#পাহাড়ের_কোল_ঘেঁষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৪
“এই কদিন হোটেলের এই চার দেয়ালে থাকবি পন করেছিস না কি?” ইরার কথায় পৃথা কোনো ভ্রূক্ষেপ করলো না। সে আপনমনে বারান্দার বাইরে তাকিয়ে আছে।
পৃথার কর্মকান্ডের ইরা বিরক্ত হলো। আজ দুদিন হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার জন্য সে নিজেও বেরোতে পারছে না। এখানে আসছে পর্যন্ত সে যেন অন্য এক পৃথা। সবকিছু রোবটের মতো চালিয়ে নিচ্ছে। তার পাশে যে আরেকজন আছে তাতেও সে নজর দিচ্ছে না। নিতান্তই ইরা নতুন বলে, নাহয় সে নিজেই একা একা বেরিয়ে যেত। দেখতে দেখতে দুদিন পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ইরা কাশ্মীরের কোনো সৌন্দর্যই দেখলো না। তাও ভাগ্য ভালো, এই দামি হোটেলে উঠার ফলে সৌন্দর্য একটু হলেও দেখেছে। নাহয় ওই চিপা চাপা হোটেলে উঠলে বারান্দার ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু হাওয়া পেতো এই যা। সেই হাওয়া দিয়েই নিজের মনকে সন্তুষ্ট রাখতে হতো।
কালকেই তারা রওনা দিবে। ইরা যখন শুনেছিল ওরা তিনদিনের জন্য কাশ্মীর যাচ্ছে তখন ভারী খুশি হয়েছিল কিন্তু এখন আর সেই খুশি নেই। এখন মনে হচ্ছে, আজকের রাতটা পেরোতে পারলেই হচ্ছে। এর চেয়ে তার বাড়ি ঢের ভালো।
.
.
“আপনার চুলগুলো বাঁধেন। আমার সমস্যা হচ্ছে।”
পৃথা চোখ বন্ধ করে পরিবেশ উপভোগ করছিলো। পাশ থেকে কারোর কণ্ঠস্বর পেয়ে সে চোখ খুলে ফিরে তাকালো। একটা সুন্দর শ্যাম গরনের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথা চোখ সরিয়ে নিল। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো , চারদিকে পর্যটক গিজগিজ করছে। তার রাগ হলো। সে কোথায় চুল খোলা রেখে নায়িকা নায়িকা ভাব নিতে চাইলো আর সেখানে ইনি এসে সব জল করে দিল। তার খোলা চুলে আরেকজনের কেন সমস্যা হবে তা পৃথা বুঝে উঠে পারলো না। সে বেশ রাগী স্বরে শুধালো,
“আমার চুলে আপনার কী সমস্যা?”
“সেটা নিজের দিকেই একবার তাকান।” বলেই ছেলেটি একটু সরে দাঁড়ালো।
পৃথা নিজের দিকে তাকাতেই দেখলো বাতাসের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে তার চুলগুলোও উড়ছে। পৃথা লজ্জা পেল। বাতাসের তালে তার চুল অন্যের মুখে আঁচড়ে পড়ছে। সে সেটা খেয়াল করতে পারেনি।
দোষ নিজের দেখে সে বলার মতো কিছু না পেয়ে রুমে চলে আসলো। রুমে এসেই এই বারান্দা দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো উঁকি দিয়ে ছেলেটিকে দেখলো।
স্মৃতিতে সেই প্রথম আলাপ ভেসে উঠতেই সেটাই পৃথা আলতো হাসলো। সেই দেখাতেই ছেলেটির প্রতি এক অদ্ভুত অনুভূতি জন্মেছিল পৃথার। যেটা পরবর্তী দিনগুলোতে আরো গাঢ় হয়ে উঠে। এবং এই প্রথম দেখাটাই হয়েছে এই হোটেলের সামনে। যেখানে পৃথা সবসময় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাজারো পর্যটকের ভিড়ে। একটু আশা, এই ভেবে যে যদি দেখা পায়! কারণ মানুষটার এই হোটেলটাই না কি প্ৰিয় ছিল!
অন্য হোটেল চিপা চাপা দিয়ে অতো সৌন্দর্য পাওয়া যায় না। সৌন্দর্য দেখতে বাইরে বের হওয়া লাগে। মানুষটির ভাষ্যমতে এই হোটেলে ঘুম থেকে উঠতেই কাশ্মীর ট্যুরের অনুভূতি পাওয়া যায়।
পৃথা চোখ বন্ধ করে নিল। আজকে শেষদিন। আর কোনোদিন এভাবে স্মৃতিস্মরণ করতে আর আসবে না সে। আজকের পরে সব মন ধ্যান সে ভবিষ্যতের জন্য দিবে। আর কোনো পিছুটান সে রাখবে না। তবু কোথাও যেন একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। সে কি আদৌ পারবে! সুখী হতে! না, তার সুখী হওয়ার দরকার নেই, আশেপাশের মানুষদের আর কোনো কষ্ট দিবে না সে । বাধ্য হয়েই চলবে সে।
ইরা এসে একটু বাইরে বের হওয়ার জন্য জোরাজোরি করলো।
পৃথা প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে ভাবলো, তার জন্য মেয়েটা আসলেই বন্দী হয়ে আছে। যেটা তার উচিত না।
পৃথা চোখমুখ মুছে হাত খোপা করে নিলো। এরপর গায়ে ভালোমতো চাঁদর জড়িয়ে নিল। হোটেল থেকে বেরিয়ে সামনে কর্নারে গিয়ে দাঁড়ালো।
ইরা এবার একটু সাহস পেল। সে পৃথার দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“আহাদ ভাই কল করছে।”
“করুক।”
“তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে। কথা আছে না কি।”
“কিন্তু আমার নেই কোনো কথা।”
“উনার তো থাকতেই পারে তাই না?”
“উনার হয়ে সাফায় গেচ্ছিস কখন থেকে? ”
“এভাবে বলিস না। উনার কথাও ভাব।”
“উনার কথা ভাবার জন্য তুই আছিস তো।”
ইরা থমকালো। মেয়েটার মাথা একেবারে গেল না কি! সে অবাক স্বরে জানালো,
“কী বলছিস এসব? তুই জানিস?”
“জানবো না কেন?”
পৃথার সহজ উত্তরে ইরা বিরক্তের সহিত শুধালো,
“কী করতে চাইছিস তুই?”
“কিছুই না।”
বলেই পৃথা সরে একদম কর্নার ঘেঁষে দাঁড়ালো। এই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়ালে তার সব অনুভূতিরা বেরিয়ে আসে। এতো অনুভূতি কীভাবে কমাবে সে! আহাদের সাথে সংসারে আদৌ সে কাউকে সুখী করতে পারবে? আহাদকে ঠকানো হবে না তো!
—–
হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো সাফাদ। সে তার হাতের আঙ্গুল ধরে থাকা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে শাসনের সুরে জানালো,
“তোমার জন্য আর পারি না।”
“চলো ঐদিকে। আম্মুকে ডাকো। আম্মু সহ দেখবে।” আদৌ আদৌ মুখে বাচ্চাটি কথাটা বলেই পেছনে থাকা মেয়েটিকে ডাক দিল।
মেয়েটি আসতে চাইলো না। বাচ্চাটির সাথে সাথে সাফাদও ডাক দিল। অনেক জোরাজোরি করে মেয়েটা রাজি হলো।
মেয়েটি এসে হাজির হতেই সাফাদ বাচ্চাটি কোলে নিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটিও সাথে সাথে হাঁটা ধরলো।
সাফাদ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো। কত পরিবর্তন! ব্যস্ততার ভিড়ে এই চারবছর এই প্ৰিয় জায়গাটিতে পাও দেওয়া হলো না! অথচ সবসময় এর স্থায়ী ট্যুরের জায়গা ছিল এটি! কীভাবে কীভাবে চারটা বছর পেরিয়ে গেল! এরই মাঝে কত কিছুই যে পাল্টে গেল!
সাফাদের ভাবনার মাঝেই বাচ্চাটি কোল থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লো। কিছু ভাবার আগেই সে হুট্ করে দৌড়ে এগিয়ে গেল একদম শেষপ্রান্তে।
“সাফওয়াজ দাড়াও।” ডাকতে ডাকতে সাফাদ পিছু পিছু এগিয়ে গেল।
একদম কর্নারের কাছে গিয়ে বাচ্চাটি থামলো। সাফাদ সামনে গিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বাচ্চাটিকে ছুঁয়ে জানালো,
“এইতো ধরে ফেলেছি। এবার যাবে কোথায়!” বলতেই বাচ্চাটিও হেসে উঠলো।
পরিচিত কণ্ঠস্বর পেয়ে পৃথা চমকে গেল। সে দ্রুত ফিরে তাকাতেই কাংক্ষিত মানুষটিকে বাস্তবে দেখে থমকে দাঁড়ালো। এটা কী আদৌ বাস্তব! পৃথা তার চোখের ভ্রম ভেবে ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্ঠা করলো।
কিন্তু না! এইবার এটা তার ভ্রম নয়। যা হচ্ছে তা বাস্তবেই হচ্ছে।
ততক্ষনে সাফাদের পাশে মেয়েটি এসে দাঁড়লো।
পৃথা থমকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ পাশে থাকা মেয়েটির দিকে পড়লো। পৃথার পা যেন কিছুর সাথে আটকে আছে। সে পালিয়ে যেতে চাইলেও যেন পারছে না। সে এক নজরে তাকিয়ে রইল। কী হাসিখুশি! সবাই স্বা’র্থ’প’রে’র মতো কী সুন্দর করে বাঁচে! শুধু সেই কী এভাবে আটকে রইল!
সাফাদের চোখ সামনে তাকিয়ে থাকা মেয়েটির দিকে পড়তেই যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল সব! এ কী তার ভ্রম! না কি সত্যি! আদৌ সে সঠিক দেখছে তো!
“পৃথা?”
পৃথা দ্বিতীয়বারের মতো চমকালো। না, তাহলে মানুষটি তাকে ভুলেনি! তার নামও মনে আছে! ভুলেনি তবে! তবে না ভুললে এটা কী! এটা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি! তবে কী কোনো ভালোবাসাই ছিল না! সব কি শুধু পৃথারই ছিল! চারটা বছর অপেক্ষার ফল তবে এটাই ছিল! অবশেষে ফিরলো কিন্তু খালি নয়! দেখা হলো কিন্তু সম্পর্ক সেই-নিষিদ্ধ ভাবেই!
#চলবে ইন-শা-আল্লাহ।