মন রাঙানোর পালা পর্ব-০৭

0
4

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_7
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে এসেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। রাগে তার চোয়াল কাপছে। কিভাবে সাজিদ তাকে এতটা অপমান করল? সে কি ভেবেছে, সুনীতি সব মুখ বেজে মেনে নেবে? তেমনটা মোটেই না। সুনীতি প্রতিবাদ করতে জানে। এদিকে নয়না খন্দকার ক্রমাগত দরজা ধাক্কিয়েই চলেছেন। কিন্তু সুনীতি দরজা খুলল না। সামিউল খন্দকার অফিস থেকে ফিরে এসব দেখে ভীষণ রেগে গেলেন। সুনীতির রুমের সামনে এসে জোরে একটা ধমক দিতেই সুনীতি এসে দরজা খুলে দিলো। তার চোখে জল। সামিউল খন্দকার রাগী কন্ঠে বললেন,”এসব কি সুনীতি? কেন এমন করছ? কি হয়েছে সেটা বলো তো।”

“আমি সাজিদ ভাইয়াকে বিয়ে করব না। ব্যস, আমাকে আর কোন প্রশ্ন করবে না।”

সামিউল খন্দকার এবং নয়না খন্দকার দুজনেই অবাক হয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারা তাকে অনেক প্রশ্ন করতে লাগলেন কিন্তু সুনীতি চুপ করে রইল। নিজের জেদে সে অটল।

শেষ পর্যন্ত সামিউল খন্দকার বাধ্য হয়ে তার বোন সালমা খন্দকারকে ফোন করে সব জানালেন। সব শুনে সালমা খন্দকার বললেন,”তোরা কোন চিন্তা করিস না। আমি ব্যাপারটা দেখছি। আমি যখন বলেছি, সুনীতিকে আমার সাজিদের বউ করে আনব তখন তাই হবে।”

বেশ অহমের সাথে কথাটা বলে তিনি ফোন কে’টে দিয়ে রাগী চোখে তাকালেন সাজিদের দিকে। সাজিদ তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সালমা খন্দকার সাজিদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস, সুনীতিকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। ও ছোট থেকেই তোকে পছন্দ করে। ও কিছুতেই এই বিয়েতে দ্বিমত করতে পারে না। এখন ভালোয় ভালোয় সবটা স্পষ্ট করে বল।”

সাজিদ সালমা খন্দকারের পায়ের কাছে বসে পড়ে। অনুনয়ের সুরে বলে,”আমায় ক্ষমা করে দিও মা, আমি..আমি সুনীতিকে বিয়ে করতে পারবো না।”

“কেন? তোর কি সুনীতিকে পছন্দ নয়? নাকি সে তোর যোগ্য নয়?”

“এমনটা নয় মা, আরো স্পষ্ট করে যদি বলি তাহলে শুধু সুনীতিই নয় আমার পক্ষে আর কোন মেয়েকেই বিয়ে করা সম্ভব নয়..”

“এর কারণ কি জানতে পারি?”

সাজিদ চোখ বন্ধ করে বলে,”আমি তোমার কাছে এসব লুকাতে চাইনি..কিন্তু বলার সাহসও পাইনি। আসলে আমি..আমি বিবাহিত মা। আমি আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার ইভা নামের একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলি। ইভা আমার জন্য ওর পরিবারকে ছেড়ে দিয়েছে। আমরা কিছুদিন আগে বিয়েও করেছি আর..”

সাজিদ নিজের সম্পূর্ণ কথা পূর্ণ করতে পারে না তার আগেই সালমা খন্দকার ঠাস করে তার গালে থা*প্পড় বসিয়ে দেয়।

“মা..তুমি আমায় মারলে?”

সালমা খন্দকার ক্ষেপে উঠে বললেন,”তোর সাহস কিভাবে হলো আমাকে না জানিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার? কি ভেবেছিলিস তুই, একটা শ্বেতাঙ্গ, বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করে একেবারে আমায় জানাবি আর আমি এই বিয়েটা মেনে নেব..কিছুতেই না।”

“আমরা একে অপরকে ভালোবাসি মা..”

“আর আমি আমি যে ছোটবেলা থেকে এত ভালোবাসা, এত কষ্টের মধ্য দিয়ে তোকে বড় করলাম তার কোন মূল্য নেই তোর কাছে?”

“আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব সবার আগে মা।”

“তাহলে আমি যা বলছি তাই কর, তুই সুনীতিকে বিয়ে কর। তুই চাইলে ইভাকে নিয়ে আমেরিকায় থাকিস অসুবিধা নেই। সুনীতি নাহয় এই দেশে আমার কাছে থাকবে। আমারও তো কারো একজনের সঙ্গ দরকার। আর সুনীতিকে এসব কিছু জানানোর দরকার নেই।”

“এসব তুমি কি বলছ মা? এমনটা করলে তো ইভা ও সুনীতি দুজনকেই ঠকানো হবে। আমি এমনটা করতে পারবো না।”

“তোকে আমার কথা শুনতেই হবে। আর যদি না শুনিস তাহলে..তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দিব..”

“মা!”

“শুধু তাই নয়, তোকে তোর বাবার সব সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করব। তুই বলছিলি না তোর একটা বিজনেস শুরু করার জন্য ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন সেই জন্য তোকে সুনীতিকে বিয়ে করতে হবে..এর মাধ্যমে সামিউল তোকে এই টাকাটা দেবে। আমি যা করছি তোর ভালোর জন্যই করছি।”

“কিন্তু..”

“কোন কিন্তু নয়। মায়েরা যা করে সন্তানদের ভালোর জন্যই করে। যা আমি ইভার সাথে তোর বিয়েটা মেনে নিলাম। তুই আমেরিকায় ওর সাথে সুখে থাক। শুধু সুনীতিকে এসব জানানোর দরকার নেই। বছরে দু-তিনবার দেশে আসবি এটুকুই। বাকিটা আমি সামলে নেব। এতে আমাদের সবার লাভ। আমার কাছে তো তোকে দেয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা নেই। সেই টাকাটা সামিউল তোকে দেবে। আর এরজন্য তোকে সুনীতিকে বিয়ে করতে হবে।”

সাজিদ এবার নিজের মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,”ঠিক আছে,মা। যা চাও তাই করব আমি।”

“এই না হলে আমার ছেলে।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অভিক পুনরায় তার আর্মি ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আহসান চৌধুরী এসে অভিককে বললেন,”এখনই ফিরে যাচ্ছ! এখনো তো এক সপ্তাহ সময় আছে।”

অভিক বলল,”এখানে আর মন টিকছে না আব্বু। এক সপ্তাহ নাহয় রেজিমেন্টেই অবস্থান করব।”

এমন সময় রাহেলা খাতুন এসে বললেন,”এখন তোমার কোথাও যাওয়া হবে না, ব্যস। যেদিন ছুটি শেষ হবে সেদিনই যাবে।”

“কিন্তু আম্মু..”

“আমি আর কোন কথা শুনতে চাইনা। অভিকের আব্বু তুমি ওকে বুঝিয়ে দাও আমি ঠিক কি বলতে চাইছি। আমি কুলসুম আপার সাথে কথা বলেছি উনি আমাকে খুব ভালো একটা মেয়ের সন্ধান দিয়েছে। আমি ঠিক করেছি যে এবার অভিক ফেরার আগেই ওর এনগেজমেন্টটা করিয়ে রাখব আর যদি সুযোগ পাই তো কাবিন করিয়ে রাখব।”

অভিক বেশ রাগী সুরে বলল,”আমি এসব ব্যাপারে আর কোন কথা শুনতে চাই না। লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”

রাহেলা খাতুনও নাছোড়বান্দা হয়ে বললেন,”আমিও বলে দিলাম, তোমাকে বিয়ে করিয়েই ছাড়ব।”

এই বলে রাহেলা খাতুন অভিকের ব্যাগপত্র কেড়ে নিয়ে বললো,”মায়ের জেদের কাছে ছেলেকে নতজানু হতেই হবে। কাল আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি এটাও লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”

অভিক একবার আহসান চৌধুরীর দিকে তাকালো কিন্তু তিনিও ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন এই ব্যাপারে তিনি আর কিছু করতে পারবেন না। অভিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”ঠিক আছে, মেয়ে নাহয় দেখতে যাব। কিন্তু বিয়ের প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারছি না।”

আহসান চৌধুরী বিড়বিড় করে বললেন,”তোমার প্রতিশ্রুতির থেকে আল্লাহর ইচ্ছাটাই বেশি কার্যকর। তিনি যদি চান, তাহলে তোমার অবিবাহিত তকমা খুব শীঘ্রই মিটবে।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাজিদ। সালমা খন্দকার রাগী কন্ঠে সাজিদকে বলছেন,”সবকিছুর জন্য সুনীতির কাছে ক্ষমা চা।”

সাজিদ মাথা নিচু করে বলে,”সকালের ঘটনার জন্য আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দুঃখিত। আমার উচিৎ হয়নি তোমায় ওভাবে বলা। আসলে তখন ঐ ছেলেটাকে তোমার এত কাছে দেখে আমি…আমি নিজেকে সামলাতে পারি নি। রেগে এত কিছু বলে ফেলেছিলাম।”

সুনীতি রেগে বলে,”আপনি যা বলেছিলেন তা অত্যন্ত অপমানজনক। আমি এতকিছুর পর আপনায় ক্ষমা করতে পারি না।”

সালমা খন্দকার বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি বেগতিক। তাই তিনি সবটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সুনীতির সামনে এসে তার সামনে হাতজোড় করে বলেন,”আমি সাজিদের হয়ে তোর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে, তুমি এসব মনে রাখিস না। আমার অনেক স্বপ্ন তোকে নিজের বাড়ির বউ করব। আমার এই স্বপ্নটা নষ্ট করিস না।”

বলেই তিনি কান্নার ভান করলেন। সালমা খন্দকারের এই কান্না দেখে সুনীতির মন গলে গেল। তাই সে বলল,”তুমি এভাবে কেঁদো না ফুফু।”

এই বলে সে সাজিদের দিকে তাকিয়ে বলল,”শুধুমাত্র ফুফুর কথা ভেবে আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম। কিন্তু দ্বিতীয় বার এমন করার কথা ভাববেন না। আমার বাবা-মা আমায় উঁচু মাথায়, আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছে। তাই নিজের সম্মান লঙ্ঘিত হওয়া আমি কিছুতেই সমর্থন করব না।”

বলেই সুনীতি একবার সাজিদ আরেকবার নিজের ফুফুর দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সালমা খন্দকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
To be continue…….