দাহন পর্ব-০৪

0
39

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৪

কিছুদিন পর ইমনের সুবুদ্ধি হল। স্ত্রী ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শুরু করল। ইমন বাবা মায়ের সমর্থন ছাড়াই সামনে আগাল। চাচার বন্ধুর কাছে ছয়মাস ফার্মেসির কাজ শিখল। শেষে কয়েকমাসের ট্রেনিং নিয়ে দোকান দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। ঔষধ কিনতে গেলে টাকার প্রয়োজন হবে। ইমন ও মিথিলা চিন্তায় পড়ে গেল। কীভাবে টাকার বন্দোবস্ত করবে।

শাহানা বেগম ছেলেকে খুব ভালোবাসেন। উনার বিয়ে দুই যুগ পরে ছেলের জন্ম। পরবর্তীতে তাদের আর কোনো সন্তান হয়নি। এই বয়সে এসেও সংসারের কর্তৃত্ব হারাতে চায়বা শাহানা বেগম। তিনি মনে করেন, পরের মেয়েকে আশকারা দিলে কর্তৃক ছিনিয়ে নিবে। মিথিলার মনে হয় না, শাহানা বেগম জীবিত থাকা অবস্থায় কোনোদিনও তার মাথায় স্নেহময় হাত রাখবে। ফার্মেসির ঔষধের জন্য টাকার প্রয়োজন। ইমনের কাছে তখন জমানো কিছু টাকা ছিল। সে ভেবেছিল, সেই টাকা দিয়েই অল্প ঔষধ কিনে আনবে। শাহানা বেগম বিষয়টা জেনে কিছু ভাবলেন।

একদিন সকালে মিথিলা রুটি বানাতা বসল। শাহানা বেগম পানের বাটা নিয়ে পাশে এসে বসলেন। ইনিয়েবিনিয়ে বলতে শুরু করলেন,” জামাইয়ের অসময়ে বউদেরই পাশে থাকতে হয়। তোমার বাপের বাড়ি থেকে না পারো নানা বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসো।”

মিথিলা অপ্রস্তুত হল। সে ভাবতে পারেনি তার শাশুড়ি এভাবে টাকা আনতে বলবে। মিথিলা দেখলো তার সামনে আর কোনো পথ নেই। কয়েকদিন পর ইমনকে সাথে নিয়ে শাহানা বেগম ঠিকই মিথিলার নানার বাড়ি গেল। সেখান থেকে হাজার বিশেকের মত টাকা ধার করে আনল। অথচ ছয় মাসেক আগে মিথিলার শ্বশুর জমি বিক্রি করেছেন। সেখানে ইমন একমাত্র ছেলেরও অধিকার আছে। কিন্তু মিথিলার শ্বশুর শাশুড়ি সেই টাকা দিল না। মিথিলা ইমনকে বলেছিল,” জমি বিক্রির টাকা থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঔষধ আনা যায় না?”
ইমন প্রত্ত্যুত্তরে বলেছিল,” তারা জীবিত থাকা অবস্থায় আমাকে তাদের টাকায় ব্যবসা করতে দিবে না।”

মিথিলার মাঝে মাঝে মনে হয়, ইমন তার বাবা মায়ের নিজের সন্তান নয়। অনেকের কাছে শুনেছে ইমন নাকি তাদের পালিত সন্তান। বিষয়টার সত্যতা নিশ্চিত করতে সে একদিন শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করেছিল। শাহানা বেগম সেদিন অনেক কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। ফার্মাসিতে ক্রয় বিক্রয় ভালই চলছিল। উদ্ভোদনের দিন মিথিলার বাবা এসেছিল। মেয়ের জামাইয়ের সুবুদ্ধি দেখে ঘন্টাখানেক প্রশংসাও করেছিল। বলে না! সুখ সবার দ্বারে আসে না! মিথিলার কপালের সুখ ধরা দিয়েও ধরা দিল না।

প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা, একদিন সন্ধ্যায় মিথিলার শ্বশুর জরুরি কাজে ডাকেন ইমন ও মিথিলাকে। ইমন দোকান বন্ধ করে আটটায় বাড়ি ফিরে আসলো। দুজন মিলে শ্বশুরের সামনে গেলে উনি বলতে শুরু করল,” খালপাড়ের জমি এমনিতেই পড়ে আছে। সেখানে বাড়ি করমু। ইমন তোর দোকান করা লাগবে না। আমি বুড়া মানুষ, দৌড়াদৌড়ি করতে পারি? সব বাদ দিয়ে বাড়ির পিছনে দৌড়া।”

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, ইমন রাজি হয়ে গেল। পরেরদিন মিথিলার বাবার কানে দোকান ছেড়ে দেয়ার কথা চলে গেল। উনি বাড়িতে আসলেন না। রাতে ইমনকে ডেকে আনলেন। ইমনের সাথে কথা বললেন,” বাবা, দোকান ছেড়ো না। তুমি বাড়ির একমাত্র ছেলে, বাড়ির কাজ করতেই হবে। তুমি কাজ করো। সন্ধ্যায় না হয়, দোকানে বসবে!”

ইমন শ্বশুরকে হ্যাঁ, না কিছু বলেনি। কিন্তু বাসায় ফিরে মিথিলার উপর রাগ খাটালো। শ্বশুর শাশুড়ির সামনে মিথিলাকে ডেকে বলতে শুরু করল,” তোমার বাবা কে, যার কথা আমার শুনতে হবে! আমি দোকান করব কী করব না তাকে কেনো জবাবদিহি করতে হবে। ও, তোমার বাবা চায় যেনো আমি সারাদিন রাত খেটেখুটে ম’রি। কতো বড়ো সাহস, আমার বাবা মা যেখানে আমাকে কিছু বলে ন। সে কোন জায়গার মাতব্বর আমাকে উপদেশ দেয়!”

মিথিলা বলল,” আমার বাবা তোমারও বাবা। উনি তোমাকে খারাপ উপদেশ দেয়নি। বউ, বাচ্চা আছে তাদের কথা চিন্তা করতে বলেছে।”

মিথিলার কথা কেড়ে নিলেন শাহানা বেগম। উচ্চ আওয়াজে বললেন,” বউ বাচ্চা মানে কী? আমরা তোমার পিছনে খরচ করি না? তিনবেলা যে ভাত খাচ্ছো কার কামাইয়ে খাচ্ছো? আর একবার আমার ছেলের কাজকর্ম নিয়ে বলবা তো বাড়ি থেকে বের করে দিব।”

শাশুড়ির কথা শেষ হতেই শ্বশুর কথা শুনালো। মিথিলা সেদিন সারারাত কান্না করেছে, ঘুমায়নি। নতুন বাড়ির কাজ শুরু হয়েছে। ইমন লোকসান করে দোকান ছেড়ে দিল। তিনজনই নতুন বাড়িতে চলে যায়। মিথিলা একা হাতে সংসার, বাচ্চা সামলাতে শুরু করল। সেদিনের পর থেকে ইমনের সাথেও মিথিলার দুরত্ব বেড়ে গেল। প্রয়োজন ছাড়া মিথিলা কথা বলে না। ইমনও তেমন কথা বলে না। সারাদিন পর বিকালে বাড়িতে আসলেও মিথিলাকে দেখেও দেখে না। ইচ্ছে হলে বাহিরে চলে যায়, রাত করে আড্ডা দেয় বন্ধুদের সাথে। এভাবেই চলছে মিথিলার সময়।

কয়েকমাস পরের ঘটনা, ইমনের তখন পাঁচ হাজার টাকার খুব প্রয়োজন হল। বাবা মায়ের কাছে না চেয়ে মিথিলার কাছে চাইল। সে টাকা কীভাবে দিবে? শ্বশুর বাড়ি থেকে কোনোদিনও হাত খরচের টাকা পায়নি। ইমন মিথিলার হাত ধরে বলল,” বাবার কাছ থেকে এনে দাও না!”

মিথিলা প্রথমে অমত করল। পরমুহূর্তে ইমন ভুলিয়ে ভালিশে রাজি করিয়ে ফেলল। মিথিলা তার মায়ের কাছে টাকা চাইলো। আমরা সমসময় যে সাহায্য পাব তেমন নয়। অর্থ সম্পদ সবসময় একই থাকে না। সবসময়ের মত মিথিলার মা এবার কোনো সাড়া দিল না। এতে করে মিথিলার জীবনে সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত চলে আসলো।

টাকা না দেওয়ার ব্যপারটা নিয়ে ইমন প্রথম কোনো পদক্ষেপ নিল না। কিন্তু কয়েকদিন পর মিথিলার বাবা দাওয়াত দিলে ইমন যেতে অবজ্ঞা করল। শাহানা বেগম কারণ জিজ্ঞেস করলে বলল,” ঐ বাড়িতে আমরা কেউ যাব না। ওরা আমাদের লোভী পরিবার বলছে।”

ইমনের কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল। ইমন কেনো মিথ্যা বলল আজ পর্যন্ত মিথিলা জানে না। ইমন কথায় কথায় টাকার কথাও বলল। শাহানা বেগম শোনার পর মিথিলাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিল না। উনি মিথিলাকে সব কাজ করতে নিষেধ করে দিলেন। রান্না করতে গেলেও কথা শুনিয়ে দেন। রাগে গজগজ করতে করতে বলেন,” তোর বাবা মার কী এতটুকু সামর্থ্য নাই! পাঁচ হাজার টাকাই তো চেয়েছিল, পাঁচ লক্ষ নয়! এভাবে আমার ছেলেরে অপমান করলো? তোর কোনো কাজ করতে হবে না, মা”””গির ঝি। তোর হাতের রান্না খাওয়া মানে বিষ খাওয়া।”

মিথিলা শাশুড়ির কটু কথা সহ্য করতে পারল না। মিথিলা তার বাবাকে ফোন করে রাগান্বিত সুরে বলল,” পাঁচ হাজার টাকাই তো চাইছিলাম। যদি দিতে তাহলে আমাকে এতো কথা শুনতে হতো না।”
মিথিলার বাবা অপরপাশ থেকে বললেন,” কবে চাইছিলা,মা! আমি তো জানি না।”

মিথিলা বুঝতে পারল তার মা তার বাবাকে টাকার কথা জানায়নি। মিথিলা আবার বলল,” মা তোমাকে বলেনি? মা কেনো এমন করল?”

মিথিলা কাঁদছে। তার কান্নাতে শক্ত বাবার মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয় যাচ্ছে। মেয়েদের বাবার বাড়িকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন টাকার ব্যাংক ভেবে বসে। দুই ইদে একটি কাপড়ের রং ফ্যাকাসে হলেও কথা শোনায়। বলে নিম্ন মানের কাপড়। এক ইদে কাপড় না দিলে টানা কথা শুনতে হয়।

মিথিলাী বাবা ফোন কে’টে মিথিলার শ্বশুরকে ফোন করল। ভদ্রভাবে অনেক কথা বলল শ্বশুরকে। সেদিন মিথিলার শ্বশুর মিথিলাকে যা তা বলে কথা শোনালো। চারদিকের এতো চাপ মিথিলার সহ্য হলো না। সে ইমনের কাছে গেল।

ইমন দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। মিথিলা চোখের পানি মুছে ইমনের সামনে এসে বলল,” তুমি কী চাও, বলো আমাকে?”

ইমন বিরক্ত হল। খাওয়ার মাঝে কথা বলার জন্য নাকি মিথিলার প্রশ্ন এড়ানোর জন্য। মিথিলা পুনরায় বলল,” পাঁচ হাজার টাকার জন্য তোমরা আমার সাথে বাজে আচরণ করছো।”

ইমন স্বাভাবিক গলায় বলল,” সহ্য করতে না পারলে মরে যাও।”

মিথিলার তখন কী হলো জানে না। সে ইমনের কথাটাই অনুসরণ করল। আলমারী থেকে নতুন সুতির কাপড় বের করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিল। ইমন সব দেখেও দেখল না। মিথিলা তখন ইমনের উদ্দেশে বলল,” এছাড়া আমি কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।”

চলবে……..