হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-১০

0
16

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ১০

বাড়ি ফেরার পর মাহিমকে দেখে আঁতকে উঠেন জামিলা। মাহিমের ঠোঁট কে’টে র’ক্ত শুকিয়ে গিয়েছে। মুখটা অসহায় পথিকের ন্যায় মনে হচ্ছে। কেমন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। মমতা ছেলেকে ধরে সোফায় বসান। হানিফকে ফোন করতেই সব কাজ ফেলে ছুটে আসেন বাড়িতে। এসে দেখেন স্ত্রী ছেলেকে জড়িয়ে কান্না করছেন। পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত রেখে স্ত্রীকে বললেন,

” কান্না থামাও জামিলা। ফাস্ট-এইড বক্সটা নিয়ে এসো। কুইক। ”

জামিলা চলে যান। মাহিম চোখ বন্ধ করে আছে। বাবার কাঁধে মাথা রাখে। শান্ত কন্ঠে বলে,

” আমি কি কোনো পাপ করেছি বাবা? কখনো কারো ক্ষতি করেছি বলেও তো মনে পড়ছেনা। আমার সাথে এমন কেন হলো? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাবা। সহ্য করতে পারছিনা। আমার লাল পরীকে নিয়ে গেল। আমার বুকে ব্যথা করছে। ”

” শান্ত হও তুমি। কি হয়েছে বলো আমাকে। ”

মাহিম সব কিছু বললো হানিফকে। তিনি হতাশ হলেন। কোনো বাবা নিজের মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার করে? ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

” তুমি এভাবে নিজেকে ভেঙে পরতে দিওনা। নিজেকে দুর্বল ভাবলে চলবে না। শক্ত থাকতে হবে। আমি কথা বলবে ইভার বাবার সাথে। ”

” কোনো লাভ নেই বাবা। তার কথার ধরন দেখেই বুঝতে পেরেছি সে কেমন। ইভা আমাকে বলেছিল তার বাবা অনেক স্বার্থপর। খারাপ মানুষ। আজকে বুঝতে পেরেছি তিনি কতটা নিচ। নিজের স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করতেও তিনি দু’বার ভাবেন না। ”

জামিলা ফাস্ট-এইড বক্স নিয়ে আসলেন। হানিফ নিজ হাতে ছেলের ক্ষত স্থানে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন। জামিলা কাঁদছেন। মাহিম তাকায় মায়ের দিকে। হাত ধরে পাশে বসায়। তিনি বসতেই মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। হাত দুটো টেনে নিয়ে মাথায় রাখে। এক হাত বাড়িয়ে মায়ের অশ্রুকণা মুছে দেয়। কিয়ৎকাল চোখ বন্ধ করে রেখে বলল,

” আমি এখন ঠিক আছি। তোমরা যাও। একটু রেস্ট করবো। ”

” চল তোকে রুমে দিয়ে আসি। ”

মায়ের সাহায্য নিয়ে রুমে গেল মাহিম। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে দরজা চাপিয়ে ওনারা বেড়িয়ে গেলেন। বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। পকেট থেকে ফোন বের করে আলভী কে কল করলো। বক্সে গান চালিয়ে ঊড়াধুরা নাচছে সে। রিংটনের আওয়াজ কানে পৌঁছাচ্ছেনা। বাজতে বাজতে কলটা কে’টে গিয়েছে। মাহিমের ধৈর্যে কুলাচ্ছে না। কয়েকবার কল দেওয়ার পরও রিসিভ হয়নি। রেগে ফোনটা দেয়ালে ছুড়ে মা’রতে গিয়েও ছুড়লো না। ডান্স শেষে ক্লান্ত হয়ে তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে মাহিম চারবার কল করেছে। ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে চেয়ে থাকে। মাহিম তো এতবার ফোন করার ছেলে না। কোনো প্রবলেম হয়েছে কি? চিন্তায় পড়ে যায় আলভী। সহসা ললাটে ভাঁজ পড়ে। দ্রুত কল ব্যাক করে। মাহিমও সহসা রিসিভ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” ম’রতে গিয়েছিলি নাকি? কখন থেকে ফোন করছি? ফোন ধরছিলি না কেন? ”

” সরি ব্রো। মিউজিক শুনছিলাম তাই রিংটনের শব্দ শুনতে পাইনি। এতবার কল করলি। এনি প্রবলেম?

” প্রবলেম তো হয়েছে। আমি ইভার সাথে কনট্যাকট করতে পারছিনা। তুই একটু ওর খোঁজ নিয়ে আমাকে জানা। ”

” ওয়েট ওয়েট। তুই কনট্যাকট করতে না পারলে আমি কিভাবে করবো? ”

চোখ বন্ধ করে রাগ কমানোর চেষ্টা করল মাহিম। শান্ত কন্ঠে সবটা খুলে বললো তাকে। সব শুনে আলভী পুরো ‘থ’ মেরে গিয়েছে। সিরিয়াস কন্ঠে বলল,

” দোস্ত আমি এক্ষুনি তোদের বাড়িতে আসছি তোকে দেখতে। সাকিব’কেও বলছি। ”

” একদম না। আমার কাছে আসতে হবে না। তোকে যেটা বলেছি সেটা কর। আমার কিছু ভালো লাগছে না আলভী। প্লিজ কথা বাড়াস না। যা করতে বলেছি সেটা কর। ”

” ওকে। ওকে। তুই কোনো টেনশন করিস না। আমি দেখছি কি করা যায়। ”

মাহিম কল কে’টে দিল। ইভার জন্য চিন্তা হচ্ছে। কে জানে মেয়েটা এখন কি অবস্থায় আছে। রেগে মাথার চুল খামছে ধরলো। কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না। তবে ইভার বাবা যে মোটেও ভালো লোক না সেটা ও বুঝে গিয়েছে। মারাত্মক ধুরন্তর লোক একটা।

**********
মেঝেতে বসে অবিরত কেঁদে চলেছে ইভা। বাড়িতে এনে ওর বাবা কয়েকটা থা*প্পর মেরেছে। শাষিয়ে বলেছে মাহিমকে ভুলে যেতে। কোনো প্রকার তার সাথে যোগাযোগ করলে মাহিমকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিবে। ইভাও বলেছে সে আর মাহিমের সাথে যোগাযোগ রাখবে না। ইভার কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ছেলেটা কত ভালোবাসে ওকে। এই কয়েক মাসে সম্পর্কে খুব ভালো করেই চিনেছে তাকে। মাহিমের মতো ভদ্র ছেলে খুবই বিরল। মাহিম’তো তার লাল পরীকে না পেলে পাগল হয়ে যাবে। বিছানার চাদর খামছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। এই কষ্টকে দ্বিগুণ করে দিলো ওর বাবার একটি কথায়। দরজা বাইরে থেকে লক করা ছিল। লিটন পাটোয়ারি এসে বললেন,

” আগামী তিন দিনের মধ্যে তোর বিয়ে। আমেরিকার বিখ্যাত বিজনেস ম্যান সুনু পাটোয়ারির ছেলে রতন পাটোয়ারির সাথে। তারা আমাদের দুস্পর্কের আত্মীয় হয়। তোকে ভীষন পছন্দ করে রতন। প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। রানীর মতো থাকবে। ”

চমকে উঠলো ইভা। নেত্র যুগল পুনরায় জলে টইটুম্বর হলো। কাঁপা কন্ঠে বলল,

” আমি তো বলেছি মাহিমের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক রাখবো না। তাহলে কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছো? ”

” তোদের বিয়ে আরো আগেই ঠিক হয়ে ছিল। পড়াশুনা করছিস বলে তোকে জানাইনি। কিন্তু তুই তো আমার বিশ্বাস ভরসা ভেঙে নাগড় জুটিয়ে রেখেছিলি। তাও আমাকে না জানিয়ে। ”

” আমি রতনকে বিয়ে করতে চাই না। তুমি ওদের না করে দাও। ”

” পাগল নাকি? বিয়ে ভেঙে দিয়ে নিজের পায়ে কুড়া’ল মারবো এমন বোকা আমি নই। তোকে রতনের সাথে বিয়ে দিলে ওমানের একটা বড় বাড়ি’সহ তাদের বিজনেস এর ফিপ্টি পার্সেন্ট শেয়ার আমাকে দিবে। সো বেশি কথা না বলে বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর। ”

” ওরা তোমাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছে। কোনো কিছুই দিবেনা তোমাকে। মিথ্যে বলছে। ওদের ফাঁদে পা দিওনা। তুমি যেটা বলবে আমি সেটাই করবো। তবুও রতনের মতো চরিত্রহীন লোক কে বিয়ে করতে বলোনা। ”

” বেশি জ্ঞান দিবিনা। তোর থেকে আমি কম বুঝি নাকি? আমি লিটন পাটোয়ারি। আমাকে ধোঁকা দেওয়া ওত সহজ না। তাই চুপচাপ আমার কথা মেনে নিয়ে নিজে ভালো থাক। আমাকেও ভালো থাকতে দে। ”

” রতনের সাথে বিয়ে হলে আমি ভালো থাকবোনা বাবা। আমার জীবনটা ধ্বংশ হয়ে যাবে। তোমাকেও ঠকাবে তারা। ”

” বেশি কথা আমার পছন্দ না। তিন দিন পর রতনের সাথে তোর বিয়ে এটাই ফাইনাল। বিয়ের পর তোকেও আমেরিকায় নিয়ে যাবে। ”

” আমি কোথাও যাবোনা। বিয়েও করবোনা। ”

” চুপ। কোনো কথা না। ফ্রেস হয়ে নে। সার্ভেন্টকে বলছি সে এসে খাবার দিয়ে যাবে। ”

ইভার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন লিটন। কান্নার বেগ বাড়লো ইভার। নিয়তি কেন এমন করছে ওর সাথে? কেন ভালোবেসে কাউকে আপন করে বাঁচতে পারবেনা? কেন সবার নজর লেগে যায় ওর সুখের উপর? কেন শান্তি প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে থাকতে পারবেনা? ফোন হাতে নিয়ে দেখে মাহিমের অসংখ্য ফোন কল আর মেসেজ। ফোনটা বুকে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। ভালোবাসা সত্যি অনেক কষ্টের। অনেক যন্ত্রণার। সেজন্যই হয়তো কেউ বলেছিল।

❝ যদি তুমি কাউকে ভালোবাসতে চাও?
তাহলে, এক বুক যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে। ❞

**********
সার্ভেন্টকে ইভার জন্য খাবার পাঠাতে বলল। লিটন বডি গার্ড গুলোক বলল কড়া নজর রাখতে। তিনি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাবেন। কাজ আছে। ফোন থেকে কল করল রতনকে। সে তখন মেয়েদের নিয়ে অশ্লীল কাজ কর্মে ব্যস্ত। মদের বোতলে চুমুক দিয়ে ফোন রিসিভ করে বলল,

” হাই ফাদার ইন-ল। হোয়াটস আপ। ”

লিটন থমথমে মুখে বললেন,

” ভালো। তোমার কন্ঠ এমন শোনা যাচ্ছে কেন? নেশা করছো নাকি? ”

রতন পৈশাচিক হেসে একটা মেয়ের ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,

” ইয়েস। নেশা করছি। তা আমাদের বিয়ের খবর কি? ”

” তিনদিন পর। তোমার বাবার সাথে কথা বলেছি এই ব্যাপারে। ”

” নাইস। ইউ আর সো সুইট ফাদার ইন-ল। তিনদিন কেন? আপনি বললে আজকেই বাংলাদেশে ব্যাক করতাম। ইউ আর ঠু লেইজি। নটি বয়। ”

” আমি এখন রাখছি। কাজ আছে। পড়ে কথা বলবো। ”

” ইয়্যাহ। সিউর। ”

ফোন রেখে পুনরায় মেয়েদের নেশায় মেতে উঠে রতন। একজন মেয়ে বলল,

” কার সাথে কথা বলছিলে? ”

” তেমন কেউ না ডার্লিং। নতুন পাখির সন্ধান পেয়েছি। সে সব ছাড়ো। মুড নষ্ট করোনা তো। এনজয় করো। ”

” মেয়েটি দু’হাতে রতনের গলা জড়িয়ে ধরে, নিজেদের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ”

চলবে,,,