মন বলেছে পর্ব-০৭

0
42

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ

[৭]

” এটা কি করলেন আপনি শয়ন ভাই? মাথামুণ্ডু খারাপ হয়ে গেছে নাকি? ”

ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে মেয়েটি। বিপরীতে দাঁত কেলিয়ে গা জ্বালা দেয়া হাসি হাসছে শয়ন সাহেব। বেশ হয়েছে। যা হয়েছে আচ্ছা হয়েছে। এবার বোঝো ঠেলা। হুহ্!

.

দিবাকরের কিরণময়ী রূপে আলোকিত ধরিত্রী। বাড়ির আশেপাশে গুনগুনিয়ে গাইছে পাখপাখালি। মৃদু হাওয়ায় দুলছে গাছের পাতা। স্নিগ্ধ সে সকালে শয়ন মিয়া ব্যস্ত বাড়ির সামনের খোলা স্থানে। তাদের পারিবারিক গাড়িটি রাখা সেথায়। কালো কুচকুচে গাড়িটি ঘষামাজা করে চেহারা ফকফকা করার দায়িত্ব পেয়েছে আজ দুই ভাই। শয়ন ও রুহান। দাদা অলিউল সাহেবের আদেশ শিরোধার্য। তাই তো সকাল সকাল ঘুমের শ্রাদ্ধ সেরে দু’জনে উপস্থিত হয়েছে এখানে। রুহান গাড়ি সংলগ্ন একটা মাঝারি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। গাড়ির উপরিভাগ ফ্যানা তুলে ঘষছে সে। শয়ন ডান পাশের উইন্ডো বরাবর। ঘষছে আর গলা তুলে বেসুরো গলায় গাইছে,

‘ আজ ব্লু হ্যায় পানি
পানি পানি পানি পানি পানি ‘

ভাইকে সঙ্গ দিতে রুহান-ও গাইছে পরের লাইন,

‘ অর দিন ভি সানি
সানি সানি সানি সানি সানি ‘

‘ আজাও অন দ্য বিচ ইয়ার
ফটো মেরি খিন্চ
ফুটি কিসমাত হোগি তেরি
গার তুনে ইয়ে বাত না মানি ‘

দুই ভাইয়ের কাউয়া কণ্ঠে আশপাশের লোকজনের সকালের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে অবিরাম। সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে এই গান। গান তো নয় যেন গলায় কোলাব্যাঙের সারগাম। অসহ্যকর অনুভূতি সমেত বাড়ির বাইরে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো ইফানা। এসে হাজির হলো এই বাড়ির সামনে। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে উঠলো,

” সকাল সকাল কি শুরু করেছেন আপনারা? আউলা বাউলা গেয়ে মানুষ মা’রতে চাইছেন নাকি? ”

শয়ন গাড়ি পরিষ্কারে ব্যস্ত। পিছু ঘুরে ওর দিকে তাকায়নি। না তাকিয়েই জবাবে বললো,

” ছিঃ ছিঃ। সকাল সকাল কিসব অনাসৃষ্টির কথাবার্তা বলছো গো! আমরা খু•নি নই যে নির্মম-নিষ্ঠুর-পাশবিক ভাবে মানুষ মা•রবো। কিরে ঠিক কিনা? ”

রুহান তৎক্ষণাৎ গলা নেড়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করলো,

” হ্যাঁ। ঠিক ঠিক। ”

” কচু ঠিক। যা করছেন করেন। কিন্তু চুপচাপ করেন। ডিস্টার্ব করবেন না একদম। ”

” আমরা কোথায় ডিস্টার্ব করলাম গো? ”

অবুঝ প্রশ্ন রেখে পিছু ঘুরে তাকালো শয়ন। ইফানার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে। তৎক্ষণাৎ তেঁতে উঠলো ইফানা। বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হলো,

” এটা কি করলেন আপনি শয়ন ভাই? মাথামুণ্ডু খারাপ হয়ে গেছে নাকি? ”

ইফানা রাগে ফুঁসছে। আপাদমস্তক ভিজে গেছে সে। হাদারামটা হাতে পাইপ নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে। ও ভিজে যাচ্ছে যে সে খেয়াল আছে কি? হালুম’টা তো গা জ্বালানো হাসতে ব্যস্ত। ইফানা দাঁতে দাঁত পিষে ডেকে উঠলো,

” শ-য়-ন ভাইইই! ”

রুহান সশব্দে হাসছে টুলে দাঁড়িয়ে। বলছে,

” একদম ঠিক হয়েছে। ঠিক ঠিক ঠিক। ”

ইফানা আহত বাঘিনীর মতো গর্জে উঠলো,

” বাঁদর ছেলে। চাপকে তোমার পিঠের ছাল তুলে নেবো। বড় ভাইয়ের অবিডিয়েন্ট শিষ্য হয়ে উঠছো? ”

রুহান হাস্যোজ্জ্বল মুখে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। শয়ন এবার পাইপটা নামিয়ে ফেললো রাস্তায়। পানি বন্ধ করে করুণ কণ্ঠে বললো,

” হ্যাঁ গো দেখলে আল্লাহ্’র কি বিচার? একদিনের ব্যবধানে চোখের সামনে জলজ্যান্ত শোধ উঠে গেল। কাল তুমি ভিজিয়েছিলে। আজ ভুলক্রমে আমি। ”

ইফানা গা হতে বিন্দু বিন্দু পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

” মিথ্যা বলবেন না একদম। কালকে ভুলবশত ছাদ থেকে আপনার গায়ে পানি পড়েছিল। কিন্তু আজকে যা হয়েছে সবটা ইচ্ছাকৃত। আপনি ইচ্ছা করে ভিজিয়েছেন আমাকে। ”

শয়ন মাথা নাড়লো। এমন চক্রাকারে মাথা নাড়লো যে ইতিবাচক না নেতিবাচক বোঝা মুশকিল। রুহান পাশ থেকে ফোঁড়ন কেটে বললো,

” আপু তুমি মিথ্যা বলছো। কালকে তুমি ইচ্ছা করে ভাইয়ার গায়ে পানি ফেলেছিলে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ”

ইফানা ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বললো,

” ভুল দেখেছো বাছা। চোখে ন্যাবা হয়েছে অটি করাও। ”

রুহান মুখ ভেংচে দিলো। হুহ্! তার চোখ কান সব ঠিকই আছে। অতিরিক্ত সজাগ। আপু ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের দোষ আড়াল করতে ঢপ মা’রছে। ইফানা এবার শয়নের দিকে তাকিয়ে অত্যধিক বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,

” আপনি আসলেই একটা ফাউল লোক, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। হুহ্! ”

মুখ ঝামটা মে রে অর্ধ ভেজা শরীরে সেথা হতে হাঁটা আরম্ভ করলো ইফানা। শয়ন পেছন হতে উঁচু গলায় ডেকে উঠলো,

” কি গো রাগ করে চললে কোথায়? বাপের বাড়ি? অমন করে রাগ করে না বাবুসোনা। ও গো… ”

ইফানা প্রায় নিজ বাড়ির সন্নিকটে পোঁছে গিয়েছে। এমন অসহনীয় কথাবার্তায় পিছু ঘুরে তাকালো সে। দ্বৈধীভাব এমন চাহনিতে তাকালো যা সরাসরি আঘাত হানলো শয়ন সাহেবের বক্ষ পিঞ্জরে। চকিতে বুকের বাঁ পাশে হাত স্থাপন করে অর্ধ অচেতন হবার নাটুকেপনায় মেতে উঠলো শয়ন। রুহান মুখ টিপে হাসছে। ইফানা দৃষ্টি হটিয়ে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলো। পেছনে হাস্যোজ্জ্বল বদনে রয়ে গেল একটি পৌরুষ প্রাণ।

ইফানা ইকবালের তরফ হতে শাফায়েত শাহরিয়ার শয়ন সাহেবের সঙ্গে অঘোষিত যে মৌন লড়াই চলমান ছিল, তার অন্ত ঘটেছে এরমধ্যে পেরিয়ে গিয়েছে কয়েক মাস। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ জারি ছিল সে-ই মৌনতা। অতঃপর এক গোধূলি লগ্নে মিলেমিশে গেল দু’টিতে। পুনরায় লিপ্ত হলো ঝগড়া ঝগড়া খেলায়। এরপর হতে সে-ই পূর্বের মতোই চলছে দিনকাল। দিন নেই রাত নেই যখন তখন লেগে যায় ঝগড়া। বড় হতে ছোট কেউ বাদ নেই। কলিজা লাগালাগি দুই বাড়িতে কলিজা পোড়ানো আয়োজন চলে অবিরাম। এই যে দুই বাড়ির মধ্যে অকথ্য শত্রুতা, এর সূচনা যে ঠিক কবে-কখন-কোন প্রহরে জানা নেই কারোর। বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় চলে আসছে এই শত্রুতা। অলিউল সাহেব এবং মোতালেব সাহেব তাদের দাদা’র মুখেও এই শত্রুতার কথা শুনেছেন। না জানি কবে থেকে চলছে এসব। অলিউল সাহেব এবং মোতালেব সাহেব বিগত বছরগুলোতে গ্রামে থাকতেন ওনারা। চাকরির সুবাদে তাদের দু’জনের পুত্র শাহরিয়ার সাহেব এবং ইকবাল হোসেন থাকতেন শহরে। তা-ও আবার একই বিল্ডিংয়ে ব্যাচেলর ভাড়া থাকতেন ওনারা। দোতলায় শাহরিয়ার সাহেব এবং তিনতলায় ইকবাল হোসেন। ওনারা চাকরিও করতেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিতে। বিয়েও করলেন দু’জনে পাশাপাশি দুই গ্রামের সুন্দরী দুই ললনাকে। ওনাদের বিয়ের আয়োজন হতে শুরু করে বিয়ের কেনাকাটা প্রায় সব ছিল হুবহু এক। এদের মধ্যে এই এক কাকতালীয় বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। কে যে কাকে করে অনুকরণ, বোঝা মুশকিল। কিভাবে কিভাবে যেন মিলেই যায় একভাবে। জায়গায় বেজায়গায় অনুকরণ চলে আসছে বহু যুগ ধরে।

শয়নের জন্মের পর শহরে জায়গা ক্রয় করে বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিলেন শাহরিয়ার সাহেব। আধুনিক জীবনযাপন করার বাসনা জাগ্রত হয়েছে মনে। পিতা অলিউল সাহেব প্রথমে এই সিদ্ধান্তে রাজি ছিলেন না। গ্রামের মাটির মানুষ উনি। গ্রামের খোলামেলা প্রকৃতি ই ওনার প্রাণবায়ু টিকিয়ে রেখেছে আলহামদুলিল্লাহ্। এই গাছপালা, জমিজমা, গবাদিপশু ছেড়ে সর্বোপরি এই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র থাকতে নারাজ তিনি। তবে যেই না গোপন সূত্র মোতাবেক খবর পেলেন ব্যাটা মোতালেব শহরে জায়গা কিনে বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অমনি এক লাফে উনিও সম্মতি পোষণ করলেন। নিজের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করলেন। দুই বুড়োই ছেলের কেনা জমিতে বাড়ি করা নিয়ে যথেষ্ট এক্সাইটেড ছিলেন। ও মা! বাড়ির কাজ শুরু হলে লাগলো জাবারদাস্ত ঝাটকা! পাশাপাশি একদম কলিজা লাগালাগি করে দুই প্লটে গড়ে উঠছে তাদের স্বপ্নের বাড়ি। এমন এক মূহুর্ত ছিল না! অবাক হতে গিয়েও ঠিকমতো অবাক হলেন না তারা। ইটস্ নরমাল। এমন নকলীকরণ চলে আসছে বহু বছর ধরে। চমকানোর কিছু নেই। এরপর শুরু হলো আবার অনুকরণের লীলা খেলা। একই ডিলার হতে ইট, সিমেন্ট, বালু ক্রয় করলো দুই পক্ষ। বাড়ির আর্কিটেক্ট সে-ও একই ব্যক্তি। প্রায় একই নকশায় তৈরি হলো দু’টো বাড়ি। বাড়ির ইন্টেরিয়র ডিজাইন করলো একই ইন্টেরিয়র প্রতিষ্ঠান। বাড়ির নাম দুটোও নকল করে রাখা। রবীন্দ্রনাথের রচনা রাখলো তো একজন। অমনি রাখলো আরেকজন। ‘ বলাকা ‘ এবং ‘ শেষের কবিতা ‘। ইফানা জন্মেছে শহরে। এই শহরের বাড়িতে। শয়নের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে বড় হয়েছে সে। সে-ই ছোট থেকেই এই দু’টো জীব শত্রু। একে অপরের শত্রু। পারিবারিক শত্রুতা ঠিক বজায় রেখেছে ওরা। বে-লাইনে যায়নি অবশ্য। এভাবেই যুগের পর যুগ, হয়তো শতক ধরে চলে আসছে এই শত্রুতাচরণ। যদিওবা আজ অবধি শত্রুতার জের ধরে একে অপরকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি তারা। তবে শুনেছে বহু বছর পূর্বে দাদা কিংবা বড় দাদার আমলে নাকি একবার লেগেছিল সে-ই ঝামেলা। র°ক্তারক্তি কান্ড নাকি হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি অবশ্য। এত আগের ঘটনা কে করবে বর্ণনা…? এ-ও কি সম্ভব?

শয়ন সাহেবের আজকাল দেখা পাওয়া মুশকিল। প্রচণ্ড ব্যস্ততায় দিনরাত কাটছে তার। বইয়ে মুখ গুঁজেই ভোজন সারছে। শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে যেভাবে সম্ভব বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ শব্দগুচ্ছ মুখস্থ-ঠোঁটস্থ-কণ্ঠস্থ করে চলেছে। পারে না শুধু গোসলের সময় বইকে সঙ্গী বানাতে। বাঙালি শিক্ষার্থী না? সারা বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছে। এখন শেষবেলায় ফাইনাল পরীক্ষার সময় নাকেমুখে পড়া আয়ত্ত করতে চাইছে। যদিওবা কতটুকু সফলতা আসছে জানা নেই। শয়ন একা নয়। বন্ধু নাজমুল, তার-ও একই দুরবস্থা। ভিডিও কলে দু’জনে মিলে কত যে গ্রুপ স্টাডি করছে…! যেখান থেকে পারছে সাজেশন কালেক্ট করছে। সব সাজেশন ই যেন এই মুহূর্তে অমূল্য সম্পদ তাদের নিকটে। যে করেই হোক থার্ড ইয়ার ফাইনাল উতরে যেতে হবে। ইমপ্রুভমেন্ট চলবে না। নাহলে পিতা মহাশয় ঝাঁটাপেটা করে কলোনী ছাড়া করবে। পূর্ব থেকেই প্রদত্ত এই হুমকি। ওদিকে মা জননী? ইফানাকে দেখতে না পারলেও বেলায় অবেলায় ওর মেধাবী গুণের সঙ্গে খালি তুলনা দেবে। আরে মা সবাই কি আর এক হয়ে জন্মে দুনিয়ায়? কেউ বেশি কেউ কম। এভাবেই তো জগৎ সংসারে সমতা রক্ষা করা হয়। কিন্তু মা জননী তা বুঝলে তো। খালি তুলনা আর তুলনা। উফ্! শয়ন বিরক্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে নোট খাতায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলো। বা*র পড়ালেখা! কে যে আবিষ্কার করেছে? ওটাকে হাতের মুঠোয় পেলে, মে°রে মেহগনি তক্তা বানিয়ে দিতো সে। সত্যি বলছে। একদম চাপাবাজি নয় কিন্তু। উহু হু হু হু…

তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে শয়নের। দেখাসাক্ষাৎ পাওয়া হয়ে উঠেছে দুষ্কর। একপ্রকার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সে। ঝগড়াঝাঁটি করা তো শত মাইল দূরের কথা। তার এই আকস্মিক উধাও হয়ে যাওয়া, কারো একজনের মনে যে যথেষ্ট দাগ কেটে চলেছে, সে কি রাখে তার খবর? রাখে না তো। রাখলে হয়তো একটুখানি মায়া দয়া দেখাতো। কৃপা করে হলেও একটুখানি মুখ দর্শন দিতো।

কৃষ্ণাভ যামিনীতে আচ্ছাদিত ধরনী। উন্মুক্ত ঘরের বাতায়ন। নিজ ঘরে বিছানায় শুয়ে ইফানা। ডান কাত হয়ে শুয়ে সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ বাতায়নে। দেখা মিলছে ওই বাড়ির ওই নির্দিষ্ট ঘরটির। ভারী পর্দা ভিড়িয়ে রাখা সেথায়। ভেতরে আলো জ্বলছে। অন্য দিনের মতো হয়তো আজো বইয়ে ব্যস্ত সে। সারাবছর পড়বে না। শেষবেলায় এসে বিদ্যাসাগর হয়ে উঠবে? রাগ হলো ইফানার। রাগ নাকি অনুরাগ বুঝলো না অবুঝ মন। বুঝতে চাইলোও না। মুখ বেজার করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ইফানা। শুলো সোজা হয়ে। মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বালিশের পাশ হতে মোবাইল নিলো হাতে। নিস্তব্ধ এই পরিবেশে আঁধারিয়া ঘরে সম্পূর্ণ একাকী সে। ফেসবুকে ঢুকলো অবসরে। নিউজফিড স্ক্রল করে চলেছে। চেনা পরিচিত বন্ধুদের পোস্টে রিয়েক্ট করছে। ফানি ভিডিও দেখলো কয়েকটা। হাসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। আজব তো! হাস্যকর ভিডিও দেখেও হাসি পাচ্ছে না কেন? সে কি একগুঁয়ে গোমড়ামুখো হয়ে গেল? গোমড়ামুখো, ছাগলের চার নাম্বার ছানা! নিজের অদ্ভুতুড়ে ভাবনায় যথেষ্ট বিরক্ত হলো মেয়েটি। মনোনিবেশ করলো ফেসবুকে। স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ হাত থেমে গেল তার। চোখের পর্দায় ধরা দিলো কয়েকটি লাইন,

‘ ভীষণ নিষ্ঠুর এই রাতের নিস্তব্ধতা
তার থেকেও নিষ্ঠুর এই নিস্তব্ধতার শব্দ

নিস্তব্ধতার সুর ভেসে আসে লেখকের গানে,
আর সেই সুর ভীষণভাবে বাজে আমার প্রানে।

একসময় এই নিস্তব্ধতা ভেঙে জন্ম নিবে নতুন আভাস,
নানান শব্দে মুখরিত হবে চারিপাশ। ‘ [ ~ সংগৃহীত ]

একটি গ্রুপে এই কয়টা লাইক শেয়ার করেছে একজন। অসম্ভব ভালো লিখেছে সে! অদ্ভুতভাবে আজকের এই তমস্র যামিনী, এই নিঃসঙ্গতা, এই নিস্তব্ধতা বড় পোড়াচ্ছে তাকে। অন্তর্দাহ হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে কেমন এক আশ্চর্যজনক জ্বালা হচ্ছে। হঠাৎ কি হলো তার? শরীরটা কি খুব বেশিই খারাপ করছে? চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত? ইফানা তার অজ্ঞাত সকল প্রশ্নের উত্তর পেল না। অসহনীয় নিস্তব্ধতায় দ’গ্ধ হয়ে মোবাইল রেখে দিলো সে। আস্তে করে বুঁজে নিলো দৃষ্টি। ঘুমের আগে দোয়া দরুদ পাঠ করতে লাগলো সে। ঘুমানো দরকার তার। দরকার মানসিক শান্তি। এই অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তার দিনযাপন বেশ অসহ্যকর হয়ে উঠেছে। বিশ্রী এক অনুভূতি যখন তখন হানা দেয় অন্তরে অন্তরে।

পড়ন্ত এক বিকেল। হালকা হাওয়ার দোলে নাচে তনু মন। চায়ের দোকানে ভীড় জমিয়েছে তারা দুই গ্রুপ। মুখোমুখি দুই কাঠের বেঞ্চিতে বসে। অলিউল সাহেবের পাশেই বসে ছোট্ট রিনি। ওদিকে মোতালেব সাহেবের সঙ্গী আজ রনি। রনি ও রিনির হাতে কেক পিস। তৃপ্তি সহকারে যা গলাধঃকরণ করে চলেছে দু’জনে। এদিকে অলিউল সাহেব এবং মোতালেব সাহেব চায়ের কাপে মগ্ন। চায়ে ছোট করে চুমুক দিচ্ছেন আর একে অপরের দিকে বিধ্বংসী নজরে তাকাচ্ছেন। চোখের চাহনিতেই যেন একে অপরকে ঘায়েল করে দিচ্ছেন তারা। সহসা তাদের এই চোখে চোখে অব্যক্ত লড়াইয়ে ব্যঘাত সৃষ্টি করে উপস্থিত হলেন প্রতিবেশী কাম ভালো বন্ধু খাইরুল সাহেব।

” আসসালামু আ’লাইকুম কাকা’রা। কেমন আছেন দু’জনে?”

মোতালেব সাহেব মুচকি হেসে সালামের জবাব দিলেন,

” ওয়া আ’লাইকুমুস সালাম। এই তো আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো খাইরুল? ”

খাইরুল সাহেব কাঠের বেঞ্চিতে বসে বললেন,

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। কাকা আপনি কেমন আছেন? ”

প্রশ্নটা করা হয়েছে অলিউল সাহেবকে। উনিও মুচকি হেসে বললেন,

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি বাবা। তোমার বাড়ির সবাই কেমন? ”

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই আছে। ”

খাইরুল সাহেব ছোট্ট রিনির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,

” কি দিদিভাই? ভালো আছো? ”

রিনি নজরকাড়া এক হাসি উপহার দিয়ে বললো,

” ভালো আতি। তুমি কেমন আতো? ”

খাইরুল সাহেব হাসিমুখে বললেন,

” ভালো আছি দিদিভাই। ”

রনি ফট করে বলে উঠলো,

” দাদা তুমি শুধু ওকেই জিজ্ঞেস করলে কেন? আমাকে করবে না? ”

সশব্দে হেসে উঠলো উপস্থিত সকলে। অলিউল সাহেব আড়ালে মুখ ভেংচে দিলেন। উহ্ ঢঙ! যথারীতি খাইরুল সাহেবের উপস্থিতিতে পরিবেশ আস্তে ধীরে বদলে গেল। অনিচ্ছুক মনে একত্রিত আড্ডায় মেতে উঠলো তিনজনে। অসমবয়সী এই বন্ধুত্ব আজকের যুগে সত্যিই বিরল। গোটা কলোনিতে এই তিনজনের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ আলোচিত। প্রশংসিত। বড়রা কথা বলছে। এদিকে এক ফাঁকে রনি মশাই সিট বদল করে রিনির পাশের ফাঁকা জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। যাতে লজ্জায় রঙধনু রঙে রঙিন হয়ে উঠছে রিনি। সে কি লজ্জা! রনি মুচকি মুচকি হাসছে। উপভোগ করছে এই লাজ। সাথে আস্তে করে কামড় বসাচ্ছে কেক পিসে। বেশ মজাদার। এই কেক!

‘ চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়-বিচ্ছেদ নয়,
চলে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন
করা আর্দ্র রজনী।

চলে গেলে আমার-ও অধিক কিছু
থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে। ‘
[ ~ রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ ]

সেদিন ছিল এক চমকিত সুবাহ। অবাক নেত্রে তাকিয়ে রইলো সে! চোখের সামনেই দেখলো এক অভাবনীয় বিচ্ছেদ। আস্তে ধীরে তার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল গাড়িটি। সে তাকিয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে। চোখ দু’টো কি হালকা ভিজে উঠলো? দুর্দম্য উচ্চনাদ বুঝি অধিষ্ঠিত হলো হৃদয়ে। অনেকটা সময় ধরে অপলক তাকিয়ে রইলো সে। দেখে গেল সে-ই প্রস্থান।

চলবে।