#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ১৯
আরওয়া যেতে যেতে অনেক সময় আছে কিন্তু সে এখন থেকে রেডি হওয়া শুরু করলো। নির্ঝর হেসে বললো: এখন থেকে রেডি হয়ে যাচ্ছো?এর বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট যদি আমাকে দেখাতে এতো কিছু হতো না।
_তুমি আমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলবে না।
_তো কি নিয়ে কথা বলবো? তুমিই বলে দাও তাহলে আর তোমার অসুবিধা হবে না।
_তুমি আমার সাথে একদম কথা বলবে না। আমিও তোমার সাথে কোনো কথা বলবো না।ব্যাস হয়ে গেলো।
আরওয়ার কথায় নির্ঝর মুখটাকে খারাপ করে বললো:এভাবে তো মানুষ শত্রুর উপরও জুলুম করে না। তুমি আমাকে এতো জুলুম করছো আল্লাহ সহ্য করবে না।
_তোমার সাথে এর চেয়ে ভালো ব্যবহার যায় না।বাই দ্যা ওয়ে, আমি রেডি হতে যাচ্ছি। অযথা বিরক্ত করবে না।
নির্ঝর হাল ছেড়ে দিলো। আরওয়ার ভালোবাসা পেতে হলে তাকে আরো প্রহর গুনতে হবে।এটা এখন সিউর নির্ঝর।থাক,সমস্যা নাই।সে আরওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে আজীবন। একদিন নাকি একদিন আরওয়াকে পাবে সে এতটুকু বিশ্বাস তার আছে।কথায় আছে প্রকৃত ভালোবাসা কখনো হেরে যায় না। নির্ঝর-আরওয়ার ভালোবাসা প্রকৃত বলেই এতো বছর পর সব ভুল বোঝা-বুঝি একপাশে রেখে দুজনেই এক ছাদের নিচে হতে পেরেছে,একে অপরকে পেয়েছে। তাহলে তো সামনেও একে অপরের থাকবে বলে আশা করা যায়। নির্ঝর হাসলো কথাগুলো ভেবে।
আরওয়া অনেকটাই দ্রুত রেডি হয়ে গেলো বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। নির্ঝর সাথে যাবে। দু’জনেই একসাথে রুম থেকে বেরিয়ে নির্ঝরের মায়ের রুমে গেলো। রুমে ঢুকতেই নির্ঝর বললো: আম্মু আমরা একটু ফুফির বাসায় যাচ্ছি। ঝামেলায় ঝামেলায় আরওয়ার তো আর যাওয়া হয়নি এতোদিন।তাই আজকে যাচ্ছি।
_আমাকে নয় তোমার বাবাকে বলে যাও।
নির্ঝর মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাবাকে ফোন দিলো। তিনি সম্মতি দিলেন যাওয়ার জন্য। তারপর দুজনেই বেরিয়ে গেলো।
নির্ঝর গাড়ি চালাচ্ছে আর আরওয়া তার পাশের সিটে বসা। নির্ঝর আড়চোখে বারবার আরওয়াকে দেখছে। একটু পর শান্ত কন্ঠে বললো: তুমি কি আজকে থাকবে নাকি আমার সাথে চলে আসবে?
_আমি তো থাকতে চাই।এতো দিন পর যাচ্ছি তাহলে চলে আসবো কেনো?
_আমি একা হয়ে যাবো। প্লিজ আমার সাথে চলে আসিও।
আরওয়া কোনো জবাব দিলো না।গাড়ি থামলো আরওয়াদের বাড়ির সামনে। দরজায় বেল বাজাতেই মারওয়া দরজা খুলে দিলো।আরওয়ার মা তো নির্ঝরকে আর আরওয়াকে দেখে মহা খুশি। নির্ঝর খুব একটা আসে না ফুফির বাসায়। আজকে তাকে নিজের বাসায় পেয়ে তো তিনি খুশি হবেন। উৎসুক কন্ঠে বললেন: নির্ঝর আসো আসো ভেতরে আসো।
ফুফির কথায় নির্ঝর হেসে ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলো।আর আরওয়া মারওয়ার সাথে ভেতরের রুমে গেলো। নির্ঝর আরওয়ার মায়ের সাথে গল্প করছে। কিছুক্ষণ থেকে সে আরওয়াদের বাড়ি থেকে চলে গেলো। এখন অফিসে যেতে হবে তাকে। তাই মূলত চলে যাওয়া।আরওয়া কয়েকদিন ছিল তাদের বাসায়। দুইদিন পর আজকে নির্ঝর এসেছে আরওয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।এই দুদিনে নির্ঝর আরওয়াকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল কিন্তু আরওয়া রিসিভ করেনি। বিষয়টা নিয়ে নির্ঝর বেশ রেগে আছে।আরওয়াদের বাসায় গিয়ে মাত্র আরওয়াকে রাগী গলায় প্রশ্ন করলো:এই মেয়ে, তুমি ফোন রিসিভ করো নাই কেনো? তোমার কি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না?
আরওয়ার এক কথায় জবাব: না করে না। তোমার সাথে কথা বলতে চাই না বলেই ফোনটা রিসিভ করিনি। বোঝা উচিত ছিল তোমার।
আরওয়া নিজেও জানে না সে কেনো নির্ঝরের ফোন রিসিভ করছে না। কেন জানি সে আগ্রহ পাচ্ছে না। শারীরিক অসুস্থতা আর মানসিক চাপ তাকে অনেকটা ডিপ্রেশনে নিয়ে যাচ্ছে।সে এখন সবকিছু থেকে দূরত্ব চায়।মনটা এখন একটু রেস্ট চায় তার। কিন্তু নির্ঝর বারবার ফোন করছে তাকে।তাই বাধ্য হয়ে রিসিভ করেনি সে ফোনটা।নির্ঝরকে এতো কথা কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছে করছে না তাই এক কথায় জবাব দিলো সে।
ঘন্টাখানেক পর নির্ঝর আরওয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজকে নির্ঝর নিজেও কোনো কথা বলছে না। মনে হচ্ছে সেও আজকে রেগে গেছে আরওয়ার উপর।থাক তাতে আরওয়ার কিছুই আসে-যায় না।
প্রায় আরো দুইমাস কেটে গেলো।নির্ঝর আর আরওয়া এখন আগের চেয়ে অনেকটা কাছাকাছি এসেছে।একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করে, নির্ঝর সারাদিন এখন আরওয়ার পেছনে আঠার লেগে থাকে।তাই আরওয়াকেও বাধ্য হয় নির্ঝরের সময় দিতে হয়। মিসেস রুমানাও চেষ্টা করছেন আরওয়ার সাথে এডজাস্ট করে নিতে। যদিও সব ভুলে দু’জনের একসাথে হতে সময় লাগবে কিন্তু সম্পর্কটা এখন আগের চেয়ে গভীর হয়েছে বলা যায়।
আজকে আরওয়া অনেকটাই খুশি।তার ভার্সিটির শেষ দিন আজকে। পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে এখন সে আরেকটা অধ্যায় শুরু হবে। অফিসিয়ালি আজকে ভার্সিটি থেকে তার বিদায়। কিছু ডকুমেন্ট আনতে যাবে আজকে শেষ বারের মতো।পড়াশোনা শেষ এই ভেবে অনেক আনন্দ লাগলেও ভার্সিটিতেও শেষ দিন এই ভেবে একটু কষ্ট তো লাগছে ঠিকই তার।
আজকে আরওয়ার সাথে নির্ঝর যাবে ভার্সিটিতে। নির্ঝরের কাজ থাকলেও আরওয়া বলেছে তার সাথে যেতে।আর নির্ঝর এক কথায় সব কাজ ফেলে আরওয়ার সাথে যাবে বলে কথা দিয়েছে।কিন্তু নির্ঝর এখনো নাক ডেকে ডেকে ঘুমাচ্ছে। যেটা এই মূহুর্তে আরওয়ার মেজাজ খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ। এভাবে চলতে থাকলে তো সবাই ভার্সিটিতে গিয়ে কাজ শেষ করে চলে যাবে আর তার যাওয়াও হবে না,কারো সাথে দেখাও হবে না। বেশ চিল্লিয়ে নির্ঝরকে ডাকলো সে,”এই ওঠো তাড়াতাড়ি, আমি কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি।আর কতোক্ষণ এভাবে বসে থাকবো?”
আরওয়ার চিল্লানি শুনে নির্ঝর ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো: আরেকটু ঘুমাই প্লিজ।
_ওকে তুমি ঘুমাও। আমি গেলাম।
আকস্মিক এমন কথা শুনে নির্ঝর লাফিয়ে উঠলো বিছানা থেকে। কিন্তু সে আরওয়ার দিকে তাকাতেই আরেক দফা শক খেলো। ভ্রু কুঁচকে ঠিক কতো সময় আরওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে জানে না।আরওয়ার আরেক দফা চিৎকার তাকে ভাবনার জগৎ থেকে বের করলো। শান্ত কন্ঠে বললো: আজকে শাড়ি পড়েছো?
_হ্যাঁ।
_শাড়ি পড়েই ক্যাম্পাসে যাবে?
_তো শাড়ি পড়ে কি মানুষ ক্যাম্পাসে যায় না?
_তোমাকে কখনো এভাবে শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে যেতে দেখিনি।তাই বললাম।বাই দ্যা ওয়ে,তোমাকে দারুন লাগছে এই শাড়িতে। অপূর্ব সুন্দরী রমণী।
নির্ঝরের কথায় আরওয়া মনে মনে হাসলো। নির্ঝর সেদিকে আরেক পলক তাকিয়ে ফ্রেশ হতে যাচ্ছিল।তখনি আরওয়া তাকে থামিয়ে দিলো। নির্ঝরের দিকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললো:এই পাঞ্জাবিটা পড়বে আজকে?
নির্ঝর হেসে আরওয়ার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে রেডি হতে চলে গেলো। প্যাকেটটা খুলতেই দেখলো আরওয়ার শাড়ির সাথে মিল করে পাঞ্জাবিটা আর্ট করা। হয়তো কাপল সেট কিনেছে আরওয়া। দ্রুত রেডি হয়ে আসলো সে।আরওয়া তাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।হাতে থাকা ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নির্ঝর তার পেছন পেছন বের হলো।নিচে গাড়ি রাখা আছে। নির্ঝর গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো আর আরওয়া তার পাশে। নির্ঝর কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরওয়া বললো:জানো? আমার অনেক ইচ্ছা ছিল সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে সাজগোজ করে তারপর ক্যাম্পাসে গিয়ে কাপল ফটোশুট করবো। আমার পার্টনারও আমার সাথে ম্যাচিং করে পাঞ্জাবি পড়বে। দু’জনেই একসাথে ক্যাম্পাসে ঘুরবো,ফিরবো আর ছবি তুলে সব স্মৃতি আটকে রাখবো। বৃদ্ধ বয়সে আর তো ক্যাম্পাসে যাওয়া হবে না। তখন এই স্মৃতিগুলো দেখবো আর মনে মনে সেই অতীতে ফিরে যাবো। এতোদিন তো পার্টনার ছিল না।যদিও এখন একটা জামাই হয়েছে। সেও থাকা আর না থাকা সেইম সেইম। তাই আর হয়নি। আজকে ভাবছি ইচ্ছাটাকে আর সময়টাকে হাত ছাড়া করা যাবে না।এই হাবলা মার্কা জামাইকে নিয়েই ইচ্ছাটা পূরণ করে স্মৃতি করে রাখতে হবে।
নির্ঝর আরওয়ার কথায় হাসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো:আমি হাবলা? আজকে ক্যাম্পাসে গেলে দেখবে তোমার সব বান্ধবী, সিনিয়র, জুনিয়র এই হাবলাটার উপর ফিদা হয়ে বসে আছে।
_ঢং কতো! আমার কোনো বান্ধবী এমন নয়। আর ভালোই হবে। তোমাকে কারো গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলে আমি খুশি। একটু রেস্ট পাবো।
_সেটা নিজেই দেখিও আজকে।
আরওয়া মুখটাকে ভেংচি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো। একটু পর নির্ঝর গাড়ি থামালো ক্যাম্পাসের মেইন গেইটে।আরওয়াকে বললো: আমি কি ভেতরে যাবো?
নির্ঝরের কথা শুনে আরওয়া রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো: এতোক্ষণ কি তোমাকে আমি জোকস্ বলেছি? তুমি ভেতরে না গেলে ঘুরবো কার সাথে?
নির্ঝর আরওয়ার কথায় আবারো মুচকি হাসলো। শান্ত কন্ঠে বললো: আমার সাথে ঘুরতে চাও সেটা আগে বলতে। তাহলে আমি তোমাকে নিয়ে পুরো মঙ্গল গ্রহে ঘুরে আসতাম।
_শখ কতো! এখন ক্যাম্পাসটা ঘুরে আমাকে উদ্ধার করো।
নির্ঝর আরওয়ার কথায় গাড়ি থেকে নামলো।আর আরওয়া ফোনটা বের করে তার দলবলকে অর্থাৎ দুই বান্ধবীকে খোঁজার জন্য ফোন লাগালো।তারা আগেই চলে এসেছে। ফোন করতেই বললো:ভার্সিটির মুক্তমঞ্চে তারা বসে আছে।
নির্ঝর আর আরওয়াও হেঁটে সে দিকটাই গেলো। কিন্তু আরওয়া খেয়াল করলো ঘটনা তো মহা জটিল পর্যায়ে যাচ্ছে। নির্ঝর ঠিক কথায় বলেছে, প্রত্যেকটা মেয়ে আরওয়ার হাবলা মার্কা জামাইকে দেখছে, অনেকেই দাঁত কেলিয়ে হাসছে।আরওয়া জাস্ট আর নিতে পারছে না।তার গাঁ এখন রাগে শিরশির করছে। রাগী চোখে একবার নির্ঝরকে দেখলো। আসলেই তাকে বেস্ট লাগছে এই পাঞ্জাবিটাতে। নির্ঝর আরওয়ার চাইনি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।আরওয়ার জেলাস দেখে নির্ঝর বেশ খুশি। এটাই তো ভালোবাসার পূর্ব লক্ষণ। নির্ঝর আরওয়ার চোখে এই রাগটাই দেখতে চেয়েছিল। মুক্তমঞ্চে যেতেই আরওয়ার বান্ধবী সাইমা আর ইশিতা আছে।তারা তাকে দেখে উঠে আসলো।নির্ঝরকে সাথে দেখে ইশিতা বললো: দুলাভাই আপনিও এসেছেন?
_জি।
নির্ঝর এক কথায় জবাব দিলো।আর কোনো উত্তর না পেয়ে ইশিতা দমে গেলো। হয়তো এটা সে আশা করেনি। একটু তো কথা বলা যায়।আরওয়াকে উদ্দেশ্য করে সে বললো: আচ্ছা চল ডিন স্যারের ওখানে যায়।সিক্স ফ্লোরে। ডিপার্টমেন্টের সবাই ওখানে আছে।
এই বলে ইশিতা আর সাইমা হাঁটা দিলো।আরওয়া আর নির্ঝর পেছনে হাঁটছে।আরওয়া রাগী গলায় ফিসফিসিয়ে বললো:ইশিতাদের সাথে কথা বললে না কেনো?ওরা কি ভাববে এখন?
_কথা বলতে ইচ্ছে করেনি।
আরওয়া আবারো ভেংচি কাটলো। বিল্ডিংয়ের নিচে গিয়ে নির্ঝর বললো: আমি এখানে অপেক্ষা করি। তুমি ওদের সাথে গিয়ে কাজ শেষ করে আসো।
আরওয়া নির্ঝরের কথামতো আচ্ছা বলে হাঁটা দিলো।
আরওয়া তার কাজ শেষ করে নিচে আসছে।তার সাথে ইশিতা,সাইমা আগে থেকেই ছিল। এখন তার ডিপার্টমেন্টের আরেক মেয়ে নওমিও আছে তাদের সাথে।যদিও নওমির সাথে আরওয়ার সম্পর্কটা খুব একটা ভালো নয় কিন্তু ইশিতার সাথে নওমির বেশ সখ্যতা থাকায় একসাথে এসেছে তারা।আরওয়া নামতেই দেখলো নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ের সাথে।দুজনেই বেশ হেসে হেসে কথা বলছে।যেনো অনেক দিনের পরিচিত দুজনেই।
চলবে…