তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-১৭

0
17

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ১৭
লেখিকা- রিয়া খান

শ্বাসরুদ্ধ সময় যাচ্ছে মিশানের উপর দিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঘুরিয়ে আসছে, এতোক্ষণ ধরে কান্না করলে মাথা স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকারই কথা।
কান্নার বেগ স্রোতের মতো বেড়ে চলছে। মিশানকে ধরে কেউ সরাতে পারছে না নিশানের লাশের থেকে।
কয়েকজন হাফেজি নারী এসেছে, নিশানকে শেষ গোসল করানোর জন্য। মিশান নিশানের লাশের দিকে পলক বিহীন নজরে তাকিয়ে কাঁদছে মহিলাগুলো আলতোভাবে নিশানকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে সে দৃশ্য দেখছে।
গোসল শেষে পাঁচ টুকরো কাপড় নিয়ে নিশানকে পড়িয়ে মুড়ানো হচ্ছে আর মিশানের কলিজাটা একটু একটু করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। নিশানের গোসলের সময় থেকে কাফনের কাপড় পড়ানোর সময় অব্ধি মিশান পাশেই থুবু হয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
একটু একটু করে নিশানের চলে যাওয়ার সময় হচ্ছে, মিশান দুচোখ ভরে শেষ দেখা দেখে যাচ্ছে। যা দেখার আজই শেষ দেখা দু বোনের। দ্বীপ এখনো একফোঁটা কান্নাও করেনি, জ্ঞান ফেরার পর যখন জানতে পেরেছে নিশান আর পৃথিবীতে নেই, ওর জবান বন্ধ হয়ে গেছে, কারো সাথে একটা কথাও বলে নি। তবে ও চলাফেরা করছে স্বাভাবিকের মতো, মিশান তাও কেঁদে হাল্কা হচ্ছে কিন্তু দ্বীপ?
গোসল দিয়ে সাদা পাঞ্জাবী পড়ে অর্ধাঙ্গিনীর জানাজা আর লাশ দাফনের জন্য তৈরী হচ্ছিল।
নিশানের লাশের খাট টা মিশানের সামনে থেকে নেয়ার সময় হলো, মিশান পাগলের মতো চিৎকার করে বলছে নিশানকে যেতে দেবে না ওর সাথেই রাখবে মৃত লাশটাকেই। নিজের সাথে রাখবে।
আত্মীয় স্বজনরা মিশানের হাত ধরে আটকে রাখলো, মিশান চেষ্টা করছে শেষ বারের মতো ছুটে গিয়ে নিশানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে, কেউ যেতে দিচ্ছে না। লাশটা তুলে নেয়া হলো,
দ্বীপ আর ওর বাবা লাশের খাট সামনে থেকে কাঁধে নিল।
জানাজা শেষে লাশ দাফনের সময়ও নিশানকে কবরে নামালো ।
এতোসময় কান্না করে শেষ সময় মিশান সেন্সলেস হয়ে যায়। জানাজা শেষে যখন নিশানকে কবর দিতে নিয়ে যায় সে সময় সেন্সলেস হয়ে যায়।
ওর মাথায় অনবরত পানি ঢালা হচ্ছে, একজন মিশানের অচেতন অবস্থাতেই ওকে গোসল করিয়ে শুইয়ে রেখেছে।
রাতের দিকে যখন সেন্স ফিরে নিজেকে নিজের ঘরে আবিষ্কার করে, মনে হচ্ছিলো কাল থেকে যা হয়েছে সবটা স্বপ্ন ছিল।
কাল রাতের এই সময়টাতেও নিশান বেঁচে ছিল, সেটা ভেবেই মিশান আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। নিশান ছাড়া এই ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
যে বিছানাটাই শুয়ে আছে এই বিছানাটাও যেনো নিশানকে ছাড়া একা মিশানকে নিতে পারছে না।
মিশান উঠে গুটিয়ে বসে ঠোঁট কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কাঁদছে।
এমন সময় দ্বীপ একটা প্লেটে দুটো রুটি এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে এসে মিশানের সামনে বসে, প্লেট আর গ্লাসটা সামনে রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে দ্বীপ বলে উঠে,
‘‘জ্ঞান ফেরার পর আমি কারো সাথে একটা কথাও বলিনি মিশান, একফোঁটা চোখের পানিও ফেলিনি, সবাই ভাবছে নিশানের মৃত্যুটা হয়তো এখনো মেনে নিতে পারিনি বলে আমি কাঁদছি না।
আমি কেনো কান্না করিনি জানিস?
আমি কান্না করিনি বলে এই না যে কান্না করবো না। কান্না আমি সেদিনই করবো যেদিন নিশানের খুনি গুলোর একজনও বেঁচে থাকবে না, ওদের এতোটা কঠিন মৃত্যু আমি দেখতে চাই যে মৃত্যুতে ওর পরিবার গুলো কষ্টর থেকে ভয় ই বেশি পাবে, ওদের মতো কুসন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে ওদের পরিবার ভয়ে কষ্টে কাঁদবে আর ওরা হারাবে নির্মম ভাবে প্রাণ!
তুই আমাকে সেই কান্নার দিন এনে দিতে পারবি মিশান?’’
‘‘তুই ওদের চিনিস?’’
‘‘নাহ, তবে দেখেছি। পরবর্তীতে ওদের দেখলেই চিনবো। জানি না ওরা কারা তবে জানতে বেশিদিন লাগবে না, ওদের খুঁজবো।’’
‘‘কাল রাতে কি কি হয়েছিল?’’
‘‘কাল বিকেল থেকে নিশান বার বার ফোন করে বলছিল বাড়ি ফিরতে, আমি অনেক ব্যস্ত ছিলাম তাই প্রতিবার ই বলে দেই আমি ব্যস্ত আছি এখন ফিরতে পারবো না, রাত হবে। এরপর ওর সেই পরিচিত ইমোশনাল ডায়লগ,‘তোমার আসতে হবে না, অফিসেই থাকো,আমি মরে গেলে এসো।’
বাধ্য হয়ে সব কাজ ফেলে বাড়িতে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসি। আসার পর পর বায়না শুরু ঢাকার বাইরে কোথায় নাকি পূর্ণিমা রাতে অনেক জোনাকিপোকা দেখা যায়, সেখানে যাবে। কার কাছে শুনেছে কোথায় দেখেছে অই ই ভালো জানে, আমি রাজি হয়ে গেলাম নিয়ে যেতে।
মাকে বলে দুজনেই বাড়ি থেকে বের হলাম ঢাকার বাইরের সেই জায়গাতেই গেলাম যেখানে ও বলেছে। যাওয়ার পর ওর কথা মতো বেশ সুন্দর মনোরম পরিবেশ দেখতে পেলাম। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছিলো চারদিকে, অঢেল জোনাকিপোকার মেলা। নিশান খুব মজা পাচ্ছিলো, জোনাকিপোকাদের সাথে খেলায় মেতে উঠছিল। আমিও ওর সাথে সঙ্গ দিচ্ছিলাম। এমন সময় বেশ কয়েকজন ছেলে এলো এসেই আমাদের দুজনকে ঘেরাও করে নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার নাম নিশান?’
নিশান মাথা নাড়িয়া হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
‘নর্থ সাউথে জার্নালিজম নিয়ে পড়ো?’
নিশান আবারো হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো,
আর নিশানের উত্তর দিতে না দিতেই একজন ছেলে নিশানের গালে জোরে থাপ্পড় মারে, নিশান থাপ্পড় খেয়ে পড়ে যায়, আমি নিশানকে তুলে নিয়ে ওদের বললাম,‘ভাই কি হয়েছে? ওকে মারলেন কেনো? কি করেছে? আমাকে বলেন, ওর গায়ে হাত তুললেন কেনো?’
ছেলেটা উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে আমাকে বলল,
‘অই চু** ভাই তুই ক্যারা? তরে ক্যান কমু? ঝামেলা তো তর সাথে না, যদি নিজের ভালো চাস তুই এইখান থিকা পালা।’
‘ভাই কি বলছেন আমার বউকে ছেড়ে আমি একা এখান থেকে পালাবো? ভাই আমাকে বলেন কি নিয়ে সমস্যা হয়েছে?’
‘অইত তুই এতো বেশি কথা কস ক্যা?’
এটা বলেই আমার পেটে লাত্থি মেরে আমাকে ফেলে দেয়, আর নিশানের চুলের মুঠি ধরে, আমি উঠে নিশানকে ছাড়াতে যাবো তার আগেই ওরা কয়েকজন আমাকে আটকে ধরে, আমি এদিক ওদিক তাকাতাকি করে লোক ডাকাডাকি করছিলাম কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিল না। আমি ওদের অনেক রিকুয়েস্ট করছিলাম অনেক কাকুতিমিনতি করছিলাম। ওরা কেউ শুনছিলো না আমার কথা। আমার চোখের সামনে ওরা নিশানকে মলেস্ট করছিলো, কিন্তু যা করেছে তা রেপের থেকে কম কিছু না।
ওরা নিশানের সাথে দুর্ব্যবহার তো করছিলোই সাথে নানা অকথ্য ভাষায় গালী দিচ্ছিলো, আর কথার ভাবে যা বুঝেছিলাম নিশানের কাছে হয়তো ওদের কোনো পারসোনাল ইনফরমেশন ছিলো যেটা নিশান অই ছেলের থানাতে জমা দিয়ে রিপোর্ট করেছিল, কিন্তু অই থানার পুলিশ নিশানের সব ডিটেইলস প্লাস ওদের উপর করা অভিযোগের প্রমাণ সব দিয়ে দেয় ওদের কাছে, অই পুলিশ গুলো ওদের সাথে হাত মেলানো।
আর অই ছেলেগুলোকে নিশানের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে ওর কোনো ক্লাসমেট, ওদের কথার ভাবে এইটুকুই বুঝতে পেরেছি, এর থেকে বেশি কিছু আমি বুঝতে পারিনি।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা নিশানকে আমার সামনে গণ ধর্ষণ করবে বলে মনে হচ্ছিলো, আমি শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে নিজেকে ওদের থেকে ছাড়িয়ে আমি ওদের হাত থেকে নিশানকেও ছাড়িয়ে নিয়ে ওই জায়গা থেকে ছুটতে থাকি
ছুটার সময় নিশানকে বার বার বলছিলাম আমার যদি আজ কিছু হয়েও যায় তুমি এখান থেকে পালাবে, নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়াও। ওদের থেকে ছুটে আমাদের গাড়িতে উঠার কোনো সুযোগ ছিল না যার জন্য দুজনেই ছুটছিলাম।
কিন্তু নিশান দৌড়াতে পারছিলো না খুব একটা, নিশান না চাইতেও আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করি
কিন্তু আমার দৌড়ও এগুচ্ছিলো না, পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা আমাদের ধরেই ফেলেছে প্রায়, এমন সময় ওরা পেছন থেকে একটা ভারী কিছু ছুড়ে মারে, যেটা আমার মাথায় লাগার পর আমি নিতে না পেরে পড়ে যাই, নিশানের মাথায় ও লেগেছিলো কিছুটা।
আমি নিশানকে নিয়েই মাটিতে পড়ে যাই, নিশান আমাকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করছিল আমি বুঝতে পারছিলাম আমি এখন আর উঠতে পারবো না, তাই বার বার নিশানকে বলছিলাম ওখান থেকে পালাতে, নিশান আমার কথা শুনছিলো না, আমি ওকে বলি ‘তুমি যদি এখন না পালাও, ওরা আমাদের দুজনকেই মেরে দেবে। একটাবার ভাবো নিশান, মিশান একা হয়ে যাবে, অন্তত ওর জন্য পালাও এখন তুমিও বেঁচে থাকবে আমিও বেঁচে থাকবো’ এটা বলার পর নিশান উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকে, এতোক্ষণে ওরা আমাদের প্রায় ছুঁই ছুঁই, আমি কয়েক ন্যানোসেকেন্ডে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলাম। তারপর আমি আর জানি না কি হয়েছে নিশানের সাথে।
হসপিটালে জ্ঞান ফিরতেই এসে দেখি ওর গায়ে বেশ কয়েকটা গুলি করা হয়েছে।
নিশানকে ওরা অনেক বাজে ভাবে মেরেছে মিশান, ওদের প্রত্যেকের ভয়াবহ মৃত্যু দেখতে চাই আমি।’’
মিশান চুপচাপ বসে দ্বীপের কথা অনুযায়ী বোনের মৃত্যুর দৃশ্য কল্পনায় ঢুকে গেল।
চোখ থেকে নিশ্চুপ জল গড়িয়ে পড়ছে এটা নিশানের মৃত্যুর জন্য গড়িয়ে পড়া জল না, এটা নিশানের খুনিদের উপর ক্ষোভের জল।
দ্বীপ একটুকরো রুটি মিশানের মুখের সামনে ধরলো, মিশান মাথা নাড়িয়ে খাবে না জানালো।
দ্বীপ বলল,
‘‘না খেয়ে মরতে চাস? না খেয়ে কেউ মরে না মিশান। দুর্বল হয়ে যাবি অসুস্থ হয়ে যাবি এর বেশি কিছু না। দুর্বল হওয়া যাবে না মিশান। যেভাবেই হোক সুস্থ থাকতে হবে, অই খুনিগুলোকে খুঁজে বের করে ওদের শাস্তি দিতে হবে।
মিশান তুই কথা দে, নিশানের খুনিদের তুই অনেক কঠিন মৃত্যু দিবি? আমার কান্নার দিন এনে দিবি। তুই আমাকে কথা দে এটা, এই কাজে আমার পাশে থাকবি? ’’
‘‘পাশে না দ্বীপ। আমি সামনে থাকবো, তুই পেছনে। একজনকে খুঁজে বের করতে পারলে বাকিদেরও অনায়েশে পেয়ে যাবো। তুই চোখ কান খোলা রেখে দেখ ওদের পাওয়া যায় কিনা।’’
‘‘অবশ্যই।’’
‘‘আমাকে এখন একটু থাকতে দে।’’
‘‘আগে খাবারটা খা।’’
‘‘নাহ আর খাবো না।’’
‘‘আর দু টুকরো মিশান।’’
না চাইতেও মিশানকে একটা রুটির অর্ধেক অংশ জোর করে খাইয়ে দিয়ে এক গ্লাস পানি খাইয়ে বেরিয়ে চলে যায়।মিশান চুপচাপ ঘরটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, নিশানের স্মৃতি গুলো খুব করে আঁকড়ে ধরছে, মাথার যন্ত্রণা উঠে গেছে, নিতে পারছে না কোনোভাবেই নিশানের বাজে মৃত্যুর ঘটনাটাকে, অই কালপিট গুলোকে কিভাবে কোথায় পাবে জানা নেই, কে ওরা সেটাও জানা নেই।
নিশানের স্মৃতি নিয়ে ঘরেই বন্দী হয়ে রইল বেশ কিছুদিন।
ওদিকে মিশান যে রিজাইন লেটার দিয়েছিলো সেটা একসেপ্ট করার আগে মিশানের সার্বিক দিক বিবেচনা করে পুনরায় জয়েন করতে বলে, কিন্তু মিশান কোনোভাবেই এই সেনাবাহিনীতে ব্যাক করবে না। কারণ এই চাকরীর পেছনে সময় দিতে গিয়ে বোনের শেষ সময়ে পাশে থাকতে পারে নি, বোনের সাথে থাকতে পারেনি বলেই আজ ওর এমন ভয়াবহ মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছে । নিশানকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে নি মিশান। সব মিলিয়ে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হতে থাকে, ঘরের কোণে বসে রুদ্ধশ্বাস সময় কাটায় গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে। বেশ কয়েকদিন পর তীব্র মিশানকে দেখা করতে বলে, মিশানকে নিয়ে সেই জায়গাটাতে যায় যেখানে নিশানের মৃত দেহটা পায়। সেদিন নিশানকে গুলি করার পর ওর হাত থেকে ওর মোবাইলটা ছিটকে দূরে পড়ে যায় , তীব্র নিশানকে তুলে নেয়ার সময় ওর মোবাইলটা পায়ের নিচে দেখতে পেয়ে নিশানকে গাড়িতে উঠিয়ে মোবাইল তুলে নেয়। এখন মোবাইল টা মিশানকে ফেরত দেয়।
‘‘সেদিন নিশানের পোস্ট মর্টেম করতে চাচ্ছিল, আমি বারণ করি। পুলিশ কেস লিখতে বলে, আমি সেটাও করি নি, উল্টো বারণ করে দিয়েছি যেনো কোনো থানা পুলিশ তো দূর এটা যেনো কোনো ভাবে জানাজানি না হয়।
থানাপুলিশ হলেই মিডিয়া জেনে যাবে আর মিডিয়া জানা মানে পুরো দুনিয়া জেনে যাবে।’’
মিশান নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে প্রশ্ন করল,
‘‘জানলেই কি, না জানলেই কি স্যার?’’
‘‘তুমি কি চাও না নিশানের খুনি যারা, তাদের শাস্তি হোক?’’
মিশান নিচুস্বরে উত্তর দিলো,
‘‘চাইবো না কেনো, অবশ্যই চাই। কিন্তু ওরা কারা আমি জানি না, কেনো মেরেছে তাও জানি না, কোথায় পাবো তাও জানি না।জানাজানিও হলেই তো ভালো হতো, ওদের খুঁজে পেতে সাহায্য হতো।’’
‘‘খুঁজে হয়তো পেতে, থানা পুলিশ হলে হয়তো ওদের যাবৎ জীবন জেল হতো। কিন্তু ওরা শাস্তি পেতো না।’’
মিশান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তীব্রর দিকে তাকায়
‘‘আইনের কথা মাথায় রেখো না, আমার সাইড থেকে যতোটুকু সাহায্য প্রয়োজন আমি করব। তুমি তোমার মতো কাজ চালিয়ে যাও। প্রশ্ন দাঁড়ালে উত্তর আমি দেবো। নিশানের সাথে করা অন্যায়ের হিসেব তোমাকে চুকাতে হবে মিশান, কাউকে ছেড়ো না।’’
‘‘কিন্তু কিভাবে কি করব স্যার? আমার মাথায় কিছু আসছে না।’’
‘‘আপাততো কিছু করতে হবে না, কিছুদিন নিজেকে ও নিজের মস্তিষ্ককে স্বাভাবিক অবস্থায় আনো’’
মিশান মলিন দৃষ্টিতে তীব্রর দিকে তাকিয়ে রইল, তীব্র মিশানের চেয়ে থাকা দেখে বলে উঠল,
‘‘ভেবো না তুমি আমার বউ বলে এই কথা বলছি। আমার নিজেরও একটা বোন আছে, নিশানও আমার বোনের মতো,
ভাই-বোন জিনিস কি সেটা বুঝি, তাদের হারালে কেমন লাগবে সেটা বুঝার ক্ষমতা আছে আমার। যদি একটা কুকুরকে মেরে দশটা কুকুরকে সাবধান করা যায়, তবে অই একটা কুকুর মরা ভালো। আশা করি বুঝতে পেরেছো। তাই যা যা বলি তাই ই করো, এতে নিশানের আত্মা ঠান্ডা হবে।’’
‘‘স্যার দ্বীপ তো অই ছেলেগুলোকে দেখেছে, যদি দ্বীপের কথামতো পেন্সিল স্কেচ করে চেহারাটা বের করা যায়?আপনাদের ডিপার্টমেন্টে তো এইরকম ভালো আর্টিস্ট আছে।’’
‘‘মিশান! এটা সিনেমা নয় বাস্তব। আর্টিস্ট দিয়ে ছবি করে নিলেও হুবুহু সেরকম হয় না, আর হলেও বাস্তবের সাথে স্কেচটা মেলানোও খুব সহজ না। কারণ অই চেহারা গুলো তোমার গোপনে খুঁজতে হবে, চাইলেই ছবিগুলো পাব্লিকের সামনে পাবলিশ করতে পারবে না। ধরো দ্বীপের কথা মতো স্কেচ করে নিলাম, সেটা মিলেও গেল, তাকে খোঁজার জন্য এক্সপোজ করা হয়েছে, ক্রিমিনাল পেয়েও গেলে, তারপর?
ওকে মারার পর সবাই ওর মৃত্যুর জন্য কাকে ধরবে আগে? অবশ্যই তোমাকে।’’
তীব্র থেমে গেল, কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বলল,
‘‘মাথা ঠান্ডা রাখো মিশান, একটু সময় নাও ব্রেইনের জন্য আমি যা বলি করো।’’
মিশান মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
‘‘ওকে স্যার।’’
বেশ কয়েকদিন যেতে থাকে মিশানের মস্তিষ্ক ধসে যেতে থাকে, আগে থেকেই তো নির্লিপ্ত এখন যেনো একদম নেতিয়ে পড়েছে।
কারো সাথে কথা বলে না, একা একা যখন তখন ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে। মানুষজন একদম ই দেখতে পারে না, অন্ধকারে নিজেকে বন্দী করে দেয়।
মিশানের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, নিজেরও জানা নেই কিভাবে কি করবে। মিশানের মতো দ্বীপেরও একই অবস্থা যদি একটাবার কোনো ভাবে খুঁজে পেতো ওদের একজনকে, তবে সব কটাকে পেয়ে যেতো।
বিষন্নময় বহু রাত পেরিয়ে যায় মিশানের জীবনে। অনেক দিন চলে যাওয়ার পর তীব্র মিশানকে কল করে জানায় নিশানের ফোনটা ভালোমতো চেক করেছিলো কিনা, মিশান ‘না’ বলে।
এরপর নিশানের ফোন ঘেঁটে দেখতে বলে কিছু পাওয়া যায় কিনা।
তীব্রর কথামতো মিশানের মাথায় বুদ্ধি আসে, মিশান নিশানের ফোনটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে দেখে, কিন্তু কোথাও কোনো কিছু মেলে না। হতাশ হয়ে তীব্রকে জানায় কিচ্ছু পায় নি, এরপর তীব্র বলে নিশানের বই খাতা বা নিশানের সমস্ত কিছুতে খুঁজাখুঁজি করতে কিছু পাওয়া যায় কিনা।
মিশান আবার সব কিছু খুঁজতে থাকে নিশানের প্রতিটা জিনিস বের করে খুঁজতে গিয়ে ওর পুরোনো স্মৃতিতে ডুব দেয়, ক্ষতটাতে আবার আঘাত লাগে, নিশানের জিনিস গুলো বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না করতে থাকে। প্রতিটা মুহুর্ত নিশানকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো সময়।
কান্না চেপে নিশানের সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কোথাও কিছু মেলে না।
তীব্রও হতাশ হয়ে দ্বীপকে নিয়ে ওর বর্ণনা মতে ছেলেগুলোর স্কেচ তৈরি করায়। সেগুলো থেকেও কোনো ক্লু মিলছিলো না তাদের। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর মিশান এক বিকেলে বসে বিখ্যাতো ফিলোসফার সিগমন্ড ফ্রেইডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম’ বইটা নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ার চেষ্টা করছিলো, এই বইটা নিশান খুব পড়তো।
দুই এক লাইন পড়ে আর নিশানের কথা মনে পড়ে। খাটে বসে জানালার গ্রিলে হেলান দিয়ে নিশান নানান রকম বই পড়তো। মিশান কিছুক্ষণ বইটা পড়ার পর আনমনে কয়েক পাতা উল্টাতে থাকে, এমন সময় একটা মেমোরি কার্ড বই থেকে স্লিপ খেয়ে মিশানের কোলে পড়লো।
মিশান অবাক হয়ে মেমোরি টা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। এরপর নিজের মোবাইলে মেমোরিটা ভরে ভেতরে ঢুকে দেখে কয়েকটা ভিডিও। মিশানের হাতটা কাঁপতে শুরু করে।
প্রথম ভিডিও প্লে করতেই দেখে,
একটা স্থানে আবর্জনার স্তুপের ভিডিও করা হচ্ছে, এমন সময় ভিডিওটা কোনো একদিকে জুম হলো, আর দেখা গেল একটা মেয়েকে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হলো, ভিডিওতে ওই গাড়িটার নাম্বারের ফুটেজও দেখা যাচ্ছিলো।
মিশান ভালোমতো ভিডিওটা দেখলো । বুঝতে পারল এটা নিশানের শ্যুট করা ভিডিও। হয়তো কয়েক ফ্রেন্ড মিলে কোনো ইভেন্টে গিয়েছিল, এই দৃশ্য দেখার পর নিশানের কয়েকটা ফ্রেন্ড ছুটে যায় অই মেয়েটার দিকে, আর নিশান সাথে অন্য কাউকে নিয়ে অই গাড়িটাকে ফলো করে, অনেকদূর ফলো করার পর দেখে
ছেলেগুলো গাড়ি থেকে নেমে একটা জায়গায় বসে ড্রাগস নেয়ায় মত্ত হয়।
এগুলো সব নিশান ভিডিও করে।
এরপর ফিরে গিয়ে অই মেয়েটার জবান বন্দীর নেয়। নিশানের ফ্রেন্ডরা মেয়েটাকে হসপিটালে ভর্তি করে, মেয়েটা হসপিটালে যেতে চায় না একপ্রকার জোর করেই নেয়া হয়।
মেয়েটার সাথে গাড়িতে কি হয় সে বিষয়ে মুখ খুলতে চায় না। অবশেষে স্বীকার করে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, এবং ছেলেগুলোর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার পর শর্ত দেয়া হয়েছে যেনো মুখ না খুলে, কেউ যেনো জানতে না পারে, নাহলে অই মেয়েকে তার পরিবার সহ মেরে দেবে। নিশান এটা নিয়ে থানায় যেতে চাইলে ওর ফ্রেন্ডরা বারণ করে কিন্তু নিশান কোনো কথা শুনে না, এভাবে যদি ছেড়ে দেয়া হয় অই ছেলেগুলোকে তবে পরবর্তীতে অন্য কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট হবে। নিশান নিজেই আর ওর এক ফ্রেন্ড মিলে চলে যায় যে থানার এরিয়াতে মেয়েটিকে ফেলে দেয়া হয়, সেই থানায় গিয়ে মামলা করে এবং সমস্ত প্রমাণ দিয়ে আসে। পুলিশ যদি হারিয়ে ফেলে সমস্ত প্রমাণ তার জন্য সব কিছু আগে থেকেই কপি করে নিজের কাছে রাখে। আর পুলিশ ওকে জিজ্ঞেস করে এগুলোর আর কোনো কপি আছে কিনা। নিশান পুলিশকে বলে এটার কোনো কপি নেই।
পুলিশ বিশ্বাস করে নেয়, আর নিশানকে আস্থা দেয় যে, তারা লিগ্যাল একশন নেবে, নিশানও ভরসা পায়। ঘটনা ক্রমে এটাই তোরাগ থানা, আর অই ছেলে গুলো ছিলো তোরাগ থানার এমপির ছেলে ও তার বন্ধু বান্ধব। অই থানার নিমক হারাম ওসি রিপন হায়দার ও এএসআই অন্তু সেদিন থানায় ডিউটি অফিসার ছিলো বলে ঘটনাক্রমে। এই ওসি ও এএসআই এর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে।
তোরাগের এমপির ছেলেকে ফোন দিয়ে তার থেকে মোটা টাকা খেয়ে, কেস ভ্যানিশ করে দেয় ও যে সমস্ত এভিডেন্স অই ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে সেগুলো তাদের হাতে তুলে দেয়। এমনকি নিশানের পরিচয়টাও।
নিশান নিজের পরিচয় সেখানে এইটুকুই দিয়ে আসে,
নর্থ সাউথের, জার্নালিজমের স্টুডেন্ট।
নাম নিশান খান। আর সিসিটিভি ফুটেজে নিশানের চেহারাটা দেখায়।
নিশানের বোকামি হয়েছিলো এ ব্যাপারে পরিবারের কাউকে জানায় নি, বাইরের ব্যাপার বাইরেই থাকতে দিয়েছিল।
কিন্তু মৃত্যু ওকে এই ওসিলা দিয়ে টেনে নিচ্ছিলো সেদিকে।
মিশান ভিডিও গুলো দেখে তীব্রকে দেখা করতে বলে, ভিডিও তীব্রও দেখে। বার বার ভালো মতো ভিডিও দেখে ইনভেস্টিগেশনস চালিয়ে মেলায় সব হিসেব, ছেলেগুলো কারা আর কেনো মেরেছে। এরপর মিশান ছেলে গুলোকে নগদে মারতে চাইলে তীব্র ওকে বুদ্ধি দেয় কৌশলে মারার জন্য। যদি অপেক্ষা করে কঠিন ফাঁদ পেতে ওদের মারা হয় তবে মিশানের নাম কোনোদিন উঠে আসবে না।
দীর্ঘদিন চিন্তা করে প্ল্যান বানায়, এরপর প্ল্যানের মূল প্যাঁচ লাগায় নিশানের খুনিদের তো মারবে এমন ভাবে মারবে যেনো কেউ কিছু বুঝতে না পারে, কোনো ভাবেই যেনো ধরতে না পারে কেনো মারছে, কে মারছে।
তাই সাইকো কিলারের স্টাইলে প্ল্যান সাজানো হয়।
আশে পাশে কিছু ক্রিমিনাল থাকে যাদের মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিৎ কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার ও টাকার গরমে তারা মুক্ত পাখির মতো ঘুরছে আর অপরাধ করছে।
তীব্র এদের একটা লিস্ট বানায়, এরপর মিশানকে বলে এদেরকে মারতে এদের সাথে গড় করে নিশানের খুনিদের মারতে। একেকজনকে একেক রকম করে মারতে।
এতে পুলিশের মাথায় যে যে এংগেল থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে সেসবের উত্তর যেনো তাদের মাথায় গুলিয়ে যায় সেইটা ভেবেই তীব্রর সব প্ল্যান। মিশানও স্বায় দেয় তীব্রর প্ল্যানে।
এরপর তাই ই শুরু করে দেয়, কিন্তু বিপত্তি বাঁধে অন্য কোথাও, মিশান স্বাভাবিক অবস্থায় কাউকে মারতে পারে না, ভয় পেয়ে যায়, টার্গেট মিস করে দেয়।
তখন এসব থেকে বেরুতে মিশান আবার রেড ওয়াইনের সাথে বন্ধুত্ব করে। ড্রিঙ্ক করার পর ই প্রফেশনাল ভাবে মারতে পারে। এভাবেই সময় নিয়ে সব গুছিয়ে এগিয়ে আসে আর ওদের কঠিন মৃত্যু দেয়। এই কাজে কেবলই দ্বীপ আর তীব্র সাহায্য করে মিশানকে।

(চলবে)