মন রাঙানোর পালা পর্ব-৪৭

0
2

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_47
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি আজ সকাল সকাল অহনার বাসায় চলে এসেছে। অহনা তার অনলাইন বিজনেসের কাজ সামলে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় সুনীতির আগমনে সে থতমত খেয়ে যায় এবং বলে,”তুই হঠাৎ?”

সুনীতির কোলে ছিল অভীক্ষা। আমাদের ছোট্ট অভীক্ষা এখন অনেক বড় হয়েছে। তার বয়স প্রায় তিন বছর। অহনাকে দেখামাত্রই অভীক্ষা তার কোলের কাছে চলে আসে। অহনা অভীক্ষাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাগ্যিস, আমায়রা এখন ঘুমিয়ে আছে। নাহলে যে কি কান্না শুরু দিত। মেয়েটা আমার এত হিংসুটে হয়েছে।”

সুনীতি অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোর সাথে আমার একটা জরুরি কথা আছে।”

“হুম, সেটা তো বুঝতেই পারছি। নাহলে কি তুই এত সকাল সকাল আমার এখানে আসতি!”

“আমাকে যে এখানে আসতেই হতো। তোর জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়ার জন্য!”

“মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?”

“দেখ, অহনা। তুই নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে রেখে কোন লাভ পাবি না৷ ছোট থেকে আমি তোকে চিনি। তোর চোখ দেখেই তোর মনের কথা বলতে পারার সক্ষমতা আছে আমার।”

“তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“আজ সাগর ওর পরিবারকে রাজি করিয়ে এখানে তোকে দেখাতে নিয়ে আসবে। তুই কিন্তু এবার আর ওকে ফেরাবি না।”

অহনা বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,”এটা হতে পারে না। তুই ওকে না করে দে।”

“আমি ওকে না করব না। এবার তোকে হার মানতে হবে। অনেক কষ্ট দিয়েছিস ছেলেটাকে ও এতদিন তোর জন্য অপেক্ষা করেছে এখন আর না৷ এবার তুইও তোর মনের কথা শোন। সমাজকে পরোয়া করিস না।”

“সাগর আমার থেকে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। ওর জীবন তো একদম ফ্রেশ। কত ভালো মেয়ে ওর জন্য তৈরি আছে৷ সেখানে ও কেন আমার মতো এক সন্তানের মাকে বিয়ে করবে?”

“নিজেকে এতটা ছোট ভাবিস না অহনা। সাগর স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে এবার যদি তুই ওকে ফিরিয়ে দিস তাহলে ও আজীবন অবিবাহিত থাকবে। এখন তুই ভেবে নে কি করবি।”

অহনা দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়। এখন কি করবে সে?!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সালমা খন্দকার হতবাক হয়ে যান সাগরের কথা শুনে। প্রথমে যখন সাগর বলেছিল, তার একটি পছন্দের মেয়ে আছে এবং সে সেই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তখন সালমা খন্দকার অনেক খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, সেই মেয়ে বিধবা এবং এক সন্তানের মা তখনই তিনি বেঁকে বসলেন। হতাশ স্বরে বললেন,”তোমার জন্য কত ভালো ভালো মেয়ের সম্মন্ধ আসছে, আর তুমি কিনা একটা বিধবা, এক সন্তানের মাকে বিয়ে করতে চাইছ। আমি এটা মানতে পারব না।”

সাগরও স্পষ্ট বলে দেয়,”মানা, না মানা তোমার ব্যাপার৷ কিন্তু আমার শেষ কথা এটাই যে, যদি আমি বিয়ে করি তো ঐ মেয়েকেই করব আর নাহয় আজীবন অবিবাহিত থাকব। এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছা।”

সালমা খন্দকার অনেক আশা নিয়ে সাজিদের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”তুই অন্তত তোর ভাইকে বোঝা। ও আবেগে অন্ধ হয়ে গেছে।”

সাজিদ বলে,”সাগরের আর আবেগের বয়স নেই আম্মু। ও যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভেবেই নিয়েছে। তুমি আর এতে আপত্তি জানিও না। নাহলে হিতে বিপরীত হবে। ও যা জেদি ছেলে একবার যা বলেছে তাই করবে। তুমি কি চাও যে, তোমার ছেলে আজীবন অবিবাহিত থাকুক?”

সালমা খন্দকার হতাশ সুরে বলেন,”সেটা তো আমি চাই না। কিন্তু এই বিয়েটা হলে যে,সমাজের নানান লোক নানান কথা বলবে। আমার অবিবাহিত ছেলেকে কেন একটা বিধবা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছি, ছেলের কোন ত্রুটি আছে কিনা এরকম হাজারটা প্রশ্ন তুলবে!”

এবার ইভা বলে ওঠে,”আপনি সমাজের কথাকে এত গুরুত্ব দেবেন না। সে তো আমি বিদেশি বলেও সমাজের অনেকে অনেক কিছু বলেছে। তবুও তো আপনি আপনার বড় ছেলের স্বার্থে আমায় মেনে নিয়েছেন৷ তাহলে নিজের ছোট ছেলের ভালোবাসাকেও পূর্ণতা পেতে দিন।”

ইভা এখন বেশ ভালোই বাংলা বলা রপ্ত করে নিয়েছে। ইভার কথা শুনে সালমা খন্দকার কিছুক্ষণ ভেবে বলেন,”তোমরা সবাই ঠিকই বলছ, আমার সমাজের মানুষের এত কথায় গুরুত্ব দেয়ার কোন দরকার নেই।আমার নিজের ছেলের সুখকেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। আমার আর কোন আপত্তি নেই৷ আমি ঐ মেয়েকে দেখতে যেতে রাজি।”

সবাই ভীষণ খুশি হয়ে যায় সালমা খন্দকারের এই সিদ্ধান্তে। অবশেষে তার শুভবুদ্ধির উদয় হয়। এরইমধ্যে সাজিদ ও ইভার ছেলে সারজিস ছুটে আসে৷ সারজিসের বয়স এখন ৫ বছর। বাংলাদেশী বাবা এবং আমেরিকান মায়ের সন্তান হওয়ায় তার দৈহিক গঠন বেশ আকর্ষণীয়। গায়ের রং ভীষণ ফর্সা, চোখের মনি নীল রংয়ের, ঠোঁটও বেশ লাল। যদিও তার চুল স্বাভাবিক বাঙালিদের মতোই কালো। সবমিলিয়ে ভীষণ সুন্দর চেহারা। সারজিস এসেই তার মা-বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমরা কি এখন চাচ্চুর জন্য পাত্রী দেখতে যাব?”

সাজিদ নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”হুম, লিটিং চ্যাম্প। তুমি তৈরি হয়ে নাও।”

ছোট্ট সারজিস ভীষণ মজা পায় ব্যাপারটায়। সে বলে,”চাচ্চুর বিয়েতে আমরা অনেক আনন্দ করব।”

“একদম।”

~~~~~~~
অভিক আজ ঢাকায় ফিরেছে। বাসায় এসে সুনীতি আর অভীক্ষাকে না দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে অভিক। রাহেলা খাতুনের মাধ্যমে জানতে পারে সুনীতি অভীক্ষাকে নিয়ে অহনাদের বাড়িতে গেছে৷ তখন সেও অহনার বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।

অহনাদের বাড়িতে প্রবেশ করেই অবাক হয়ে যায় কারণ সে দেখতে পায় সেখানে সোফার মধ্যে সাগরের পুরো পরিবার বসে। সাগর অভীককে দেখামাত্রই স্যালুট দেয়। অভিক সাগরকে জিজ্ঞেস করে,”তোমরা এখানে?”

তখনই সুনীতি অহনাকে সাথে করে নিয়ে এসে বলে,”ওরা সবাই অহনাকে দেখতে এসেছে।”

সুনীতির কন্ঠ শুনেই সাগর অহনার দিকে তাকায়। অহনার দিকে তাকাতেই সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। অহনা এমনিতেই অনেক সুন্দরী দেখতে। আজ যেন তার সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না, তার দুই বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে।

সালমা খন্দকারও অহনাকে দেখে খুশি হন। সুনীতি অহনাকে নিয়ে এসে সবার সামনে বসায়। অহনা এখন তার মা এবং মেয়েকে নিয়ে আলাদা এপার্টমেন্টে থাকে। মামারবাড়ি থেকে অনেক আগেই চলে এসেছে। তাই অহনার তরফ থেকে এখানে শুধু সুনীতি আর অহনার মাই রয়েছেন। সালমা খন্দকার সুনীতিকে বলেন,”এতদিন পর তোকে দেখে ভালো লাগল। তোর বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর অপরাধবোধের কারণে কখনো তোর মুখোমুখি হতে পারিনি। অতীতের জন্য আমি সত্যি ভীষণ লজ্জিত।”

সুনীতি বলেন,”অতীতের কথা এখন বাদ দাও না, ফুফু। এখন তোমরা বর্তমান নিয়ে ভাবো। আমার মনে কারো জন্যে কোন ক্ষোভ নেই। সাজিদ ভাইয়াকে তো অনেক আগেই বলে দিয়েছিলাম এটা।”

অহনার মা সবার মধ্যে বলে ওঠেন,”আমার মেয়েটার জীবন বড্ড অগোছালো। জন্মের পর থেকেই অনেক দুঃখ, কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে ও। ওর যখন পাঁচ-বছর বয়স তখন ওর বাবার সাথে আমার ডিভোর্স হয়, তার এক বছরের মাথাতেই ওর বাবা মারা যায়। এরপর আমি অনেক কষ্টে ওকে বড় করি। ওর বিয়ের পর ভেবেছিলাম একটু সুখের দেখা পাবে কিন্তু সেই সুখও চিরস্থায়ী হলো না।”

কথা বলতে বলতেই তার চোখে জল চলে আসে। তিনি সেই জল মুছে বলেন,”আমি চাই, এবার আমার মেয়েটাকে একটু সুখে থাকুক। তাই আপনাদের কাছে এটাই অনুরোধ থাকবে যে, আমার মেয়েকে তার অতীত নিয়ে খোটা না দিয়ে সাদরে গ্রহণ করতে পারলে করুন নাহয় আর কথা আগানোর দরকার নেই।”

সালমা খন্দকার বলেন,”আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে যখন আমার ছেলে পছন্দ করেছে তো আমাদের বাড়িতে আমরা ওকে একদম রাণী করে রাখব। কোন অযত্ন হতে দেব না।”

এরমধ্যে অহনা বলে ওঠে,”আমার একটাই কথা। আমার মেয়ে আমার সাথেই থাকবে সবসময়। যদি আপনাদের এটা নিয়ে কোন সমস্যা না থাকে তো এই বিয়েতে আমার কোন আপত্তি নেই।”

সালমা খন্দকার হেসে বলেন,”এটা তো কোন ব্যাপারই না। আমার তো একটা নাতিও আছে। তোমার সাথে সাগরের বিয়ে হলে তোমার মেয়েও আমার নাতনী হবে। সবাই মিলেমিশে থাকব।”

অহনা স্বস্তি পায় এটা শুনে। সব ঠিক হবার পর বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়। সাগর এবং অহনা দুজনের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
To be continue…….