#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ৪
মাহিম রিসোর্টের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দূরের সমুদ্রের এঁকে বেঁকে চলা ঢেউ দেখতে লাগলো মন দিয়ে। লাল পরীকে দেখার পর থেকেই চোখ দু’টো শুধু তাকেই খুঁজে চলছে অবিরত। মাহিমের রুমের বাম পাশের রুম টাই ইভার। সে সবেই ডিনার করে এসেছে। ইভা বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে এক মনে কফি খাচ্ছে। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে আর হাসছে। শব্দ পেয়ে মাহিম সেদিকে তাকালো। ইভাকে দেখতে পেয়েই ওর চোক্ষু জোড়া চকচক করে উঠল। রাতের পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। এই স্নিগ্ধ পরিবেশে উত্তাল বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে লাল পরী। কি মায়াবি চেহারা তার। যতই দেখে তৃষ্ণা যেন মিটতে চায়না। কাজল কালো টানা টানা চোখ দুটো কি সুন্দর। তার পড়নের নেভি ব্লু কালারের ঢিলে ঢালা টিশার্ট। বাতাসের তালে প্রতিটা ঝাপটায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার গাঁয়ের শার্টা। সেই সাথে কোমড় পর্যন্ত খোলা চুল গুলো হাওয়ার তালে দুলছে। পড়নে ঢোলা কালো প্লাজুটাও বাতাসের প্রকোপে উড়ছে। প্লাজু উড়ার সাথে সাথে ইভার ফর্সা পা দুটো দেখা যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিললো মাহিম। তার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে চলছে। নেত্র যুগল বন্ধ করে নিল মাহিম। পুনরায় নেত্র খুলে চাইলো লাল পরীর দিকে। ইভাকে ডেকে বলল,
” লাল পরী কার সাথে কথা বলছো? তখন তোমার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল বলোনি। কি ভেবেছ? তুমি না বললে আমি জানতে পারবো না! তা কার সাথে এত হেসে হেসে কথা বলছো। তোমার বয়ফ্রেন্ড নাকি? ”
একক্ষেণে মাহিমকে লক্ষ করে ইভা। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
” আপনি! আপনি এখানে কি করছেন? আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলি বা অন্য কারো সাথে, সেটা যেনে আপনার কি কাজ? নিজের লিমিটের মধ্যে থাকুন মিস্টার! অনধিকার চর্চা আমি পছন্দ করিনা। আর তখন আমাকে আপনি বলছিলেন। এখন হুট করেই তুমিতে চলে গেলেন? বাহ! একেই বলে ছেলে মানুষ। মেয়ে দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে তাইনা! ”
” ভুল বললে। রিসোর্টা তোমার একার নয় রাইট? তোমাকেন কেন জানি আপনি বলতে ইচ্ছে করেনা। তুমি বলতেই ভালো লাগে। আর আমি মোটেই সেরকম টাইপের ছেলে নই। মেয়ে দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। শুধু তোমাকে দেখলেই কথা বলতে মন চায়। ইউ আর সো অ্যাট্রাকটিভ লাল পরী। ”
” এ্যাই! লাল পরীটা আবার কে? বাবা-মা আকিকা দিয়ে নাম রেখেছে ইভানা। আমি আমার নাম নিয়ে খুশি। আর মেয়েদের সাথে কথা বলেন কি না বলেন সেটাতো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। ”
” সে তোমার নাম যেটাই হোক। আমি তোমাকে লাল পরী বলেই ডাকবো। তা এখানে কত দিনের জন্য আছো? বাড়ি কোথায় তোমার? ”
” আপনাকে কেন বলবো? এসব জেনে আপনার কি কাজ? ”
” সেটা তোমার না জানলেও চলবে। যেটা জিজ্ঞাসা করেছি সেটা বলো। ”
” না বলবোনা। ”
” ওকে। বলা লাগবেনা। চলো নিচ থেকে ঘুরে আসি। ”
ইভা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” ঘুরতে যাবেন! এখন? তাও এত রাতে। পাগল নাকি আপনি? আপনি ভাবলেন কিভাবে আপনার সাথে আমি যাবো। এ্যাই মিস্টার আপনার মতলবটাকি শুনি? ”
মাহিম ফিচলে হেসে, ইভার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
” মতলবতো একটাই তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া। সবে দশটা বেজেছে। তেমন রাত হয়নি। আমার লাইফে তুমিই প্রথম মেয়ে যাকে আমি নিজে থেকে কিছু বলছি। ”
ইভা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
” এরকম ডায়লগ সব ছেলেরাই দেয়। আমার মতো সুন্দরি মেয়েদের পটানোর ধান্দা। ”
বেশ ভাব নিয়ে কথাটা বললো সে। মাহিম ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
” তুমি সুন্দর? ”
থমথমে খেয়ে যায় ইভা। বলল,
” আলবাত আমি সুন্দর। কেন? আমাকে কি দেখতে সুন্দর লাগেনা? ”
” মোটেই না। তুমি সুন্দর না। দেখলে মনে হয় বটগাছের পেত্নী। তোমার চোখ দুটো কেমন। ঠোঁট তো আরো বিশ্রী ছিঁহ! ”
ইভা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কটমট করে বলল,
” একদম বাজে কথা বলবেননা। আমি যথেষ্ট সু্ন্দরি। কত ছেলে আমার জন্য পাগল। ”
মাহিম মিটিমিটি হেসে বলে,
” আচ্ছা তুমি অনেক সুন্দর। খুশি? চলো এবার যাওয়া যাক। ”
ইভার ঘুম আসছে না। রাত বারো’টা-এক’টা ছাড়া ঘুমায়না ও। ওর বন্ধুরা যে যার রুমে চলে গিয়েছে। ভাবলো, সময় কাটানোর জন্য কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসাই যায়। তবে এভাবে অপরিচিত একজন ছেলের সাথে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? পরম মুহূর্তেই ভাবলো, সেখানে নিশ্চই আরো মানুষ থাকবে। মাহিমের কথায় সম্মতি প্রকাশ করল সে। রিসোর্ট থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই বীচ। আশেপাশে অনেক মানুষ দেখা যাচ্ছে। অনেকে একে অপরের সাথে গল্প করছে। ট্রুথ, ডিয়ার খেলছে। কেউবা প্রেমলীলায় ব্যস্ত। ওরা সবার থেকে অনেকটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের কাছাকাছি চলে এসেছে। ঢেউয়ের শব্দ উপভোগ করছে তারা। দু’জনই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছেনা। এদিকটা আবছা অন্ধকার। এখানে সচারাচর কোনো মানুষ রাতে আসেনা। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে মাহিম, ইভা। নিরবতা ভেঙে মাহিম বলল,
” কিছু বলছো না যে? ”
” কি বলবো? ”
” তোমার যা ইচ্ছা। ”
” আমার কিছুু বলার নেই। ”
” আমার যে তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে। ”
ইভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
” মানে? ”
” কিছুনা। এখানে কত দিনের জন্য ঘুরতে আসছ? বাড়ি ফিরবে কবে? ”
” আছি আরো দুই দিনের মতো। কিন্তু কেন? ”
” এমনি জিজ্ঞাসা করেছি। তা পড়াশুনা কতদুর?”
” অনার্স ফাইনাল ইয়ার। আপনি? ”
” সেইম। পাশাপাশি আমাদের অফিসে জয়েন করেছি। বাবাকে যতটা পারি ব্যবসায় হেল্প করছি।”
ইভা কথা বলছে আর একটু একটু করে হাঁটছে। কথার মাঝেই হঠাৎ কয়েকজন ছেলে সামনে চলে আসলো। কেমন বিচ্ছড়ি একটা গন্ধ নাকে আসছে। মেবি নেশা করেছে ছেলে গুলো। পাশকাটিয়ে চলে যেতে নিলেই ওদের মধ্যে একজন ছেলে ইভার ওড়না টেনে ধরে। চমকে যায় ও। ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,
” হাউ ডের ইউ ইডিয়ট! আমার ওড়না কেন ধরেছেন। ”
ছেলে গুলো কিছু বলবে তার আগেই মাহিম এসে ওড়না ধরে থাকা ছেলেটার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” তোর কলিজায় তো অনেক সাহস দেখছি। কার জিনিসে হাত দিয়েছিস জানিস? ”
বলেই ছেলেটার হাত পেছন দিকে মুচড়িয়ে ধরলো। ছেলেটা ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠল। ক্রোধে মাহিমের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। রাগে শরীর কাপছে। ধা’ক্কা দিয়ে নিচে ফেলে এলোপাথাড়ি লা”থি দিচ্ছে। বাকি ছেলে গুলো ভয় পেয়ে যায়। নেশা করায় ছেলেগুলো ঠিক মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। অধরা এসে মাহিমকে আটকানোর চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে ছেলেটার মুখ দিয়ে র*ক্ত উঠে এসেছে। ওকে মার খেতে দেখে বাকি ছেলেরা কোনো রকম তাকে মাহিমের থেকে ছাড়িয়ে চলে যায়। মাহিম রাগে ফুঁসছে। বিশ্রী ভাষায় গা’লি দিল ওদের। মাহিমকে এভাবে রেগে যেতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ও। সাথে অবাকও হয়েছে। ও বলল,
” মিস্টার আপনি শান্ত হোন। এত হাইপার হবেননা। ”
মাহিম চোখ বুঝে লম্বা শ্বাস নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” তুমি আমাকে আটকালে কেন? জা*নো*য়ার টাকে আজকে মে’রেই ফেলতাম। ”
” ছেড়ে দিন। এরকম বাঁজে ছেলেদের সাথে ঝামেলায় না জড়ানই ভালো। বাই দ্যা ওয়ে। আপনার নামটা যেন কি? ”
মাহিম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। বলল,
” মাহিম। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারো। সেইম ইয়ার যেহেতু। ”
” ডান। চলুন রিসোর্টে ফিরে যাই। ”
” ওকে চলো ”
**********
সকালে ঘুম থেকে ওঠেছে আলভী। তিনটা রুম বুক করেছিল রিসোর্টে। সাকিব আর ও একই রুমে থাকবে । মাহিম এক রুমে। আর মনা, মিম এর জন্য এক রুম। আড়মোড় ভেঙে সাকিবের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর কোমড় থেকে লুঙ্গি আলগা হয়ে গিয়েছে। যেকোন সময় খুলে যেতে পারে। ফ্রেস না হয়েই তো রুম থেকে বেরিয়ে যাবে! বিরক্ত হয় আলভী। মানুষ যে কিভাবে লুঙ্গি পড়ে! টাউজারেই ও কমফর্ট্যাবল ফিল করে। আলভী, সাকিবকে ডাকতে লাগল। মুখ কুঁচকে ফের ঘুমানোর চেষ্টা করল সে। আলভী ওর কানের কাছে চেচিয়ে উঠতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল সে। কটমট কন্ঠে বলল,
” সমস্যা কি? এভাবে ষাড়ের মতো চিৎকার করছিস কেন? ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। ধ্যাৎ! ”
” কয়টা বেজেছে সেদিকে খেয়াল আছে? আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। জলদি ওঠ। ”
” তোর ক্ষিধে পেলে তুই গিয়ে খাঁ। আমাকে কেন ডাকছিস? ”
” আমার একা যেতে ভালো লাগেনা। তাই তোকেও আমার সাথে যেতে হবে। ”
সাকিব বিরক্ত হয়ে ওঠে পড়ে। ওয়াশরুমের সামনে যেতেই ওর লুঙ্গি খুলে নিচে পড়ে যায়। আলভী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। দ্রুত লুঙ্গি তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” ঘরে কি তোর বাপ, ভাই নেই ? এভাবে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছিস। তোর লজ্জা না থাকলেও আমার আছে। ”
আলভী মিটিমিটি হেসে বলল,
” তোর যে কত লজ্জা সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এ্যাটলীসট ভিতরে একটা কিছু পড়েতো ঘুমাতে পারতিস। ”
” আমি কিছু পড়ি বা না পড়ি সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো তুই আমার দিকে কেন তাকাবি ? দরকার হলে আমি কাপড় ছাড়াই থাকব। তবুও তুই আমার দিকে নজর দিবিনা। ”
” ছ্যাহ! তোর দিকে তাকানোর থেকে প্রিন্সিপাল স্যারের টাকলা মাথার দিকে তাকানো ঢেড় ভালো। অন্তত রাস্তা ক্লিয়ার হবে। ”
সাকিব ভেঁঙচি কেটে আলভীকে বকতে বকতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আলভী দাঁত কেলিয়ে হেসে বিছানা গুছাতে শুরু করল।
চলবে,,,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন। )