প্রেমে পরা বারণ পর্ব-২৫+২৬

0
147

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-২৫

বিয়ের কাবিননামায় সই হচ্ছে।


কিছু সময় পূর্বে,
আরশিকে নিজের স্ত্রীকে বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে জহুরা মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমে বসে থাকা প্রত্যেকের মাথায় বাজ পড়ে। মাহেরের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। এখন সে গতরাতে আরশির বিষন্ন কন্ঠের কারণ বুঝতে পারছে।

অর্কর দু’মিনিট সময় লাগলো রুহানের কথা বুঝতে। সাথে সাথে সে রুহানের দিকে তেড়ে যেতে নিলে রুহান আর তার মাঝে দাঁড়ায় আরশি।
রেগে অর্ক বলে,
–আরশি সরে যাও আজ এই জানোয়ারটাকে আমি ছাড়বো না
আরশি খুব ঠান্ডা গলায় বলে,
– অর্ক মাইন্ড ইউর টাং। হি ইজ মাই হাসবেন্ড।
যা শুনে অর্ণব তেড়ে এসে বলে,
–ফাজলামো পেয়েছো? তোমরা দুই ভাই-বোন মিলে বিয়েটাকে মজা বানিয়ে দিয়েছো। প্রথমে আমাকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করতে বাধ্য করলে। এখন বলছো নিজে একটা সাইকোপ্যাথকে বিয়ে করেছো। আমি এ বিয়ে মানি না। যাও ঘরে যাও এসব শাড়ি গয়না বদলে নিজের কাপড় পরে এসো।
অর্ণবের চোখে চোখ রেখে আরশি বলে,
–বিয়েটাতো হয়ে গেছে ভাইয়া। দুদিন আগেই না তুমি অর্ককে বলছিলে, আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়। আমার বিয়েটাও হয়ে গেছে।
অর্ণব কিছু বলবে তার আগেই রুহান আরশিকে উদ্দেশ্য কড়া গলায় বলে,
–আমি কি বলেছিলাম ভুলে গেছো? কারও সাথে কোন কথা বলা যাবে না। Get in the car.
আরশি মাথায় দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে নীরবে বের হয়ে যায়। আরশির এমন রোবটিক ব্যবহারে সবাই এতোটাই হতভম্ব ছিলো যে কেউ কিছু বলতেই পারলো না। কিন্তু মাহের সবার অলক্ষ্যে আরশির পিছু গেলো।
আরশি বের হয়ে গেলে রুহান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আপনাদের কাছে এখনো সময় আছে আমাকে সারা জীবন সহ্য করতে না চাইলে, (নির্জনার দিকে তাকিয়ে) আমার জিনিস আমাকে ফেরত দিয়ে দিন, নিজেদের মেয়েকে ফিরিয়ে আনুন।

অর্ক এবার আর ছাড়ে না সোজা একটা ঘুসি রুহানের মুখে বসিয়ে দেয়। এরকম অতর্কিত হামলায় রুহানকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে নিচে পরে যায়। আর অর্ক ক্রমাগত তাকে দু’হাতে ইচ্ছেমতো ঘুসি দিতে থাকে। খুব দ্রুত অর্ককে আটকে দেয় রুহান কিন্তু ততক্ষণে তার ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরেছে।
রুহানও অর্ককে পাল্টা আক্রমণ করে কিন্তু তাদের লড়াইয়ের মাঝখানে জাফর সিদ্দিকী বাঁধা দেয়।
–আল্লাহর দোহাই তোমারা থামো। অর্ণব তোমার ভাইকে থামাও। আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তে আমার মেয়ের জীবনটা উলটপালট হয়ে গেছে। অর্ক এসব করে নিজের বোনের জীবনে আর ঝামেলা বাড়িও না। ভুলে যেও না রুহান এখন তোমার বোনের স্বামী।
অর্ক থেমে যায়। রুহান আর অর্ক দুজনের উঠে দাঁড়ায়।
ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোঁটের কোণের রক্তটা মুছে শয়তানি হাসি দেয়।
–ফাইনালি এ বাড়িতে সামওয়ান ইন্টেলিজেন্ট।। (জাফর সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে) শ্বশুর মশাই আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি এখনো হয়নি। মেয়ের বাবা ছাড়া রেজিস্ট্রি করলে সারা জীবন আপনার মেয়ে আমার বাড়িতে কথা শুনবে। তাই শ্বশুর মশাই এক ঘন্টা পর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে চলে আসবেন। আর এই যে আমার দুই সম্বন্ধি আজ সন্ধ্যায় আমার বিয়ের রিসিপশন দাওয়াত রইলো।


আরশি বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বের হতেই মাহের তার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
–কিছু বলবেন মি.মাহের হুদা?
আরশির অনুভূতি শূন্য গলার আওয়াজে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় মাহেরের কিন্তু তার এটারই প্রপ্য ছিলো৷
–কেন করলেন এটা?
আরশি বোঝেও না বোঝার ভান ধরে বলে,
–কি করেছি আমি?
শক্ত করে আরশির দুবাহুতে চাপ দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে মাহের বলে,
–কেন করেছেন ঐ অমানুষটাকে বিয়ে? কেন নিজের জীবনটা নষ্ট করলেন?

মাহেরের হাতগুলো সরিয়ে দৃঢ়ভাবে আরশি বলে,
–আমাকে এসব প্রশ্ন করার আপনি কে?

মাহেরের এতো প্রশ্ন, এতো অস্থিরতা সব আরশির একটি প্রশ্নে থেমে যায়। সত্যিই তো সে আরশির কে? এক না বলা অপ্রকাশিত ভালবাসার কি আদৌ কোন নাম থাকে?
কথায় বলে, সময় গেলে সাধন হয় না। মাহেরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যে মানুষটা কাঙালের মতো তার কাছে এতদিন ভালবাসা ভিক্ষা চাইছিলো আজ সেই মানুষটার কাছে সে নিষিদ্ধ।

আরশি শান্ত গলায় বলে,
–আমার প্রশ্নের কোন উত্তর যেমন আপনার কাছে নেই, ঠিক তেমনই আপনার প্রশ্নেরও কোন উত্তর আমার কাছে নেই । তাই ভবিষ্যৎতে এমন প্রশ্ন করে আমকে বিব্রত করবেন না।
তারপর সে মাহেরকে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় পেছনে ফেলে গাড়ির দিকে চলে যায়।


রুহান আরশিকে নিয়ে চলে যায়।
জহুরা মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমে আবার বৈঠক চলছে যেখানে জাফর সিদ্দিকীর অনুরোধে মাহেরও উপস্থিত। অর্ক নিজের জবানবন্দি দিচ্ছে। প্রীতি আর নির্জনাকে বাঁচাতে গতকাল আরশি আর তার করা সমস্ত পরিকল্পনার কথা সবাইকে বলছে। যা শুনে প্রীতি বলে,
–কিন্তু আমি তো তোমার ভাইয়াকে ভালোবাসি না। আর আমি একথা আগেও বহুবার সেটা ক্লিয়ার করেছি।
প্রীতির কথা শুনে অর্ণবের কষ্ট হলেও সে সায় দিয়ে বলে,
–উনি সত্য বলছেন।
অর্ক অবাক হয়ে বলে,
–তাহলে আরশি মিথ্যা কেন বললো?
–রুহানের জন্য।
নির্জনার কথা শুনে সবাই তার দিকে প্রশ্নবোধক নজরে তাকায়।
নির্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–আমি রুহান খন্দকারকে চিনি। হি ইজ এ্যা মনস্টার। আমাকে পাওয়ার জন্য সে সবকিছু করেছে । এমনকি বিহানকে ফিরিয়ে এনেও ভালো সাজার চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয় নি। তাই আরশিকে ব্যবহার করছে যাতে অর্ক আমাকে ছেড়ে দেয়।
আপনারা তার কথা মেনে নিন আমাকে রুহানের হাতে তুলে..

কিন্তু নির্জনাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে অর্ক,
–ভুলেও কথা মুখে আনবে না।
নির্জনা নিজের মুখ থেকে অর্কর হাত সরিয়ে বলে,
–আপনি বুঝতে পারছেন না আরশির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে তাছাড়া আমার জন্য আপনারা কেন আরশির জীবন নষ্ট করবেন?

অর্ক নির্জনার কথার জবাব দেওয়ার আগেই জাফর সিদ্দিকী বলে,
–কারণ তুমি এ বাড়ির বউ। আমি জীবনে অনেক বড় ভুল করেছি আর না। এবার সব শোধরানোর সময় এসেছে। নিজের ছেলে-মেয়েদের ভালোর জন্য অন্যদের সাথে অন্যয় করেছি। প্রীতিকে আশ্বাস দিয়েছে অর্কর চিকিৎসার বদলে ওর ভাইকে খুঁজে দেবো কিন্তু কথা রাখিনি। অর্ক পাগল কখনো সুস্থ হবে না জেনেও অবস্থার সুযোগ নিয়ে তোমার সাথে তার বিয়ে দিয়েছি। (মাহেরকে উদ্দেশ্য করে) এই ছেলেটাকে শুধুমাত্র গরীব বলে তাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছি ব্ল্যাকমেইল করেছি যাতে সে আরশির ভালবাসাকে একসেপ্ট না করে। এসবই আমার কর্মফল যা আমার ছেলেমেয়ে ভোগ করছে। মাহেরের মতো অনেস্ট ছেলে নিয়ে আমার সমস্যা ছিলো অথচ আজ আমার মেয়ে একটা বড়লোক উন্মাদের বউ। আমি যেমন আমি নির্জনার অবস্থার সুযোগ নিয়েছিলাম রুহানও আরশির অবস্থার সুযোগ নিয়েছে। আমাকে তোমরা সবাই ক্ষমা করো।

পুরুষ মানুষ কাঁদে না কিন্তু বাবারা কাঁদে।তাই আজ জাফর সিদ্দিকীও কাঁদছে।

–কিন্তু এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো কোনো সমাধান হবে না। আমাদের ঐ পাগলটার হাত থেকে আরশিকে বাঁচাতে হবে।
মাহেরের কথায় সবাই সম্মতি দিলেও বাস্তবিক পক্ষে কারো কাছে এর কোন সমাধান ছিল না। কারণ আরশি নিজে বন্দী জীবন বেছে নিয়েছে। তাছাড়া খন্দকারদের টাকা আর ক্ষমতার কাছে এই মুহূর্তে এরা সবাই অসহায় । আর নির্জনাকে রুহানের হাতে তুলে দেওয়ার মতো অবিবেচকও কেউ নয়। তাই সবাই সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় রইলো।

এরই মধ্যে জাফর সিদ্দিকীর ফোনে তমিজউদদীন খন্দকারের ফোন আসে। ফোনটা রিসিভ করে দুই মিনিট কথা বলে লাইন কেটে তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
–আমি যাচ্ছি মেয়েটা যদি রাজি হয় আমার সাথে ফেরত আসে। আর না হলে বাবা হিসেবে মেয়ের মৃত্যুর দলিলে সই করবো।
–বাবা আমি যাবো।
অর্ণব আর অর্ক একসাথে বলে উঠে।
কিন্তু জাফর সিদ্দিকী তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলে,
–তমিজউদদীন খন্দকার স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তোমারা গেলে আমাকে ঢুকতে দিবেন না। তবে সন্ধ্যায় রিসিপশনে সবাইকে যেতে বলেছে।
–স্যার আমিও আপনার সাথে যেতে চাই। আপনার বডিগার্ড হিসেবে গেলে কেউ আপত্তি করবে না।
মাহেরের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাফর সিদ্দিকী তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
–তোমার কাছে মাফ চাইবো সেই মুখ আমার নেই। তবে গুরুজন হিসেবে একটা পরামর্শ দেই যেও না। আমার মেয়ে যদি আমার কথায় রাজি না হয় তবে কষ্ট পাবে।
মাহের বিষন্ন হাসি দিয়ে বলে,
–আমি তাকে যে কষ্ট দিয়েছি তার তুলনায় তো এটা কিছুই না।
অগত্যা জাফর সিদ্দিকী মাহেরকে নিয়ে হোটেলে রওনা হন।


জাফর সিদ্দিকী ভেবেছিলেন তিনি মেয়ের সাথে কথা বলে তাকে আলাদাভাবে বোঝাবেন, মাহেরের কথা বলবেন। কিন্তু হোটেলে পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলেন সেই সুযোগ রুহান রাখেনি।
উনি পৌঁছানোর সাথে সাথে বিয়ের কাজ শুরু হয়ে যায়। তবুও তিনি একটা শেষ চেষ্টা করলেন আরশি সই করার আগে তার উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলেন,
–তুমি চাইলে এখনো সবকিছু আটকাতে পারো, আমি সব সামলে নিবো। আর মাহেরও
কিন্তু আরশি তাঁকে কথা সম্পূর্ণ করতে দেয় না। ফিসফিস করে বলে,
–বাবা প্লিজ ওই নামটা নিও না, আমার ম্যারিড লাইফে সমস্যা হতে পারে।
জাফর সিদ্দিকী আর কোন কথা বলতে পারলেন না। মাহেরের দিকে এক নজর না তাকিয়ে আরশি একমনে কাবিননামায় সই করে দিলো, দ্বিতীয়বারের মতো রুহানকে কবুল করলো।
মাহের ভেবেছিলো আরশি তাকে দেখে সই করবে না কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। মাহেরের চোখের সামনে নিজের ভালবাসার সমাধি হতে দেখলো। ধীর পায়ে সে বিয়ের আসর থেকে বের হয়ে যায়।


সন্ধ্যায় নববধূর মতো সেজে উঠে রাজধানীর বিলাসবহুল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল।
“রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইয়ুথ আইকন রুহান খন্দকারের বিবাহ অনুষ্ঠান চলছে”
সোস্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে টেলিভিশন মিডিয়া সবখানে এই খবরটাই ট্রেন্ড করছে।
মন্ত্রী-আমলা, ব্যবসায়ী, বিনোদন তারকা, বুদ্ধিজীবী দেশের এমন কোন গণ্যমান্য ব্যাক্তি নেই যারা এই বিয়েতে উপস্থিত হন নি। হাজারেরও বেশি দেশি বিদেশি রান্না, চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জা এসব কিছু ছাপিয়ে গেছে বিয়ে বাড়ির একটা গুঞ্জনে,
“রুহান খন্দকার শেষমেশ একটা আটার বস্তা বিয়ে করলো!”
মুহুর্তে এটিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। যাইহোক নিন্দুকের কাজ নিন্দা করা তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে?
অফ হোয়াইট লেহেঙ্গার সাথে বহুমূল্য হীরে ও নীল রুবির গয়নায় আরশিকে বেশ ভালো লাগছে তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে নীল স্যুট সাদা শার্ট রুহান। বাঁহাতে রোল্যাক্স ঘড়ি, ঠোঁটের কোণে কাটা দাগ আর মিশিকালো চাপদাঁড়ির সাথে গোরা বর্ণের রুহানের গায়ে নীল রং জ্বলজ্বল করছে।
দেশের অধিকাংশ টিনএজর মেয়েরা এই মুহূর্তে রুহান খন্দকারের মতো স্বামী পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে কিন্তু যার সাথে রুহানের বিয়ে হয়েছে সে এক নীল বিষাদে ডুবে আছে। কারণ ঐ সহস্র তরুণীতো আর রুহান খন্দকারের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে জানে না।
অবশ্য বিষাদে শুধু আরশি না ডুবে আছে আরও অনেকে যেমন সিদ্দিক পরিবার (হ্যাঁ অর্ণব-প্রীতি, অর্ক-নির্জনারা এসেছে ), ফরিদ রহমানের পরিবার আর রুহানের মা মাইমুনা খন্দকার। তিনি ভাবতেও পারেন নি তার ছেলে এমন স্থুলকার একটা মেয়েকে বিয়ে করবে। তাঁর মতে এই মেয়ের তুলনায় প্রীতি হলো পরী। কিন্তু প্রীতিতো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করলো, লজ্জায় ফরিদ রহমান আর তার স্ত্রী বাড়ি ফিরে গেছেন। তাই বাধ্য হয়ে এমন মেয়েকে মেনে নিতে হচ্ছে তার। অন্যদিকে তমিজউদদীন খন্দকার বেশ খুশি ছেলে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে এই তো অনেক।
রুহান আরশির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
–মনে হচ্ছে তোমার ভাই ভাবিরা খুব সুখে আছে।
আরশি বুঝতে পারছে রুহান কোন একটা ঝামেলা পাকাতে চাইছে তাই সে অনুরোধের সাথে বলে,
–আপনি যা বলেছেন আমি সব করেছি। দয়া করে আমার বাড়ির লোকদের ভালো থাকতে দিন।
একটা পৈচাশিক হাসি দেয় রুহান।
–তুমি জানো না বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি হলো মেয়েদের আসল বাড়ি। আর তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের ভালো থাকতে হলে (অর্ক-নির্জনা,অর্ণব-প্রীতির দিকে ইশারা করে) ওদের খারাপ থাকতে হবে।
কথাগুলো বলেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এক, দুই, তিন গুণে তুড়ি বাজায় সাথে সাথে উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষের ফোনে একটা ভিডিও আসে।

–চলবে?

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-২৬

“কুষ্টিয়ায় RAB-4এর গোপন অভিযান প্রাক্তন চার ছাত্রনেতা অস্ত্রসহ গ্রেফতার। জিজ্ঞাসাবাদের পর সেই ছাত্রনেতা দেওয়া তথ্যমতে এক গণ কবরের সন্ধান পেয়েছে RAB এর সদস্যরা। যেখানে কুষ্টিয়ার প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্রকে তারা গুম করে পুঁতে রেখেছে বলে জানায়। সেখান থেকে অর্ধ গলিত লাশ ও মানব কঙ্কাল উদ্ধার করছে রেব। বর্তমানে অনেক নিঁখোজ ছাত্রদের মা-বাবা সেখানে ডিএনএ টেস্টের ভিড় করছেন । এর মধ্যে সাত বছর আগে নিঁখোজ হওয়া একমাত্র হাফেজ ছেলের সন্ধানে এসেছেন স্কুল শিক্ষক ফরিদ রহমান।”

এরপর ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে প্রীতির বাবা ফরিদ রহমানের চেহারা ভেসে ওঠে তিনি কান্নায় ভেজা গলায় আহাজারি করতে থাকেন।
এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে। কিন্তু হুট করে কেন এটি সবার ফোনে ভাইরাল হলে তা উপস্থিত কারোরই মাথায় এলোনা তবে
সংবাদটি দেখা মাত্রই প্রীতি অর্ণবকে বলে,
–আমি বাবা-মায়ের কাছে যাব।প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন, লাগছে দম বন্ধ লাগছে। না এটা হাসিব হতে পারে না।

অর্ণব তাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
–প্লিজ আপনি শান্ত হন, এভাবে প্যানিক করবেন না, আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি চলুন ।
এরপর অর্ণব তার বাবা, তমিজউদদীন খন্দকার আর অর্ককে বলে সেখান থেকে বের হয়ে গেল ।

এদিকে আরশি কিছুই বুঝতে পারছে না চোখে আশঙ্কা নিয়ে রুহানকে প্রশ্ন করে,
– কি করেছেন আপনি? এসব কিসের ভিডিও?
রুহান গম্ভীর হেসে বলে,
–আমি তেমন কিছুই করিনি, জাস্ট সত্যটা বের করানোর জন্য একটু টাকা আর পাওয়ার খরচ করেছি।
–কিসের সত্য?
–অপেক্ষা করো জানতে পারবে।
আরশি অস্থির হয়ে বলে,
– না আমি অপেক্ষা করবো না আপনি বলুন কিসের সত্য।
কিন্তু রুহান চুপ করে থাকে। এতে আরশি রেগে গিয়ে বলে,
–আপনি যদি না বলেন তাহলে কিন্তু আমি সবাইকে বলে দিবো আমি কেন এই বিয়েটা করেছি।
কিছুটা হকচকিয়ে যায় রুহান। নাহ এতো সাজানো একটা খেলা এই বোকা মেয়েটার জন্য সে হেরে যেতে পারে না। এই মেয়েটাকে বহু পরিকল্পনা করে সেদিন ফাঁসিয়েছিলো।

প্রীতিকে বিয়ে করার ইচ্ছে কখনোই রুহানের ছিলো না কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছিলো। তবে প্রথম থেকেই সে বিয়েটা ভাঙার উপায় খুঁজে গেছে । আর সেটা পেয়েও যায়। অর্ণব প্রীতিকে ভালোবাসে, সেটা রুহান জহুরা মঞ্জিল থেকে প্রীতিকে আনতে যাওয়ার দিনই অর্ণব-প্রীতির কথোপকথনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলো। তাই সে প্ল্যান করেছিলো অর্ণব আর প্রীতির কিছু আপত্তিকর ছবি তুলে সেগুলো ব্যবহার করে ব্যবহার করে বিয়ে ভাঙবে তাইতো এনগেজমেন্টের দিন অর্ক আর প্রীতিকে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলো। সে তার আর প্রীতির বিয়ের সাথে সাথে চেয়েছিলো বিহানকে ব্যবহার করে অর্ক আর নির্জনার সম্পর্কটা ভাঙতে। কিন্তু নির্জনা আর অর্কর ভালোবাসার কাছে সে হেরে যায়। তাই মরিয়া হয়ে প্রীতিকে ব্যবহারের কথা ভাবে। যেহেতু প্রীতি আর অর্ক ভালো বন্ধু তাই রুহান মনে করে অর্ক প্রীতির জন্য নির্জনাকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে অর্ক প্রীতির জন্য চিন্তিত কিন্তু নির্জনাকে ছাড়বে না তখন সে হতাশ হয়। তখনই তার হতাশার মধ্যে আলো নিয়ে আসে আরশি। এনগেজমেন্টের দিন যখন অর্ণব প্রীতির সাথে একান্তে কথা বলছিলো তখন আরশি তাদের একত্রে দেখে এগিয়ে যেতে নিলে রুহানই তাকে অন্যত্র নিয়ে বলেছিলো,
–অন্য কারও পার্সোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করা উচিত না।
আরশি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো, ভাইয়া আর প্রীতির মধ্যে কি চলছে আপনি জানেন?
ঠিক সেই মুহূর্তে রুহানের মাথায় আসে এই মেয়েটাকে ব্যবহার করে সে সম্পূর্ণ বাজি পাল্টে দিতে পারে। নিরজনাকে নিজের করে পেতে পারে কারণ অর্ণব আর অর্ক দুজনেই নিজের বোনের প্রতি অনেক বেশি দুর্বল।
তাই সে আরশিকে বলে,
–প্রীতি আর আপনার ভাইয়া একে অপরকে ভালবাসে। তারা নিজেদের ফেয়ারওয়েল করছে।
তাহলে আপনি কেন প্রীতিকে বিয়ে করছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর রুহান বলেছিলো,
–তো কি করবো প্রতিবার আপনার ভাইয়েদের জন্য ত্যাগ করে দেবদাস হবো? আমারও ভালো থাকার অধিকার আছে।
আরশি অসহায় হয়ে রুহানকে অনুরোধ করেছিলো তার ভাই আর প্রীতির জীবন থেকে সরে যেতে। রুহান রাজি হয় কিন্তু বিনিময়ে শর্ত রাখে তাকেই রুহানকে বিয়ে করতে হবে।
মাহের তাকে ভালবাসে না ভেবে নিজের ভাইদের ভালোর জন্য আরশি রাজি হয়ে যায়।

নাহ এই মেয়ের সাথে ইমোশনালি খেলতে হবে। এই ভেবে রুহান বলে,
–আমি শুধু প্রীতির গুম হয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজে বের করার জন্য পি.এমকে একটা ফোন করেছি। এর বেশি কিছু না।

আরশি চোখমুখ শক্ত করে বলে,
–আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।
রুহান কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলে,
–বিলিভ মি, আমি নির্জনার কসম কেটে বলছি।
চুপ হয়ে যায় আরশি। কারণ ভালবাসা বিষয়টা তার কাছে খুবই জটিল। নিজে একজনের ভালবাসা পায় নি তাই এর মূল্য বোঝে। হয়তো সেই কারণেই এখনো অব্ধি রুহানের এই একপাক্ষিক ভালেবাসাকে ঘৃণা করতে পারছে না।


অনুষ্ঠান শেষে অর্ক, নির্জনা বাড়ি ফিরে এসেছে আর জাফর সিদ্দিকী গেছে পিএমের সাথে দেখা করতে কারণ তাকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ।
বাড়ি ফিরে নির্জনা অভ্যাস বশত অর্কর সাথে তার রুমে আসে কিন্তু অর্ণবের দেওয়া আদেশ মনে পরতেই অন্য রুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তখনই অর্ক তার হাত ধরে বলে,
–কোথায় যাচ্ছো?
নির্জনা স্বাভাবিক গলায় বলে,
–গেস্ট রুমে।
অর্ক অনুরোধের স্বরে বলে,
–যেও না। আমার খুব অসহায় লাগছে। নিজের বোন অমানুষের হাতে, ভাইয়ার লাইফে ঝড় তুলে দিয়েছি, বাবাকেও আজকে অনেক বেশি এগজোস্টেড লাগছিলো। সব আমার জন্য। আমি কেন রুহানের চালাকি ধরতে পারি নি। জানিনা কালকে কি হবে। প্লিজ আজকে রাতটা অন্তত আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও। আই নিড ইউ ।

নির্জনা চুপ হয়ে থাকে। কারণ এসবের জন্য সে নিজেকে দায়ী ভাবছে। যদি সে অর্ককে বিয়ে না করতো তবে এ বাড়ির মানুষগুলোর জীবনে এতো ঝড় আসতো না। নির্জনাকে চুপ থাকতে দেখে অর্ক তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আমি মনে করেছিলাম তুমি বিহানকে এখনো ভালোবাসো তাই ওভাবে তোমাকে ডিভোর্সের কথা বলেছিলাম নাহলে তো আমি তোমাকে শুরু থেকেই ভালোবাসি।
অর্ককে এক ধাক্কায় সরিয়ে নির্জনা বলে,
–শুরু থেকে ভালোবাসি মানে? আপনি পাগল ছিলেন না?
অর্ক আর নির্জনার কাছ থেকে কিছু লুকাতে চায় না। কারণ সে বুঝে গেছে এখন তাকে আর নির্জনাকে আলাদা করতে রুহান এই সত্যিটাকেও ব্যবহার করতে পারে। তাই সে একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলে,
–হ্যাঁ আমি পাগল ছিলাম না। ইনফ্যাক্ট গত পনের বছর ধরে আমি পাগলের অভিনয় করে গেছি।


জাফর সিদ্দীকির সাথে পি.এম এর বৈঠক চলছে।
পিএম কোন ভনিতা ছাড়া বলে,
–কুষ্টিয়া তোমার নির্বাচনী এলাকা। সেখানে সন্ধান পাওয়া গেছে মানে দায় তোমার। এ নিয়ে পার্টির উপর যাতে কোন প্রশ্ন না উঠে তাই তুমি মিনিস্ট্রি থেকে পদত্যাগ করবে।

– আমি একা অপরাধী নই সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।

–আমরাও নিরুপায় জাফর , দায় তোমাকেই নিতে হবে । তুমি ভেবো না নেক্সট নির্বাচনে তোমাকে জিতিয়ে আবার সব ঠিক করে দিবো।

–নেক্সট পরে হবে আগে এবারেরটা হিসাব হোক। আমি ডুবলে সবাইকে নিয়ে ডুববো।

–জাফর একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো।
–আমার মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা। আপনি অন্য মুরগি খুঁজে বের করুন।
বলে জাফর সিদ্দিকী বের হয়ে যায়।

সাথে সাথে পিএম রুহানকে ফোন দিয়ে বলে,
–আপনার শ্বশুর তো দায়ভার নিতে রাজি না।
রুহান স্বাভাবিক গলায় বলে,
–আমি জানতাম এমনই হবে। আপনি এই ইনভেস্টিগেশন ফেয়ার করে মার্ডারারদের জেলে ঢুকান বাকিটা আমি বুঝে নেবো। আর আপনার কাছে আরেকটা ফাইল চেয়েছিলাম মিনিস্টার জাফর সিদ্দিকীর ড্রাইভারের এক্সিডেন্টের।

–আমি মেইল করে দিচ্ছি।
বলে লাইন কেটে দেয়।
রুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–সুইটহার্ট আমি যা সন্দেহ করছি তা যদি হয় তবে তোমার বাবাকে জাফর সিদ্দিকী খুন করিয়েছে৷ এবার আমিও দেখবো তুমি কি করে অর্কর সংসার করো।


মাঝরাতে প্রীতি-অর্ণব কুষ্টিয়ায় পৌঁছায়। ফরিদ রহমান এতকিছুর মধ্যেও মেয়ের ধোঁকার কথা ভুলেন নি। তিনি সরাসরি বলে দিয়েছেন মেয়ের তার বাড়িতে কোন ঠাঁই নেই। কিন্তু প্রীতির মা মেয়ের দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারেন নি। তাই স্বামীকে অনুরোধ করন ছেলের সঠিক খবর পাওয়া অব্দি যেন তাদের থাকতে দেওয়া হয়। প্রীতির বড় দুই বোনও মায়ের পক্ষে কথা বলে তাই ফরিদ রহমান অনুমতি দেয়।
রাতে প্রীতি আনমনে বসেছিলো তখন অর্ণব তার হাত ধরে বলে,
–আমি জানি না কি বলে তোমাকে সান্ত্বনা দিবো। তবে একটাই কথা তোমার পাশে আছি সবসময়।
এই মুহূর্তে একটা ভরসার হাত প্রীতি খুব দরকার যে তাকে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। অর্ণব সেই চেষ্টাটাই করছে। সে অর্ণবের বুকে কান্না ভেঙে পরে আর বলতে থাকে,
–আমার ভাইটাকে ওরা খাওয়ার মাঝ থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো। তারপর আর ফিরিয়ে দেয় নি।

প্রীতি এতো জেরে বিলাপ করছিলো যে ফরিদ রহমান, তার স্ত্রী মোরশেদার ও প্রীতির বড়ো দুবোনের জখম তাজা হয়ে যায়।
আজকে প্রীতি বড় দুই বোন তার মায়ের সাথে শুয়েছে। প্রীতির বিলাপ শুনে তার বড় বোন পাঁপড়ি বলে উঠে,
– হাসিবকে প্রীতি সবচেয়ে বেশি আদর করতো। বাইরে সবাই বলাবলি করছে, এই খুনগুলো মিনিস্টার জাফর সিদ্দিকীর ইশারাতে হয়েছে। যদি সত্যি এমন কিছু হয়, তাহলে তো প্রীতি জাফর সিদ্দিকীর ছেলের সংসার করবে না আম্মা ।

–চলবে?