার সহিত ছেলের পিঠে অয়েনমেন্ট ঘঁষে দিচ্ছেন উনি। এমন করছেন কেন? করবেন না?! আদরের দুই কু’পুত্রের জন্য মানসম্মানের লে হালুয়া হয়েছে যে।
” আম্মু আস্তে করো না। লাগছে। ” আকুল স্বরে বললো শয়ন।
রেহানা ধমক দিয়ে বললেন,
” লাগুক। বুভুক্ষের মতো আচার খেতে গিয়ে মা’র খেয়ে এসেছিস। মাথায় তুলে নাচবো এখন? ”
” নাচবা ক্যান? একটু আস্তে দাও। ও আল্লাহ্! ”
আর্তনাদ করে উঠলো ছেলেটা। মা আচ্ছা মতো ঘঁষে দিয়েছেন যে। স্বল্প দূরত্বে আরেক সোফায় শায়িত রুহান। তাকে সেবাযত্ন করছে বড় বোন শায়লা। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। মায়ের ওমন সেবায় ম’রার ঘর ঘুরে আসা হয়ে যেতো কয়েকবার। আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন ওকে। দাদী জোহরা খাতুন আদরের নাতি দুটোর এমন করুণ অবস্থা দেখে যথেষ্ট মর্মাহত। উনি কটমটিয়ে বলে উঠলেন,
” আজরাইলের গুষ্টি একটা! আমার নাতি দুটোকে আধমরা করে ছেড়েছে। ছাড়বো না একটাকেও। শাপ লাগবে ওদের। শাপ। ”
একথা ‘বলাকা’ ঠিক পোঁছে গেল। তাই তো ওপাশ থেকে মমতা বেগম শ্রবণযোগ্য কণ্ঠে বলে উঠলেন,
” এই যে বুড়ি। কাদের শাপ দিচ্ছো হা? গণপিটুনি দিয়ে চোর মে’রেছি আমরা। কি করে জানবো যে চোরের লেবাস ধরে আজকাল শেষের কবিতার লোকেরা ঘুরে বেড়ায়? আগে নিজের নাতিপুতি ঠিক করো। এরপর অন্যকে শাপ দিতে এসো। শাপ। ”
জোহরা খাতুন কিছু বলার আগেই রেহানা আবেগঘন কণ্ঠে বলে উঠলেন,
” কাকিমা আপনারা কি মানুষ? এভাবে কেউ কাউকে মা’রে? আমার ছেলে দু’টো! ”
কেঁদে উঠলেন উনি। মাতৃমন তো। ওদিক থেকে মনিরা বেগম বললেন,
” শোনো ভাবী। ভুল কিন্তু আমাদের একার নয়। ওদেরও আছে। দিনদুপুরে চুরি করতে এসেছে কেন ওরা? এসেছে এসেছে। মা’র খাওয়ার সময় ম্যা ম্যা না করে একবার নিজেদের পরিচয় দিতে পারতো। আমরা তো চোর পেটানোর ধান্দায় ছিলাম। অত খেয়াল করিনি। এর ওপর ওদের মুখ ঘুরিয়ে রাখা ছিল ওদিকে। কিন্তু ওরা। ওরা কেন মুখে কুলুপ এঁটে ছিল? জিজ্ঞেস করো ওদের। ”
রেহানা ছ্যাৎ করে উঠলেন,
” একদম বাজে বকবে না মনিরা। নিজেরা আকাম করে আমার বাচ্চা দুটোকে দোষারোপ করছো? ”
মোতালেব সাহেব বিদ্রুপাত্মক হাসিতে বললেন,
” ওরে আমার বাচ্চা রে। বাচ্চা চোর। ফিডার খায় এখনো। ”
” আঙ্কেলরা ফিডার খেতে খেতে চুরি করে? ”
শুধালো ইফানার ভাতিজা রনি। অবুঝ প্রশ্নে হাসির জোয়ারে ভাসছে বলাকা’বাসী। সে হাসিতে আক্রমণাত্মক অগ্নিতে পুড়ছে শয়ন। আরক্ত চোখে তাকিয়ে ওই বাড়ির জানলায়। সেথায় দাঁড়িয়ে ইফানা। পরিবারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। শয়ন আস্তে করে তার শিকারী দৃষ্টি হটিয়ে নিলো। মনে মনে কঠিন ষ”ড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো বিবেক।
চলবে।