প্রেমে পরা বারণ পর্ব-১৩

0
41

#প্রেমে_পরা_বারণ
পর্ব -১৩
#Nosrat_Monisha

অজ্ঞান অর্কর রক্তাক্ত মাথাটা নিজের কোলে রেখে গাড়িতে বসে অঝোরে কাঁদছে নির্জনা। আর একটু হলেই তার জন্য আরও একটি প্রাণ ঝরে যেতো। তাছাড়া এই কয়েক দিনেই অর্কর সাথে সে অদৃশ্য এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। বিহানের পর যদি সে অর্ককেও হারিয়ে ফেলতো তবে? এসব কথা ভেবে নিজের বুকটা কেঁপে উঠছে নির্জনার।
জাফর সিদ্দিকী ভাবতেই পারে নি রুহান এতদূর যেতে পারে। ভেবেছিলেন বিহান নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তাই রুহান এসব করেছে। কিন্তু একটা মেয়ের জন্য সে মন্ত্রীর ছেলের গায়ে হাত দেবে সেই কথা তার কল্পনাতেও কখনো আসেনি। কিন্তু এখন তার মাথা গরম করলে চলবে না। সামনে ইলেকশন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও তিনি তমিজউদদীন খন্দকারের কাছ থেকে আরও ফান্ড যোগাড় করেছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে এবারও তার মন্ত্রী পদ এবং অর্ণবের জন্য এমপিট সিট নিশ্চিত। আর একবার ইলেকশনটা হয়ে গেলেই তিনি রুহান খন্দকারকে দেখে নিবেন। নিজের ছেলের গায়ে হাত তোলা ব্যক্তিকে তিনি এত সহজে ছেড়ে দেবেন না।
এদিকে অর্ক আর নির্জনাকে গাড়িতে তোলার পর থেকে মাহেরের মনটা অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু তিনি কোন কিছুই বলতেও পারছে না কারণ সে জাফর সিদ্দিকীর বেতনভুক্ত কর্মচারী মাত্র।
কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে জাফর সিদ্দিকীই বললেন,
–বাড়িতে সবাইকে যা বলার আমি বলবো তোমরা দুজন চুপ থাকবে। অর্ক মনে রাখতে পারবে না সে কাকে দেখেছে। আর মনে রাখলেই বা রুহান খন্দকার তাকে কিডন্যাপ করেছে এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই তোমাদের দুজনকেই কথাটা বলছি, রুহান খন্দকার এই কাজ করেছে সেটা যেন কেউ জানতে না পারে।
নির্জনে জানতো এরকম একটা কিছুই হবে তাই সে চুপচাপ রইলো। অর্কর তখনো কিছু কিছু জ্ঞান আছে।
সে বাবার এসব কথা শুনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়ে মনে মনে বলে,
–এখনো মিথ্যা বলবে বাবা? তোমার কাছে নিজের সন্তানের চেয়ে রাজনীতি বড়ো? আজ মনে হচ্ছে আমার পাগল সেজে থাকার সিদ্ধান্তটাই সঠিক।

কিন্তু মাহের এসব সহ্য না করতে পেরে বলে,
–স্যার, আমি তো বুঝতেই পারছি না কিডন্যাপার যখন পরিচিত তখন আগেই তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেন নি কেন? তাছাড়া তাকে ঠিকমতো মাইর না দিয়ে, শুধুমাত্র স্প্রে করে অজ্ঞান করার অর্ডার কেন দিলেন?

জাফর সিদ্দিকী কাঠখোট্টা গলায় বলে,
–সেসব তোমার না জানলেও চলবে। তোমাকে যতটুকু বলা হয়েছে তুমি শুধু ততটুকু করবে। রুহান খন্দকার আবার ওদের উপর অ্যাটাক করতে পারে, তাই তুমি যেকোনো মূল্যে ওদের প্রটেক্ট করবে। কিন্তু খেয়াল রাখবে যাতে রুহানের কোনো ক্ষতি না হয় ।
নির্লিপ্ত গলায় মাহের বলে,
–তাহলে স্যার আমার স্যালারি বাড়াতে হবে।

–তুমি এমনিতেই বাড়তি স্যালারিতে কাজ করছো।

তাচ্ছিল্যের সাথে মাহের বলে,
–আমি কাজ করছি বডিগার্ড হিসেবে। আমার কাজ হলো,আমি যার বডিগার্ড তার শত্রুরা তার উপর কোন অ্যাটাক করলে তাদেরকে মেরে ফেলা অথবা পুলিশে দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখানে নিজের বসকেও বাঁচাতে হবে আবার তার শত্রুকেও বাঁচাতে হবে। এটাতে রিস্ক বেশি তাই স্যালারিও বেশি ।

এজন্য আজকালকার ছেলে-মেয়েদের জাফর সিদ্দিকী দেখতে পারেন না। সব কিছুতেই নিজের স্বার্থ খুঁজে। আগে হলে তিনি এই অফার রিজেক্ট করে দিতেন কিন্তু আজ মাহেরের ফাইটিং স্কিল দেখার পর তিনিও বিশ্বাস করেন মাহের বেস্ট। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
–ওকে ডান। অ্যামাউন্টটা এসএমএস করে দিও তোমার একাউন্টে পৌঁছে যাবে।


রুহানকে আবার খন্দকার ম্যানসনে নিয়ে আসা হয়েছে।
মাইমুনা খন্দকার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
–কি হলো?
–যা হওয়ার তাই হয়েছে, আর একটু হলে তোমার ছেলে আবারও একটা মার্ডার কেস মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরতো। তুমি ভাবতেও পারবে না, কেমন অমানুষ তৈরি হয়েছে? একটা মেন্টালি সিক ছেলেকে খুন করতে যাচ্ছিলো।
মাইমুনা খন্দকার অবিশ্বাসের সাথে বলেন,
–অসম্ভব। আমার ছেলে এমন কাজ করতে পারে না।
–আমিও তাই ভেবে ওর শর্তে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু বাদ দাও। তুমি ভাবতে পারছো, আজ যদি আমি ওর উপর নজর না রেখে সঠিক সময়ে জাফর সিদ্দিকীকে ইনফর্ম না করতাম আর তিনি যদি সঠিক সময়ে বডিগার্ড না পাঠাতো তবে কি হতো? আরে তুমি জানো না তোমার ছেলে ঐ অসুস্থ ছেলেটাকে কিভাবে পিটিয়েছে। তবুও তার অন্যায়ের সাজা না দিয়ে তাকে অক্ষত বাড়ি ফেরানোর জন্য জাফর সিদ্দিকীর সাথে ডিল করেছি।(একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) দিন দিন এই ছেলে আমাকে কতো নিচে নামাচ্ছে তুমি ভাবতেও পারবে না।


অর্ককে হাসপাতালে থেকে ড্রেসিং করিয়ে বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। মাহেরকে দেখে সবার মনে সন্দেহ জাগলেও জাফর সিদ্দিকী সবাইকে বলেছেন সে এখন থেকে নির্জনা আর অর্কর বডিগার্ড হিসেবে এ বাড়িতেই থাকবে।
ডা. প্রীতিকে উদ্দেশ্য করে অর্ণব বলে,
– আপনি অর্কর সাথে কাল একটু কথা বলবেন। আমার মনে হয় ওর কাউন্সিলিংয়ের দরকার অনেক বড় শক পেয়েছে। (আরশিকে উদ্দেশ্য করে)তুমি তোমার ভাই-ভাবিকে ঘরে নিয়ে যাও। তাদের রেস্টের প্রয়োজন।

কিন্তু আরশির কান দিয়ে কোন কথাই প্রবেশ করলো না। সে তো এক দৃষ্টিতে হাঁ করে মাহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের বোনকে তাদেরই বেতনভুক্ত কর্মচারীর দিকে এভাবে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ অস্বস্তি হয় অর্ণবের। তাই সে জোরে ধমকে উঠে,
–আরশি!
আরশি এবার চমকে উঠে।
–জ্..জ্বি-হ্যাঁ ভাইয়া? আমাকে কিছু বলেছো?
অর্ণব নিজের মেজাজটাকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করে দাঁত কটমট করে বলে,
–অর্ক আর নির্জনাকে তাদের ঘরে যেতে হেল্প করো।
ভাইয়ের রাগটা আরশি বুঝতে না পেরে মাহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আপনি একটু অর্ককে ধরে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন?
এবার কোন কারণ ছাড়াই অর্কর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে রাগে ফুঁস ফুঁস করে বলে,
–কারও সাহায্য লাগবে না আমি একাই যেতে পারবো।
এরপর সে পা খুঁড়াতে খুঁড়াতে নিজের ঘরে দিকে চলে গেলে তার পিছু নির্জনাও যায়।
তারা চলে যেতেই আরশি বলে,
–ওরা তো নিজেরাই চলে গেছে। (মাহেরকে উদ্দেশ্য করে) আপনি আমার সাথে আসুন আমি আপনাকে থাকবার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।
মাহের কিছু বলার আগেই অর্ণব গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–বডিগার্ড মাহেরকে ঘর দেখানোর লোকের এই বাড়িতে অভাব নেই, তুমি নিজের ঘরে যাও।
অর্ণবের কন্ঠ শুনে আরশি একটা শুকনো ঢোক গিলে সেখান থেকে কোনমতে পালিয়ে যায়। অর্ণব একটা মেইডকে ডেকে বলে,
–উনাকে আউট হাউজে একটা রুম খুলে দাও।
এই কথার মাধ্যমেই মাহের বুঝতে পারে,অর্ণব তাকে প্রথম দিনই তাকে তার যোগ্য অবস্থান বুঝিয়ে দিতে চাইছে। তাই সে চুপচাপ সেখান থেকে চলে যায়।
সবাই চলে যেতেই অর্ণব নিজের বাবার মুখোমুখি দাঁড়ায়৷
ডা. প্রীতির তখনকার কথা আর এখন বডিগার্ড এইসকল কিছু মিলিয়ে অর্ণব এবার নিজের বাবাকে সরাসরি প্রশ্ন করে,
–তুমি কি লুকাচ্ছো বাবা?
জাফর সিদ্দিকী নিজের দুর্বলতা ঢাকতে গর্জে উঠে,
–কি বলতে চাইছো তুমি? কি লুকাবো?
–সে তুমি ভালো জানো। আমার মনে শুধু শুধু প্রশ্ন জাগে নি। সত্যি করে বলো, তুমি কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করনি তো?
নিজের চোখ-মুখ শক্ত করে জাফর সিদ্দিকী বলেন,
– তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি জাফর সিদ্দিকী যে কি-না কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না।

অর্ণব মুচকি হেসে বলে,
–তাই যেন হয়। কারণ তুমি যদি অন্যায়ের সাথে আপোষ করো আর তা যদি আমি জানতে পারি, তবে তোমাকে শাস্তি দিতে আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না।
–তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছো।
–নাহ সাবধান করছি।


রাতটা সবার অস্থিরতা আর ক্লান্তিতে কাটে।
পরদিন সকাল সকাল ডা.প্রীতি অর্ককে নিয়ে কাউন্সিলিংয়ের জন্য বসেছে। কাউন্সিলিং শুরু করার পর থেকে অর্ক একটা কথাও বলে নি। ডা.প্রীতি অনেকক্ষণ কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে করতে ক্লান্ত। একে তো সে বুঝতে পারে যে জাফর সিদ্দিকী কিছু লুকচ্ছে, তার উপর গতদিন অর্ণবের করা অপমান, এখন আবার অর্কর নিরবতা সব মিলিয়ে সেও মেজাজ হারাচ্ছে। শেষমেশ রেগে সে অর্ককে বলে,
–যা খুশি তাই করো। কিচ্ছু বলতে হবে না আমাকে। আমিও আর এখানে থাকবো না। উঠতে বসতে তোমার ভাই আমাকে অপমান করে আমি চলে যাবো।
ডা.প্রীতিকে এভাবে রাগতে অর্ক কখনোই দেখেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলে,
–তুমি বিহানের ছবি দেখেছো প্রীতি?
–বিহান! ও-হ্যাঁ তোমার বউয়ের এক্স। নির্জনার ফোনে তো আমরা সবাই সেদিন দেখলাম, কি সুন্দর একটা ছেলে। আহারে অকালে প্রাণটা হারালো। কিন্তু কেন?
–প্রথমে ভেবেছিলাম নির্জনার এক্স বিহান সে কোন এভারেজ একটা ছেলে হবে মানে প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোটখাটো চাকরি করে সংসার চালায় দেখতে আর কতো ভালো হবে? কিন্তু নির্জনার ফোনে ছবি দেখে মনে হলো বাংলাদেশে আমার ভাই ছাড়াও হ্যান্ডসাম ছেলে আছে৷

নাক কুচকে ডা.প্রীতি বলে,
– তোমার ঐ তারছেঁড়া ভাইয়ের চেয়ে বিহান অনেক হ্যান্ডসাম। তাতে তোমার সমস্যা কি?

–তেমন কিছু না। সমস্যা হলো আমার বউয়ের জীবনে যত পুরুষ মানুষ আছে সবাই সুদর্শন।
–মানে?
একরাশ হতাশা নিয়ে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অর্ক বলে,
–মানে তোমাকে কিভাবে বুঝাই? তার এক্স শাহরুখ খানের মতো, তার ভাসুর হলো ক্যাপ্টেন আমেরিকার মতো, ভেবেছিলাম ভিলেনটা অন্তত অমরেশ পুরির মতো হবে কিন্তু সেটা তো আরও এক কাঠি উপরে তারে দেখলে বোঝাই যায় না সে বাঙালি না এ্যারাবিক। আর তার টাকা আর পাওয়ারের কথাতো ছেড়েই দিলাম। তবুও ভাবলাম যাই হোক ভিলেনের সাথে ফাইট করে আমি নায়িকাকে ইমপ্রেস করবো কিন্তু ঐ শয়তানটা তার সব সাঙ্গ-পাঙ্গ আমার উপর ছেড়ে দিলো। এটা কোন কথা? আমি কি সাউথের এ্যাকশন হিরো না-কি? এতগুলো লোককে ডিফ্যান্ড করবো। তাই ভাবলাম এতগুলো লোকেকে মারার চেয়ে মাইর খেয়ে বউয়ের সিমপ্যাথি আদায় করা বেস্ট আর সহজ হবে। কারণ আমার বাপ তো তার লোক লস্কর দিয়ে আমাকে বাঁচাবেই। কিন্তু আমার বাপ আমার সেই আশায় এক বালতি পানি ঢেলে ঋত্বিক রোশানের মতো এক বডিগার্ড পাঠিয়েলো, যে-কিনা একাই সবাইকে কাবু করে ফেললো। আমার বাপে আমার জীবনটা তামা তামা করে দিছে। বিয়ে করিয়ে এমন এক মেয়েকে আনছে যার জীবনে তার নিজের হাসবেন্ড মানে আমি ছাড়া সবাই হ্যান্ডসাম।

––চলবে?