তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-০৩

0
27

#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৩
ফজরের আজানের পর পর তীব্র বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়, বাড়ির বাইরে সিকিউরিটি তীব্রকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, কারেন্টের গতিতে গেট খুলে দেয়। তীব্র গাড়ি ছাড়া হেঁটে হেঁটে বাড়িতে এসেছে। সিকিউরিটি কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল তীব্রর চোখের ইশারায়। হাতে থেকে সিগারেট মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে, ভেতরে প্রবেশ করলো।
তীব্রর মা নামাজ পড়ে ড্রয়িংরুমে বসে তসবি জিকির করছিলো, তীব্রকে দেখা মাত্র দেহে প্রাণ ফিরে এলো যেনো। তীব্র কথা না বলুক ওকে একটা নজর দেখলেই তার দেহে প্রাণ বসবাস করে। যতক্ষণ তীব্র বাইরে থাকে তার ভেতরে ঝড় চলে।
‘‘তুমি ঘুমাও নি রাতে?’’
‘‘ঘুমিয়ে ছিলাম তো।’’
‘‘চোখ দেখে মনে হচ্ছে না তো।’’
‘‘না মানে নামাজ পড়তে উঠেছিলাম তো তারপর আর ঘুম হয় নি, তাই রেহেনাকে বলেছি এক কাপ চা দিতে খেয়ে আবার ঘুমিয়ে যাবো।’’
‘‘মা তুমি আমাকে শিখিয়ো না, তোমাকে আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, নেক্সট টাইম যদি দেখি রাতে না ঘুমিয়ে জেগে জেগে কাটিয়ে দিয়েছো, আমি প্রমিস করছি।আমি বাড়ি ছেড়ে কোয়াটারে গিয়ে থাকবো, তোমাদের সাথে থাকবো না।’’
‘‘ওরকম করে বলিস না বাবা। তোর জন্য চিন্তা হয় খুব। তুই এতো রাত করে ফিরিস, বেশির ভাগ সময় রাত পোহালে ফিরিস। খুব টেনশন হয় রে বাবা!’’
‘‘কিসের চিন্তা মা? আমি কি একাত্তরের যুদ্ধে যাচ্ছি? পুলিশের চাকরী আর মানুষ করে না? বাবার বেলায়ও কি একই কাজ করতে? আমাকে ভুলভাল এক্সকিউজ দেখাবে না বললাম!’’
তীব্রর মা নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
মাকে চোখ রাঙিয়ে নিজের রুমে চলে গেল তীব্র, ওর রুমে ঢুকেই প্রথম কাজ হলো ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়া।
তীব্র সব সময় নিজের মতো করে থাকে। সাদাসিধে জীবন ওর, একজন এসপির লাইফ স্টাইল যেমন হওয়ার কথা তার কিঞ্চিৎ বিশেষ্যত্বও দেখা যায় না ওর মধ্যে। বাবার পেনশনের পুরো টাকা দিয়ে ঢাকাই একটা বড় করে বাড়ি করেছে তীব্রর মায়ের মন মতো করে।
তীব্রর ঘরটা অনেক বড় হলেও এর ভেতরে কেমন অদ্ভুত ডেকোরেশন। থাই গ্লাস দিয়ে কয়েকটা ছোটো ছোটো কেবিনের মতো করা রুমের ভেতরে, একপাশে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস পর্যায়ক্রমে সাজানো, আরেক পাশে হোয়াইট বোর্ড যার চারপাশে বিভিন্ন নিউজ পেপারের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আরেক পাশে শুধু একটা পড়ার টেবিলের মতো আর চারপাশে বুক শেল্ফ দিয়ে ঘেরাও করা।
আরেকপাশের কেবিনে সিংগেল খাট একটা, একটা ওয়াল কেবিনেট আরেকটা কাপড় রাখার স্ট্যান্ড,এই কেবিনের সাথে একটা এটাস্ট ওয়াশরুম।
পুরো রুমে একটা জানালা আছে, জানালার এই পাশে কোনো কেবিন করা হয় নি, এতোগুলো কেবিনের ভীড়ে এই অংশটুকু একটা করিডোরের মতো লাগে, জানালা ঘেঁষে একটা ছোট্ট গোল টি টেবিল আর একটা ছোফা ।
পুরো বাড়িতে তীব্রর এই অংশটুকুতে তীব্র ছাড়া আর কারো পা পড়ে না। ঘর পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলে নিজ দায়িত্বে করে নেয়। কাউকে রুমে ঢুকতে দেয়ার মতো রিস্ক তীব্র নেয় না, কারণ অনেক দরকারি ইনফরমেশন তীব্রর রুমে ছড়ানো ছিটানো থাকে। তীব্র বাদে সবার কাছে এই ঘরটা একটা রহস্যময় ঘর, এই ঘরের ভেতর কি আছে, কেমন তার নকশা সেটা শুধু তীব্র জানে আর যাকে দিয়ে ভেতরের এই নকশা করেছে সে জানে। এই ঘরে তীব্র ছাড়া আর একজনের পা পড়েছে, কিন্তু দুবছর আগে তার আসাও বন্ধ হয়েছে। রুমটা ডিভাইস সিস্টেম করে সিকিউরিটি লক করা, এই রুমটা খুলতে হয় তীব্রর ফিংগার প্রিন্ট লাগবে না হয় সিক্রেট পাসওয়ার্ড/পিনকোড। রুম থেকে বেরিয়ে রুম লক করে রেখে যায়, ভেতরে ঢুকেও লক করে রেখে দেয়। বাই এনি চান্স তীব্র যদি ঘরের ভেতর মরেও থাকে ওকে উদ্ধার করা বড্ড জটিল হয়ে পড়বে।তার মধ্যে এই রুমের আশেপাশে কোনো বারান্দাও নেই।
এই অদ্ভূতুড়ে জীবন ধারী তীব্রর জীবন রহস্যে ঘেরা, যে রহস্যের ঠিকানা জন্মদাতা পিতা মাতাও জানে না। পিতা কিঞ্চিৎ পরিমাণ জানলেও মাতা কিচ্ছুটি জানে না। তীব্রর ঘুম আসছে না, তবুও ঘুমাতে হবে শরীর সুস্থ রাখার জন্য, স্লিপিং পিল খেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে চোখের পাতা লেগে আসে।
আর এদিকে মিশান যার চোখ ভরা ঘুম থাকতেও কেউ যেনো ওর ঘুমকে দণ্ডনীয় অপরাধ জারি করেছে, যার জন্য চাইলেও ঘুমাতে পারছে না। একটু গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেই দুঃস্বপ্ন গুলো মস্তিষ্কতে চড়ে বসে। মিশানের মামা একজন সেনাবাহিনীর কর্নেল অফিসার।
দ্বীপ একজন সিনিয়র রিসার্চ ফার্মাসিস্ট, আর তাপসিন লেখা পড়া করছে,ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে কেবল।আর মিশান খায় দায় ছন্নমতি হয়ে ঘুরে ফিরে, এই ওর জীবন। মামা মামীর কাছে তাদের ছেলের থেকেও মিশান প্রিয়, কিন্তু এটা মিশানের পছন্দ নয়, ছোটো বেলা থেকে কিছু চাওয়ার আগেই মামা মামী সেটা দিয়ে হাজির। এতে মিশান খুশি না হয়ে বিরক্তবোধ করে। মামা-মামী ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নেয় কারণ মিশানের জীবনীর সাথে এমনটাই মানানসই, মিশানের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো রুমে এতো সুন্দর খাট থাকতে ঘরের এক কোণে একটা ফ্লোর বেডে শুয়ে বসে দিন কাটে মিশানের।
এইরকম টা ও আগে করতো না, প্রায় গত একবছর ধরে এমন করছে। কারণটা হয়তো নিশান।
নিশান মিশানের একমাত্র ছোটো বোন, হঠাৎ করে নিশানের মৃত্যুটা মিশান মেনে নিতে পারে নি, নিশান মারা যাবার পর মিশানের মানুষিক অবস্থা আরো বিদ্ধস্ত হয়ে গেছে, পুরো রুমে নিশানের অস্তিত্ব অনুভব করে, যেদিকে তাকায় শুধু নিশানকে দেখতে পায়।
ছোটো বেলা থেকে বাবা মা হারিয়ে অর্ধেক সাইকো হয়েছে মিশান আর নিশান মারা যাবার পর পুরো সাইকো হতে বাদ নেই। এতো আঘাত ও নিতে পারছে না সোজা কথা।
নিশান মিশানের একমাত্র কলিজার টুকরা, ওর পুরো পৃথিবী ছিলো নি, প্রার্থনা জুড়ে শুধু নিশানের মঙ্গল কামনা ছিলো, নিশানের জীবন আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক ছিলো না, ওর রক্তে রেড ব্ল্যাড সেল পর্যায়ক্রমে ক্ষয় হতে থাকে, নতুন করে উৎপন্ন হতো না। যার জন্য প্রায় প্রতিমাসেই নিশানকে ব্ল্যাড দিতে হতো, নিশান মিশানের ব্ল্যাড গ্রুপ একই ছিলো বলে মিশান ই বেশিরভাগ সময় ব্ল্যাড দিতো। মিশানের প্রার্থনা ছিলো মৃত্যু যদি দুই বোনের একসাথে লিখা থাকে তবে এর থেকে মঙ্গলকর আর কি হতে পারে? নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে বোনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারে নি! বেলা শেষে হেরে যায় প্রকৃতির করা কিছু কঠিন যোজন-বিয়োজন প্যাটার্নের কাছে!
সকাল সাড়ে দশটার পর এসবিতে আসতে না আসতেই তীব্রর সামনে এসে দাঁড়ালো ইরফান শেখ। তীব্র চোখ তুলে ইরফান শেখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নজর সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘‘অবরোধ করলেন নাকি, রাস্তা আটকালেন যে? ’’
‘‘রাস্তা আটকেছি একটা প্রশ্নের জন্য।’’
‘‘হয়তো প্রশ্নটা আমি জানি, কিন্তু আমি আগেই বলে দিচ্ছি এর উত্তর আমার কাছে নেই।’’
‘‘স্যার, আপনি আমাকে একটু বেশিই বিব্রত করতে ভালোবাসেন আমি জানি, কিন্তু আপনি যতোই বলুন আন্দাজি ঢিল ছুঁড়েন এটা আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য নই।সব কিছুর পেছনেই কারণ থাকে।’’
‘‘ হতে পারে, কিন্তু আমার কোনো কাজের পেছনে আমি কোনো কারণ রাখি না। আমার যখন যা মন চাই তাই বলি তাই করিও।’’
‘‘তাই বলে কাটাই কাটাই মিলে কি করে আপনার বাণী?’’
‘‘মিলে কিনা জানি না। তবে একটা ফিলোসফি আছে, কোনো এক বিখ্যাতো ফিলোসফার বলেছিল ‘আমরা যা বিশ্বাস করি আমাদের সাথে তাই ই হয়।’ আপনি ভেবে দেখুন আপনি কাল আমার কথা গুলো না চাইতেও বিশ্বাস করেছেন আর তাই ই হয়েছে, অবিশ্বাস করে দেখতেন একবার তারপর না হয় প্রশ্নটা যুক্তিগত ছিল।’’
‘‘ঠিক আছে এটা বাদ দিলাম, তাহলে এখন এটা বলুন, আজ সকালে ভালো মত খোঁজ নিয়ে দেখি কাল রাতে সিরিয়াল কিলারটার হাতে কারো মৃত্যু হয় নি। আর আপনি কিন্তু কাল ভবিষ্যৎ বাণী দিয়েছিলেন এটা মিলে গেলো কি করে? না জেনেই মানুষ এতো বড় ভবিষ্যৎ বার্তা দেয় কিভাবে?’’
‘‘আসলে কি জানেন যে সিরিয়াল কিলার সে আমার বউ। আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম কাল রাতে যেনো কোনো ঘটনা না ঘটায়। সেই জন্যই এতো কিছু।’’
ইরফান শেখ তুচ্ছার্থক হাসি দিয়ে বলল,
‘‘আপনার বউ? স্যার আপনি আমাকে বিব্রত করতে গিয়ে একটু বেশিই বলে ফেললেন না? সিরিয়াল কিলার আপনার বউ তো দূরে থাক সে একজন নারী এটা বললেই তো ব্যাপারটা চরম পর্যায়ের হাস্যকর!’’
তীব্র সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘‘তারমানে আপনি বলতে চাইছেন সিরিয়াল কিলার একটা পুরুষ?’’
‘‘অবশ্যই!’’
‘‘আপনি কি করে জানলেন ওটা কোনো পুরুষ, নারী হতেই পারে না?’’
‘‘এটা না জানার কি হলো! বুঝায় যায় সব, কোনো নারীর পক্ষে এরকম কাজ করা সম্ভব না।’’
তীব্র রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
‘‘এই যে আপনি আপনার যুক্তিটা দিলেন যে থিউরি তে, আমিও আমার প্রতিটা যুক্তি দেই একই থিউরিতে।’’
ইরফান শেখ ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল।
তীব্র ইরফান শেখের একদম কাছে দাঁড়িয়ে খানিকটা মাথা ঝুঁকে বলল,
‘‘ইরফান শেখ কোনো ভাবে আপনি তো আমার কাজকর্মে ফ্যান হয়ে যাচ্ছেন না আবার? এসবের কোনো ফায়দা নেই বুঝলেন! আমার কাজে শিক্ষণীয় কিছু পাবেন না।’’
ইরফান শেখ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তীব্রর উপর প্রচুর রাগ হচ্ছে, কিন্তু সিনিয়র অফিসার বলে রাগ চেপে রইল, তীব্র উনার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
মিশান ড্রয়িংরুমে সোফা ছেড়ে ফ্লোরে বসে হাতে একটা বাটিতে মুড়ি নিয়ে খাচ্ছে আর টিভি দেখছে, এমন সময়
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চশমা ঠিক করতে করতে তাপসিন মিশানের কাছে দৌড়ে গেল। খানিকটা আতংকিত স্বরে মিশানকে বলতে শুরু করল,
‘‘আপি আপি দেখো কি হয়েছে!’’
বরাবরই ছোটো খাটো ব্যাপারে তাপসিনের বড় বড় রিয়্যাকশন দেয়ার সমস্যা আছে। যার কারণে তাপসিনের এই আতংকিত চেহারা মিশানের মনে কোনো আলাদা উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করতে পারে নি, অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মিশান জিজ্ঞেস করল,
‘‘কি হয়েছে?’’
‘‘দেখো সেদিন বললাম না তোমায় ফেসবুকে নিউজে দেখলাম শহরে সিরিয়াল কিলার এসেছে? তুমি বললে ভুয়া নিউজ। এই দেখো এটা পত্রিকাতেও দিয়েছে, আর সিরিয়াল কিলারের মার্ডার সংখ্যা প্রতি রাতে বেড়েই চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এক আলোচনা সভাতে জানিয়েছেন উনি স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে অতি শীঘ্রই আসামী ধরা পড়বে।’’
‘‘বেল পাকলে কাকের কি? আসামী ধরা পড়লেই কি না পড়লেই কি! আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না।’’
‘‘যায় আসে না মানে! এই যে রাত বিরাত আমরা মাঝরাতে বাড়ির বাইরে বের হই গাড়ি সিকিউরিটি ছাড়া। যদি সিরিয়াল কিলার এসে এট্যাক করে আমাদের উপর?’’
‘‘ঠিক আছে এখন থেকে আমি একাই বের হবো। তোদের কারো যেতে হবে না আমার সাথে।’’
‘‘আপি তুমি বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা!আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি শুনো
প্লিজ!’’
‘‘এক কাজ কর তার আগে আমার বাটিতে মুড়ি গুলো শেষ হয়েছে, তুই নিজে গিয়ে আর কয়টা মুড়ি নিয়ে আয়। আর মিমিকে বল আমার রুমের লক খুলে দিতে।’’
‘‘না তার আগে কথা শুনো!’’
‘‘কি শুনবো? টিভিতে তো দেখলাম ই নিউজ। অনবরত প্রতিটা নিউজে বলছে সবাইকে সাবধান হতে, শহর মৃত্যুপুরী হয়েছে। রাত হলেই সিরিয়াল কিলার শহরে অবতরণ করছে! আরো নানান কথা।’’
‘‘ওহ তাহলে শুনেছই।’’
‘‘হুম।’’
তাপসিন বাটি হাতে নিয়ে উঠে পড়ল,
‘‘আর শোন তাপসিন।’’
‘‘বলো,’’
‘‘আমার মোবাইলটা যেনো কোথায় রেখেছি খুঁজে দেখ তো।’’
‘‘কোথায় রেখেছো আর কোথায় খুঁজবো এতো বড় বাড়িতে!’’
‘‘আরে বাসাতে কাজের লোক আছে না! কি জানি নাম, তাকে বল খুঁজতে।’’
‘‘তুমি যে কি মিশান আপিই।’’
‘‘কথা বাদ দিয়ে যা তো। মোবাইলটা দরকার।’’
‘‘তাহলে আমার টা নাও’’
‘‘আরে মুশকিল তো! আমি কি নাম্বার মুখস্ত করে রেখেছি নাকি? কল করবো।’’
‘‘দ্বীপ ভাইয়া ছাড়া তুমি আর কাকে কল দাও, আমার ফোনে তো ভাইয়ার নাম্বার আছেই।’’
মিশান চোখ বন্ধ করে দাঁত চেপে বলল,
‘‘তাপসিন বেশি বুঝা কিন্তু ভালো না।
যেটা বলছি সেটা কর।
তাপসিন ভয় পেয়ে চলে গেল সামনের দিকে, কিচেনে মাকে গিয়ে মুড়ির কথা বলে মিশানের মোবাইলের খোঁজে ছুটাছুটি শুরু করছে।
তাপসিন স্থান ত্যাগ করার পর মিশান সোফাতে উঠে বসে সোফার কুশন সরিয়ে মোবাইল বের করল। মোবাইল টা হাতে নিয়ে মোবাইলের ব্যাক কাভার খুলে সেখান থেকে একটা ছোট্ট পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে গভীর পর্যবেক্ষণের সাথে দেখতে লাগলো আর কিছু একটা ভাবনায় ডুবে গেল।
দুদিন কেটে যেতেই তীব্রর র‍্যাবে পোস্টিং কনফার্ম হলো। কনফার্মেশন লেটার হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় আবার সেই মিটিং। শেষ বারের মতো মিটিংয়ে জয়েনের অনুরোধ করা হলো তীব্রকে, মন না চাইতেও বিরক্তি নিয়ে ইচ্ছে করে মিটিংয়ে লেট করে এন্ট্রি নিলো।
‘‘এতো লেট কেনো তীব্র? সময়ের প্রতি একটু রেসপন্সেবল হতে পারো। ক্যাডেটে তো তোমাদের অনেক ভাল সময়ানুবর্তীতা শিখিয়েছে তাহলে তুমি এমন করো কেনো? ’’
‘‘সময় জ্ঞান কি শুধু আমার একার কম? আর একটা কথা আমি এখন এসবির প্রোডাক্ট না, একটু আগে র‍্যাবে কনভার্ট হয়ে গেছি, যদিও কাল সকাল থেকে কালো পোশাক পড়ে বের হবো। তারপরেও এখন আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চে নেই, ধরতে গেলে আমি এখন বাইরের মানুষ, এসবির আত্মীয়। তারপরেও কেনো আমাকে আপনাদের মিটিংয়ে ডাকা হয়েছে?’’
‘‘তীব্র সামনে যেসব মিশন আছে সেগুলো ক্যান্সেল করো, আর যেটা বলছি সেটাতে ফোকাস করো। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ, এই সিরিয়াল কিলারের ব্যাপারটা যতোই ধামা চাপা দিয়ে রাখতে চাইছি ততোই যেন লোক জানাজানি হচ্ছে।একদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর চাপ আরেক দিকে মিডিয়া সাংবাদিক। এগুলোর কৈফিয়ত দিতে দিতে আমরা হাঁপিয়ে গেছি। আসামী ধরার মতো কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছি না, আসামী তো দূরে থাক। কেউ কেউ ভাবছে এগুলো পুলিশদের কাজ।’’
‘‘এসব আমাকে বলছেন কেনো আমি কি পুলিশ? আমি এখন র‍্যাব।’’
‘‘তীব্র বুঝার চেষ্টা করছো না কেনো?একজন সিনিয়র অফিসার হয়ে রিকুয়েস্ট করছি তোমায় তারপরেও তুমি আছো তোমার তালে!’’
‘‘বেয়াদবি কি করছি স্যার? প্লিজ স্যার অন্তত এই বেয়াদবির কারণে আমাকে সাসপেন্ড করে দেয়া হোক প্লিজ স্যার!
মোশারফ হোসেন ব্যর্থতার নিশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। তীব্রকে কখনোই কোনো কিছু বুঝানো যায় না, ও নিজে যেটা ঠিক করবে সেটাই।’’
‘‘স্যার আমি এক কথার মানুষ একবার যখন বলেছি যে আমি চেষ্টা করবো ক্রিমিনালকে ধরতে না পারলেও শনাক্ত করার। তারপরেও কেনো এতো টেনশন?’’
‘‘তীব্র ইট’স এন ইমারজেন্সি! হোয়াই ইউ ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড? নিউজ দেখো না কতোটা ভয়ানক অবস্থা দেশের? মানুষ আতংকিত! অন্ধকার নামার সাথে সাথে শহর ঘুমিয়ে যাচ্ছে, মানুষ ঘরবন্দী হচ্ছে।প্রয়োজন হলেও বের হতে পারছে না, প্রাণের ভয়ে।’’
‘‘এখন আমি কি করতে পারি? আমি তো ম্যাজেশিয়ান না! ডিপার্টমেন্টে আরো পুলিশ আছে হাজার হাজার পুলিশ আছে তাদের বলুন আমি কেনো? আমার কি এগুলো কাজ? একজন পুলিশ সুপারের কাজ হলো নেতৃত্ব দেয়া, কিন্তু সেখানে আমি কি করছি? যাকে খাটি বাংলায় বলে কামলা দেয়া! পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আমি একাই একজন পাওয়ারফুল পুলিশ, সবার প্রাণের ভয় থাকতে পারে আমার পারে না! আমার ব্ল্যাড গ্রুপ কি কোনো ভাবে মনুষ্যপ্রজাতির থেকে আলাদা? নাকি আমি অমর?
আমার অন্য একটা মিশন আছে। আমার কাছে এটার থেকে সেটা বেশি ইম্পোরট্যান্ট সো আমি যাচ্ছি আমার পথে।’’
তীব্র উঠে দাঁড়াতেই মোহাম্মদ মাঝ্হারুল ইসলাম এডিশনাল ডিআইজি স্যার বলে উঠলেন,
‘‘তীব্র তুমি কি চাও না দেশটা ডেঞ্জার মুক্ত হোক? তুমি সব ধরনের কেস সামলে আসছো, প্রাইমারী স্কুলের ম্যাথের মতো সহজ তোমার কাছে কেস সলভ করা।কোনো কেস তোমার হাতে দিলে তুমি সাদরে তা গ্রহণ করো। তাহলে আজ কেনো তুমি এই কেসটা নিতে চাচ্ছো না?ইন্ডাইরেক্টলি কেনো প্রত্যাখ্যান করছো?তুমি সিনিয়রদের এভাবে এভোয়েড করো, অবাধ্য হও।তোমার জুনিয়র গুলো কি শিখবে তোমার কাছে? যখন তুমি আমাদের লেভেলে আসবে তখন তোমার সাথেও কি এমন হবে না?’’
‘‘আমি কোনো দিন চেষ্টাও করবো না আপনাদের লেভেলে যাওয়ার জন্য।প্রয়োজনে আরো নিচের লেভেলে যাওয়ার চেষ্টা করবো। ’’
‘‘তুমি তো এসপি হতেও চাও নি, হও নি এসপি? এমনকি পুলিশের চাকরীও করতে চাও না, করতে হচ্ছে না চাকরী?
এসব কৈফিয়ত দিতে হবে না। তুমি শুধু এইটুকু বলো, কেনো তুমি এই কেসটা পরোক্ষ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো? আমরা কি যার যার মতো অন্য কিছু ভেবে নিবো?’’

চলবে…………