#পূর্ণিমা_সন্ধ্যা
লেখক: নবনীতা শেখ
[২]
সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবনব্যবস্থা নিয়ে মায়ের সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অরণী। এখন কোথায় যাবে, কী করবে, কীভাবে থাকবে—কিচ্ছু জানে না সে। শুধু একটা কথাই তার মাথায় গেঁথে আছে—যারা তার মাকে এত কষ্ট দিয়েছে, তাদের কাছে আর এক মুহূর্তও নয়।
অরণী একটা সিএনজি ডেকে নিল। ঢাকার একটা সনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরুন টিউশনির ডিমান্ড বেশি অরণীর। দুইজন ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের স্টুডেন্টকে সে পড়ায়। তাতে ভালোই একটা অ্যামাউন্ট আসে। অন্যদিকে অরণী একজন ফ্রিল্যান্সারও। ইন্টারমিডিয়েট শেষে শখ করে কোর্স করেছিল। এরপর তার এফোর্টে এখন মোটামুটি ভালো একটা পর্যায়ে আছে সে। ক্লায়েন্টদের কাছে তার ডিমান্ড ভালো। মান্থলি আর্নিং যথেষ্ট। ঢাকা শহরে এ টাকায় সংসার চালানো কষ্টসাধ্য নয়। এখানটায় এসে অরণী বুকভরে শ্বাস টানল। ভাগ্যিস সে নিজেকে চালাতে সক্ষম! ভাগ্যিস আর্নিং সোর্স সে রেখেছিল! নয়তো এখন কী করত?
প্রতিটা মেয়েরই উচিত—বসে বসে সময় অপচয় না করে, সে সময়টাকে কাজে লাগানো। যে বিষয়ে আগ্রহী সে, সেটাতে নিজেকে দক্ষ করা। দক্ষতা অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি উপকারী। এদিকে, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবিষ্যতকে সুসজ্জিত করতে পারে। অরণীর ভীষণ সুন্দর একটা দিক ছিল, সে বসে থাকেনি, সে কাজ করেছে, সে খেটেছে।
অরণী তার মাকে নিয়ে সিএনজিতে করে তাবাসসুমের বাসায় চলে গেল। তাবাসসুমের বাসা শেওড়াপাড়ায়। অরণী তাকে কল দিয়ে সংক্ষেপে কিছুটা জানাল, এরপর বলল,
-“আমি তোর বাসায় আসছি।।”
তাবাসসুম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
-“তুই আন্টিকে নিয়ে আমার বাসায়ই আয়। যতদিন খুশি থাকবি।”
অরণী বাসায় পৌঁছোতেই তাবাসসুমের মা হেনা শরবত করে এনে দিলো ওদের জন্য। আয়শা বড়ো চুপচাপ হয়ে আছে। তাবাসসুম যতটা জানত, মাকে বলছিল। তাই হেনা বুঝতে পারছে। সে নিজেও খুব কষ্ট পেয়েছে অরণীদের এমন অবস্থা শুনে। হাপিত্যেশও করছে।
অরণী বহু কষ্টে আয়শাকে কিছু খাওয়াল। এরপর আয়শাকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আস্তে-ধীরে ক্লান্ত শরীরটা নেতিয়ে আসে। আয়শাও অরণীর টুকটাক কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে।
এদিক দিয়ে একটু আরামবোধ করার পর অরণী তাবাসসুমকে বলল,
-“আমি একটু বেরোব। মায়ের খেয়াল রাখিস।”
-“কই যাবি?”
-“বাসা খুঁজতে।”
তাবাসসুম ও তার মা ভীষণ নারাজ তার এমন কথায়। এখনই কেন এত ব্যস্ত হতে হবে অরণীকে! অথচ অরণী বুঝিয়ে পারছে না, তার মাকে সে সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে বাড়ির বাইরে বের করেছে। তাই থাকা, খাওয়া, পড়ার দায়িত্বও তাকেই নিতে হবে। অন্য কারো সাহায্য নিয়ে চলতে অরণীর আত্মগরিমায় বড়ো বাঁধবে।
অরণী বুঝিয়ে-শুনিয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর খুঁজতে লাগল বাসস্থান। মাসের এই অর্ধেকে এসে কোথাও তার যেমনটা লাগবে, তেমন কোনো খালি বাসা সে খুঁজে পাচ্ছে না। পাওয়াটাও সহজ নয়। দুপুর থেকে খুঁজে যাচ্ছে, এখন সন্ধ্যা নামবে বলে। প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীর আর চলছে না। এমন সময় কাজিপাড়ার একটু ভেতরের দিকের গলিতে একটা বাসা সে খুঁজে পেল। যানবাহনের আওয়াজ এদিকে আসে না। অরণী বড়ো আশা নিয়ে টুলেটের দিকে তাকাল। লেখা আছে, ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া হবে। একটা বেডরুম, একটা ড্রইংরুম, বারান্দা, ডাইনিং, বাথ, কিচেন…. সব মিলিয়ে তার যেমনটা চাই, তেমনই।
সে ভেতরে প্রবেশ করল। কেয়ারটেকারের কাছে জানতে পারল, বাসা খালি আছে। একটা ইমার্জেন্সিতে এই অর্ধমাসেই শিফট হয়েছে এই বাসায় থাকা লোকটা। অরণী চাইলে উঠতে পারে।
তিনতলা বাড়ির তৃতীয় তলার সুসজ্জিত ছাদ, আর তার একপাশে এই ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় তলায় বাড়িওয়ালা থাকে, বাকি তিনটা ফ্ল্যাটে অন্যান্য ভাড়াটিয়া। নিচ তলায় গ্যারেজ। ছাদ সংলগ্ন হওয়া ফ্ল্যাটটাও সুন্দর। অরণী তৎক্ষনাৎ এডভান্সড করতে চাইলো। কেয়ারটেকার জানাল, দুইমাসের ভাড়া এডভান্সড পে করতে হবে।
অরণী পড়ল বিপাকে। তারকাছে এই মুহূর্তে ক্যাশ আছে পনেরো হাজার টাকা। এখন গিয়ে টাকা উঠিয়ে আবার এসে পে করতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া দুইমাসের ভাড়া দেওয়ায় কিছুটা সংকটেই পড়তে হবে এ মাসে। এমনিতেও খরচ অনেক। তাই সে একমাসের ভাড়া দিতে চাইল।
কেয়ারটেকার এতে রাজি না হওয়ায় অরণী বলল,
-“আমি কি বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে পারি?”
-“পারেন।”
কেয়ারটেকার ওকে বাড়িওয়ালার নম্বর দিলো। বাড়ির মালিক বাড়িতে নেই, থাকে না তারা এখানে। অরণী নাম্বারটায় কল লাগাল। তিনবার রিং হওয়ার পর একজন রিসিভ করল। অরণী সালাম দিয়ে বলল,
-“আপনার বাসার তৃতীয় তলায় যেই ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে আছে, আমি সেটায় উঠতে চাইছি আজ। এখন চাচা বলছেন যে দুইমাসের ভাড়া আগে পে করতে হবে। আমি যদি একমাসেরটা আজ করি এবং মাসের ভাড়া প্রতি মাসের শুরুতে দিই, তাহলে হবে না?”
কলের ওপাশের ব্যক্তি অরণীর একনাগাড়ে বলা এতগুলো কথা শুনে খানিকটা থমকাল। একটু সময় নিয়ে আসলেই মাথা নাড়ল, ছোট্ট করে বলল,
-“ওকে!”
বড়ো করে দম নিয়ে অরণী বলল,
-“থ্যাংক ইউ।”
অরণী কল কেটে দিলো। এরপর বাসা ভাড়া নেওয়ার চুক্তিপত্রটা পূরণ করে, কেয়ারটেকারের হাতে একমাসের ভাড়াসহ, নিজের আইডেন্টিটি কার্ডের কপি আর যা যা প্রয়োজন সব গুছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। থাকার ব্যবস্থা করা শেষ। এখন প্রয়োজনীয় সামগ্রী লাগবে।
সব প্রয়োজন বাবা মেটাতো বলে নিজের উপার্জিত টাকা তার খরচ হতো না। মাঝেমধ্যে শখ করে মাকে এটা-সেটা কিনে দিত, নিজে কিনত—সেটুকুতে সব তো ফুরিয়ে যায়নি। অরণীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তাই একটা ভালো অ্যামাউন্ট জমা আছে। সে টাকা উঠিয়ে নিল। খাট, আলমারি, ড্রেসিং মিরর, তোশক, চাদর, পর্দা, ফ্যান, লাইট, থালা-বাসন, চাল-ডাল, মশলা, তরকারিসহ যা যা খুব জরুরি, অরণী পাশের কয়েকটা দোকান থেকে তা কিনে নিল। বাকিসব আস্তে-ধীরে নেওয়া যাবে।
আর কিছুক্ষণের ভেতরেই সব নিয়ে এই নতুন বাসায় হাজির হলো সে। যারা ফার্নিচার নিয়ে এসেছিল, তাদের দিয়েই জায়গামতো সব রাখল। সব গোছাতে গোছাতে বাজল রাত সাড়ে নয়টা। পরনের নীল রঙের গোলজামা ঘেমে গায়ের সাথে লেপটে আছে। খোঁপায় বাঁধা চুল মাথার ওপরে আঁট করে বাঁধা। পুরো মুখ ক্লান্তিতে কালো হয়ে আছে। তার ওপর সারাদিনের না খাওয়া। অরণী বেডরুম, কিচেন সবদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। এ-ফাঁকে ভুলেই গেছে দরজা খোলা।
_________
ইফতি হাতে একটা আইডি কার্ডের কপি নিয়ে ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কার্ডে একটা মিষ্টি দেখতে মেয়ের ছবি। সাধারণত ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডের ছবি ভালো আসে না। তবে এতে ভালো দেখা যাচ্ছে। নাম আঞ্জুমান অরণী।
ইফতিকে যখন কেয়ারটেকার করিম বলে,
-“স্যার, বাড়িতে তো আজই মাইয়াটা উঠতে চায়। কী করুম? আমার সুবিধার লাগতেসে না। এমনে না জাইনা, না শুইনা ভাড়া দেওন কি ঠিক হইলো?”
মেয়েটার অমন ক্লান্ত আওয়াজে অতগুলো কথা শুনে ইফতি নিশ্চিন্তমনে বলল,
-“মেয়েটার প্রয়োজন হয়তো। আর এনআইডি, এড্রেস সব দিয়েছে। আমি এলেই না-হয় বাকিসব দেখে নেব।”
করিম আর এতে কিছু বলেনি। ইফতি কাজ শেষেই তাই এ বাসায় চলে আসে। ফ্রেশ হয়ে হাতে এককাপ ধোঁয়া ওড়ানো কফি নিয়ে ছাদে এসে সে দাঁড়িয়ে আছে এবং করিমের দেওয়া অরণীর কার্ডের কপিটা দেখছে।
ছাদে ওঠার সময় চোখ অবশ্য ফ্ল্যাটের ভেতরে গেছিল। মেয়েটাকে আনমনে কাজ করতে দেখে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল তখনই। কিন্তু কথা বলা জরুরি! অনেক সময় হয়েছে ছাদে আসার। সে কফির মগটা রেলিংয়ের ওপর রেখে পকেটে হাত গুঁজে লম্বা লম্বা পায়ে ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেল। ফ্ল্যাটের ভেতরে না তাকিয়ে দরজায় নক করল।
অরণী ত্বরিতে এদিকে ঘুরল। গায়ের ওড়না ঠিক করে এগিয়ে এলো এ-পাশে। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে রইল ইফতির দিকে। অরণী যখন তার মুখোমুখি দাঁড়াল, ইফতি চোখ তুলে তাকাল তখন। সারাদিনের অনাহার, মাথার ওপর এত এত চিন্তা, ক্লান্তি সব মিলিয়ে অরণীকে যেমনটা দেখাচ্ছে, তা বলা বাহুল্য। ছোট্ট শরীরটায় আর দাঁড়িয়ে থাকারও জোর নেই। তবুও শরীরের সাথে মনের জেদ চলছে তার, সেই জেদ দেখিয়েই এখনও কাজ করে যাচ্ছে।
সাধারণত অপরাধীরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না, চোখের পাতা কাঁপে তাদের। ইফতি বিষয়টা বোঝে। অরণীকে পরীক্ষা করতে, কিংবা এমনিই ইচ্ছে করছে বলেই হয়তো তার দিকে ইফতি স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। গলায় গাম্ভীর্যের শতভাগ স্পর্শ রেখে বলল,
-“আমি ইফতেখার মাহমুদ।”
অরণীর খুব বলতে ইচ্ছে করল,
-“ওহ আচ্ছা। সুন্দর নাম।”
চলবে…