দাহন পর্ব-০১

0
47

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১

” বউয়েরা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমাবে আর শাশুড়ী সকাল থেকে কামলা খাটবে। বিয়ের দেড় বছর হলো, এপর্যন্ত কী বলতে পারবে; আমাকে এক বেলা ভাত রান্না করে খাইয়েছে কি না?”

শাশুড়ীর টানা কথা শুনে ঘুম ভাঙল মিথিলার। ঘড়ির কাটা তখন আটটার ঘরে। আজ ফোনে এলার্মও বাজলো না, নাকি মিথিলা শুনতে পায়নি কে জানে? শেষ রাতে ঘুমিয়েছিল সে। কোলের বাচ্চাটার সে কী জ্বর! থরথর করে কাঁপছিল বাচ্চাটা। পাশে তার স্বামী ইমন ঘুমে নিমগ্ন। শ্বশুর-শাশুড়িও আরামে ঘুমাচ্ছিল; শুধু ঘুম ছিল না মিথিলার চোখে। দোয়া পড়ে বাচ্চাটার শরীরে ফু দিচ্ছিল বারবার। ঔষধ খাইয়ে, জলপট্টি দিয়ে শেষ রাতে জ্বর কমলো বাচ্চাটার। বাচ্চাকে বুকে নিয়ে তখন মাথা রেখেছিল বালিশে। কখন যে রাত ফুরিয়ে সকাল হল বুঝতে পারল না।

এদিকে শাহানা বেগমের কথা শোনানো তখনও শেষ হয়নি। মিথিলার ঘরের দরজা খুলছে না বলে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল সে। মিথিলা বাচ্চাকে ভালেভাবে শুয়ে দিয়ে দরজা খুলল। অপরাধীদের মতো দাঁড়িয়ে বলল,” বাবুর জ্বর আসছিল, আম্মা। তাই দেরী হয়ে গেল।”

শাহানা বেগম তৎক্ষনাৎ ঘরে ঢুকলেন। মিথিলার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে সত্যতা প্রমাণ করলেন। ছেলের গা ভেজা, ঘেমে জবুথবু সারা শরীর। মিথিলার শাশুড়ী ঘরে থেকে নিঃশব্দে বের হলেন। ঘরে তার ছেলেও আছে, সে ঘুমে নিমগ্ন। শুনে নিলেও সমস্যা আছে। মাকে খারাপ ভাববে। বাংলাদেশের আশি শতাংশ শাশুড়িরা হয়তো এমনই হয়, ছেলের সামনে ছেলের স্ত্রীদের মা ডাকবে কিন্তু আড়ালে অত্যাচার করবে। আশি শতাংশ শাশুড়ির কথা বলা শেষ হলে বিশ শতাংশ শাশুড়ির কথাও বলা হোক! এই শাশুড়িরা ছেলের স্ত্রীদের মেয়ে মনে করে। নিজের সর্বত্র বিলিয়ে দেয় সেই মেয়ের জন্য। মেয়ের দুঃখে ব্যথিত হয়, মেয়ের সুখে খুশি হয়। এই মেয়েদের ভাগ্যকে রাজকপাল বলা যায়। মিথিলার দুর্ভাগ্য, সেই আশি শতাংশ শাশুড়ির মধ্যে সে পড়লো। শাহানা বেগম রাগে কটমট করে তাকালো তার দিকে। মুখ বাঁকিয়ে বলল,” কেমনে মুখের উপর মিথ্যা বলে দিলে,বউ? গেদার শরীর দেখি ঠান্ডা হয়ে রইছে।”

মিথিলা নতমুখী হয়ে উত্তর দিল,” বাবুর জ্বর ছিল,মা! আমি সত্যি,,,

পূর্বের তুলনায় শাহানা বেগম আরো রেগে গেলেন। মিথিলার সামবে থেকে সরে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। সেখান থেকে যা তা বলতে শুরু করলেন, ” জমিদারের ঝি আনছি। সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাইয়া মিথ্যা কথা বলে। শান্তার মার কতো ভালা কপাল! ছেলের বউ বলার আগেই সব সামনে হাজির করে। সংসারের সব কাজ করে। আর আমার ছেলের বউ! পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে আর আমাকে বান্দির মতো খাটায়!”

শাশুড়ির কথা শোনানো এই প্রথম না। শুনতে শুনতে মিথিলার সহ্য হয়ে গেছে। সে চোখের পানি মুছে আকাশের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,” আর কী কী করলে শাশুড়ির মন পাব বলে দাও আল্লাহ!”

দুপুরে ডাল ভুনা রান্না হয়েছিল। খাওয়ার পর যতটুকু বাকী ছিল ঐটুকু দিয়ে ডালপুরি বানাতে বসল মিথিলা। বিকালের নাস্তা সবার জন্য। শাহানা বেগম ঘরে বসে বসে তসবিহ পড়ছিলেন। এদিকে মিথিলার বাচ্চাটার আবার জ্বর আসছে। বাবুকে ঘরে শুইয়েই নাস্তা বানাচ্ছিল সে। তার শাশুড়ির কানে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পৌছায়না। মিথিলা তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাচ্ছিল ঠিক তখনই অঘটন ঘটল। ডুবো তেলে পুরি দেওয়ার সময় অসাবধানতায় হাতে তেল ছিটকে এলো। মিথিলা চোখ বন্ধ করে নিলো। নাহ! সে গগনচুম্বী চিৎকার করেনি। শাশুড়ির কর্ণধারে উহ আওয়াজটাও যেনো না পৌঁছাতে পারে সেই প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হল। হাত জ্বলছে অনবরত। পানির টেপের নিচে কিছুক্ষণ ধরে রাখল। জ্বালা কমছেই না। টুথপেষ্ট লেপ্টে দিল। এবার কিছুটা আরামবোধ করল মিথিলা। সবগুলো পুরি বানিয়ে ঘরে আসলো সে।

মুঠোফোন বের করে ইমনকে ফোন করল। ইমন তখন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মত্ত। স্ত্রীর ফোন পেয়ে খানিকটা বিরক্ত হল সে। বিরক্ত হওয়ার কারণও আছে। মেয়ে মানুষের বিকাল হলেই এটাসেটা খেতে ইচ্ছে করে। সে ভাবছে, মিথিলারও হয়তো ইচ্ছে করছে! ইমন বেকার, ইন্টার পাস করার পর পড়াশোনা করেনি। ছেলে খারাপ হয়ে যাবে ভেবে বাবা মা বিয়ে করিয়ে দেয়। কিন্তু মিথিলা ছিল ইমনের বিপরীত। পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। ইন্টার প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পর বাবা মা ইমনের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। ইমনের বাজে কোনো স্বভাব নেই এই দিকটাতেই সে মিথিলার বাবা মার মনে জায়গা করে নেয়। শুরুতে সবকিছু ঠিক ছিল। সমস্যা দেখা দেয় মিথিলার ছেলে হওয়ার পর। ছেলের সিজারের সময় মিথিলার বাবা মা অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে। মেয়ের চিকিৎসা বাবদ মাত্র দশ হাজার টাকা খরচ করতে পারে। বিষয়টা শাহানা বেগমের চোখে লাগে। ছেলেকে ফুসলিয়ে মিথিলার বিরুদ্ধে নিয়ে আসে। মিথিলার স্বামী যে তার কষ্টে কাদতো সেই স্বামী পর হয়ে গেল। মিথিলাকে আর পড়তেও দিল না। যদি মিথিলা তার থেকে উপরে উঠে পড়ে, এই ভয়ে।

ইমন কল রিসিভ করলো। মিথিলা ব্যথাতুর গলায় বলল,” একটা বার্ন ক্রিম আনতে পারবেন?”

” কার কী পুড়লো?”

” আমার হাত পুড়ে গেছে,অনেকখানিই।”

কীভাবে হাত পুড়লো, তার এ টু জেড সব বলল মিথিলা। ইমন তখন মিনমিন সুরে বলল,” আমার কাছে তো টাকা নেই।”

মিথিলা লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বিনা শব্দ করে কল কে’টে দিল। মাগরিবের আজান দিবে একটু পর। মিথিলার শ্বশুর মসজিদে যাবেন। বাসায় অজু করতে এসেছেন। মিথিলা শাশুড়ির কাছে গেল।তিনি তখনো তসবিহ পড়ছিলেন।মিথিলা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। শাহানা বেগম মিথিলাকে দেখে বলল,” এভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”

মিথিলা ইতঃস্ততবোধ করে বলল,” নামাজ পড়ে আসার সময় আব্বাকে একটা বার্ন ক্রিম আনতে বলবেন।”

” আবার কী পুড়ছো?”

মিথিলা হাত সামনে বাড়িয়ে দেখিয়ে বলল, ” হাত পুড়ে ফেলছি।”

শাহানা বেগম কিছু বললেন না। শুধু কপাল কুঁচকে রাখলেন। এটা তার স্বভাব। মিথিলা এতে অভ্যস্ত। সে নিঃশব্দে ঘরে চলে আসলো। নামাজ পড়ল। বাবুকে দুধ বানিয়ে খাওয়ালো। এরমধ্যে মিথিলার শ্বশুর মসজিদ থেকে ফিরে আসলেন। ইমনও মিথিলার হাত পোড়ার কথা শুনে বাসায় আসলো। স্বভাবগতভাবে নাস্তা করার জন্য মিথিলা ও ইমন শাশুড়ির ঘরে গেল। মিথিলা ভাবলো এই সুযোগে ক্রিম পোড়া স্থানে লাগিয়ে নিবে। নামাজ পড়ার পরও শাহানা বেগম তসবিহ পড়ছিলেন। মিথিলা বাচ্চাকে কোলে রেখেই শ্বশুর ও স্বামীকে পুরি পরিবেশন করল। একফাঁকে শ্বশুরকে প্রশ্ন করল,” আব্বা, ক্রিম আনছেন?”

মিথিলার শ্বশুর বেশ অবাক হলেন। কীসের ক্রিমের কথা বলছে মেয়েটা? বিস্ময়ের সুরে পাল্টা প্রশ্ন করলেম,” কীসের ক্রিমের কথা বলছো?”

মিথিলা শাশুড়ির দিকে তাকালো। শাহানা বেগম জায়নামাজ ভাজ করে রাখার মাঝেই বললেন” তোমার শ্বশুরকে বলতে ভুলে গেছি।”

মিথিলা প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলল না। ইমনের বিষয়টা খারাপ লাগল। বেকার ছেলেকে প্রতিমাসে হিসাব করে টাকা দেয় তারা। এই টাকাতে মাসের শেষে টেনেটুনে চলে সে। ঘরের বাজার মিথিলার শ্বশুর করে। ঔষধপাতিও তিনি কিনেন। ইমন ভেবেছিল, বার্ন ক্রিমও নিয়ে আসবে।
ইমন নীরবতা ভেঙে বলল, ” কীভাবে এতটুকু পুড়লে।ধ্যান কোথায় ছিল তোমার!”

বউয়ের জন্য ছেলের আহ্লাদ করতে দেখে শাহানা বেগম তেতে উঠলেন। মিথিলা উত্তর দেয়ার পূর্বে উনিই বলতে শুরু করলেন, ” সব ইচ্ছে করে করেছে তোর বউ। কাজ করতে কষ্ট লাগে বুঝছোস? আমাকে পাইছে এক বান্দি! সারাদিন কামলার মতো খাটাইবো আর তোর বউ সারাদিন বসে থাকবো। কোনো অজুহাত পাচ্ছিল না তো! হাত পুড়াইলো।”

শাশুড়ির বক্তব্য শুনে মিথিলার চোখ বেয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মানুষ নিকৃষ্ট মনোভাবের হয় তাই বলে এত নিচু মনোভাব! সে তো ইচ্ছে করে পুড়েনি। ইমনও চুপ হয়ে গেল। দেখা গেল, আশানুরূপ প্রক্রিয়া না পেয়ে শাহানা বেগম নিজেই ঘর ছেড়ে বের হল। বেলুন, পিঁড়ি নিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে আটা গুলাতে শুরু করল। মিথিলা জানে, এই মুহূর্তে শাশুড়িকে নাফ ফেরালে বড়ো সরো কিছু ঘটিয়ে ফেলবে সে। বাবুকে ইমনের কোলে দিয়ে এগিয়ে আসলো মিথিলা। চোখের পানি মুছে বলল, ” আম্মা আমি করতে পারব। একটুই তো পুড়েছে, একটু জ্বলবে পরে ঠিক হয়ে যাবে। দেন আমি রুটি বানাই।”

শাহানা বেগম চিল্লাতে থাকলেন,” হয়েছে আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। আমার কাজ করতে গেলেই তোমার সব সমস্যা শুরু হয়।”

মিথিলা শাশুড়ির কথা শুনল না। আগের মতই জোরে জোরে করতে লাগতো। এবার সাহারা বেগম ক্ষিপ্র হয়ে মিথিলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। ফলস্বরূপ পোড়া জায়গায় আবারও ব্যথা পেল। মিথিলার শ্বশুর শান্ত মেজাজের মানুষ। বউকে খুব ভয় পায়। বিবাহিত জীবনের পঞ্চাশ বছর বউয়ের কথামতো উঠতে বসতে হয়েছে তার।এই বয়সে এসেও একই কাজ করেন। পরের মেয়ের উপর হাত তোলা পছন্দ করলেন না তিনি। শাহানা বেগমকে হাত ধরে উঠিয়ে বললেন,” নিজে দোষ করছো এই মেয়ের গায়ে হাত তুলছো কেনো?”

শাহানা বেগম হাত ঝাড়া দিয়ে আটার বয়াম উঠিয়ে নিচে ফেলে দিলেন। রুটির পিঁড়ি দিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করতে লাগলেন। ইমন বাবুকে কোলে নিয়ে মায়ের হাত থেকে পিঁড়ি সরিয়ে ফেলল। মিথিলা ভয়ে চিকিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। এক হাত পোড়া নিয়ে এতো বড়ো ঝগড়ার সৃষ্টি হয়ে গেল। মিথিলার শ্বশুর সহ্য করতে না পেরে হাত তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তা দেখে শাহানা বেগম বিলাপের সুরে বলতে লাগলেন,” এই মেয়ের জন্য আমাকে মারতে আসলেন? আমি এই জীবন আর রাখব না। পরের মেয়ের জন্য আমাকে কথা শোনালেন। আমি আজই ম’রে যাব, আজই।”

বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন, শাহানা বেগম। এত দ্রুত উনি এমন একটা কাজ করবেন, উপস্থিত কেউ ভাবতে পারেনি।”

মিথিলা দৌড়ে আসলো। দরজায় কিছুক্ষণ কষাঘাত করল কিন্তু লাভ হল না। মিথিলা স্বামী ও শ্বশুরকে কিছু করতে বলল। তারা দৌড়ে গেল বাহিরে, পাড়া প্রতিবেশীকে খবর দিতে।

চলবে…………………