দাহন পর্ব-০৯

0
43

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৯

মিথিলার অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছিল দেখে তার মা একজন হুজুরের কাছে নিয়ে গেল। হুজুর মিথিলার সমস্যা শুনে কিছু পড়লেন সময় নিয়ে জানালেন, মিথিলার উপর কালোজাদু করা হয়েছে কিন্তু কে করেছে জানালেন না। এমনটা হয়ে থাকে। যে কালোজাদু করে তার নাম জানানো হয় না। মিথিলার মা জিজ্ঞেস করেছিল কি দিয়ে করা হয়েছে এবং কোথায় করা হয়েছে। উত্তরে বলল,” মিথিলা শ্বশুর বাড়ির একটি ছোট্ট গাছের নিচে তাবিজ আছে। তারমধ্যে মিথিলার কালো রঙের ওড়নার কিছু অংশ আছে, এঁটো ভাত, মাথার চুল দিয়ে করা হয়েছে।

মিথিলার সুস্থতার জন্য পানি ও তেল পড়া দিল। সাথে একটি তাবিজও দিল। হুজুর মিথিলার সাথে তার শ্বশুর বাড়ি এসে বলা গাছটির নিচে তাবিজ পেল। এবং বলা অনুযায়ী জিনিসপত্র পেল। মিথিলা শ্বশুর বাড়ি ফিরে এলে কালো ওড়না থেকে কিছু অংশ ছেঁড়া পেল। সে বুঝে গেল, এই কাজটা কার। মিথিলা শাশুড়ির ঘরে গিয়ে চিৎকার করে বলল,” আমাকে বলে কয়ে লাভ হয়নি বলে কালো জাদু করলেন? আম্মা আপনিও তো মেয়ে মানুষ। আমার সাথে আপনার কীসের এতো শত্রুতা। আমাকে শেষ করার জন্য এতো জঘন্য কাজ করলেন।”

শ্বশুরের সামনে জিনিসপত্রগুলো রেখে কান্না করতে থাকল মিথিলা। শাহানা বেগম বুঝতে পারলেন, উনার স্বামী ও ছেলের কাছে এখনই খারাপ হয়ে যাবেন। তিনি মিথিলার হাত ধরে বললেন, ” এসব কী বলতাছো বউ! আমি তোমার ক্ষতি করতে যামু কেন। তোমার লগে আমার বনে না ঠিকই তাই বলে মা’ই’রা ফেলমু এই চিন্তা করি না।”

মিথিলার শ্বশুর গম্ভীর কণ্ঠে বুঝালো,” যা হইছে খুব খারাপ হইছে। আমার বংশের বাত্তি যে দিছে তার ক্ষতি আমি চাই না। বউও আমার ছেলের বউও আমাদের। দুইজন মিল্লা-মিশ্যা থাকতে না পারলে আলাদা করে দিমু।”

শাহানা বেগম আলাদার কথা শুনে বুকে চাপড় দিতে দিতে আহাজারি করতে থাকল,” আমার একটামাত্র ছেলে। আলাদা হওয়ার থেইকা ম’র’ণ’ই ভালা।”

শাশুড়ির নাটক দেখে ইমন মিথিলার কিছু বলার বাকী রইলো না। তবে এই বিষয়ের উপর বিচার বসবে এই প্রত্যাশা দিল মিথিলার শ্বশুর।

——————-

মিথিলার এক বছরের চাকরি শেষ হতে আরো একমাস বাকী আছে। বিয়ের পর হানিমুন দূরের কথা। দূরপাল্লায় ভ্রমণের সুযোগ হয়নি তাদের। ইমনও কখনো ঘুরতে যেতে রাজি হয়নি। কারণ, তার টাকা পয়সা। মাসিক খরচ যেটা দেয়া হয় তা হাত খরচেই চলে যায়। এবার ইমন সেখান থেকে তিনমাসে অল্প অল্প টাকা জমালো। মিথিলাও একই কাজ করল। বিগত তিনমাসের এক টাকাও খরচ করল না। দুইজনের টাকা মিলিয়ে মোটামুটি এমাউন্ট আসলো তা দিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করল।

শাহানা বেগমের আচরণ ভাল হবার নয়। মিথিলা যোগ্য জবাব দিয়ে দেয় বলে এখন মুখে কিছু বলে না। তবে সুযোগ পেলে কাজ করে দেখায়। কক্সবাজার যাওয়ার কথা শোনার পর থেকেই মুখ ফুলিয়ে রেখেছেন শাহানা বেগম। আর এক সপ্তাহ পর তারা কক্সবাজার যাবে। ইমন টিকিট কেটে এনে যখন মিথিলাকে দেখালো তখন মিথিলার মনে হলো আরো কিছু পয়সা হলে ভালোভাবে ঘোরা সম্ভব হবে। শ্বশুর বাড়ি থেকে টাকার দিবে তা ভাবাও বোকামি। মিথিলা ভাবল, তার মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসবে। কিন্তু শাহানা বেগমকে জানালে উনি কখনো যেতে দিবে না। তাই সে বুদ্ধি বের করল। মিথিলা তার মাকে ফোন করে বলল যেন তার শাশুড়ির কাছ থেকে বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য দেয়া হয়। মিথিলার মা ফোন করল ঠিকই কিন্তু ভুল সময়ে। শাহানা বেগম তখন গোসল করছিল। মিথিলার শ্বশুর ফোন রিসিভ করল। মিথিলার মা মেয়েকে একদিনের জন্য বাড়ি যেনো আসতে দেয় তার অনুমতি চাইলো। মিথিলার সামনেই তার শ্বশুর বলল,” আচ্ছা বিকালে যাবে নে।”

অনুমতি পেয়ে মিথিলা সময় নষ্ট করল না। এহসানের কিছু কাপড় গুছিয়ে নিল। তিনটার মধ্যে মিথিলার মেজোবোন নিতে চলে আসলো। ইমন শ্বশুর বাড়িতে যায় না। লজ্জায় নাকি অস্বস্তিতে তা সেই জানে। ইমনের সাথে আলেচনা করেই মিথিলা বাবার বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শাহানা বেগম দুপুরের খাবার খেয়ে মিথিলার মেজো বোনকে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল,” ও আসছে কেনো?”

মিথিলা বলক,” আমাকে নিয়ে যেতে। আব্বাকে তো মা ফোন করে বলেছিল।”

শাহানা বেগমের চারদিন হল ঠান্ডা লেগেছে। মিথিলা ঔষধ সেবন করার কথা বললেও ঔষধ নেননি তিনি। মিথিলা বাবার বাড়ি একরাতের জন্যই যেতে চাইছে। পরেরদিন বিকালে চলে আসবে। এতেও শাহানা বেগম অমত করতে থাকলো। সে মিথিলার কথা শুনে কপাল কুঁচকে অন্যঘরে চলে গেল। গোছানো চেয়ার টেবিল সরিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার মিথ্যা চেষ্টা করল যেন মিথিলা পুনরায় কিছু বলতে না পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। এরমধ্যেই মিথিলার শ্বশুর দশ কেজি গরুর দুধ নিয়ে আসলো। মিথিলা সেগুলো গোছগাছ করার জন্য ধরলেই বুঝতো পারল, অধিকাংশ দুধই বরফে ঢাকা। চারটা বড়ো বালতিতে পানি ভরে মিথিলা সেগুলো ডুবালো। শাহানা বেগম ঘরের কাজ শেষ করে সজিনা পাতা নিয়ে আসলো। মিথিলাকে বলল, এগুলো ভেজে পাটায় পিষতে। মিথিলা তাই করল। সজিনা পাতা, চাল ও চিড়া ভাজা, পেয়াজ, রসুন, কালোজিরা ভেজে বেটে গুঁড়ো করে দিল। এই কাজগুলো করতে করতে মাগরিবের আজান দিল। এতসময়ে দুধ গুলোও গলে গেল। মিথিলা বড়ো একটি পাতিলে সেগুলো ছেঁকে ঢেলে চুলায় বসালো। দুধ উবরানো হলে ঠান্ডা করার জন্য রেখে শাশুড়ির কাছে এসে বলল, ” আম্মা, লিমা তো দুপুর থেকে বসে আছে। এবার আমি যাই।”

উল্লেখ্য শ্বশুরকে বাদ দিয়ে শাশুড়ির অনুমতি নেওয়ার কারণ হল, মিথিলা বাবার বাড়ি গেলে শাহানা বেগমই কোনো না কোনো ঝামেলা করে। এবারও করবে না তার গ্যারান্টি কী?

শাহানা বেগম অসন্তুষ্ট হয়ে আস্তে করে উত্তর দিল, “যাও।”

মিথিলা রেডি হয়ে ছেলে ও বোনকে নিয়ে রওনা দিল। ভরসন্ধ্যায় মেয়েকে আসতে দেখে মিথিলার মা খুব বকলো। বোরকা খুলে মিথিলা হেসে সারাদিনের করা কাজের কথা জানালো। এহসানকে কোলে তুলে মিথিলার মা আদর করছিল তখনই মিথিলার ফোনে কল আসলো। ইমন কল করেছে। বিকালেই তো চলে যাওয়ার সময় বলেছিল। হয়তো ঠিকঠাকভাবে পৌঁছেছে কি না জিজ্ঞেস করবে! মিথিলা রিসিভ করলে ইমনের রাগান্বিত স্বর ভেসে আসলো,” আমি কী তোমার ভরণপোষণ দেই? যারা ভাত কাপড় দেয় তাদের অনুমতি ছাড়া বাপের বাড়ি গেলা কোনো?”

মিথিলা অবাক হলো। এসব কী বলছে ইমন! মিথিলা বলল,” আম্মা অনুমতি দিয়েছে পরেই আসছি। কি হয়েছে?”
ইমনের কণ্ঠস্বর তখন ভাড়। হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে। পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারছে না হয়তো। সে বলতে শুরু করল,” আম্মা একটু আগে আসছিল। আমি দোকানে বসে ছিলা প্রায় বিশ পঁচিশজন মানুষের মাঝে। সেখানে এসে আমাকে ব’কা শুরু করল।”

” কি বলেন। আপনাকে ব’ক’লো কেনো?”

ইমন চিল্লিয়ে বলল,” তোমার জন্য। আমাকে এতো মানুষের সামনে বলছে জুতা দিয়ে পিটাবে। জুতা তুলে আসছিলোও। দোকানদার থামাইছে। আরো বলছে, তোর বউ তোর কথা শুনে না কেনো? আমি কি করছি তুমি বলো। আমার কথা মান্য বা অমান্য করার কোনো কারণ আছে? আমার ইনকাম নাই। পরিবারে আমার কোনো দাম নাই। আমার কথা কেউ শুনে? আমাকে এতোগুলা মানুষের সামনে মা’র’তে আসলো। এটা না করে,আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে কয়েকটা জুতার বাড়ি দিত। তা না করে কি করল!”

মিথিলার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝড়ছে। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,” আমি কী চলে আসবো?”

ইমন তখনো রেগে আছে। শান্ত হচ্ছে না। মিথিলা পুনরায় বলল,” আপনি বাসায় আসেন। আমি আসতেছি।”

সোফায় বসেই কথা বলছিল। ঘরে আর যাওয়া হলো না। মিথিলা পুনরায় বোরকা পরে মায়ের উদ্দেশে বলল,” তোমার মেয়ের কপালে সুখ কখনো ধরা দিবে না, মা!”

মেয়ের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে মিথিলার মা স্বমাীকে ফোন করলেন। খালি মুখে মেয়েকে বিদায় দিলেন না। ঘরে যা ছিল তা দিয়েই নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন। মিথিলার বাবা নিজেই মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানেও শাহানা বেগম নানান কথা শোনালেন।
ইমন বাড়ি ফিরলে খুব চিল্লাপাল্লা করল। মিথিলার বাবার উদ্দেশে বলল,” আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান। এই বাড়িতে আমি মোমের পুতুল। আমার কোনো দাম নেই। এখানে থাকলে এই মহিলার অত্যাচারে হয় আপনার মেয়ে ম’রে যাবে নয়তো আমি।”

মিথিলার বাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে গেলেন। উনি পারতেন মেয়ের সংসারে বাম হাত ঢোকাতে কিন্তু মেয়ের এতো বছরের সংসার জীবনের পরিসমাপ্তি চান না।

মিথিলার বাবা চলে গেলে শাহানা বেগম ভাইয়ের ছেলেদের ডাকলেন। তারা আসলে বললেন বিচার করতে। সবসময়ের মতো মিথিলার উপর দোষ আরোপ করে বিচার করা হলো। এতেকরে শাহানা বেগম খুশি হলেন।

ইমন বাবা মায়ের উদ্দেশে বলল, সে আগামীকাল সকালেই বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কথাটা শোনার পর শাহানা বেগম বিলাপ করতে থাকলেন। এতো নাটক করার কারণ মিথিলা বুঝতে পারল। যেহেতু তারা কক্সবাজার যাবে। টাকাপয়সার ব্যাপার। শ্বশুর বাড়ি থেকে দিতেই হবে। ইমনও বুঝলো। সে বলল, ” তোমাদের থেকে এক পয়সাও আমি নিব না।”
সত্যি সত্যিই ইমন একপয়সাও নেয়নি বাবার কাছ থেকে। মিথিলার শ্বশুর শাশুড়িও জোর করেনি। আচার, চকলেট আনার জন্য শুধুমাত্র দুই হাজার টাকা দিল।

মিথিলা কীসের আশায় শ্বশুর বাড়ি পড়ে আছে প্রশ্ন করা হলে বলা যাবে, স্বামীর জন্যই পড়ে আছে। আর যাইহোক ইমন কখনো মিথিলার গায়ে হাত তুলেনি। মিথিলাকে শেষ সময়ে পাশে থেকেছে। আজকে ইমনের জন্য খুব খারাপ লাগছে। আগামীকাল তারসাথে কী হবে ইমনই জানে।

চলবে………………..