তুমি ছুঁয়ে দিলে এ মন পর্ব-০৭

0
32

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব:৭

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

ভারি বর্ষনে চারপাশ মুহূর্তের মধ্যেই জলে থৈ থৈ হয়ে গিয়েছে। সামান্য আশ্রয় না পাওয়ার কারনে ত্রিশা যতটা না ভীতবিহবল হয়েছিলো, তার চেয়ে বেশি ভীত হলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আহনাফের আগমন ও মাথার উপর ছাতা দেওয়ায়।

ত্রিশা ভীত কন্ঠে বলে উঠলো, ” স্যার আপনি?”

ত্রিশা যেনো স্বাভাবিক হতে পারে সেজন্য আহনাফ মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

” হুউম আমি, এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ বাইকের চাকা পাংচার হলো তাই দাঁড়িয়ে পড়লাম।

পাশেই দাঁড় করানো বাইকের দিকে ইংগীত করে বললো,

” ঐ দেখো বাইকটা, কে জানি রাস্তায় পেরেক দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো, আর সেটাতেই কুপোকাত!”

তারপর আবার হেসে বললো,

“এটা কলেজের দপ্তরি রফিক চাচার ছাতা। ”

আহনাফের মিষ্টি হাসিভরা মুখের কথাতেও ত্রিশা অভয় পেলো না। কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেলো ওর মধ্যে। কিন্তু অনিচ্ছা স্বত্তেও পালাবার পথ নেই। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এত বড় পড়ছে যে ছাতা সোজাকরে ধরে রাখাও কষ্টকর হচ্ছে। ওরা রাস্তার ঠিক পাশেই একটা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এদিকে জনবসতি কম। আর দোকানপাটও নেই।

ত্রিশা লক্ষ করলো, আহনাফের ঠিক বুকের সামনাসামনি ওর মাথাটা। আহনাফের হৃদপিন্ডের শব্দ পর্যন্ত ওর কর্ণগোচর হচ্ছিলো। আর মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রান ভেদ করে আহনাফের শরীরের পুরুষালি ঘ্রানটাও। আহনাফ আড়াআড়ি আর ত্রিশা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট ছাতার নিচে বেশ অনেকক্ষণ। দুজনে চাপাচাপি করে এমনভাবে দাঁড়িয়ে যেনো প্রবল বর্ষণের গ্রাস হতে মুক্ত থাকে। কিন্তু বাতাসের টানে বৃষ্টি কখনো এদিক দিয়ে আর কখনো ওদিক দিয়ে ঝাপ্টা দিয়ে ওদেরকে ক্রমশ ভিজিয়েই দিচ্ছে। বৃষ্টির পানির চাপে এদিক ওদিক নড়চড় করাও যাচ্ছে না তেমন।

আহনাফ ত্রিশাকে অদূরেই একটা গাছ দেখিয়ে বললো,

” চলো, ঐ গাছের নিচে যাই”

ত্রিশা “হ্যাঁ” বোধক মাথা নাড়লো।

বৃষ্টি বাতাস ডিঙ্গিয়ে ঐ গাছের নিচে যাওয়া শুরু করতেই ত্রিশা এক জায়গায় ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আহনাফ শক্ত হাতে ওকে ধরে ফেললো একদম কোমড় জড়িয়ে। ছাতা দুজনের মাথার উপর হতেই সরে গেলো। ত্রিশার ভেজা শরীর লেপ্টে গেলো আহনাফের শরীরের সাথে।

তিরতির করে কাঁপতে থাকা ত্রিশার ভেঁজা গোলাপি ওষ্ঠগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত হলো আহনাফের।
সেই ওষ্ঠ দেখে আহনাফের হৃদপিন্ডে প্রেমের জোয়ার যেনো উছলে পড়লো। ভেজা কাপড়ের ফাঁকেও ত্রিশার টগবগ করা যৌবন উঁকি দিচ্ছিলো। একবার চোখ পড়লেও আহনাফ দ্রুত ওদিকে হতে চোখ সরিয়ে ফেললো। আহনাফের সমস্ত আকর্ষণ শুধু মেয়েটার সারল্যে আর শালীন সৌন্দর্যে।

আহনাফ ভাবতে লাগলো,
“আহ! কি স্বর্গীয় সুন্দর মেয়েটা! বৃষ্টির পানিতে ভিজে ঠিক হুরপরীদের মতোই সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।”

ত্রিশা দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দুজনেই দৌড়ে গাছতলায় গিয়ে ছাতা নিয়ে দাঁড়ালো। ছাতাটা শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতা। দুজনেই কাকভেজা হয়ে গিয়েছে।

আহনাফের হাত দিয়ে ধরে রাখা ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ত্রিশা ভাবতে লাগলো,
“এরকম কেনো হচ্ছে আমার সাথে? গতরাতে একবার স্যারের সাথে ধাক্কা, তারপর পা পিছলে তার উপরে পড়ে যাওয়া। আজ আবার বৃষ্টির পানির কারনে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়া। আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে? স্যার কি ভাববে আমাকে? আর একবার তো ভেবেই বসেছিলো যে, আমিও সেই মেয়েদের দলে, যারা তাকে ডিস্টার্ব করে। ছি:”

ত্রিশা মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানাতে লাগলো।

আর আহনাফ ভাবছে,
” নিয়তিই মেয়েটাকে বারবার আমার কাছে এনে দিচ্ছে। যেখানে মনস্থির করেছিলাম, আর কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রতি দুর্বল হবো না, তার পরো এই মেয়ের প্রতি একদিনেই কেমন দুর্বল হয়ে গেলাম। সত্যিই মন নামক জিনিসটাকে বুঝা বড় দায়!”

দুজনেই দুজনার ভাবনার জগৎ থেকে ঘুরে আসতে আসতেই বৃষ্টি থেমে গেলো।

ত্রিশা হঠাৎ ই ” উঁহ! উঁহ! ” স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। ওর পায়ে পিঁপড়া ধরেছে। ঘাসের উপর বসে পড়ে বড় বড় লাল পিঁপড়ে ছাড়াতে ইতস্তত করতে লাগলো সে। আহনাফও বসে পড়লো ভেঁজা ঘাসের উপর ত্রিশার ঠিক পাশেই। ত্রিশার মাখনের মতো নরম পায়ে হাত দিতেই সে আৎকে উঠলো।

” একি?”

আহনাফ বললো, ” আরে! মেয়ে পিঁপড়ে সরিয়ে দিচ্ছি”

ত্রিশার পায়ে আহনাফের স্পর্শ ওকে বিচলিত করে দিলো।

পিঁপড়ে সরিয়ে দিতেই সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,

” থ্যাংক্স স্যার, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আমি যাই”

ত্রিশা তাড়াহুড়া করলেও আহনাফ যেনো ত্রিশাকে আরো কিছু সময় ত্রিশার সাথে কাটাতে উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

তাই ধমকের স্বরে বললো,

” থামো মেয়ে! আমি কল করেছিলাম, চাকা নিয়ে আসছে একজন, পাঁচ মিনিটেই ঠিক করে দিবে, আমিই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো, তাছাড়া এই পথে এখন আর কোনো সি এন জি বা অটোরিকশাও পাবে না তুমি”

সত্যিই ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই একজন চাকা নিয়ে এসে গেলো বাইকে করে। পাঁচ মিনিটে চাকা লাগিয়েও দিলো।

লোকটা চলে যেতেই আহনাফ ত্রিশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,

” উঠে বসো”

ত্রিশা সংকোচ করলো। কিন্তু স্যারের আদেশ উপেক্ষা করার উপায় নেই। বাইক চলতে লাগলো। আহনাফ হেলমেট পড়লো না।

আহনাফ ত্রিশাকে বললো, ” চুলগুলো ছেড়ে দাও, নইলে ভেজা চুলে ঠান্ডা লাগবে”

আসলে আহনাফ যেনো ত্রিশার চুলের গন্ধের নেশায় পড়ে গিয়েছে। তাই সে চাচ্ছে মেয়েটা চুল ছেড়ে দিলে সেই গন্ধটা আবার সে অনুভব করতে পারবে।

বাধ্য মেয়ের মতো ত্রিশা মাথার স্কার্ফ খুলে চুলগুলো ছেড়ে দিলো।

ওর লম্বা লম্বা ভেজা চুলগুলো শ্রাবণ হাওয়ায় ভেসে আহনাফের মুখ পর্যন্ত চলে এলো।

আহনাফ প্রাণ ভরে সেই ঘ্রাণ শুঁকতে লাগলো।

দেখতে দেখতে সময় চলে গেলো। পনেরো মিনিটেই বাসার সামনে চলে এলো ওরা।

বৃষ্টি না থাকলেও তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তবে কেউ না দেখলেও আহনাফ আর ত্রিশাকে একজন দেখে ফেললো।

.
.

বাসায় ঢুকতেই ত্রিশা দেখে জামিল শেখ চলে এসেছে। বাহারী খাবারের সুগন্ধে গোটা বাড়ি মজে রয়েছে।

কনকচাপা কে ব্যতিব্যস্ত দেখালো৷

ত্রিশা ভেঁজা কাপড় নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখে সবাই ডাইনিং এ খাবার খেতে ব্যস্ত। একদল মেহমানও দেখা গেলো। প্রত্যেকেই বিরাট স্বাস্থ্যবান। কিন্তু ত্রিশা তাদেরকে ভালো করে লক্ষ্য করলোনা। দ্রুত ওয়াশ রুমে ঢুকে কাপড় চেইঞ্জ করে এলো সে।

হঠাৎ ই ববিতার আওয়াজ।

” ত্রিশা, এই ত্রিশা, নিচে আসো তো একটু”

ববিতার ডাক শুনে ত্রিশা হতচকিত হয়ে গেলো। বাসায় মেহমান বা বাইরের কেউ আসলে সবাই ওর সাথে বেশ ভালো আচরন করে। যদিও সবই নাটক এবং সাময়িক। কারন তারা এটা শো অফ করতে চায় যে, বাবা হারা ত্রিশাকে তারা অতি আদরে বড় করছে যেনো বাবা, দাদী, ফুপু সবার আদরের মনি ত্রিশা। যদিও তারা কেউই আপন নয়, তবুও ওদের এসব অসত্য মহানুভবতা ওরা পাব্লিকলি শো অফ করতে চায়।

দ্রুত নিচে আসতেই দেখে, ববিতা মিটিমিটি হেসে একজনকে দেখিয়ে বলল,

” দেখো চেনো কিনা একে?”

ত্রিশার চিনতে কষ্ট হলো না। ইনি তো সেই যে, বিয়েবাড়িতে ওকে প্রশ্ন করেছিলো, সে কেনো বিয়েবাড়িতে এ ধরনের ড্রেস পড়ে এসেছিলো?

ববিতা ইনিয়ে বিনিয়ে নরম স্বরে পরিচয় করিয়ে দিলো,

” ত্রিশামনি, ইনি হলো তোমার বাবার স্কুল জীবনের বান্ধবী পান্না”

বলতেই পান্না নামক সেই স্বাস্থ্যবতী জুয়েলার্সের দোকান একগাল হেসে ত্রিশাকে বলে উঠলো,

” আসলে ত্রিশামনি, আমি তোমার বাবার শুধু স্কুলজীবনের বান্ধবিই নই, এক্স গার্লফ্রেন্ড ও বটে! যে কঠিন প্রেম করেছি আমরা দুজনে! তোমাদের বাসায় কত এসেছি, বসেছি, থেকেছি, তুমি কোথা থেকে জানবে? তুমি তো ছিলে অন্য কোথাও!”

বলতেই ববিতা আর সেই জুয়েলার্সের দোকান হা হা করে হেসে উঠলো।

শেষের কথাটা আসলে কথাটা সে ত্রিশাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই ইচ্ছে করে বলেছে তারা।

ববিতা ত্রিশাকে দেখিয়ে বললো, ” বুঝলে পান্না? ত্রিশা মেয়েটা হয়েছে অতিরিক্ত সোজাসাপ্টা। একটা দামী অর্নামেন্ট বা দামী পোশাকও সে পরবে না, বরং পড়বে কি? পুরাতন আর রংচটা পোশাক, একদম স্ট্যাটাস বুঝে না মেয়েটা! ”

বলেই সে ত্রিশাকে একটা ড্রেসের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বললো,

” ত্রিশা দাদুমনি আমার, এই নতুন ড্রেসটা পড়ে আসো তো, সাথে এই অর্নামেন্ট গুলোও। তোমার পান্না আন্টি, তোমার কয়েকটা ছবি নিয়ে যাবে”

ত্রিশা ববিতার আচরনে অবাক হলো না। কারন বাইরের মানুষের সামনে এরা ত্রিশার সাথে যার পর নাই ভালো আচরন করে। কারন সবাই যেনো এটা ভাবতে পারে যে, ত্রিশাকে তারা মাথায় তুলে রাখে। ত্রিশার আদর যত্নের কোনো খামতি নেই। আসলে বাইরের মানুষের সামনে নিজেদেরকে মহৎ বলে প্রমাণিত করাই এদের উদ্দ্যেশ্য।

ত্রিশা এ ধরনের ড্রেস কোনোদিনই পড়েনি। একটা ওয়েস্টার্ন ড্রেস, বেশ চাপা আর খাটো। পড়তেই কেমন লজ্জা লাগছিলো। তবুও যদি মানা করলে দাদী রাগ হয় সেই ভয়ে আর কিছুই উচ্চারন করলো না।

ত্রিশা ড্রেস পড়ে আসতেই সেই মহিলা এমনভাবে ওর দিকে তাকালো যেনো খেয়ে ফেলবে।

” যা দারুন ফিগার তোমার! ”

বলেই ওর মুখে ফাউন্ডেশন মাখা শুরু করলো।

” তোমার স্কিনও তো ভারি সুন্দর ত্রিশা! একদম বোম্বের নায়িকাদের মতো, একটু যত্ন করো শুধু”

ববিতা পাশের সোফায় আরাম করে বসে একগাল পান খেতে খেতে শুধু হাসতে থাকলো।

ত্রিশা বুঝতে পারলো না, হঠাৎ ই ওকে এতো আদর আপ্যায়ন করে সাজানোর মানে কি? কি এদের উদ্দ্যেশ্য, কি চায় এরা? উদ্দ্যেশ্য ছাড়া তো এরা আর কিছুই করে না।

ত্রিশা এবারে সেই অর্নামেন্টের দোকান আন্টিকে জিজ্ঞেস করলো,

” আন্টি, কিসের ফটোসেশন এটা?”

পান্না নামক সেই অর্নামেন্ট আন্টি একগাল হেসে উত্তর দিলো,

” খুব সুন্দর একটা রাজপুত্রের বউ বানাবো তোমাকে ত্রিশামনি সেজন্য”

(চলবে)