#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২
একমাত্র বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে মিথিলা। পাশের ঘরেই শাশুড়ির আহাজারির শব্দ কানে আসছে তার। শাহানা বেগম দরজা আঁটকে বসে ছিলেন। নিজের ক্ষতি করার মতো মানুষ না উনি। মিথিলার মামা শ্বশুর এসেছে বিচার করতে। ভাইয়ের কাছে বিলাপের সুরে স্বামী ও ছেলের নামে নালিশ করছেন শাহানা বেগম। মিথিলা ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে তার বাবাকে কল করেছিল। জানিয়েছিল তখনকার পরিস্থিতি। এও বলেছিলযে, তার শাশুড়ি গলায় ফাঁ’শি নিতে যাচ্ছে। কী করবে সে। মিথিলার বাবা আসতে চাইছিল কিন্তু যখন সে দেখতে পেলো শাহানা বেগমের ভাই এসেছেন; পুনরায় কল করে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল।
ইমন চুপচাপ মায়ের অভিযোগ শুনে যাচ্ছে। তার বাবাও চুপচাপ। একপর্যায়ে শাহানা বেগমের ভাই বলে উঠলো,” বয়স তো শেষের পথে, ভাইসাহেব। সংসারের কর্মকাণ্ডের প্রতি না তাকিয়ে জায়নামাজে বসে থাকেন।”
মিথিলার শ্বশুর কথা বাড়ালো না। এমনিতেও কম কিছু করেনি তার স্ত্রী। এখন কথা হজম না করলে দেখা যাবে শেষ বয়সে এসে না খেয়ে কষ্ট করতে হবে। শাহানা বেগম স্বামীর মৌনতা দেখে আশকারা পেয়ে গেলেন। বিলাপের সুরে বলতে শুরু করলেন,” ভাই রে! কাকে পেটে ধরলাম। নিজের সন্তানও আজ আমার কথা শুনে না। বউয়ের একটু হাত পুড়ছে বলে আমাকে কথা শুনালো। আমি যে সারাদিন কাজ করি, একবারও তো ফিরে দেখেও না।”
শাহানা বেগমের ভাই এবার ইমনকে বকতে থাকল,” কি বেডা হইলা। বউয়ের কষ্ট বুঝো কিন্তু মায়ের কষ্ট বুঝো না!”
ইমন কিছু বলল না। মিথিলা ভেবেছিল আজ ইমন কিছু হলেও বলবে কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। মিথিলাকে আর ঔষধ এনে দেওয়া হল না। মিথিলাও দ্বিতীয়বার আওয়াজ করল না। একরাত্রির জ্বালাপোড়া সহ্য করে পরেরদিনই ঠিক হয়ে গেল। উহ পোড়া স্থান নয়! জ্বালাপোড়া ঠিক হয়ে গেল।
ফর্সা হাতে ফোস্কা পড়ে দাগ হয়ে গেল মিথিলার হাতে। হাতের ঘা শুঁকিয়ে গেলেও মনের ঘা তাজাই রইল। মিথিলার বাচ্চাটাও আস্তে আস্তে বড়ো হতে লাগলো। ও হ্যাঁ! মিথিলার ছেলে বাচ্চা। যার নাম এহসান। নামটা মিথিলাই রেখেছে। শ্বশুর বাড়িতে তার প্রতি কারো দয়া না থাকলেও সন্তানের যেনো মিথিলার উপর দয়া থাকে।
মিথিলা জীবনের আরেকটি করুণ ঘটনা বলা হোক! আতুড়ঘরে চল্লিশদিন পাড় হয়নি তখন মিথিলার। এহসান হওয়ার পর শাহানা বেগম মিথিলাকে তেল মসলা বিহীন খাবার রান্না করে খাওয়াত। বাবু পেটে থাকা অবস্থায়ই শাহানা বেগম বলেছিলেন, আতুড়ঘরে থাকা অবস্থায় মিথিলা কোনো কাজই করতে পারবে না। শাহানা বেগম কাজ করতে দিবেই না। কেননা আতুড়ঘরে থাকা সময়টা অপবিত্র সময়। এই অবস্থায় মিথিলা প্লেট,পাতিল ধরলে শাহানা বেগম সেই প্লেট,পাতিল আর ব্যবহার করবেই না। অগত্যা মিথিলা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায়নি। মিথিলার মা এহসানের হওয়ার দশদিন পর্যন্ত এবাড়িতেই ছিল। সাধারণত মেয়েদের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতে হয়।বাংলাদেশের শতকরা সত্তর পার্সেন্ট মেয়েদের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতেই হয়ে থাকে। মিথিলার শাশুড়ি তাকে বাবার বাড়ি যেতে দেয়নি। তখন বলেছিল, ” আমার একটা মাত্র ছেলের সন্তান আমার বাড়িতেই হবে।”
মিথিলার বাবা মা জোর করতে পারেনি। এহসানের বয়স যখন পাঁচদিন হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয় তাদের। মিথিলার মাও মেয়ের সাথে আসেন। সেই রাত্রিতে মিথিলার মাকে তার শাশুড়ি আলু ভর্তা দিয়ে ভাত দেয়। মিথিলার মা সানন্দে খেয়ে নেয়। কি! ভাবনায় আসছে না, এটা কোনো ব্যপার হলো! কোনো ব্যপার না। আসল ব্যপারটা পরেরদিন চোখে লাগে। মিথিলাও কষ্ট পেল পরের দিন যখন দেখতে পেল শাহানা বেগম রাতের বাঁশি আলু ভর্তা দিয়ে সকালেও মিথিলার মাকে ভাত খেতে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে মিথিলার মা ভাত গিলে নিয়েছিল। সেদিন দুপুরেই নিজ বাড়িতে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলেছিল, ” মারে! সহ্য করে নে। দুধ দেয়া বাছুর লাথি দেওয়াও ভাল। আজ কষ্ট করছিস একদিন ঠিকই সুখে থাকবি।”
পরেরদিন থেকে মিথিলার কপালে শনির দশা নেমে আসে। দিনের পর দিন তেল মসলা ছাড়া খাবার। খাবার দেয়ার সময় চোখ মুখ অন্ধকার করে রাখা। শাশুড়ির এমন আচরণ সহ্য করতে না পেরে আতুড়ঘরে থাকা অবস্থায়ই রান্নার কাজে হাত লাগায়। আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই সময় শাহানা বেগমের অপবিত্রের ব্যপারে কথা উঠায়নি। মিথিলা সেদিন বুঝেছিল, সুখ তার কপাল ছেড়ে চলে গেছে।
————–
এহসানের বয়স আটমাসে পড়ল। ছোট বাচ্চাদের ঘুমের নির্দিষ্ট রুটিন থাকে। এহসানেরও আছে। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠলে ঘুমায় সকাল দশটায়। আজও তাই হল। মিথিলা এহসানকে ঘুম পাড়াচ্ছে। এমন সময় মিথিলার শ্বশুর ছোট মাছ নিয়ে আসলো। মিথিলা ভাবল, ছেলেকে ঘুম পাড়িয়েই সে মাছ কে’টে নিবে। ইমনও বাসায় ছিল। সে পাশে শুয়েই মুঠোফোনে গেম খেলছে। মিথিলা টুকটাক গল্প করছে স্বামীর সাথে। শাহানা বেগম বাহিরে ছিল। বাড়ির পাশে এক টুকরো জমিতে ফসল চাষ করেন তিনি। সময়টাও ভাল কাটছিল মিথিলার। প্রায় পাঁচ মিনিট পর মিথিলার শাশুড়ি বাড়ি আসলো। বারান্দায় মাছ দেখে রাগে গজগজ করতে করতে দরজা খুলল। যার ফলে ঘুমন্ত বাচ্চা সহ মিথিলাও ভয়ে লাফিয়ে উঠল। শাহানা বেগম দরজা খুলে রাগান্বিত সুরে বলল,” তুই আজই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি।আমি আমার ছেলেকে আরেকটা বিয়ে করাব। তোর মতো মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসাবে আর রাখব না।”
ইমনকে আজও নীরব থাকতে দেখে মিথিলা এই প্রথমমুখ খুলল,” আপনার ছেলের মতো বেকারকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে শুনি? মেয়েরা কোনো মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষকে বিয়ে করতে চাইবে না।”
শাহানা বেগম হা হুতাশ করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললেন কিছু সময়ের মধ্যেই। এহসানকে খাটে শুইয়ে রেখে মিথিলাও বের হয়ে আসলো। পাড়া প্রতিবেশী একত্রিত হল। শাহানা বেগম বিলাপ করছেন,” আমার ছেলে লাখে এক। চান্দের গায়ে দাগ আছে কিন্তু আমার ছেলের জীবনে কোনো দাগ নেই। এই মাইয়া বলে কী! আমার ছেলে বেকার! আরে ঐ মেয়ে, ভাত কাপড় তোরে কে দেয়! আমার ছেলে নাকি আমরা?”
মিথিলা শান্ত সুরে বলল,” আপনার ছেলের সাথে বিয়ে বসছি, আম্মা! আপনাদের সাথে নয়। একটা সন্তান হয়েছে এখনো যেই মানুষটা কোনো কর্ম করতে পারেনি। তার সাথে আমি সংসার করছি বলে। অন্যকেউ হলে,,,,,
” এই বেজন্মা! আমার ছেলে কিছু করবে না। তুই থাকলে থাক না থাকলে নাই! বুঝি তো, কে তোরে ফুসলাইয়া দিচ্ছে। তোর মা তো! সারাদিন ঐ ফোনের ভেতর ঢুইক্কা মায়ের থেকে কুমন্ত্রণা নে, আমি কী বুঝি না!”
মিথিলার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। শেষ কবে মিথিলার ফোনে টাকা ঢুকানো হয়েছে মনে নেই তার। সপ্তাহে একবারও যদি তার মায়ের সাথে কথা হয় মিথিলা এই সেই বাহানা বলে কল কে’টে দেয়। কেননা সে তার শাশুড়িকে চিনে। মিথিলা মায়ের সাথে কথা বলার সময় প্রায়ই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
পাড়া প্রতিবেশীরা একেকজন জিজ্ঞেস করছে, ” ব্যপারখানা কী?”
শাহানা বেগম প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” মাছ রাইখা জমিদারের ঝি দরজা আটকে বসে আছে। আমি সারাদিন কাজ করতে করতে শেষ! আর মাগির ঝি, সারাদিন দরজা আটকিয়ে কখন জামাইয়ের সাথে শুইবো তাই ভাবে।”
পাড়া প্রতিবেশীরা ছি ছি করছে। কয়েকজন ঘৃণার চোখে তাকিয়ে আছে। ইমন ঘর থেকে বেরুল। শাহানা বেগমের উদ্দেশে বলল,” বাবুকে ঘুম পাড়িয়েই মিথি মাছ কা’ট’ত। তুমি সবসময় নিজে যা বুঝো তাই সঠিক মনে কর।”
শাহানা বেগম তেতে উঠলেন। তার হাতে সবজি কা’টা’র কাঁচি ছিল সেটা নিয়েই তেড়ে আসেন,” ও গোলামের পুত! বউয়ের দোষ কতো আর ঢাকবি? মা তো তোর কেউ না। তোর বউ যে তোর নামে কতো কথা শুনাইলো। তা শুনেও আমারে দোষ দিচ্ছিস!”
ইমনের গলার স্বর পরিবর্তন হল। সে কাটকাট গলায় বলল,” মিথিলা ভুল বলেনি, আম্মা! বিয়ের পরই বলেছিলাম ব্যবসার জন্য টাকা দিতে। আব্বা দিল না। তুমি বললা শ্বশুর বাড়ি থেকে টাকা এনে ব্যবসা কর। আমি টাকা কীভাবে আনি!”
শাহান বেগম ছেলের কথা সহ্য করতে পারলেন না। তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। মিথিলার আজকের ঘটনা সহ্য হল না। সে আজও বাবাকে কল করল। তার বাবা খুব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ। মেয়ের সংসার ভাঙতে নারাজ। উনি মিথিলার উকিল মাকে পাঠালেন এই বলে,” আমি আসলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসবো বেয়াইন। ব্যপারটা ভাল দেখাবে না। আপনি বুঝদার মানুষ, মেয়েকে বুঝিয়ে আসেন। আর আমার বেয়াইনকে বলবেন, আমার মেয়েকে যেনো একটু বুঝিয়ে কথা বলে। রাগ করে কথা যেনো না বলে।”
মিথিলার উকিল মা আসলেন। উনি সম্পর্কে মিথিলার চাচী শাশুড়িও। মিথিলা তখন কাঁদছিল। শাহানা বেগম তখন বিলাপ করছেন। ছোট জাকে দেখে বলতে শুরু করলেন,” দেখরে রুকাইয়া, কয়েকটা মাছ কাটতে বলছিলাম বউরে। আমারে যা তা বলে কথা শুনালো।”
রুকাইয়া বড়ো জায়ের সম্পর্কে সবকিছুই জানেন। উনি শাহানা বেগমকে ঘরে নিয়ে পানি খাইয়ে শুয়ে থাকতে বললেন। আবার এও বললেন যে উনি মিথিলার বিচার করবেন।
রুকাইয়া এসে দেখল, মিথিলা মাছ কুটছে। সেও হাত দিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছুই জেনে নিল। মিথিলা মায়ের মতো মমতা পেয়ে কান্না করে মনে লুকানো সুপ্ত কষ্টের কথাগুলো বলল,” মা! আম্মা বলছিল না, বিয়ের পর আমাকে পড়াবে?”
রুকাইয়া উত্তরে বলল,” হ্যাঁ, বলেছিল।”
” তাহলে পড়ায়নি কেনো? কেনো পড়ার কথা উঠালে মিথ্যা বলে! আমি নাকি মায়ের থেকে কুমন্ত্রণা নেই, এটাও বলল আজ।”
শাহানা বেগম কান পেতে শুনলো। বিছানা ছেড়ে সোজা মিথিলার ঘরে গেল। মিথিলার ঘরের টেবিলের উপরে থাকা মোবাইল হাতে নিয়ে উঠোনে নিক্ষেপ করে বলল,” মাগির ঝি, তোর মোবাইলই আমার সংসার বিনাশ করব। তাই মোবাইলই রাখমু না।”
মাছ কা’টা বাদ দিয়ে মিথিলা দাড়িয়ে পড়ল। তার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগল।
চলবে………….