মন রাঙানোর পালা পর্ব-০৩

0
6

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_3
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি নিজের কক্ষে বসে নিজের স্বপ্নের পুরুষের কথা ভেবে মুচকি মুচকি হাসছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই মিষ্টি হাসির লোকটার কথা। যে হাসলেই বাম গালে টোল পড়ত। সুনীতি দুচোখ বন্ধ করে তার কথা ভেবে বলে,”আপনি কবে দেশে ফিরবেন সাজিদ ভাই? আপনার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি যে আমি।”

সুনীতির ভাবনার মাঝেই সালমা খন্দকার তার কক্ষে এলো। সালমা খন্দকারকে দেখে সুনীতি ভীষণ খুশি হলো। সালমা খন্দকার সুনীতির খুশি মুখ দেখে বললো,”তোর ইচ্ছাটা তো আমি পূরণ করে দিলাম। কেমন লাগল আমার এই সারপ্রাইজ?”

সুনীতি সালমা খন্দকারকে জড়িয়ে ধরে বলল,”তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ফুফু। তুমি আমার কথা রেখেছ। আমি তো ভেবেছিলাম, আমার কয়েক বছর আগে বলা কথাটাকে তুমি ছেলেমানুষী ভাববে। কখনো ভাবতে পারিনি, তুমি কথাটাকে এত সিরিয়াস ভাবে নেবে!”

সালমা খন্দকার মৃদু হেসে সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”সেদিন তোর চোখের ভাষা দেখেই আমি তোর মনের কথা বুঝে গিয়েছিলাম। সেদিনই আমি ঠিক করে নেই, তোকেই আমার সাজিদের বউ করে ঘরে তুলব। কিন্তু সেই সময় তুই ছোট ছিলি জন্য এই কথাটা আমি তুলিনি৷ ভেবেছিলাম, যখন তোর উপযুক্ত বয়স হবে এবং তোর মা-বাবা তোর বিয়ে দিতে চাইবে, তখনই তাদের কাছে আমি তোর হাত চাইতে আসব। আর আজ সেই শুভ দিনটা চলে এলো।”

সুনীতি উত্তেজনায় তার ফুফুকে জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা, সাজিদ ভাইয়া কবে দেশে ফিরবে? সেই ব্যাপারে কিছু জানো তুমি ফুফু?”

সালমা খন্দকার বলেন,”ও দেখ, তোকে আসল খবরটা দিতেই ভুলে গেছিলাম। আমার আজ সকালে সাজিদের সাথে কথা হয়েছিল। ও আমাকে বলেছে, আজকেই ফ্লাইটেই ও নিউইয়র্ক থেকে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেবে। বাংলাদেশ সময় কাল সকাল নাগাদ পৌঁছে যাবে।”

সাজিদের ফেরার খবর শুনে সুনীতির অধরের হাসি দৃঢ় হয়। কতদিন পর মানুষটাকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ পাবে সে। সুনীতির দুটো চোখ যে তার শখের পুরুষকে দেখার তৃষ্ণায় ব্যকুল। তাই তো সে সালমা খন্দকারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ফুফু, আমি কাল তোমাদের সাথে এয়ারপোর্টে যেতে চাই সাজিদ ভাইকে রিসিভ করতে। তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”

“আপত্তি থাকবে কেন? আমার তো ভালোই লাগবে তুই সাথে গেলে। সাজিদও তোকে দেখে ভীষণ খুশি হবে৷ আমি সাজিদকে তোর ব্যাপারে জানাতেই ও এই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে।”

একথা শুনে যেন সুনীতির খুশি আরো বেড়ে যায়। তার সরল মনে চিন্তা আসে,
“তাহলে কি সাজিদ ভাইও আমাকে পছন্দ করত?”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অনেক সময়, আমরা যা ভাবি বাস্তবতা তার থেকে আলাদাই হয়। এই যেমন যখন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে সুনীতি ভাবছে, তার সাজিদ ভাইও তাকে ভালোবাসে। অন্যদিকে সাজিদ অন্য এক রমনীকে নিজের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে।

ইভা থমাস, আমেরিকান এক শ্বেতাঙ্গ রমনী। মেয়েটার আরো একটা পরিচয় হচ্ছে সে সাজিদের প্রেমিকা এবং বিগত দুই বছর থেকে তারা নিউইয়র্কের একটি ফ্ল্যাটে লিভ ইন সম্পর্কে রয়েছে।

সাজিদ ইভাকে ভালোবাসে। সে চায় ইভাকে নিয়ে নিজের জীবন গড়তে। কিন্তু একই সাথে সে নিজের মাকেও ভীষণ ভালোবাসে। বাবার মৃত্যুর পর সালমা খন্দকারই সাজিদসহ তার ছোট ভাইকে একা হাতে সামলেছেন। সাজিদ আজ যেই জায়গায় পৌঁছেছে তার পেছনেও সালমা খন্দকারের অবদান অনস্বীকার্য। সাজিদ চায়না তার মাকে কখনো কষ্ট দিতে। আর সে এটা খুব ভালো করেই জানে, তার মা কখনো ইভার সাথে তার এই সম্পর্ক মেনে নিবে না। সাজিদ সবসময় মায়ের বাধ্যগত সন্তান। তাই মায়ের বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলতেও পারবে না।

এজন্য সে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে করে দুই কূলই রক্ষা পায়। সাজিদের সিদ্ধান্ত হলো, সে তার মায়ের পছন্দমতোই মেয়েকে বিয়ে করবে এবং সেই মেয়ে বাংলাদেশেই থাকবে। একইসাথে সে আমেরিকায় ইভার সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখবে। আপাতত এছাড়া আর কোন রাস্তা খুঁজে পায়না সে। কারণ এই ইভা নামক মেয়েটাও যে তার জন্য কম ত্যাগ করেনি। ইভার পরিবার তাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি জন্য ইভা তার পরিবারকে ত্যাগ করেছে। সাজিদ অবশ্য নিজের পরিবারকে ত্যাগ করার সাহস রাখে না। কিন্তু যতদূর করতে পারার সে করবে।

আর কিছুক্ষণ পরই তার ফ্লাইটের সময়। এজন্য সাজিদ উঠে বসে তৈরি হতে নেয়। ইভা বিষাদসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে সাজিদের দিকে। সাজিদ হেসে ইভার দিকে তাকাতেই ইভা বলে,”তুমি ফিরছ কবে?”

“এক সপ্তাহেই মধ্যেই ফিরব।”

“আমারও ইচ্ছা ছিল তোমার সাথে তোমার দেশে যাওয়ার। তোমার ফ্যামিলির সাথে তো এখনো আমায় পরিচিত করিয়ে দিলে না। আমি গেলে পরিচয়টাও হয়ে যেত।”

ইভার উদাস কন্ঠ শুনে সাজিদ অসহায় কন্ঠে বলে,”তোমাকে তো আমি বলেছি ইভা, আমার মা কনজার্ভেটিভ মাইন্ডেড একজন মহিলা। তিনি এত সহজে আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবেন না। আমাকে তাকে মানানোর জন্য একটু সময় চাই।”

“আচ্ছা, তুমি সাবধানে যেও। আমার শরীরটা কয়েকদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। নাহলে আমি তোমাকে এয়ারপোর্ট অব্দি পৌঁছে দিতাম।”

“তুমি নিজের খেয়াল রেখো, ইভা। আমি এলিনাকে(ইভার বান্ধবী) বলে দিয়েছি এই ক’দিন ও তোমাকে কোম্পানি দেবে।”

বলেই মিষ্টি একটা হাসি দেয়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতি বারবার নিজেকে আয়নায় দেখছে। আজ সে একটা মেরুন কালারের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। গতবছর ঈদে এটা তার মা তাকে কিনে দিয়েছিল। একটু পরই সালমা খন্দকার সুনীতিকে নিতে আসবে। তারপর সবাই মিলে একসাথে সাজিদকে এয়ারপোর্টে পিক করতে যাবে।

সুনীতি সাধারণত খুব একটা মেকআপ করে না। তবে আজ হালকা মেকআপ করেছে। আয়নায় বারবার চোখ বুলিয়ে দেখছে তার সৌন্দর্যে কোন কমতি আছে কিনা। সাজিদের সামনে নিজের কোন খামতি প্রকাশ করতে চায়না সে। এদিকে নয়না খন্দকার দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়ের পাগলামো দেখছেন। বারবার মেয়েকে এভাবে আয়নায় তাকাতে দেখে বলেন,”তোমাকে অনেক সুন্দরী লাগছে, মামনী। বারবার এভাবে আয়নায় দেখতে হবে না।”

নিজের মাকে আসতে দেখে সুনীতি খানিক লজ্জা পায়। তাই তো আয়নার সামনে থেকে সরে আসে। নয়না খন্দকার এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলেন,”কারো নজর না লাগুক।”

সুনীতি খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দেয়। এদিকে সামিউল খন্দকার রুমে এসে তাড়া দিয়ে বলেন,”হলো তোর? আপা তো সাগরকে নিয়ে চলে এসেছে।”

সাগর হলো সাজিদের ছোট ভাই। বর্তমানে ইন্টার সেকেন্ডে ইয়ারে পড়ছে। বেশ চঞ্চল স্বভাবের ছেলেটা। সুনীতি সামিউল খন্দকারের সাথে নিচে যেতেই সাগর সুনীতিকে দেখে বলে,”বাহ, আজ তো তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আপি। আমিই তো তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। ভাইয়ার যে কি অবস্থা হবে!”

সালমা খন্দকার ধমক দিয়ে বলেন,”খুব পাকা হয়েছ তাইনা? কানটা ধরে মলে দিলে ভালো হবে।”

এদিকে সুনীতি লজ্জায় মিইয়ে যায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
এয়ারপোর্টে এসে গাড়ি থেকে নেমে সুনীতি খেয়াল করে উত্তেজনায় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির চেহারা দেখবে। তাই একটু বেশিই উত্তেজিত সে। তার বাবা, ফুফু এবং সাগর ইতিমধ্যেই এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিয়েছে। বর্তমানে এয়ারপোর্টের সামনে বেশ ভালোই ভিড়। কারণ হজের মৌসুম চলছে। যে কারণে এত ভিড়ের মাঝে হাটতে সুনীতির অসুবিধা হচ্ছিল। তার উপর অতিরিক্ত উত্তেজনা তো আছেই। এরমধ্যে যে ঘোষণা শুনতে পায় যে আমেরিকান এয়ারলাইনসের নিউইয়র্ক John F. Kennedy International Airport থেকে আসা বিমানটি একটু পরই ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করেছে৷ এটা শুনে তার উত্তেজনা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সে সাজিদকে দেখার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য দৌড়াতে যায়। এমন সময় বেধে যায় বিপত্তি। এত্ত এত্ত লোকের মাঝে হঠাৎ এভাবে দৌড়াতে গিয়ে কারো একটা সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেয় সুনীতি। এমন সময় দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে আকড়ে ধরে। সুনীতি ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে নেয়। ভেবেছিল পড়েই যাবে। তবে হঠাৎ আবিষ্কার করে সে হয়তো শূন্যে ভাবছে। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই যা দেখে তাতে ভয়ে কুকড়ে ওঠে।

একজোড়া বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তার দিকে স্থির। সুনীতি কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু ভয়ে তার কথা গলাতেই আটকে যায়। এদিকে মেজর অভিকের বিরক্তির পরিমাণ বাড়ে। সে এখানে এসেছিল তার বন্ধু আরাফাতকে রিসিভ কর‍তে। এরমধ্যে হঠাৎ খেয়াল করে সুনীতি পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা একটা লোকের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিতেই তাকে ধরে ফেলে। অনেকক্ষণ থেকে মেয়েটার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে ভারিক্কি কন্ঠে ধমকে বলে উঠল,”এয়ারপোর্টটাকে কি প্লে গ্রাউন্ড পেয়েছ নাকি যে উন্মাদের মতো দৌড়াচ্ছিলে?”

To be continue…….