#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
শেষ পর্ব
আরওয়া তার কাজ শেষ করে নিচে আসছে।তার সাথে ইশিতা,সাইমা আগে থেকেই ছিল। এখন তার ডিপার্টমেন্টের আরেক মেয়ে নওমিও আছে তাদের সাথে।যদিও নওমির সাথে আরওয়ার সম্পর্কটা খুব একটা ভালো নয় কিন্তু ইশিতার সাথে নওমির বেশ সখ্যতা থাকায় একসাথে এসেছে তারা।আরওয়া নামতেই দেখলো নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ের সাথে।দুজনেই বেশ হেসে হেসে কথা বলছে।যেনো অনেক দিনের পরিচিত দুজনেই।
আরওয়া ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই ইশিতা বললো:মেয়েটা কে রে?চিনিস তুই? আমার সাথে তো কোনো কথা বললো না তোর হাসবেন্ড।ওর সাথে এভাবে গল্পে মশগুল হয়ে আছে। নাকি তোর সামনে ফেরেশতা সাজতে চেয়েছিল বলে আমার সাথে কথা বললো না?
ইশিতার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নওমি বললো:কোনটা ওর হাসবেন্ড?
_ওই যে ডানে দাঁড়ানো ছেলেটা।
নওমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইশিতাকে বললো:তোর সাথে কথা বলেনি মানে?
_আমি যখন উনার সাথে কথা বলতে গেলাম উনি আমাকে এভয়েট করলো আর এখন আরওয়ার অপজিটে গিয়ে এই মেয়ের সাথে হেসে হেসে আড্ডা দিচ্ছে।
নওমি হেসে দিলো ইশিতার কথায়।হাসতে হাসতে বললো:আরে ভাই পুরুষ মানুষ।বউয়ের সামনে এমনটা সাজতে হয় তাদের।বাই দ্যা ওয়ে,তোর হাসবেন্ড হ্যান্ডসাম আছে। সত্যি আরওয়ার সাথে ওর যায় না। আমাদের মতো আপডেট হলে ওর সাথে তাল মেলাতে হলে আরওয়াকে আরো অনেক আপডেট হতে হবে।
নওমির কথাটা ঠিক হজম হয়নি আরওয়ার। ইচ্ছে করছে গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে।একে তো নির্ঝরকে ওই মেয়ের সাথে দেখে তার মেজাজ খারাপ তার উপর এমন কথা কিভাবে সহ্য করা যায়?আরওয়া নিজেকে শান্ত করলো। শান্ত গলায় বললো: তাহলে তুমি আমার জামাইর সাথে যাও কিনা একবার দেখে আসো। তোমার সাথে মিললে আমি ফ্রিতেই তোমাকে দিয়ে দিবো।
নওমি অবাক চোখে আরওয়ার দিকে তাকালো আর আরওয়া চুপচাপ নির্ঝরের দিকে হাঁটা দিলো কিন্তু নির্ঝরের সাথে কোনো কথা না বলে তার পাশ দিয়ে চলে আসলো। তার আকস্মিক এমন আচরণ নির্ঝরের চোখে ঠিকই পড়েছে। ভ্রু কুঁচকে একবার আরওয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নির্ঝর তার পেছন পেছন গেলো। পেছন থেকে বললো: ভেতরে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? তোমাকে এমন অন্যরকম দেখাচ্ছে কেনো?
আরওয়া নির্ঝরের কথা শুনতে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনো জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না তার।কি দরকার ছিল এতো কাহিনী করার?নওমি আর ইশিতার কথাগুলো কি মেনে নেওয়া যায়?আর নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে অন্যরা যখন চোখের সামনে সমালোচনা করে তখন প্রতিবাদ করতে তা পারার কষ্ট কিভাবে সহ্য করে মানুষ? ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে অধিকার শুধু নিজের সেটা ভালোবাসুক, কষ্ট দিক বা সমালোচনা করুক। কিন্তু আরওয়া নির্ঝরকে নিয়ে করা সমালোচনার কোনো জবাব দিতে পারলো না শুধু নির্ঝরের কারণে। মেয়েটার সাথে কথা বলেই যেন নির্ঝর অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে।তাই তার সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।নওমির কথাগুলো ভাবতেই চোখ ছলছল করছে তার।
নির্ঝর আরওয়াকে পেছন থেকে ডেকে চলেছে কিন্তু আরওয়ার কোনো রেসপন্স নেই। ভার্সিটির অনেকেই তাদের কাণ্ড দেখছে।নির্ঝর ঠিক বুঝতে পারছে না আরওয়া কি তাকে অপমান করতে ক্যাম্পাসে এনেছে কিনা!কেনো এমন করছে সে?পেছন থেকে সে আরওয়ার হাতটা ধরে তাকে থামালো। একবার আরওয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো:কি হয়েছে তোমার? এভাবে পাবলিক প্লেসে ওভাররিয়্যাক্ট করছো কেনো?
_আমি করেছি নাকি তুমি করেছো?
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বললো:আমি আবার কি করলাম?
_তুমি জানো না তুমি কি করেছো?
_জানলে কি জিজ্ঞেস করতাম?
_তুমি আমার সামনে ইশিতার সাথে কথা বলোনি আর আমি চলে যেতেই অমনি অন্য মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছো। তাহলে রিয়্যাক্ট না করে কি করবো?
নির্ঝর একবার আরওয়ার দিকে তাকালো।তার মেজাজ যথেষ্ট খারাপ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে কন্ট্রোল করছে এটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।শান্ত গলায় বললো:এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কেউ এরকম একটা জনবহুল জায়গায় এতো জঘন্য আচরণ করে? আজকে তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এমন চড় দিতাম যে জীবনে আমার সাথে কথা বলতে সে ভয় পেতো।
_অবশ্যই করে। এটা সামান্য বিষয়?তোমার জন্য আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়েছে?
সাহস যদি হয় মারো তো।
নির্ঝর রাগী গলায় বললো: এখানে সাহসের কথা তুলবে না।সাহস নেই এমনটা নয়। তোমাকে ভালোবাসি বলেই মারতে কষ্ট হবে।তা না হলে নির্ঝর চৌধুরীকে সাহস নিয়ে প্রশ্ন করাটা বোকামি।আর মেয়েটা আমার পরিচিত তাই কথা বলেছি। পরিচিত মানুষের সাথেও কি কথা বলতে পারবো না?
_আমি কি তোমাকে কথা বলতে বারণ করেছি?
_তাহলে এভাবে রিয়্যাক্ট করছো কেনো?
_তুমি ইশিতার সাথে কথা বলোনি আর মেয়েটার সাথে কথা বলেছো।এটা নিয়ে ওরা ঠাট্টা করছিল। তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার কষ্ট লাগে। আমি ওদের কিছু বলতেও পারিনি। তাহলে রিয়্যাক্ট না দেখিয়ে কি করবো?
আরওয়ার কথায় নির্ঝর খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আচমকা তার সকল রাগ যেন হাসির সাথে উড়ে গেছে কোথাও।আরওয়া ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের হাসির দিকে তাকালো। নির্ঝর হাসি থামিয়ে বললো: আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে তোমার রাগ হয় কেনো?
_কারণ আমি তোমাকে ভালো…
আরওয়া আর উচ্চারণ করলো না। থেমে গেলো সে। নির্ঝর এবার মুচকি হাসি দিলো। তারপর বললো: পুরোটা শেষ করো। আমি তো অপেক্ষায় আছি পুরোটা শোনার জন্য।
আরওয়া কোনো কথা বলছে না আর। মনে হচ্ছে নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেলো সে।একটু পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বললো: তোমার সাথে আর ঘুরতে চাই না। তুমি ওর মেয়ের সাথে ঘুরো আমি গেলাম।
কথাটা বলেই আরওয়া চলে যাচ্ছিল। তখনি নির্ঝর আবারো তার হাত ধরে ফেললো। একটু কাছে টেনে আনলো নিজেকে। শান্ত চাইনিতে একনজর আরওয়াকে দেখলো। তারপর বললো: তোমার মন জানে, তুমি জানো আমাকে ভালোবাসো সেটা। শুধু প্রকাশ করছো না। একবার স্বীকার করো ভালোবাসো সেটা।আমি পুরো দুনিয়ার সব সুখ তোমাকে দিবো।
_আমার লাগবে না তোমার দেওয়া সুখ।যেই মানুষটা একলা পৃথিবীতে আকাশ সমান কষ্ট দিয়ে চলে যায় তাকে নতুন করে ভালোবাসবো? এতটুকু বোকা আমি নয়।
_কতোবার বলবো এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমার বাধ্য হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কোনো উপায় ছিল না।
_দেখো আমার আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না।আমি যাচ্ছি।
আরওয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলো। নির্ঝর তাকে থামানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু সে দাঁড়ায়নি।পরে নির্ঝরও বাধ্য হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।শান্ত কন্ঠে বললো: তুমি আজকে ক্যাম্পাসে ঘুরবে বলেই আমাকে সাথে এনেছিলে। তাহলে চলে যাচ্ছো কেনো?
_অনেকটা আগ্রহ নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু তুমি সব শেষ করে দিয়েছো।
_আমি কিছুই করেনি।মেয়েটা আমার এক কলিগের বউ। বিবাহিত একজন মেয়ে।সেই সুবাদে দেখলাম বলে কথা বললাম।এটা নিয়ে এতো কিছু হয়ে যাবে কে জানতো। আচ্ছা যায় হোক এবার আর রাগ করিও না।প্লিজ চলো।
নির্ঝর আরওয়াকে কিছুতেই ছাড়ছে না। যেতেই হবে ক্যাম্পাসে।আরওয়া বাধ্য হয়ে বললো: এখন ক্যাম্পাসে যেতে চাচ্ছি না আর।ওরা হাসিঠাট্টা করবে।
_কেনো আমরা কি জোকার?
_কারো ঠাট্টার পাত্র হতে জোকার হতে হয় না। অতিরিক্ত যোগ্য হতে হয়।
_তুমি যাবে মানে যাবে।কারো কথায় এভাবে চলে যাবো এটা হতে পারে না।
আরওয়া ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নামলো আবার।নির্ঝরও হাসি মুখে নেমে দুজনেই একসাথে পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরলো।নির্ঝর আরওয়ার হাত ধরে হাঁটছে।আরওয়ার বেশ ভালোই লাগছে বিষয়টা।কতো বছর পর এভাবে হাঁটছে তারা দুজনে। হাঁটতে হাঁটতে আরওয়া হঠাৎ করে বললো: আজকে ছয় বছর পাঁচ মাস সতেরো দিন পর তোমার হাত ধরে একসাথে হাঁটছি।
_কতো দিন পর সেটা তোমার মনে আছে কি করে?
_আমি ডায়েরির পাতায় সব হিসাব করে লিখে রেখেছি। তোমার আমার সব স্মৃতি সেখানে আছে।কেউ পড়লে অনায়াসে সবটা বুঝে যাবে আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি।
_আমাকে কতোটা ভালোবাসো?
আরওয়া থেমে গেলো।সে কথার ঘোরে কতো কথা বলে ফেলছিল এখন। আজকে প্রায় তাদের বিয়ে হয়েছে ছয় মাস। কিন্তু কিছুতেই আরওয়া নির্ঝরকে একটুও সময় দেয়নি।নির্ঝরও সবটা মেনে নিচ্ছে।সে তো জানে আরওয়া অভিমান করেছে।এটা তো তাকে মেনে নিতে হয়। দুজনের হাঁটতে হাঁটতে পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরলো। ক্যাম্পাস ছোট হওয়ায় হাঁটতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাদের। নির্ঝর থামলো একটু। গম্ভীর গলায় বললো:এখনো কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? হয়তো একটা ভুল ছিল।ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ক্ষমা করে দাও এবার।
আরওয়া মনে মনে হাসলো।সেও ভাবছে নির্ঝরকে আর অপেক্ষা করাবে না। এভাবে দুজনের মান-অভিমানে তাদের জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।সময় তো আর থেমেও থাকে না আবার ফেরতও আসে না।তাই এখন সব ঠিক করে দুজনের একসাথে সংসারটা গোছানো উচিত।আরওয়া বললো:যাও ক্ষমা করে দিলাম। ভবিষ্যতে যদি এমন কিছু হয় তাহলে মনে রাখবে আমাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছো।
নির্ঝর আরওয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো: তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আর কখনো এই হাতটা ছাড়বো না। অতীত ভুলে যাও।দুজনেই নতুন করে সব শুরু করবো। একবার বলো ভালোবাসো!
আরওয়া একটু থামলো। তারপর বললো:#বুঝে_নাও_ভালোবাসি
নির্ঝর আরওয়ার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে আরওয়াকে জড়িয়ে ধরলো।আরওয়াও সব অভিমান এক পাশে রেখে নির্ঝরকে ক্ষমা করে দিলো। ভালোবেসে নির্ঝরের বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে নিলো।
সমাপ্ত…