মন রাঙানোর পালা পর্ব-৪৪

0
2

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_44
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অহনা ও সুনীতি সেনা ক্যাম্পে এসে বসে আছে। কিছু সেনা সদস্য তাদের এখানে নিয়ে এসেছে। দুজনেরই ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। কারণ অভিক এবং আরাফাতের কোন দেখা মিলছিল না। অহনা সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোর কি মনে হচ্ছে দোস্ত? আমার তো ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। ওরা তো কিছু বলছেও না আমাদের। এমনিতেই আমার মনটা কু গাইছিল সকাল থেকে। এই মিশনে গিয়ে কোন বিপদ হলো না তো?”

সুনীতিও চিন্তিত স্বরে বলে,”আমারও তো সেটাই ভয় হচ্ছে রে! আল্লাহ না করুক, ওদের যেন কোন বিপদ না হয়।”

সুনীতির এই কথা বলার পরই অভিক চলে আসে। তাকে অনেক বিধ্বস্ত লাগছিল। চোখগুলো একদম রক্তিম। সুনীতি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে সাবধানতার সহিত অভিকের কাছে গিয়ে বলে,”তুমি ঠিক আছ তো? আমার ভীষণ ভয় হচ্ছিল।”

অভিক কোন উত্তর দেয় না। এবার অহনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আরাফাত কোথায় ভাইয়া? ওকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।”

আরাফাতের নাম শুনেই অভিকের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে পিছন ফিরে তাকায়। কয়েকজন সেনা সদস্য একটা লাশ বহন করে আনছে। অহনা চরম হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে সেদিকে। লাশটা অভিকের নির্দেশে মাটিতে নামানো হলো। অহনা গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। সুনীতিও হতবাক হয়ে তাকিয়ে। হঠাৎ প্রবল হাওয়া এসে লাশের মুখ থেকে কাপড়টা সরে গেল। সাথে সাথেই অহনা একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো। সুনীতিও মুখ চেপে কাঁদলে লাগল। অভিক সুনীতির মাথায় হাত রেখে বলল,”তুমি সামলাও নিজেকে। অহনা ভাবিকে তো এখন তোমারই সামলাতে হবে।”

এদিকে অহনা আরাফাতকে এভাবে দেখে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সে আরাফাতের মৃতদেহের পাশে বসে পড়ে আহাজারি করে বলতে থাকে,”আরাফাত! এই আরাফাত, চোখ খোলো না, তাকাও আমার দিকে। তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। আমার যে তোমাকে অনেক বড় একটা খুশির খবর দেয়ার আছে। জানো, আমি মা হতে চলেছি। আমার গর্ভে তোমার সন্তান বেড়ে উঠছে। তুমি কিভাবে আমাদের দুজনকে ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারো? তুমি তো এখনো ওর আগমনের খবরও পেলে না আর না আমাদের সন্তান তার বাবার সান্নিধ্য পেল,,চোখ খোলো আরাফাত।”

সুনীতি এগিয়ে এসে অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”তুই শান্ত হ অহনা।”

“কিভাবে শান্ত হবো আমি? লোকটা সকালেও একদম সুস্থ স্বাভাবিক ছিল আর এখন,,,আমি বলেছিলাম ওকে আজ যেন কোন মিশনে না যায় কিন্তু ও আমার কথা শুনল না,,ও এভাবে কেন আমায় ছেড়ে চলে গেল? এখন আমি কি নিয়ে বাঁচব?”

অহনা এভাবে আরো কিছুক্ষণ আহাজারি করে অতঃপর জ্ঞান হারালো। সাগর এসে অহনার পাশে বসল। সুনীতিকে বলল,”ওনাকে এখনই ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। ওনার অবস্থা আমার ভালো ঠেকছে না।”

“কিভাবে ভালো থাকবে ও? আরাফাত ভাই ওর স্বামী ছিল, ওর জীবনসঙ্গী, ওর অনাগত সন্তানের পিতা। ও কিভাবে এই ধাক্কাটা সামলাবে? আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না, আরাফাত ভাই কিভাবে..”

“আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যই উনি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। উনি একজন বীর।”

বলেই কেঁদে ফেলল সাগর। তার মনে এতদিন আরাফাতের জন্য যে একটা চাপা ক্ষোভ ছিল আজ তা অপ্রতুল সম্মানে পরিণত হয়েছে। সাগর বুঝতে পারছে এই লোকটা কতটা ভালো ছিল, অহনাও কতটা ভাগ্যবতী ছিল যে এমন একজন লোককে স্বামী হিসাবে পেয়েছিল।

~~~~~~~~~~~~~~
আরাফাতের মৃত্যুর খবর শুনে তার বাবা শফিক ইসলাম এবং মা আনোয়ারা বেগমও ছুটে চলে এসেছেন। আনোয়ারা বেগম এসেছেন থেকে যতোটা না ছেলের জন্য আফসোস করছেন তার থেকে অনেক বেশি দোষারোপ করছেন অহনাকে। অহনার জ্ঞান ফেরার পর সে একটু বাইরে আসে আরাফাতের লাশের কাছে। আনোয়ারা বেগম অহনাকে দেখামাত্রই ছুটে এসে তার গালে ঠাস করে থা*প্পড় মে*রে বলেন,”এই কালনাগিনী আমার ছেলেটাকে খেয়ে নিলো। এর জন্য আমার ছেলেটা মরে গেছে। তোর কখনো ভালো হবে না।”

শফিক ইসলাম এমনিতেই নিজের ছেলের শোকে কাতর। তার উপর স্ত্রীর এহেন ব্যবহার দেখে তিনি আর নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে বলেন,”আল্লাহর দোহাই লাগে আনোয়ারা, তুমি মেয়েটাকে এভাবে বলো ন। জন্ম, মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে। তুমি কোন হিসেবে মেয়েটাকে এভাবে দোষারোপ করছ?”

আনোয়ারা বেগম দমে না গিয়ে আরো বলতে থাকেন,”আমার ছেলে তো এর আগেও অনেক মিশনে গেছে,কখনো তো এমন হয়নি। কিন্তু এই মেয়েটার সাথে বিয়ের পরই এমন হলো। না এই মেয়ের চরিত্র ভালো আর না ভাগ্য। এটা একটা অপয়া। আমার ছেলের খুনি ও।”

সুনীতি আর চুপ থাকতে না পেরে আনোয়ারা বেগমকে বলেন,”অনেক হয়েছে আন্টি, এবার দয়া করে চুপ থাকুন। অহনাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না। এতক্ষণ আমি কিছু বলিনি মানবতার খাতিরে। ভেবেছিলাম আপনি নিজের ছেলেকে হারানোর শোকে এসব ভুলভাল বলছেন কিন্তু এবার আপনি লিমিট ক্রস করছেন। আপনি যেমন নিজের ছেলেকে হারিয়েছেন তেমনি অহনাও কিন্তু ওর স্বামীকে হারিয়েছে। তাই ওর কষ্টটাও কোন অংশে কম না।”

আনোয়ারা বেগম বলেন,”আমাকে এসব শোনাতে এসো না। এই মেয়ের যা চরিত্র। যা হারিয়েছি সেটা শুধু আমি। আমার একমাত্র ছেলেকে। এ তো দুদিন পর ঠিকই আরেকটা জুটিয়ে ফেলবে।”

সুনীতি এবার চরম রেগে বলে,”অহনা আপনার পুত্রবধূ। ওর সম্পর্কে আপনি দয়া করে এত নিম্ন কথা বলবেন না। তার উপর ও আপনার ছেলের সন্তানের মা হতে চলেছে।”

আনোয়ারা বেগম একথা শুনে আরো বেশি ক্ষেপে গিয়ে বলেন,”কি প্রমাণ আছে যে এই বাচ্চাটা আমার ছেলের? এই মেয়েকে তো বিয়ের দিন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জানি না, এর সাথে কোন ছেলের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। হয়তো সেই ছেলেরই,,,”

আনোয়ারা বেগম নিজের পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই শফিক ইসলাম ঠাস করে চড় বসিয়ে দেন। আনোয়ারা বেগম চড় খেয়ে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ফোসফাস করতে থাকেন। শফিক ইসলাম বলেন,”তুমি আর একটাও বাজে কথা বলবে না। নিজের ছেলের মৃত্যুর পর কোন মা এমন জঘন্য কথা বলে ছি!”

“তুমি শুধু আমাকেই দোষ দিতে পারবে। আর কিছু পারবে না। কিন্তু একটা কথা আমি সর্প স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি এই মেয়েকে আমি কিছুতেই আমার ঘরে তুলব না। এর জন্য আমার ছেলের সাথে আমার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল,মৃত্যুর আগ অব্দি ছেলেটা আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলল না,এই মেয়েকে আমি মেনে নিব না,না ওর গর্ভের সন্তানকে নিজের বংশধর হিসেবে মানব। আর তুমি যদি আমার সিদ্ধান্ত মেনে না নেও তো আমি বিষ খাবো।”

“আনোয়ারা!”

অহনা এসব তিক্ত কথা শুনে ভীষণ ব্যথিত হয়। যদি সে একা থাকত তাহলে হয়তো অপমানে এতক্ষণে নিজেকে শেষ করে দিত৷ কিন্তু তার গর্ভে যে বেড়ে উঠছে নতুন প্রাণ। তার আরাফাতের শেষ চিহ্ন। এটা তো সে নিঃশেষ হতে দিবে না। অহনা ছোট থেকে তার মায়ের সিঙ্গেল মাদার হিসেবে কিভাবে সংগ্রান করেছে তা দেখেছে৷ এখন তাকেও হয়তো সেই সংগ্রাম করতে হবে। অহনা নিজের চোখের জল মুছে বলে,”যদি ভাগ্যে এমনটাই লেখা থাকে তো তাই হবে। আমি হার মানবো না। আমার সন্তানের জন্য আমায় শক্ত থাকতে হবে। আরাফাত তো আমাদের কথা ভাবল না। কিন্তু আমাকে তো ভাবতে হবে ”

দূর থেকে সাগর দেখছিল অহনাকে। এতক্ষণ নির্জীব অহনার চোখে হঠাৎ অন্যরকম একটা অনুপ্রেরণা দেখে সাগরের মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। সাগর মনে মনে বলে উঠল,”মেজর আরাফাত আমাদের সবাইকে ঋণী করে রেখে গেছে। সেই ঋণ আমরা শোধ করবোই!”

আরাফাতের মৃতদেহকে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়। অতঃপর তার জানাজা শেষে নিজ গ্রামের বাসা সাভারে দাফন করা হয়। অহনা পুরোটা সময় শক্ত মূর্তিতে পরিণত হয়। এখান থেকে যে তার জীবনের নতুন যাত্রা শুরু!

To be continue……