মন বলেছে পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
139

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ

[অন্তিম পাতা]

তমসায় আচ্ছাদিত সে তিমির। মৃদু হলদে রঙের আলোয় আলোকজ্জ্বল ঘরটি। উন্মুক্ত জানালার ধারে অবস্থিত পড়ার টেবিল। সেথায় বাতাসের সুর তালে উড়ু উড়ু মনে নৃত্য করে চলেছে ডায়েরির শুভ্র অবশিষ্ট পৃষ্ঠাগুলো। একটি সফেদ শূন্য পৃষ্ঠায় একমনে লিখে চলেছে মেয়েটি। অবিরাম চলছে হাতে থাকা কলম। লিখে চলেছে,

‘ অপ্রিয় শয়ন ভাই,
আসসালামু আ’লাইকুম। কেমন আছেন আপনি? আমি বিহীন খুব ভালো আছেন বুঝি? কিংবা জ্বলছেন আমার মতোই অজ্ঞাত এক অগ্নি দহনে। হচ্ছেন অবিরাম ভস্মীভূত। জানেন শয়ন ভাই, আমি না ভালো নেই। ভালো থাকার জন্য, সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যই তো এখানে এসেছিলাম। খুব এক্সাইটেড ছিলাম নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে। এখানে আসার একদিন আগে পর্যন্ত আমি খুব উৎফুল্ল ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। সবাই তো ঢাবি, জাবি পাগল। আমি ছিলাম চবি পাগল। পাহাড়ের দেশে এক নতুন পরিবেশে স্বপ্ন বুনন করতে চেয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ্ সে আশা পূরণ হয়েছে। এইচএসসি পরবর্তী এখানে আসার সুযোগ মিলেছে আমার। আলহামদুলিল্লাহি আ’লা কুল্লি হাল। কত সুন্দর ভাবে স্বপ্নপূরণের পথচলা শুরু হয়েছে। তবুও এক অব্যক্ত শূন্যতা প্রতি মুহূর্ত পুড়িয়ে যাচ্ছে আমায়। আমি জানি, বুঝি সবটা। এই অনুভূতি যে নিষিদ্ধ। বড় অন্যায় আমার জন্য। আমি নগন্য এক বান্দী হয়ে ধর্ম বিরুদ্ধ আচরণ করতে পারি না। হারাম কি করে আমায় আকৃষ্ট করতে পারে? এ তো গুনাহ। অপ্রিয় শয়ন ভাই! এ কি জাদুবলে সম্মোহিত করলেন আমায়? যতই আপনাকে ভুলে থাকতে চাইছি, মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছি ততই যেন আরো আটকা পড়ছি। এ কেমন চক্রব্যূহে আবদ্ধ হয়ে গেলাম আমি? এটা তো ঠিক নয়। না এই অনুভূতি আমার জন্য সঠিক, না একে প্রশ্রয় দিতে চাইছি আমি। তবুও বেলাশেষে কষ্টের আর্তনাদ নিঃসৃত হয়েই চলেছে। আমার কষ্ট হচ্ছে শয়ন ভাই। খুব কষ্ট হচ্ছে। এই হারাম অনুভূতি কখনো হালাল হবার নয়। আমাদের পরিবার এক হবার নয়। যা আমাদের জন্য নয়, সে অনূভুতি কেন জন্ম নিলো আমার মনে? কেন কেন? কেন আপনার আঁখি যুগলে ভিন্ন এক অনুভূতির দেখা পেলাম আমি? কেন উপলব্ধি করতে পারলাম ঝগড়াবিবাদের অন্তরালে লুকায়িত মোহাচ্ছন্নতার! যা আমার জন্য নয়, কেন তার স্বপ্ন দেখলাম? এখন যে দিবারাত্রি জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি? আপনার অবিচ্ছেদ্য মায়ায় ভস্মীভূত হচ্ছি অবিরাম। এই যন্ত্রনা যে আর সহে না মন। জানেন শয়ন ভাই,

‘ মায়া, এক নীরব ঘা°তকের নাম।
এই ঘা°তক চুপিসারে এসে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে,
মানুষকে ধ্বং°স করে দিয়ে চলে যায়।
এর পরিণাম নিশ্চিত ধ্বং°স।
তবে তা তিলে তিলে ধ্বং°স করে।
মানুষ কখন মায়ার ফাঁদে পড়ে যায়, নিজেও তা জানে না।
যখন বুঝতে পারে, তখন আর ফেরার উপায় থাকে না।

তবুও আমরা মায়ায় জড়াই,
অনেক সময় ইচ্ছে করে জড়াই।
আঘাত পাবো জেনেও ভালোবাসি।
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হই, তবুও ভালোবাসি!

মায়ায় জড়িয়ে আমরা ভুল করি, শাস্তি পাই।
একই ভুল বার বার করি, বার বার শাস্তি পাই!
তবুও ফিরে আসতে পারি না
একেই বলে মায়ার খেলা…! ‘ [ সংগৃহীত ]

আজ দু’টো বছর পরিবার থেকে, আপনার থেকে সুদূর এই চট্টগ্রামে আছি। গ্ৰাজুয়েশন পড়ছি। দু’টো বছর কম তো সময় নয়। আপনার থেকে এতখানি দূরত্বে এসেও বেরোতে পারলাম না সে-ই মায়াব্যূহ থেকে। মায়া নামক নীরব ঘা’তক আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েই ধরলো তবে। তিলে তিলে করে দিলো নিঃশেষ। আমি বেরোতে চাই। এই মায়া নামক গোলক ধাঁধা হতে বেরোতে চাই।‌ হারাম অনুভূতি থেকে মুক্তি চাই আল্লাহ্। ইয়া আল্লাহ্ রহম করুন আমায়। আমি.. ‘

আর লেখা হলো না। মুখ থুবড়ে পড়লো কালো কালির কলমটি। টেবিলে ডায়েরির লিখিত পাতায় মুখ লুকিয়ে শায়িত হলো ইফানা। দু চোখের কোল গড়িয়ে নামতে লাগলো অঝোর বারিধারা। মুক্তি চাই তার। হারাম, দমবন্ধকর অনুভূতি হতে মুক্তি চাই। শয়ন নামক মায়া হতে মুক্তি চাই। কেননা,

[ বিয়ের আগে প্রেম, স্বামী স্ত্রী ব্যতীত সকল প্রকার প্রেম হারাম হারাম হারাম। বিবাহের উদ্যেশ্যে প্রেম করা, ফোনে কথা বলা, চ্যাটিং করা সকল প্রকার বিবাহপূর্ব অবৈধ কাজ যিনা, যারা করে তারা নিঃসন্দেহে জাহান্নামী, নাউজুবিল্লাহ্।

রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যেখানে দু’জন বেগানা নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত হয়, সেখানে তৃতীয়জন হিসেবে উপস্থিত হয় শয়তান। [সহীহ্ তিরমিযী, ১১৭১]

আল্লাহ্ বলেন “তোমরা অ•শ্লীলতার ধারে কাছেও যেও না।” [আল ইসার ১৭:৩২]

এ বিষয়ে আরো দ্রষ্টব্য→ [সহিহ্ বুখারী: ৬৩৪৩ ও সহিহ্ মুসলিম:২৬৫৭]

রাসূল (সঃ) বলেছেন, ” চোখের যিনা হচ্ছে দেখা, কানের যিনা হচ্ছে শোনা, হাতের যিনা হচ্ছে ধরা, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, পায়ের যিনা হচ্ছে তার দিকে হেঁটে যাওয়া, আর অন্তরের যিনা হচ্ছে তাকে নিয়ে কল্পনা করা এবং লজ্জাস্থান তা মিথ্যায় বা সত্যে পরিনত করা। ” (মিসকাত ৮৬)

রাসূল (সঃ) আরো বলেছেন, ” যে সকল নারী পুরুষ যিনা নামের অ”শ্লীল কাজ করবে, তারা একসাথে উ•লঙ্গ অবস্থায় আগুনে জ্বলতে থাকবে।” ( মিসকাত ৪৬২১)

মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন_ ” মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে. যারা আল্লাহ্কে ভালোবাসার মত মানুষকে ভালোবাসে..(অর্থাৎ শির্ক করে) আর মুমিনরা আল্লাহ্কেই বেশি ভালোবাসে। ” (সূরা বাকারা ১৬৫)

” ইসলামের বিয়ের পূর্বে নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসা সম্পর্ক হারাম। ” [ সহিহ্ মুসলিমঃ (২/৩৪৬) ]

আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন এবং বুঝার ও মানার তৌফিক দান করুন। আমার রব যেন আমাদের এই জঘন্যতম হারাম থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহুম্মাগফিরলী। { ~ শব্দগুচ্ছ:- সংগৃহীত} ]

দুই বছর হয়ে গিয়েছে ইফানা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। বাড়ি যায় বছরে দুয়েকবার। ছুটি পেলে অল্পদিনের জন্য যায়। শয়ন নামক প্রহেলিকা হতে যথাসম্ভব পালিয়ে বেড়ায়। উপলব্ধি করে দুই পরিবারের মধ্যকার বিবাদ এখনো চলমান। হয়তো একটুখানি হ্রাস পেয়েছে। তবে পুরোপুরি নয়। ইফানা অবিরাম মনে মনে কুঁকড়ে যায় কেন যে সে শয়নে হারালো! কেন তার অবাধ্য মনটা তার বাধ্যবাধকতা মানলো না! কেন হলো এমন? এই মায়ানুভূতি তো আজকের নয়। বহু পূর্ব হতেই। ওই পঁচা, ফাউল ছেলেটার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে কখন যে দুর্বল হয়ে পড়েছে নিজেও জানে না সে। ওই যে সেবার রাতের অন্ধকারে কাঁটা মুণ্ডু দেখে ভয়ে জ্বরাক্রান্ত হলো। তখন তো জানতো না ওসবের মূল হোতা কে। এরপর একদিন ভুলবশত বেলকনিতে শয়ন ও বন্ধু নাজমুলের ফোনালাপ শুনে ফেললো মেয়েটা। শুনে অজান্তেই এতটা কষ্ট পেয়েছিল না! বিশ্বাসই করতে পারছিল না শয়ন ভাই করেছে ওসব‌। সে প্রতিশোধ নিতে ওকে এমন ভয়ঙ্করভাবে ভয় দেখিয়েছে। রাগে, অভিমানে, কষ্টে ইফানা কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। পুরো পাঁচটা সপ্তাহ মুখে কুলুপ এঁটে ছিল সে। পৈ`শাচিক আনন্দ সমেত উপভোগ করেছে শাফায়েত শাহরিয়ার শয়নের অসহায়ত্ব। একটুখানি কথা বলার জন্য ব্যগ্রতা। তবে বেশিদিন তা বজায় রাখতে পারলো না। একদিন এক গোধূলি বেলায় কথায় কথায় সে-ই লেগে গেল ঝগড়া। এরপর থেকে পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে তাদের বিবাদ। এই জীবনে তা বোধহয় অন্ত হবার নয়। ভালোবাসা নামক পবিত্র অনুভূতি না হোক ঝগড়াই নাহয় সহি। অশ্রুসজল চোখে ইফানা তাকিয়ে ডায়েরির পাতায়। বিগত দিন, সমাপ্ত, মাস, বছর ধরে এই ডায়েরিই তো তার একান্ত সঙ্গী। মনের অব্যক্ত অনুভূতি সমগ্র প্রকাশ করার রোজনামচা।

গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ। ছুটিতে বাড়ি এসেছে ইফানা। কয়েকমাস বাদে বাড়িতে এসে মনটা সে-ই উৎফুল্ল। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুপল। হৃৎপিণ্ড হতে নির্গত হচ্ছে স্পষ্ট ধুকপুক ধুকপুক ধ্বনি। চোখের তারায় খুশির আমেজ। চওড়া হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। অতঃপর কাঁধে ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে ইফানা নামক মেয়েটি তিড়িং বিড়িং করে প্রবেশ করলো ভেতরে। ভেতরে প্রবেশ করেই চক্ষু চড়কগাছ তার। বাড়িতে রীতিমতো হৈহৈ রব। বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে সকলের। বিশেষ করে নারী সদস্যরা। রান্নাবান্না, ঘর গোছানোয় ব্যস্ত তারা। ইফানা বসার ঘরে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে। কি থেকে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা চলমান। সহসা কোথা থেকে ছুটে এলো বছর এগারোর রনি,

” পিপি! তুমি এসেছো? ”

ফুপির কোমর আলিঙ্গনাবদ্ধ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো রনি। ইফানা হাসিমুখে হাঁটু গেড়ে বসলো। জড়িয়ে ধরলো ওকে।

” রনি। সোনা বাবা আমার। কেমন আছিস? ”

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি পিপি। তুমি ভালো আছো?”

ইফানা হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে হাসিমাখা বদনে বললো,

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি বাবা। ”

চওড়া হাসলো রনি। ইফানা চারপাশে নজর বুলিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত চেহারায় বললো,

” বাড়িতে কি হচ্ছে রে রনি? এত আয়োজন কিসের? ”

রনি লম্বা করে হেসে বললো,

” আজকে তো মেহমান আসবে। ”

” কে আসবে? ”

” তোমাকে নাকি দেখতে আসবে। কি মজা হবে, তাই না? ”

বিস্ফোরক চোখে তাকিয়ে ইফানা। লহমায় বুকের মধ্যে কি যেন এক প্রবাহিত হলো। চিনচিনে ব্যথা আরম্ভ হলো বক্ষপিঞ্জরে। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো ইফানা। একটু আগের হাস্যোজ্জ্বল আভা হারিয়েছে অজানায়।

” আরে ইফু কখন এসেছিস? যা মা তাড়াতাড়ি ঘরে যা। চটাপট গোসল করে নে তো। অতিথি আসবে। ”

মনিরা বেগম প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন। ইফানা আস্তে করে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। বাবা গত সপ্তাহে ফোনে বলছিল বিয়ের কথা। তাই বলে এত দ্রুত চলে আসবে তারা, ভাবতে পারেনি ও। মেয়েটা তার ব্যাগপত্র নিয়ে ধীরজ পায়ে অগ্রসর হলো নিজ ঘরের দিকে। ঘরে প্রবেশ করেই প্রথমে নজর কাড়লো ও বাড়ির সে-ই আকাঙ্ক্ষিত ঘরটি। একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গালের নরম ত্বক বেয়ে।

ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে মাঝারি টুলে বসে ইফানা। পড়নে মায়ের একটি জামদানি শাড়ি। মাথায় দেয়া ঘোমটা। মুখশ্রীতে প্রসাধনীর ছোঁয়া। অন্তরে চলমান দুর্দমনীয় সাইক্লোন। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে রেখেছে সে। মনে মনে বারংবার স্মরণ করছে স্রষ্টাকে। সে যেন নিজেকে সামলাতে সক্ষম হয়। হারাম নয় বরং স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে পারে হালালকে। জিকিরে মগ্ন মেয়েটি। কিছুক্ষণ বাদে শোনা গেল পাত্রপক্ষ এসেছে। ধক করে উঠলো বুকটা। তপ্ত শ্বাস ফেলে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো ইফানা। চক্ষু বন্ধ করে মহা পরাক্রমশালী রবকে স্মরণ করতে লাগলো। খানিক বাদে এলো ভাবী তনিমা। বললো,

” ইফু চলো বোন। তোমাকে ডাকছে তারা। ”

ইফানা কৃত্রিম হেসে উঠে দাঁড়ালো। ভাবীর সঙ্গে অগ্রসর হলো বসার ঘরে। পথিমধ্যে শুনতে পেল বেশ হট্টগোল। এত হৈচৈ হচ্ছে কেন অতিথিদের সঙ্গে?

ভাবীর সঙ্গে লজ্জালু পায়ে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হলো ইফানা। আগত অতিথিদের উদ্দেশ্য নম্র কণ্ঠে সালাম দিলো,

” আসসালামু আ’লাইকুম। ”

” ওয়া আ’লাইকুমুস সালাম। কেমন আছো ইফানা? বসো এখানে। ”

পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর শ্রবণ পথে পৌঁছাতেই আশ্চর্যজনক চাহনিতে মুখ তুলে তাকালো ইফানা! বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল পাত্রপক্ষকে দেখে! একে একে সকলের মুখ দর্শন করে নিলো। সে ফাঁকে পাত্র সাহেব তো সবার অলক্ষ্যে চোখ টিপে দিলো ওকে। ইফানা অবাক! হতভম্ব! বিস্মিত! কি হচ্ছে এসব? বাবার মুখপানে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সে। ইকবাল হোসেন ইশারায় শান্ত হয়ে বসতে বললেন। করুণ তার চাহনি। ইফানা বিভ্রান্ত চেহারা সমেত সোফায় বসলো। মুখোমুখি বসে মিটিমিটি হাসছে পাত্র শাফায়েত শাহরিয়ার শয়ন। অদ্ভুত! বড়ই অদ্ভুত।

” কি নাতবউ! বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকে থেকে তো শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে যাচ্ছো। হোস্টেলে তিনবেলা ঠিকমতো খেতে দেয় না নাকি? ”

জোহরা খাতুনের প্রশ্নে মমতা বেগম তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ স্বরূপ বললেন,

” এসব কি ধরনের কথাবার্তা বুড়ি? নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আমার নাতনি। ওদের খাবার সবার সেরা। ”

” তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ”

বিড়বিড় করে উঠলেন জোহরা খাতুন। অতঃপর কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন পাত্রীকে,

” তা নাতবউ কাজকর্ম কিছু শেখা হয়েছে কি? না শুধু পড়ালেখাটাই আয়ত্ত করেছো? ”

বড় ভাই ইনজাম গর্বিত কণ্ঠে বললো,

” আলহামদুলিল্লাহ্ বোন আমার সব রকমের কাজ পারে। পড়া থেকে শুরু করে রান্না সব। অলরাউন্ডার সে। ”

জোহরা খাতুন এসব শুনে মনে মনে তুষ্ট হলেন বোধহয়। ইনজাম এবার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

” তা আপনাদের ছেলে কি পারে, হা? পড়ালেখার নমুনা তো দেখলাম অনেক। আর কিছু পারে কি? নাকি আকাইম্মার ঢেঁকি? ”

অলিউল সাহেব গদগদ কন্ঠে বললেন,

” জুতো সেলাই থেকে শুরু করে চণ্ডিপাঠ, থুক্কু যেকোনো পাঠ পারে আমার নাতি। একদম পারফেকশনিস্ট। ”

ইনজাম বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো শয়ন পানে। শয়ন সাহেবের তাতে হুঁশ থাকলে তো? সে তো নিষ্পলক তাকিয়ে তার হবু সঙ্গিনীর মুখপানে। ডার্ক ট্যারাকোটা রঙের জামদানি পড়নে রমণীর। পোড়ামাটির তৈরি জীবন্ত এক মায়াবিনী লাগছে দেখতে! মাশাআল্লাহ্! মনে মনে মহান আল্লাহ্’র সৃষ্টির সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে পারলো না শয়ন। শ্যামাঙ্গী মুখখানি আজ এতটা মায়ায় আচ্ছন্ন, চোখের পলক ঝাপটানো হয়ে উঠেছে দুষ্কর। স্থান কাল পাত্রভেদ ভুলে তাকিয়েই রইলো ছেলেটা। বুকের ভেতর চলমান অস্থিরতায় ক্রমশ কাবু হয়ে চলেছে সে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে এই শ্যামময়ী হালাল রূপে হবে শুধু তার? হারাম নয় সে-ও যে বিশ্বাসী হালালে। বিবাহ পরবর্তী বরকতময় প্রণয়ে। তাই তো আজ এখানে এভাবে আগমন সপরিবারে। অপেক্ষা এখন শুধু সেই কাঙ্খিত দিনটির।

‘ বলাকা ‘ এবং ‘ শেষের কবিতা ‘ তে আজ ঈদের আমেজ লেগেছে যেন। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুদের ভীড় জমেছে দু’বাড়িতে। ইফানার ঘরে মেয়েদের দলবল জমায়েত হয়েছে। কনে’কে সাজানো হচ্ছে। মেকআপ আর্টিস্ট পাঠানো হয়েছে শয়ন সাহেবের পক্ষ হতে। স্পষ্ট রূপে জানানো হয়েছে তার শ্যামাঙ্গিণীকে যেন অতিরিক্ত মেকআপে ভূত না বানানো হয়। ন্যাচারাল রূপেই যথাসম্ভব সাজানো হবে। মেকআপ আর্টিস্ট তা-ই করছে। শ্যাম বদন সাজিয়ে তুলছে মেকআপ তুলিতে। দুই বেস্ট ফ্রেন্ড মিলা এবং ছন্দা সক্কাল সক্কাল হাজির। শুরু থেকেই বান্ধবীর সঙ্গে রয়েছে তারা। খুনসুটি, দুষ্টুমি চলমান। লাজুকতার ন্যায় মিইয়ে রয়েছে আজ ইফানা। সবটা স্বপ্নের ন্যায় ঠেকছে এখনো। কতবার যে নিজেকে নিজে চিমটি কেটেছে বলার বাইরে। বারবার শুকরিয়া আদায় করছে রবের। মহান রব যে না চাইতেও অভাবনীয় এক সুখানুভূতি দিয়েছে তাকে। হারাম নয় হালালে সজ্জিত হতে চলেছে তার ভবিষ্যৎ। আলহামদুলিল্লাহ্!

গ্রীষ্মের ছুটিতে দুই সপ্তাহের জন্য বাড়ি এসেছিল ইফানা। এসেই সম্মুখীন হলো পাত্র পক্ষের। এরপর মাত্র এক সপ্তাহ পার হতেই আজ এই আয়োজন। শাফায়েত শাহরিয়ার শয়ন এবং ইফানা ইকবালের আকদ। পারিবারিকভাবে পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে তারা। সে এখন তৃতীয় বর্ষে। শয়ন মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। শয়নের পড়ালেখা শেষে চাকরিবাকরি হলে ইনশাআল্লাহ্ আসছে বছর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহ আয়োজন সম্পন্ন হবে। ততদিন অবধি হালাল কপোত কপোতীর ন্যায় নিজস্ব জীবনযাপন করবে তারা। এটাই বড়দের সিদ্ধান্ত।

বসার ঘরে দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা। দুরুদুরু বুকে বর রূপে সোফায় বসে শয়ন। ডান পাশে বসে দাদা অলিউল সাহেব এবং বাম পাশে বন্ধু নাজমুল। পিতা শাহরিয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে এই বিয়ের মধ্যস্থতাকারী খাইরুল সাহেবের পাশে। কাজী সাহেব হাদীসসম্মত খুতবা পাঠ করছেন। খুতবায় উল্লেখিত আয়াতাদির অনুবাদ পাত্রকে বুঝিয়ে দেওয়া উত্তম। অবশ্য, এ খুৎবা আকদের জন্য জরুরী নয়, সুন্নত। অতঃপর কাজী সাহেব পাত্র পাত্রীর নামধাম উল্লেখ করে দেনমোহরের পরিমাণ জানিয়ে পাত্রের সম্মতি চাইলেন এই বিয়েতে। শয়ন মনে মনে আল্লাহ্কে স্মরণ করে নিলো একবার। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের দিকে তাকালো। অলিউল সাহেব মুচকি হেসে ইশারায় ভরসা দিলেন। অতঃপর শয়নের মুখনিঃসৃত হলো সে-ই আকাঙ্ক্ষী শব্দগুচ্ছ,

‘ আলহামদুলিল্লাহ্, আমি এই বিবাহ কবুল করছি। ‘

খুশির ঢেউ আছড়ে পড়লো যেন বসার ঘরটিতে। ‘ আলহামদুলিল্লাহ্ ‘ বলে শুকরিয়া আদায় করে উঠলো উপস্থিত পুরুষ সদস্যরা। এরপর সকলে বরের উদ্দেশ্যে একাকী দোয়া করলো,

بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا فِيْ خَيْرٍ.

উচ্চারণঃ- বা-রাকাল্লা-হু লাকা অবা-রাকা আলাইকা অজামাআ বাইনাকুমা ফী খাইর।

অর্থাৎ, আল্লাহ্ তোমার প্রতি বরকত বর্ষণ করুন, তোমাকে প্রাচুর্য দান করুন এবং তোমাদের উভয়কে মঙ্গলের মাঝে একত্রিত করুন।

বাহ্যিক আড়ম্বরহীন ইসলামে এইখানে বিবাহের আসল কর্ম শেষ।

মায়াবী, আদরিনী আজকের এই যামিনী। চন্দ্রের হাস্যোজ্জ্বল দ্যুতি নির্দ্বিধায় প্রবেশ করছে জানালা গলিয়ে অন্দরে। সুগন্ধীময় হরেক রকমের পুষ্পে সেজেছে ঘরটি। মোমবাতির হালকা মিঠে সুবাস, নাসিকা পথকে সম্মোহন করে চলেছে। বিছানার ঠিক মধ্যিখানে বসে নববধূ ইফানা। লম্বা ঘোমটায় আবৃত মুখশ্রী। কম্পিত অন্তঃস্থল। ভেতরটা হীম হয়ে আসছে অজানা শঙ্কায়, তীব্র উত্তেজনায়। মনে মনে এতকাল চেয়ে এসেছে যারে, আলহামদুলিল্লাহ্ চিরদিনের জন্য আজ পেয়েছে তারে। এ যে স্বপ্ন। সুমধুর, অলীক এক স্বপ্ন। অভাবনীয় আবেগের প্রস্ফুটন হলো আজ। বাস্তবে রূপ নিলো স্বপ্নটা। ইফানা যেন দম আটকে বসে রয়েছে। অপেক্ষায় রয়েছে ওই ফাউল পোলাটা ওরফে তার সদ্য বিবাহিত সোয়ামির। কিছুপল পেরিয়ে গেল। ঘরে অনুভূত হলো দ্বিতীয় কারোর উপস্থিতি। শাড়ির একাংশ খামচে ধরলো ইফানা। জোরপূর্বক খিচে নিলো চোখ দু’টো। শয়ন এলো। দ্বার আটকে নিকটবর্তী হলো বধূয়ার। মুখাবয়বে তার আমোদিত উল্লাস। ইফানার মুখোমুখি বিছানায় বসলো শয়ন। ঘোমটাবৃত নববধূর দিকে অনেকটা সময় ধরে তাকিয়ে রইলো। ওদিকে শ্বাসরোধ অবস্থায় বসে ইফানা। দম ফেলা যেন মুশকিল। শয়ন মিটিমিটি হেসে এবার মুখ খুললো,

” ওহে ফণা তোলা সাপ! ফণা তুলে দুলতে দুলতে শেষমেষ পৌঁছে গেলে আমাদের অন্দরমহলে? ”

ইফানা এতক্ষণ লাজে রাঙা হয়ে ছিল। কিন্তু আকস্মিক এমন অসহ্যকর কথাবার্তায় ফুঁসে উঠলো সে। চট করে দু হাতে তুলে ফেললো ঘোমটা। চোখের তারায় স্পষ্ট রূপে ধরা দিলো জীবনসঙ্গিনীর শ্যামাটে মুখাবরণ। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল শয়ন। ওদিকে ইফানা গজগজ করতেছে,

” ফাউল লোক। দুলতে দুলতে আমি গেছি নাকি আপনি? হা? নিজের দোষ খালি অন্যের ওপর চাপিয়ে দেন। ওই মিয়া ওই। করছেন টা কি? কি বলে ব্লাকমেইল করলেন আমার ফ্যামিলিকে? হু? ”

শয়ন একথার পৃষ্ঠে কিছু বললো না। বরং তার অধরকোণায় ফুটে উঠলো দুর্বোধ্য এক হাস্যরস। যাতে আশ্চর্যান্বিত হলো ইফানা! কিছুটা নরম সুরে শুধালো,

” কি বলেছেন আপনি? কিভাবে ম্যানেজ করলেন সবটা? দেখুন মিথ্যে বলবেন না। আপনাকে আমার খুব ভালো করেই চেনা আছে। আপনি যে কি চিজ! সব করতে পারেন। এবার বলুন না। কিভাবে কি করলেন? ”

” ইটস্ টপ সিক্রেট মাই বেবিগার্ল। ছাড়ো না ওসব। আজকের এই মধুরাত। চুপিচুপি মধু অন্বেষণ করতে দাও না গো। ”

বিস্মিত পলক ঝাপটালো ইফানা। অজান্তেই লালিমা উদিত হলো দুই গালের কোমলতায়। বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো শয়ন। ঠোঁটে মুচকি হাসি। ইফানা আস্তে করে দৃষ্টি নত করে নিলো। মৃদু কণ্ঠে বলতে লাগলো,

” চোখের পলকে কি থেকে কি হয়ে গেল। সবটা এখনো যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। বিশ্বাস হতে চাইছে না। ”

ত্যাছড়া হেসে বললো শয়ন,

” ডোন্ট ওয়্যারি। আজ রাত শেষে সবটা বিশ্বাস হয়ে যাবে। আই অ্যাস্যুর ( assure) ইয়্যু দ্যাট। ”

লজ্জাময় বিহ্বল নজরে তাকিয়ে ইফানা! আলতো করে চাপড় বসালো স্বামীর বাহুতে। সশব্দে হেসে উঠলো শয়ন। সঙ্গী হলো ইফানা নিজেও। আস্তে ধীরে দুজনার হাসিমাখা মুখশ্রী হতে লাঘব হলো হাসিটুকু। প্রগাঢ় নয়নে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছেলেটি। সে চাহনির গাঢ়ত্বে বশীভূত হয়ে অবনত মস্তকে বসে রইলো ইফানা। শয়ন তাদের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস করে নিলো। অতি সন্নিকটে বসে সে। স্ত্রীর মুখাবয়বে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বললো,

” অজস্র দোয়ায় রবের তরে চেয়েছি তোমায়। আলহামদুলিল্লাহ্ আজ চির জনমের জন্য নিজের নামে বেঁধে নিলাম তোমায়। শুধু আমার হয়ে যাওয়ার জন্য এক আকাশসম শুকরিয়া, আমার ক্ষ্যাপাটে শ্যামাঙ্গিণী। ”

বিমোহিত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইফানা। শয়ন প্রথম হালাল স্পর্শ এঁকে দিলো স্ত্রীর ললাটে। দীর্ঘস্থায়ী হলো সেই স্পর্শ। চক্ষু বুঁজে সেই প্রথম পরশ অনুভব করলো ইফানা। দু’জনের চোখেই আনন্দ অশ্রু। শয়ন চুমু সমাপ্ত করে ইঞ্চি খানেক সরে আসতে যাচ্ছিল। তখুনি ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে তার মিসেস করে বসলো এক অভাবনীয় কাণ্ড। আলতো ভাবে স্বামীর অশ্রু কণা মুছে দিলো। চুমু খেল একে একে দু চোখের পাতায়। এই ক্ষুদ্র, ভাবনাতীত পরশে শয়নের অন্তরে বিশালাকার তৃপ্তি জায়গা করে নিলো। স্ত্রীর বাঁ কানের নিচে গলিয়ে দিলো ডান হাতের চারটে আঙ্গুল। বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে চিবুক। ঘন হয়ে আসা স্বরে বললো শয়ন,

‘ মন বলেছে, পাখা মেলেছে
আজ অকথ্য-সুপ্ত অনুভূতিরা..
হবে কি, ও হবে কি…
তুমি আমার অপরূপা…? ‘

অশ্রুসজল চোখে বারংবার ইতিবাচক মাথা নাড়লো ইফানা। লহমায় সে বন্দিনী হলো পুরুষালী চওড়া সে বক্ষবেষ্টনীতে। ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠলো আলিঙ্গন। একে অপরকে জড়িয়ে তারা খুঁজে নিচ্ছে অপরিমেয় সুখের প্রবাহিণী। এই হালাল পরশ, হালাল সম্পর্ক এতেই তো নিহীত রবের সন্তুষ্টি। সর্বোৎকৃষ্ট সুখানুভূতি। রহমত ও বরকত। এজন্য হারাম নয় বেছে নিন হালালকে। ইনশাআল্লাহ্ নিরাশ হবেন না। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও হালাল অনুভূতি সমেত আপনার অপেক্ষায় রয়েছে কেউ। তাই তো হারামকে ‘না’ বলুন আর ‘হ্যাঁ’ বলুন হালালকে।

•• সমাপ্ত ••