#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat _Monisha
পর্ব-২০
আরশির কাছে গিয়ে মাহের অস্থিরভাবে তাকে ঝাঁকি দিতে থাকে।
–আরশি…আরশি.. এই.. আরশি.. আপনি উঠছেন না কেন? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
মিনিট দুই পর আরশি পিটপিট করে চোখ খুলে বলে,
–এত জোরে ঝাঁকি দিলে আমার হাড়গোড় ভেঙ্গে যাবে। সমান্য লেগেছে। আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না।
মাহেরের চেহারা দেখলে যে কেউ বলতে পারবে সে ততটা স্বস্তি পেয়েছে যতটা স্বস্তি মানুষ নিজের প্রাণপাখি ফিরে পেলে পায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরশিকে ফুটপাতের সাথে থাকা একটি দোকানে ধরে ধরে বসিয়ে বলে,
–আপনি এখানে বসুন আমি দেখছি ওখানে কি হয়েছে।
–আমি এখন ঠিক আছি। আমিও যাবো।
–এই মেয়ে এতো বেশি কথা বুঝো কেন? চুপচাপ বসো নাহলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। খুব বেশি জেদ হয়েছে তোমার।
ধমকের স্বরে কথাগুলো বলে মাহের রাস্তা পার হওয়ার জন্য রওনা হলো। অন্যদিকে আরশি অবাক হয়ে মাহের দিকে তাকিয়ে রইল কারণ মাহের প্রথমবার তাকে তুমি বলে ডেকেছে। তার বুকে মৃদু কম্পন হচ্ছে।
মাহের মাঝ রাস্তায় গিয়ে আবার ফেরত এলো। তবে সে আরশির কাছে না গিয়ে পাশেরই একটা দোকানে গেল। সেখান থেকে কিছু চকলেট, চিপস,আইসক্রিম আর পানি আরশির হাতে ধরিয়ে বলে,
–একদম লাফালাফি করবে না।
এরপর দ্বিগুণ গতিতে রাস্তা পার হয়ে গেল। আরশি খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
–কি করে জানলো এগুলো আমার ফেবারিট।
।
।
এদিকে কাঁপা পায়ে অর্কর নিঃশ্বাস পরীক্ষার জন্য সামনে এগিয়ে যায় নির্জনা। কিন্তু তার চোখ রক্তমাখা ছুরির দিকে পরতেই আগে সেটা ধরে। সাথে সাথে অর্ক বেদনায় কাতরে ওঠে,
–মা..গো..
–অর্ক, তুমি ঠিক আছো?
অস্থির হয়ে বলে ওঠে নির্জনা।
অর্ক কিছু না বলে চুপচাপ নির্জনার হাতে বিহানের লকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–সরি ধস্তাধস্তিতে একটু ছিঁড়ে গেছে।
অর্ককে কথা বলতে দেখে ভিড়ের মানুষ জন নানা পরামর্শ দিয়ে জায়গা খালি করে দেয়।
–কি হলো নাও। সরি আমি বুঝতে পারি নি কিভাবে ছিঁড়ে গেলো। আমি কথা দিচ্ছি ঠিক করে দিবো।
নির্জনা বুঝতে পারে এই লকেটটার জন্য অর্ক নিজের জীবন বাজি রেখেছে। রাগে-দুঃখে সে লকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে,
–লাগবে না আমার লকেট। কে বলেছে তোমাকে এই লকেট ফিরিয়ে আনতে? আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো?
অর্ক সামান্য হেসে উঠে বসে দেখে লকেটটা একটু দূরে পরে আছে সে হাত দিয়ে লকেটটা এনে বলে,
–কিছু হয়নি সামান্য একটু কেটে গেছে। তুমি এতো ভেবো না।
( লকেটটা নির্জনার হাতে দিয়ে) তোমার এই লকেটটার জন্য ওই লোকটা আমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে আর তুমি এটা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছো?
নির্জনা কাঁদতে কাঁদতে অর্ককে জড়িয়ে ধরে বলে,
–এতো রিস্ক কেন নিলে?
অর্ক নির্জনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
–কারণ আমি জানি এই লকেটটা তোমার কাছে কত ইম্পরট্যান্ট।
নির্জনা অর্ককে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–লকেটটা ইম্পর্টেন্ট কিন্তু তোমার চেয়ে বেশি না । এটা জাস্ট একটা জিনিস। একটা গেলে আরেকটা পাওয়া যাবে, কিন্তু আজ তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো?
অর্ক খানিকটা অভিমান করে বলে,
–এটাতো বিহানের শেষ স্মৃতি ।
নির্জনা অর্ককে ছেড়ে নিজের চোখ মুছে বলে,
–ওটা স্মৃতি।আর স্মৃতি কোন জিনিসের সীমাবদ্ধ নয়। বিহান আমার মনে সময় থাকবে। তাকে মনে রাখার জন্য আমার কোন জড়বস্তুর প্রয়োজন নেই।
বলে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে কাটা জায়গাটা ধোয়া শুরু করে।
এদিকে অর্ক নির্জনার কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে মনে মনে বলে,
–দেখেছো বিহান, আজ নির্জনা আমার জন্য তোমার দেওয়া লকেট ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। নো অফেন্স ব্রো, তুমি খুব ভালো প্রেমিক কিন্তু আমার বউয়ের মনে থাকতে পারবে না। এমন একদিন আসবে যখন নির্জনা তোমার স্মৃতি ভুলে আমাকে আপন করে নিবে। আমি জানি তুমি যেখানেই আছো তুমি এটাই চাও।
তখনই মাহের তাদের কাছে পৌঁছায়।
–এসব কি করে হলো? ম্যাম আপনারা ঠিক আছেন?
নির্জনা মাথা নাড়িয়ে না করে বলে,
–ছিনতাইকারী এসেছিল, আমার গলার লকেট নিয়ে দৌড় দিয়েছিল, ওটার পিছু করতেই অর্ককে ছুরি মেরে পালিয়েছে। খুব বেশি কাটেনি কিন্তু অনেক বেশি ব্লিডিং হয়েছে। ওকে একটু ধরুন হাসপাতালে যেতে হবে।
মাহের ক্ষতটা পরীক্ষা করে বলে,
–হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই রাস্তার ওপাশে আমি একটা ফার্মেসি দেখেছি আমি ফার্স্টেড করে দিচ্ছি।
অর্ক নির্জনা আর মাহের রাস্তার অপর পাশে এসে দেখে আরশি বসে আইসক্রিম খাচ্ছে।
অর্কর রক্তাক্ত শার্ট দেখতে ভয়ে আরশি আইসক্রিম ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু এক্সিডেন্টে পা মচকে যাওয়ার দরুন ব্যাথায় কেঁদে ওঠে।
মাহের অর্ককে ছেড়ে আরশিকে ধমকে উঠে,
–বলেছিলাম না, বেশি লাফালাফি না করতে।
এরপর তাকে চেয়ারে বসিয়ে নির্জনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–ম্যাম আপনারা বসুন আমি ফার্স্টেড কিট নিয়ে আসছি।
নির্জনার মুখে আরশি সমস্ত ঘটনা জানতে পারে। আবার তার সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাও নির্জনাকে বলে।
এদিকে আরশি এক্সিডেন্ট করতে যাচ্ছিল এটা শুনে অর্ক ধমকে উঠে,
–দেখে রাস্তা পার হতে পারো না? আর বডিগার্ড কই ছিল? এই তার দায়িত্ববোধ?
আরশি অর্ককে থামিয়ে বলে,
–আহা তুমি শুধু শুধু এরকম করছ। উনার কোন দোষ নেই আমি জেদ করে
আবারও অর্ক ধমকে উঠে,
–কেন জেদ করবে? এখনো কি বাচ্চা আছো নাকি? বোধ বুদ্ধি কিছু নেই ? দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছ?
অর্কর এমন ব্যবহারে নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায় নির্জনার। সারাদিন নির্জনাকে বিরক্ত করতো কিন্তু সে যদি সামান্য ব্যথা পেত তাহলে সেই ভাইই সারা বাড়ি মাথায় তুলতো।
–হালকা মচকে গেছে আপনার ব্যান্ডেজ করে উনার পা-টাও বেঁধে দেবো তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।
পেছন থেকে মাহের জবাব দেয়।
মাহেরের কথায় অর্ক দ্বিমত প্রকাশ করে বলে,
–আগে ওকে দেখুন। আমার মনে হয় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে যদি অন্য কোথাও কোন সমস্যা হয়ে থাকে। এত বড় একটা এক্সিডেন্ট ।
মাহের অর্কর কথায় মৃদু হেসে দেয়। কারণ এই সেই অর্ক যে ছুরিতে আঘাতের পরেও কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, কিন্তু বোনের সামান্য পা মচকানোতে সে হসপিটালে যেতে চাইছে। ভাই বোনের সম্পর্ক গুলো এমনই হয় সে নিজেও তো বোনের জন্য..বোনের কথা মনে পরতেই কিছুক্ষণ পূর্বে আরশির সাথে তার করা ব্যবহার মনে পরে। সে মনে মনে বলে,
–মাহের হুদা আবার ভুল করতে যাচ্ছিলে। ভুলে যেও না এখন তোমার প্রায়োরিটি কে।
কিন্তু মাহেরে ভাবনায় ছেদ পড়ে আরশির গলায়,
–মোটেও না আমার কিছুই হয়নি। আগে তোমাকে ব্যান্ডেজ করবে ইস কত রক্ত বেরিয়ে গেছে।
–হোক সে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আগে তোমার চিকিৎসা হবে।
অর্ক এখন আর বাচ্চাদের মত কথা বলছে না। বোনের ব্যথা দেখে তার বাচ্চামো সম্পূর্ণ উবে গেছে। নির্জন আর মাহের যদি চিন্তার জগতে মগ্ন না থাকতো তবে অর্কর অভিনয় আছে ধরা পরতো।
অতঃপর অনেক তর্ক বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হয় রাতের মধ্যে পা ঠিক না হলে আরশি ডাক্তারের কাছে যাবে।
মাহের আরশির পায়ে হেঁচকা একটা টান দিয়ে মচকানো পা-খানি সোজা করে বেঁধে দেয়।
যদিও বাসা খুব বেশি দূরে না তবুও তারা উবার কল করে।
আরশি ভেবেছিল মাহের তার সাথে আরও একটু কথা বলবে কিন্তু তার সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে পুরোটা রাস্তায় সে চুপচাপ রইল, একবার তার দিকে ফিরেও তাকালো না। শুধু তাই নয় পায়ে ব্যান্ডেজ করার সময় এমন ভাবে ব্যান্ডেজ করলো যেন ডাক্তার অচেনা নতুন রোগীকে ব্যান্ডেজ করছে।
।
।
আরশি ভেবেছিলো মাহের তাকে কোলে তুলে বাসায় যাবে কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে মাহের আগে আগে জহুরা মঞ্জিলে প্রবেশ করে।
যা দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে আরশি বলে,
–খালি দেখতে হ্যান্ডসাম আর কিছু না। আনরোমান্টিক ব্যাটা।
অন্যদিকে অর্কর হাতটা খুব শক্ত করে ধরে জহুরা মঞ্জিলে প্রবেশ করে নির্জনা। আরশি বাধ্য হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবার পেছনে আসে।
কিন্তু ভেতরে পা-রাখতেই নির্জনার হাতটা অর্কর হাত থেকে আলগা হয়ে যায়।
নির্জনার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বের হয়,
–বিহান!
এতক্ষণ সানন্দে নিজের স্ত্রীর হাত ধরে থাকা অর্ক নির্জনার মুখে বিহানের নাম শুনে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায়। আর তার চোখের সামনে চারটি চেহারা ভেসে উঠে।
ডা.প্রীতি, রুহান, নির্জনার মা, আর বিহান যার ছবি সে দেখেছিলো নির্জনার ফোনে।
রুহানের চেহারায় গজদন্তের বাঁকা শয়তানি হাসি জ্বলজ্বল করছে।
#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-২১
বিহান বেঁচে আছে। যেমন এর আনন্দময় অনুভূতি নির্জনার জীবনে আর আসে নি,ঠিক তেমনি এরচেয়ে বেশি হারিয়ে ফেলার বেদনা অর্ক কখনো পায় নি। কিছু সময় আগেও যাকে নিয়ে ভালবাসার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিলো এখন অর্কর জন্য তার প্রেমে পরাও বারণ হয়ে গেছে। নিজের ভাইয়ের কষ্টটা বেশ ভালো অনুভব করতে পারছে আরশি।
অন্যদিকে রুহান নির্জনাকে সব কিছু ব্যাখ্যা করছে।
–আমি সাইকোপ্যাথ, দুনিয়ার নিকৃষ্টতম মানুষ কিন্তু খুনি না। তোমার বাবা-ভাই সত্যিই অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। তোমার সুযোগসন্ধানী চাচারা তোমাদের ভয় দেখানোর জন্য আমার উপর ফলস এলীগেসন লাগিয়েছে। আমি সব প্রমাণ তোমার মাকে দিয়েছি বিশ্বাস না-হয় পরে দেখে নিও।
নির্জনে পাপিয়া আক্তারের দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
রুহান আবার বলে,
–বিহানের সাথে আমার শত্রুতা ছিল শুধু তোমার জন্য কিন্তু কাউকে মেরে ফেলবো এমন মানুষ আমি না। হ্যাঁ সেদিন গুলি চালিয়েছিলাম কিন্তু তারপরে ওকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাও করেছি। তুমি আমাকে ভালোবাসবে এই আশায় বিহানকে আটকে রেখছিলাম। কিন্তু…যাই হোক আমি জানি আমি তোমার উপর অনেক অত্যাচার করেছি, তাই আমার কোন কাজই জাস্টিফাইড না। তবে তুমি নিজেও জানো তোমার জন্য আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। সেদিন যখন জানতে পারি তুমি আমাকে এতটা ঘৃণা করো যে, একটা মানসিক বিকারগ্রস্ত লোককে বিয়ে করে তার সংসার করতে রাজি আছো তবু আমাকে কখনোই ভালোবাসবে না। সত্যি বলতে তখনই আমার চোখ খুলে যায়। তাইতো তোমার কথা ভুলে আমি প্রীতিকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাই। নতুনভাবে শুরু করতে হলে পুরনো সব ভুলে যেতে হয়। তাই তোমার বিহানকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিলাম। আগামীকাল এনগেজমেন্ট, পরশু হলুদ তারপর দিন বিয়ে। আশা করি তোমরা সবাই আসবে। বাবা অলরেডি মি.সিদ্দিকীর কাছে ইনভিটেশন কার্ড পৌঁছে দিয়েছে। মি. বিহান আমি জানি সরি বললে কোন কিছু ঠিক হয় না তবু আই এ্যম সরি। আপনার সাথে যা কিছু করেছি তার জন্য আমি মাফ চাচ্ছি। আপনিও আসবেন। প্রীতি আই থিংক তুমি তোমার পেশেন্টের সাথে প্রাইভেটে কিছু বলতে চাও।
প্রীতি মাথা নাড়ায়।
রুহান মনে হাতের কালো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমাদের শপিংয়ে যেতে হবে তাড়াতাড়ি করবে।
এতক্ষণে সবার নজর অর্ক আর আরশির দিকে যায়।
তাদের হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে অর্ণব অস্থির হয়ে বলে,
–কি হয়েছে? এরকম হলো কিভাবে?
এই দুই ভাই বোন অর্ণবের প্রাণ।
এসব কিছুর মধ্যে অর্ণব একদম চুপ ছিলো। সে শুধু একটু পর পর প্রীতিকে দেখছিলো তাই তাদের দিকে চোখ যায় নি। কিন্তু প্রীতি অর্কর কথা বলতেই সে খেয়াল করে অর্ক আর আরশির এই অবস্থা দেখে। তার মনে হয় কেউ তার কলিজায় আঘাত করেছে।
আরো অস্থির সে হয়ে বলে,
–কি হল কথা বলছো না কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও কে করেছে এসব? আর এই যে বডিগার্ড আপনি কোথায় ছিলেন?
মাহের কিছু বলবে তার আগেই অর্ক বলে,
–ও কিছু না ভাইয়া। আমি আর আরশি রাস্তায় ঝগড়া করতে গিয়ে স্লিপ কেটে পরে গেছি। হালকা একটু কেটেছে মিস্টার মাহের ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে তুমি চিন্তা করো না।
জোরে ধমকে উঠে অর্ণব
–রাস্তাঘাটে ঝগড়া করো আর আরশি তুমি কি ছোট মানুষ? যে ওর সাথে ঝগড়া করছিলে।
আরশি কাঁচুমাচু মুখে বলে,
–ভাইয়া আমি
অর্ক আবার বাধা দিয়ে বলে,
–আরশির কোন দোষ নেই ভাইয়া, আমিই ওকে মারছিলাম। তুমি ওকে একটু ঘরে দিয়ে আসো।
এরপর সে আর ডা.প্রীতিকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
অর্ণব সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরশিকে সোফায় বসিয়ে পা দেখতে থাকে। যেন এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। আরশিকে যে দুই ভাই কতো ভালোবাসা সেটা মাহের প্রতিমুহূর্তে বুঝতে পারছে।
–উনি ঠিক আছেন সামান্য মচকে গেছে আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি।
মাহেরের বলা কথায় অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় অর্ণব তারপর বলে,
–you are not a doctor right. So keep your mouth shut.
আপনি এখন ঘরে যেতে পারেন। এখানে আমাদের ফ্যামেলি ম্যাটার নিয়ে কথাবার্তা চলছে এখানে আপনার না থাকাই ভালো।
মাহের মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে যায়।
অর্ণব একটা মেইডকে ইশারা করে আরশিকে ঘরে দিয়ে আসতে।
অর্ণব বেশ বিচক্ষণ, যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। তাই এই মুহূর্তে বাড়ির বউয়ের কেলেঙ্কারি নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চাইছে না। তাছাড়া জাফর সিদ্দিকী নির্বাচনী এলাকায় যাওয়াতে সেখানে ছিলোই না।
ভাইয়ের বউয়ের প্রাক্তন প্রেমিক,স্টকার সবকিছু একসাথে এসে ভিড় করেছে কিছুদিন আগে হলেও অর্ণব এদের কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিত না কিন্তু প্রীতিকে ভালোবাসার পর থেকে ভালোবাসা সম্পর্কে তার মতাদর্শ অনেক বদলে গেছে। এটা সে বেশ ভালোই বুঝতে পারে বড়সড় একটা ঝড় আসতে চলেছে। কারন সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার সেটা তো নির্জনাই নিবে ।
তাই একজন মেইডকে ডেকে বলে,
–গেস্টরুমগুলো ক্লিন করা আছে?
–জ্বি স্যার।
– মি.বিহান আর আন্টির জন্য দুটো খুলে দাও। আপনারা এখন রেস্ট করুন কাল বাবা এলে সব কথা হবে।
বিহান এ নিয়ে আপত্তি করে বলে,
–আমার বাসা খুব বেশি দূরে নয়। আমি বরং আজ
কিন্তু তাকে মাঝ পথে থামিয়ে অর্ণব বলে,
–প্লিজ আমি রিকোয়েস্ট করছি আজকে রাতটা অত্যন্ত থাকুন তারপর ডিসিশন নেয়া যাবে।
নির্জনা অর্ণবের কথায় সায় দেয়।
–ভাইয়া ঠিক বলেছে। মা চলো আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
বলে বিহান আর পাপিয়া আক্তারকে নিয়ে নির্জনার সে স্থান ত্যাগ করে। কিন্তু যাবার আগে একবারও রুহানের দিকে তাকায়নি।
অর্ণব একটা মেইডকে ইশারা করে বলে,
–স্যারের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো আমি ঘরে যাচ্ছি। মিস্টার খন্দকার আশাকরি আপনি কিছুটা সময় এখানে অপেক্ষা করতে রাজি আছেন । কি বলুনতো আমার অনলাইনে একটু কাজ আছে না হলে আপনার সাথে বসতাম।
কিন্তু সত্য তো এটাই যে অর্ণব মোটেও রুহানের সাথে বসতে চাইছে না। কারণ যতই লোকটা বলুক সে ভালো হয়ে গেছে অর্ণবের মনে কোথাও একটা খটকা লাগছে।
রুহান মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
–ডোন্ট ওরি মিস্টার সিদ্দিকী আই উইল বি ওকে।
।
।
–রুহানকে বিয়ে করো না।
অর্কর ক্ষতটা চেক করার সময় তার মুখ থেকে এই শব্দগুলো শুনে ডা.প্রীতির হাত থেমে যায়। সে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে,
–কেন?
–তুমি সবটা জানার পরেও এ কথা বলছ তুমি জানো না ও নির্জনার সাথে
ডা.প্রীতি স্বাভাবিক গলায় বলে,
–আমি সবটা জানি। ইনফ্যানক্ট রুহানই আমাকে সব বলেছে।
–তাহলে?
–অর্ক, রুহান নির্জনের সাথে যা করেছে সেটা অবশ্যই অন্যায় তবে সে যা ঘটেছে সেটা অতীতে ঘটেছে। রুহান এখন নির্জনাকে ভোলার চেষ্টা করছে।
–মিথ্যে, সে নিশ্চয়ই আবার কোন প্ল্যান করছে এটা তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে কেন বুঝতে পারছে না?
–অর্ক, আমি এখানে আমার পার্সোনাল ম্যাটার নিয়ে ডিসকাস করতে আসিনি। আমি এখানে ডিসকাস করতে এসেছি তোমার ব্যাপার নিয়ে। তুমি কি করবে বলে ঠিক করেছ?
অর্ক ভ্রুকুটি করে বলে,
–কোন ব্যাপার?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নির্জনা বলে,
–আর কতদিন পাগল সেজে থাকবে?
কিছু সময় আগে হলেও অর্ক বলতো, আর মাত্র কয়েক দিন কিন্তু বিহানের ফিরে আসা সব উলট পালট করে দিয়েছে। সে-তো এটাই বুঝতে পারছে না এটা আদৌ বিহান কি-না। তাছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো রুহান । অর্ক আজ রুহানের চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে সে কোন একটা সাংঘাতিক প্ল্যান করছে। কিন্তু ডা. প্রীতিকে এ নিয়ে কিছু বলে লাভ নেই।
–এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার। আমি তোমার সাথে ডিসকাস করতে চাই না।
–অর্ক, আমি তোমার ভালোর জন্য
তাকে থামিয়ে অর্ক বলে,
–তুমি আর আমার ডাক্তার নও,সেই চাকরি তুমি ছেড়ে দিয়েছো সো আমার ভালো-মন্দ দেখার তোমার আর প্রয়োজন নেই।
এবার প্রীতির ইগো হার্ট হয়। সে বেশ দুঃখ পায়। সে কখনোই শুধু ডাক্তার ছিলো না। অর্কর সাথে তার সম্পর্কটা সবসময়ই বন্ধু, ভাই-বোনের মতো ছিলো। আজ অর্ক তাকে এতো বড় কথা বলল?
একপ্রকার অভিমান নিয়ে অর্কর ঘর থেকে বের হয়ে যায় ডা.প্রীতি।
।
।
অর্কর রুম হতে বের হবার সময় ডা.প্রীতির মুখোমুখি অর্ণব রাস্তা আগলে দাঁড়ায়। সাথে সাথে আড়ালে একটি ছায়ার আবির্ভাব হয়। কেউ এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যেখানে থেকে তাকে দেখা যায় না কিন্তু সে প্রীতি এবং অর্ণবকে দেখতে পাচ্ছে।
ডা. প্রীতি ভ্রুকুটি করে বলে,
– কিছু বলবেন?
– কেন করছেন এ বিয়ে?
– আর আমি আপনাকে এর জবাব কেন দিবো মি. সিদ্দিকী? আপনি আমার কে?
কথাটি বলার সাথে সাথে অর্ণব তাকে একটা পিলারের সাথে চেপে ধরে। অর্ণবের বলিষ্ঠ শরীরটাকে সরানোর অনেক চেষ্টা করে প্রীতি কিন্তু ব্যর্থ হয়৷
–এতো অহমিকা কি বড়লোক, হ্যান্ডসাম হাসবেন্ড পাবেন বলে?
প্রীতি রক্তচক্ষু করে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমি আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিবো না। আমাকে ছাড়ুন নাহলে এমন চেঁচাবো যে সবাই চলে আসবে।
প্রীতির কানের কাছের চুলগুলো সরিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–আমি কাউকে ভয় পাই না।
–পাওয়া উচিত। আমার ফিয়ান্সির পাওর সম্পর্কে আপনার কোন আইডিয়া নেই।
–টাকার গরম দেখাচ্ছেন।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে প্রীতি বলে,
–কেন এই অধিকার কি শুধু আপনার আর আপনার বাবারই আছে? ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম অসহায় মানুষকে ব্যবহার করা, ব্ল্যাকমেইল করা এগুলো আপনাদের বাপ-দাদার সম্পদ।
এবার প্রীতির বাঁধন কিছুটা হালকা করে অর্ণব বলে,
–এসব কি বলছেন আপনি? আমি কখন…
তখনই আচমকা অর্ণবকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়।
–লিসেন মি.সিদ্দিকী আর কোন দিন আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না। নাহলে আমার চেয়ে ভয়ংকর আর কেউ হবেনা।
এরপর হনহন অর্ণবের কোন কথা না শুনে ধুপধাপ দু’’পা ফেলে চলে যায়। সেই ছায়াটিও প্রীতির আগে সেখান থেকে সরে যায়।
।
বিহান আর পাপিয়া আক্তারকে নিয়ে নির্জনা একটা গেস্ট রুমে আসে।
বিহান খুব স্বাভাবিক গলায় বলে ,
–কেমন আছো অবুঝ বালিকা?
বহুদিন পর নিজের প্রিয় মানুষের গলা শুনতে পাচ্ছে নির্জনা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে সে বিহানকে দেখে খুব খুশি হয়েছে কিন্তু আজ তার মনে বিহানের জন্য কোন উথাল-পাথাল হচ্ছে না। বিহানের চোখে আজও সে ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু চাইলেও আগের মতো এই ভালোবাসার প্রেমে পরতে পারছে না কোন একটা অদৃশ্য দেয়াল তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সে-তো বিহানকে ভালোবাসে তাহলে এ দেয়াল কেন?
–আমি ভালো আছি । তুমি কেমন?
বিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–নিজের প্রাণ পাখিকে অন্য কারো সংসারে দেখলে কি আর ভালো থাকা যায় বলো?
নির্জনা নিজেও জানে কেন না বিহানের সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে কোন রকমে বলে,
–তুমি রেস্ট করো, আমি মায়ের সাথে যাই।
পাপিয়া আক্তার নির্জনার অস্বস্তির কথা বুঝতে পেরে বলে
–নির্জনা ঠিক বলেছে বিহান তুমি রেস্ট করো। আমরা কাল কথা বলবো।
।
।
–আর ইউ ওকে?
গাড়িতে বসে প্রীতির দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে রুহান।
–হুম।
–তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও।
প্রীতি একবার ভাবে রুহানকে অর্ণবের কথা বলবে কিন্তু পরক্ষণেই মনে করে এটা তেমন কিছু নয় তাই সে মাথা নাড়িয়ে না করে দেয় ।
।
খাবার টেবিলে সবাই চুপচাপ ছিলো তখন পাপিয়া আক্তার বলে,
–আপনারা কেউ কিছু মনে না করলে নির্জনা আজকে আমার সাথে থাকবে।
মায়ের সাথে মেয়ে থাকবে এখানে বাধা দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া পাপিয়া আক্তার যে অনুমতি চাইছে এমন না, তিনি সবাইকে শুধু বলছে, সেটা তার গলার আওয়াজেই বুঝা গেছে। বিহান ফিরে আসায় পাপিয়া আক্তারের মধ্যে একটা অদ্ভুত আত্নবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। অর্ণবের মন ভালো না থাকায় প্রতিউত্তর পারেনা। আর অর্ক বিহানকে নির্জনার আশেপাশে দেখে কেমন যেন ভেঙে পরেছে।
নির্জনাও ঠিক করেছে আজকের রাতটা মায়ের সাথে থাকবে । অনেক কথা জমে আছে নিজের ঘরে আসতে দেখে অর্ক ঘুমাচ্ছে। ফোনের চার্জার নিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে।
নির্জনা চলে যেতেই অর্ক উঠে বসে,
–তুমি বিহানকে এতটাই ভালোবাসো যে একবার জিজ্ঞেসও করলে না আমার শরীর এখন কেমন? তুমি যদি সত্যি মুক্তি চাও তবে কথা দিচ্ছি তোমাকে মুক্ত করে দিবো। কিন্তু আগে রুহান কি চায় সেটা আমাকে বের করতে হবে । আমি চাই তুমি যার সাথেই থাকো ভালো থাকো। সেখানে যাতে কারও কালোছায়া না পরে।
।
মাঝরাতে ফোনের রিংটোনে মুচকি হাসি ফুটে উঠে রুহানের ঠোঁটে।
সে ফোনটা কানে লাগিয়ে বলে,
–বলো অর্ক, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
অপর পাশ থেকে অর্কর গম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা যায়,
–তুমি কি জানতে আমি ফোন করবো?
রুহান অর্ক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে,
– কথা না ঘুরিয়ে পয়েন্টে আসো হঠাৎ এত রাতে আমাকে কেন ফোন দিলে?
অর্ক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– তুমি নতুন কি খেলা শুরু করেছো?সবচেয়ে বড় কথা ছেলেটা কে?
ভাবলেশহীন হয়ে রুহান প্রশ্ন করে,
–কোন ছেলে।
প্রচন্ড ক্রোধে অর্ক চিৎকার করে বলে যাকে,
– তুমি যাকে বিহান সাজিয়ে আমার আর নির্জনার মাঝখানে পাঠিয়েছো।
চলবে।