#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_20
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভিক ও আরাফাত সেনা ক্যাম্পের একটি কক্ষের বাইরে বসে আছে। ভেতরে চিকিৎসকরা সেই আগন্তুক মেয়েটির চিকিৎসায় ব্যস্ত। অভিক যেন একটু বেশিই চিন্তিত হয়ে উঠেছে মেয়েটিকে নিয়ে। আরাফাত অভিকের উদ্বিগ্নতা লক্ষ্য করছে৷ সে জানে অভিক কেন এত উদ্বিগ্ন। নিজের প্রথম ভালোবাসার প্রতি সবারই যে একটু বিশেষ অনুভূতি থাকে! আরাফাত অভিকের কাধে হাত রাখে। অভিক আরাফাতের দিকে করুণ চোখে তাকায়। আরাফাত বলে,”চিন্তা করিস না। ও ঠিক হয়ে যাবে।”
অভিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,”আমি ভাবতেও পারিনি আরাফাত! এত গুলো বছর পর..এভাবে..এভাবে ওর সাথে দেখা হয়ে যাবে।”
আরাফাত একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”হয়তো এটাই নিয়তি ছিল। তাই আজ আবারো তোকে তোর অতীতের সম্মুখীন হতে হলো।”
এরইমধ্যে ডাক্তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। অভিক তার মুখোমুখি হয়ে বলে,”উনি এখন কেমন আছেন?”
“চিন্তার কোন কারণ নেই,মেজর। উনি ঠিক আছেন। ওনার জ্ঞান ফিরেছে।”
“ওনার জ্ঞান ফেরার পর কি উনি কিছু বলেছেন?”
“উনি এখান থেকে চলে যেতে চাইছেন। বেশ উদ্ভট আচরণ করছিলেন। আমি অনেক কষ্টে ওনাকে স্বাভাবিক করেছি।”
“আমি কি এখন ওনার সাথে দেখা করতে পারি ডাক্তার?”
“হ্যাঁ, পারেন। তবে একটু খেয়াল রাখবেন..যেন উনি বেশি উত্তেজিত না হয়ে ওঠেন।”
ডাক্তারের কথা শুনে অভিক রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। আগন্তুক রমনী তখনো চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। তাকে মুখে ফুটে উঠছে আতঙ্কের ছাপ। অভিক রমনীর মুখ পানে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলে ওঠে,”আনিসা!”
রমনী পিটপিট চোখ মেলে তাকায়। দীর্ঘ দিন পর,সেই চেনা কন্ঠ। ধীরে পায়ে উঠে দাঁড়ায়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। অভিকের একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবেগাপ্লুত স্বরে বলে,”অভি, তুই?!”
অভিক যেন খানিকটা দূর্বল হয়ে পড়ে। ভুলে যায় বর্তমান প্রেক্ষাপট। আনিসাকে আলিঙ্গন করে ফেলে আবেগের বশে৷ অতঃপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত দূরে সরে আসে। আনিসা অভিকের এমন কাণ্ডে অবাক হয়। হালকা হেসে বলে,”এত গুলো বছর পর আমায় দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হচ্ছিস, তাইনা?”
অভিক বলে ওঠে,”এতদিন কোথায় ছিলিস তুই?”
“আমি বোধহয় প্রশ্নটা আগে করেছি।”
“তুই জানিস না, আনিসা। এতগুলো বছর আমি কোথায় কোথায় তোকে খুঁজেছি। কিন্তু সেই রাতের পর সেই যে তুই হারিয়ে গেলি এরপর আর তোর খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।”
আনিসার চোখমুখের ভাবভঙ্গি হঠাৎ করেই পালটে যায়। সে খানিক মশকরার স্বরে বলে,”যে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু যে স্বেচ্ছায় আড়ালে লুকিয়ে থাকে তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, যদি না সে নিজে থেকে ধরা দেয়।”
“তোর হেয়ালি করার স্বভাব গেল না!”
আনিসা হঠাৎ করে বলে ওঠে,”আমার একটা সাহায্য করতে পারবি অভি?”
“কি সাহায্য?”
“এখন আমায় কোন প্রশ্ন করিস না প্লিজ। সঠিক সময় হলে, আমি নিজেই তোকে সব জানাব। আপাতত শুধু আমায় ক’টা দিন একটা নিরাপদ আশ্রয় দে।”
“নিরাপদ আশ্রয়?!”
“হ্যাঁ, কেন পারবি না? তুই তো সেনাবাহিনীতে আছিস এখন৷ তোর জন্য এটা করা নিশ্চয়ই কোন কঠিন কাজ নয়!”
আরাফাত অবাক চোখে আনিসার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অতঃপর বলে,”তুই যখন ভরসা করে আমার কাছে নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিস তখন আমি নিশ্চয়ই তোকে আশ্রয় দেব। তবে মনে রাখিস,আপাতত আমি তোকে কোন প্রশ্ন না করলেও তোকে যখন আমি প্রশ্ন করব তখন তোকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। তোর থেকে অনেক কিছু জানার আছে আমার।”
আনিসা হালকা হেসে বলে,”আচ্ছা, বেশ। সঠিক সময় আসলে আমি অবশ্যই তোকে সব বলব। কিন্তু তার জন্য আমাকে সময় দিতে হবে।”
আনিসার সাথে কথা বলে রুমের বাইরে আসে অভিক। আরাফাত অভিকের জন্যই অপেক্ষা করছিল। অভিক বাইরে আসতেই সে অভিককে জিজ্ঞেস করে,”কি বললো ও? কোথায় ছিল এতদিন? আমরা তো ওকে সব খানে খুঁজেছি কিন্তু..”
“ও আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। শুধু আমার কাছে নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছে। আমি ভাবছি ওকে আমাদের কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে রাখব।”
আরাফাত রেগে গিয়ে বলে,”তুই কি পাগল নাকি অভিক? আরে এভাবে কিভাবে….আনিসা এতদিন কোথায় ছিল কিভাবে ছিল সেটা কেউ আমরা জানি না। ওকে উদ্ধার করা হয়েছে এমন একটি স্থান থেকে যা ছিল অপরাধীদের আস্তানা। এতসব কিছুর পর আমরা কিভাবে ওকে বিশ্বাস করতে পারি? আর তার থেকে বড় কথা তুই কোন আক্কেলে ওকে তোর কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে রাখতে চাইছিস? একবারও ভাবলি না সুনীতি ভাবি ওকে দেখে কিরকম রিয়্যাক্ট করতে পারে?”
“নীতি যথেষ্ট বুঝদার। ওকে সবটা বুঝিয়ে বললেই ও বুঝবে।”
“কিন্তু..”
“কোন কিন্তু নয় আরাফাত। আনিসাকে দেখে আমি যতটা যা বুঝেছি, ও একদম ভালো নেই। আগের সেই রূপবতী, হাসিখুশি আনিসা একদম বদলে গেছে। ওর চেহারা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, পুরো শরীরে কালসিটে দাগ, চেহারা বিষাদের ছাপ। এত সবকিছু ভালো কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে এতগুলো বছর আনিসা ভালো ছিল না। ওর সাথে নিশ্চয়ই অনেক খারাপ কিছু হয়েছে।”
আরাফাত বলে,”কিন্তু অভিক..ওকে তুই যে কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে চাইছিস তো সুনীতি ভাবিকে কি বলবি?”
“বলব যে, ও আনিসা। তোর আর আমার স্কুল এবং কলেজের ফ্রেন্ড। ও এখন বিপদে পড়েছে তাই সাহায্যের জন্য আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আর এটাই তো সত্যি। তোর মনে নেই, সেই ক্লাস ১ থেকে কলেজ পর্যন্ত আমরা তিনজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। আজ ওর বিপদে কি আমাদের সাহায্য করা উচিৎ নয়?”
“আমি কিচ্ছু ভুলিনি অভিক। কিছু ভুলিনি জন্য এটাও মনে রেখেছি যে..আনিসা কেবল আমাদের বান্ধবী ছিল না। তোর বয়সন্ধিকালের প্রথম প্রেম ছিল..যবে থেকে তুই ভালোবাসা কি সেটা উপলব্ধি করেছিস তবে থেকে ওকে একতরফা ভাবে ভালোবেসেছিস। আর তারপর…”
“ব্যস, আরাফাত। আর কিছু বলিস না প্লিজ। বিশেষ করে নীতি যেন এসব কিছু না জানে। আমি অতীত নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে চাই না। অতীতের সাথে বর্তমানের তুলনা চলে না। এখন আনিসা আমার কাছে শুধুই আমার ভালো বন্ধু যার আমার সাহায্যের প্রয়োজন।”
আরাফাত আর কিছু বলে না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতির সময় কাঁটছে মারাত্মক দুশ্চিন্তায়। অভিক মিশনে যাওয়ার পর প্রায় ১২ ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু তার কোন খোঁজ নেই। সুনীতি বারবার আল্লাহর কাছে অভিকের জন্য প্রার্থনা করছিল। এত সব উদ্বিগ্নতার মাঝেই হঠাৎ করে কলিং বেল বেজে উঠলো। সুনীতির মনে আশার আলো জ্বলল। সে একপ্রকার ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই অভিককে দেখতে পেয়ে সাতপাঁচ না ভেবে তাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে। ক্রন্দনরত স্বরে বলে,”জানো, আমি তোমার জন্য কতটা চিন্তা করছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, যে তুমি একদম সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছ।”
সুনীতির কথাটা বলে চোখ মেলে তাকায়৷ হঠাৎই তার নজর যায় অভিকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুক রমনীর দিকে। আগন্তুক রমনীও তার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে। অভিক সুনীতির দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে,”তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, ও হলো আনিসা। আমার আর আরাফাতের স্কুল এবং কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। আর আনিসা ও হলো সুনীতি যদিও ওকে আমি নীতি বলে ডাকি। ও আমার স্ত্রী।”
আনিসা খানিক চমকে উঠে বলে,”তুই বিয়েই করে ফেলেছিস অভি! ইশ, আমার দাওয়াত টা মিস হয়ে গেল।”
অভিক সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আনিসা আসলে বিপদে পড়েছে। তাই ও কিছুদিন এখানে আমাদের সাথে থাকবে। তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”
সুনীতি একপলক আনিসার দিকে তাকায়। মেয়েটার চেহারা অনেকটা ফ্যাকাসে এবং দেহের অনেক স্থানে কালসিটে দাগ। এতসবকিছুও তার সৌন্দর্য ফিকে করতে পারেনি। দেখে অনুমান করা যাচ্ছে, মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী ছিল একসময়। সুনীতির মায়া হলো খানিক। তাই সে বলল,”আমার কোন অসুবিধা নেই। তুমি ওকে ভেতরে নিয়ে এসো।”
To be continue…….