হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-১১

0
16

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#সুমাইয়া_সুলতানা
#পর্বঃ১১

আজ দু’ দিন হতে চললো মাহিমের সাথে ইভার কোনো যোগাযোগ নেই। মাহিম অনেক চেষ্টা করেছে ইভার সাথে কথা বলার জন্য পারেনি। নিজেকে অসহায় লাগছে খুব। এই দুইদিন না ঠিক মতো খাবার খেয়েছে। না ঠিক মতো কারো সাথে কথা বলেছে। প্রয়োজনে আলভীর, সাকিবের সাথে কথা হয়েছে। বাড়ি থেকেও তেমন বেড় হয়না। যখনি বের হয়েছে ইভার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছে। তবে দিন শেষে খালি হাতেই ফিরতে হয় তাকে। ছেলের কষ্টে জামিলা প্রতিটা মুহূর্তে কাঁদে। তার ছেলেটা কেমন ছন্নছাড়া হয়েগিয়েছে। ওনারাও ইভার বাবার সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিক করতে চেয়েছিলেন। ইভার বাবা মাহিমের বাবাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। মাহিমকে মারার হুম’কিও দিয়েছেন। ভদ্রলোক ছেলে হারানোর ভয়ে আর কিছু বলেননি। তবে ছেলের এই কষ্টও তিনি দেখতে পারছেন না। কি করবেন? কিছুই ভেবে পান না। আলভী খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে ইভাকে তার বাবা বাড়িতে রুমের মধ্যে আটকে রেখেছে। ও জানে ওর লাল পরী ভালো নেই। ভালো নেই তার মাহিমকে ছাড়া। ওর মতো সেও কষ্টে আছে। মর’ন যন্ত্রণা ভোগ করছে। কিন্তু জানতে পারেনি আর একদিন এরপর তার লাল পরীকে অন্য কেউ বিয়ে করে ওর চোখের আড়াল থেকে অনক দূর নিয়ে যাবে। ওর জীবনটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে হারিয়ে যাবে ওর লাল পরী। মাহিম কি সেই বেদনা সহ্য করতে পারবে?

নদীর পাড়ে একা দাঁড়িয়ে আছে মাহিম। কোনো কিছু ভালো লাগছেনা। আশেপাশের সব কিছুই বিরক্ত লাগছে। সন্ধ্যা হয়েগিয়েছে। নিস্তব্দ পরিবেশ। এক দৃষ্টিতে হালকা ঢেউ খেলে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে থাকা মুঠো ফোনটা বাজতেই সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আলভী ফোন করেছে। ওর এখন কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। না চাইতেও রিসিভ করে। রেগে কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে কান্না মিশ্রীত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

” আমাকে তুমি নিয়ে চলো মাহিম। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি…. ”

আর বলতে পারে না। কান্না গুলো গলায় যেন দলা পাঁকিয়ে গিয়েছে। চোখ থেকে ঝড়নার ন্যায় অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। মাহিম ধরা আশা গলায় শুধু উচ্চারন করলো,

” লাল পরী! ”

ফোনের ওপাশ থেকে ঝাঁজালো কন্ঠে আলভী বলল,

” বা*ল তোদের ইমোশোনাল কথাবার্তা পরে বলিস। হাতে বেশি সময় নেই। আগে আমি একটা ঠিকানা বলছি দ্রুত সেখানে চলে আয়। এখানে এসে যত পারিস ইয়ে করিস। আই মিন রোমান্টিক, দুঃখের সুখের কথা বলিস। ”

বলেই ফোন কে’টে দিয়েছে। মাহিমের ফোনে এড্রেস মেসেজ করে দিয়েছে। মাহিম ও আর এক মুহূর্ত দেড়ি না করে তার লাল পরীর কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। আলভী ইভাকে শান্ত হতে বলছে। বোঝাচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলভীর দেওয়া নির্দিষ্ট ঠিকানায় চলে আসে মাহিম। জায়গাটা অনেকটা জঙ্গলের মতো দেখতে। আশেপাশে বাড়ি-ঘরও তেমন একটা চোখে পড়ছে না। সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশ চোখ বুলিয়ে সম্মুখের দিকে এগিয়ে গেল। মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই আলভী’কে দেখতে পেল। কিন্তু তার চোখ দুটো তো লাল পরীকে খুঁজছে। আলভী মাহিমকে দেখতে পেয়ে বলল,

” কি মামা! আজ এত ফাস্ট ফাস্ট চলে এলি। আড্ডাতে তো অনেক লেট করে আসিস। ”

মাহিম বিরক্ত হয়। অধৈর্য সহিত জিজ্ঞেস করলো,

” ইভা কোথায়? তোর ফোন থেকে কথা বলেছিল না? কোথায় ও? জলদি বল? ”

তখনি গুটিগুটি পায়ে লাল বেনারসি পড়া এক সুন্দর রমণী ওর সামনে এসে দাঁড়াল। সাথে সাকিবও আছে। কি সুন্দর লাগছে। মুখে মেকআপ না থাকলেও চোখের নিচের কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক, খোলা চুলে কোনো অপসরা থেকে কম মনে হচ্ছে না। যদিও কান্না করার জন্য কাজল লেপ্টে গিয়েছে। দু হাতে লাল, কালো মিশ্রণের কাঁচের চুড়ি। কানে ছোট পাথরের দুল। গলায় কিছু নেই। ফর্সা গায়ে লাল শাড়িটা বেশ মানিয়েছে। শুধু মাথায় দোপাট্টা দিলেই হবে। একদম বউ বউ লাগবে। মাহিমের বউ। আনমনেই হেসে ফেলে। ইভার বুকের ভেতর ধকধক করছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। আলভী, সাকিব কে নিয়ে কোনো একটা কাজে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। মাহিম আরো একটু এগিয়ে এসে ইভার মুখশ্রী দু হাতের তালুতে নিয়ে মন ভরে দেখতে থাকে। ইভাও অশ্রু ভরা নয়নে ভালোবাসার মানুষটির দিকে চেয়ে। মাত্র দুই দিন মানুষটিকে দেখতে পারেনি। ওর মনে হচ্ছে যেন কত যুগ পর দেখছে। সে নিজেও মাহিমের মুখে হাত দিয়ে আলতো ভাবে ছুয়ে দিচ্ছে। মাহিম চোখ দুটো বন্ধ করে ফের খুলে, হাত টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লাল পরীকে। ইভাও দু হাতে ঝাপটে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। মাহিমের চোখ থেকেও এক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। বুক থেকে তুলে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। আবারো বুকে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যেন বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে। অনেক্ষণ একে অপরকে আলিঙ্গন করার পর মুখ তুলে ইভার চোখের জল মুছে দেয়। পুনরায় কপালে চুমু খেয়ে মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে নিষেধ করে। কিছু একটা খেয়াল হতেই সহসা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ইভার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধালো,

” বউ সেজে আছো কেন? এই সাজ কি আমার জন্য? ও গড! আমার লাল পরী এত ফাস্ট জানতামই না। তা এখানে এসে ডি’রেকটলি বিয়ে করবে বলে প্ল্যানিং করে এসেছ নাকি? ”

মাহিমের ঠোঁটে দুষ্ট হাসি। কিন্তু ইভার মুখটা মলিন হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। কিছু বলছে না। মাহিম এবার ইভার দু কাঁধে হাত রেখে সিরিয়াস মুডে জিজ্ঞেস করলো,

” কি হলো লাল পরী? চুপ করে আছ কেন? তুমি এখানে কিভাবে আসলে? তোমার বাবা তোমাকে আসতে দিয়েছে? এসেছো যখন এখানে না এসে আমার বাড়িতে কেন আসলে না? আলভী’কে বলতে পেরেছো আর আমাকে বলতে পারলে না! আমাকে বলতে আমি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসতাম। নাকি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে? হুম? ”

ভ্রু নাচিয়ে বলে কিঞ্চিত হাসল। তক্ষুণি পেছন থেকে আলভী ওদের দিকে আসতে আসতে বলল,

” হয় হয়! তোকে সারপ্রাইজ দিতেই বউ সেজে এসেছে। এমন সারপ্রাইজ দিতো যে তোকে সারা জীবন বিধবা হয়ে থাকতে হতো। ”

ওর কথার প্রেক্ষিতে সাকিব বলল,

” শা*লা দিনের বেলা মদ খেয়ে মাতলামি কেন করছিস? ছেলে মানুষ কি বিধবা হয়? ”

” প্রথমত আমি তোর শা*লা না। দ্বিতীয়ত এখন প্রায় রাত নয়’টা। আর তোর কাছে দিন মনে হচ্ছে? কে মদ খেয়ে মাতলামি করছে এবার বুঝতে পারলি? বাকি রইল বিধবা নিয়ে কথা! কে বলেছে ছেলেরা বিধবা হয় না? আমাকে দেখ আজ পর্যন্ত বিধবা লাইফ কা’টাচ্ছি! ”

” হোপ ব্যাটা! এজন্যই মেয়েরা তোকে ভাই ডেকে চলে যায়। সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে থেকে যাবি তুই। মিলিয়েনিস আমার কথা। ”

ফুঁসে উঠল আলভী। কটমট করে বলে,

” তোর মুখে কালো গরুর গোবর পড়ুক। রাতা মুরগির খসখসে পায়ের লাথি পড়ুক। পঁচা কুমড়ো তোর মাথায় পড়ুক। সব মেয়ে যেন তোর মুখের উপর পঁচা ডিম ছুড়ে মা’রে। ”

মাহিমের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। ইভার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে সটান হয়ে বুকে দু হাত গুজে দাঁড়ায়। সাকিব কিছু বলতে নিবে তার আগেই সে ধমকে বলল,

” তোদের এসব ফা*লতু কথা বন্ধ কর। আমাকে বল যে ইভাকে তোরা কিভাবে নিয়ে আসলি? ”

সাকিবকে ঝাড়তে পেরে আলভীর শান্তি লাগছে। ফুরফুরে মনে বলল,

” তোর ইভাকে আমরা গাড়িতে করে নিয়ে এসেছি। ”

বিরক্ত হয় মাহিম। ইচ্ছে করছে কষিয়ে এক থা*প্পর লাগাতে। এরকম পরিস্থিতিতে কেও মজা করে? এই ছাগলের দ্বারাই সম্ভব। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” ফাইজলামি করছিস? গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিস সেটা বলিনি। মানে ওদের বাড়ি থেকে কিভাবে নিয়ে আসলি? ইভার বাবা কিছু বলেনি? আর ওর গায়ে বউয়ের সাজ কেন? ”

” কারন আজকে ইভার বিয়ে তাই। ”

” মানে? বিয়ে! কার সাথে? বুঝতে পারছিনা। পরিষ্কার করে বল সবকিছু। ”

সাকিব, মাহিমের কাঁধে এক হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,

” আমি বলছি। এই শা*লা পারে শুধু আজাইরা বকবক করতে। ”

” বল। তুই ওর কথায় কান দিস না। ”

” তুই সেদিন আলভী’কে যখন ইভার ব্যাপারে বললি তখন আমাকেও কথাটা জানায় ও। দুজন মিলে ইভার খোঁজ করার চেষ্টা করি। অনেক ভাবে ট্রাই করেছিলাম বাট ফলাফল শুন্য। এদিকে তুই আমাদের সাথে তেমন একটা কথা বলিস না। তোর সাথে প্লানিং করে কিছু যে করবো তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। উদাস মনে বসে থাকিস। আন্টি ফোন করে তোর কথা বলে কান্নাকাটি করে। আমরাও হাল ছেড়ে দেইনি। জানি তুইও ইভার খোঁজ নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিস। এভাবে দু’দিন কে’টে গিয়েছে। পরিচিত সবার থেকে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা কেউ বলতে পারেনি। পরে ভাবলাম ইভাকে ওর বাবা দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। যার খোঁজ তিনি ছাড়া কেও জানে না। আজকে গুলশান গিয়েছিলাম কিছু কেনাকা’টা করতে। যখন ইভাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসলাম দেখলাম বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম। সাধারনত এরকম থাকে না। ইভার কিছু হলো নাকি জানতে কৌতহল বসত একজন লোককে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আজকে নাকি লিটন পাটোয়ারির মেয়ের বিয়ে। আমি বললাম, এত বড়লোকের মেয়ের বিয়ে আর তেমন কোনো আয়োজন নেই। ঝাকঝমক চমকপ্রদ কোনো ব্যাপার নেই। আশ্চর্য! তিনি বললেন ” কেউ জানলে নাকি অসুবিধা হবে। তাই পাটোয়ারি গোপনে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এটুকু বলেই লোকটা চলে গিয়েছে। আমি তখন আলভী কে ফোন করে সবটা জানালাম। তোকে বললে তুই পাগলামো করতি। মাথা গরম করে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতি। এতে কাজের কাজ কিছুই হতো না। আমরা দুজন প্লান করলাম কিভাবে ইভাকে ওখান থেকে নিয়ে আসা যায়। মিম আমাদের হেল্প করেছে এই কাজে। প্লান মতো ছদ্মবেশে আমরা ইভাদের বাড়িতে যাই। কাজটা এতটাও সহজ ছিলো না। ইভার রুমে ওর বাবার বডি গার্ডরা পাহাড়া দিচ্ছিল। কোনো ভাবে ম্যানেজ করে মিমকে পাঠাই রুমে। সেখানে আরো তিন জন মেয়ে ছিল। তাদের মধ্যে একজন যখন বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। তখন বাকি দুজন চিৎকার শুরু করল। মূলত ওই দুটো মেয়ে আমারই পরিচিত। পার্লার থেকে কনে সাজাতে এসেছিল তারা। টাকা দিয়ে মানিয়েছি। প্রথমে অবশ্য রাজি ছিল না। পরে সব কিছু বুঝিয়ে বললে রাজি হয়ে যায়। মেয়েদের চিৎকার শুনে ভেতরে গেলে বডি গার্ড দুটো তখনই মিম আচমকা সামনে এসে ক্লোরোফোম শুকিয়ে দেয়। ঘুমের ইনজ্যাকশন দিয়ে দেয় বডি গার্ড দুটোকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমিয়ে গেলে ইভাদের বাড়ির পেছনের গেইট দিয়ে মিম পার্লারের দুটো মেয়ে’সহ ইভাকে নিয়ে পালিয়ে আসে। সেদিকটা তেমন মানুষ না থাকায় খুব সহজেই লুকিয়ে আসতে পেরেছে। আমি আর আলভী ততক্ষণে যে কয়টা লোক ছিল পাহাড়ায় তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছি। যাতে পালানোর সময় ওদের কোনো অসুবিধা না হয়। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ইভা আমাকে মেসেজ করে দেয়। সেটা দেখে আলভীকে ইশারা করে আমরাও ওদের বাড়ি থেকে সাবধানে কে’টে পড়ি। তারপর ওদের কাছে গিয়ে মিমকে বাড়ি পোঁছে দিয়ে ইভাকে নিয়ে এই জঙ্গলের দিকটায় চলে আসি। মিম বাড়ি থেকে বের হয়েই পার্লারের মেয়ে দুটো কে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানে এসে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আলভীকে বলে সন্ধ্যায় তোকে ফোন করে আসতে বললাম। এবার বুঝেছিস? ”

চলবে,,,,

( ভুলত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন। )