আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-০৯

0
14

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#নবম_পর্ব

-‘এটা রুপক ভাইয়ার বোন? এর জন্য দেশে গিয়েছো তুমি? ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ ভাইয়া। পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছেও৷ আচ্ছা ভাবির ঠোঁটের পাশের তিলটা কি রিয়েল? জানাবে কিন্তু। আর হ্যাঁ,ভাবিকে দেখানোর জন্য এমন নাটকের মানে বুঝল না।’

রিমির ম্যাসেজ দেখে রিদওয়ান আড়চোখে পাশে তাকাল। কুহু চকলেট চিবুতে চিবুতে পথঘাট দেখছে। দেখছে মানুষ।
গাছগাছালি। একটা কুকুর ছানাদের দুধ খাওয়াচ্ছে। সেটাও মনোযোগ সহকারে দেখল৷ তারপর হাসল। তাকে নিঃশব্দে হাসতে দেখে রিদওয়ান সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অভিজ্ঞ
হাতে টাইপ করল,

– ‘ বুঝতে হবে না। তবে শোন বাবার জন্য বাঁশ রেডি। তুই আবার ওভার এক্টিং করে সব গড়বড় করে দিস না। সো বি কেয়ারফুল। আর যাকে তাকে ভাবি ভাবা বন্ধ কর। পাশে বসলেই ভাবি হয়ে যায় না৷ ভাবি হতে গেলে তোর ভাইয়ের সঙ্গে আগে বিয়ে হতে হবে। তারপর ভাবি ডাকার সুযোগ পাবি। হ্যাঁ, এটা রুপকের ছোটো বোন। সঙ্গে আমার ছাত্রীও। তাই ফান করেও এসব বলবি না আর৷ ফান জিনিসটা মাঝে মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করে। এসব ফান রুপকের নজরে পড়লে ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে৷ আমি নিজেও লজ্জিত হবো।
তাছাড়া প্রতিটা সম্পর্ককে আগে সুন্দর নজরে দেখতে হয়, জানতে হয়, ভাবতে হয়, এরপর সেটার মন্তব্য করতে হয়৷
তুমি যেটা করছো এটা মোটেও ঠিক না। বরং এভাবে বলা অন্যায়। আর ‘ওর জন্য দেশে এসেছি’ এইকথার মানে কি? এমন এক চটকানা দিবো না, একমাস গাল নাড়াতে পারবি না, বেয়াদব। আমি দেশে এসেছি শুধু বাবা মায়ের ডিভোর্স ঠেকাতে। কোনো বন্ধুর বোনের জন্য নয়। বোঝা গেল?তোর গোবরভরা মাথায় কথাটা ঢুকল? নাকি আবার বলতে হবে?
আর একটা আজাইরা কথা বললে তোমারর কপালে দুঃখ আছে৷ পাজি কোথাকার।’

উক্ত মেসেজটি সেন্ড করে রিদওয়ান ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। রিমিটা দিন দিন বড্ড বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আবার বলে কি না, ‘ভাইয়া তুমি ভাবিকে নিয়ে ঘুরছো?’

দেশে আসা দুই সপ্তাহ হলো না এর মধ্যে নাকি ভাবি জুটিয়ে ফেলবে। এসবকিছু এত সহজ? পাশের এই তারকাটা পাগল মেয়েকে আর যাই হোক রিমির ভাবি বানাবে না সে। কখনো না। তাহলে জীবনে শান্তি বলে যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও চলে যাবে। তাছাড়া বাবা মায়ের সম্পর্কের অবস্থা দেখে তার বিয়ের প্রতি কেন জানি অনিহা কাজ করে। সম্পর্কগুলোকে জটিল সমীকরণ মনে হয়। হঠাৎ একটা কথা মনে হেতেই সে
আরেকবার কুহুকে দেখে নিলো। আসলে কুহুকে নিয়ে বের হওয়া পরিকল্পনার অংশমাত্র। এর পরিকল্পনাদাতা কেবলই রুপক। আজ রুপকের ছোট্ট একটা অপারেশন হবে। তার পায়ের টিউমার। একথা সবাই জানলেও শুধু কুহু জানে না।
এতক্ষণ ইসরাত আরা বেগম, রুপক, আর তার বাবা হয়তো বেরিয়ে গেছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। কাজ হয়ে গেলে সেও যাবে কুহুকে সঙ্গে নিয়ে। এমন করার কোনো কারন ছিল না। ভাইয়ের অপারেশন অথচ বোন জানবে না ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায়। রিদওয়ানের কাছের ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগছিল। পরে জানতে পারল, বছর তিনেক আগে রুপক আর কুহুর
একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেদিন তারা দুইভাইবোন বাইক করে বাসায় ফিরছিল। সেই এক্সিডেন্টে রক্ত, কাঁটাছেড়ায়
কুহুর মনে ভাইকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরেছিল। সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘদিন সময়ও লেগেছিল। তাছাড়া কুহুর রক্ত ফোবিয়া আছে। রক্ত দেখলে তার হাত পা থরথর করে কাঁপে। মাথা ঘুরে। আপনাআপনি চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনে পড়ে যায় ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহের কথা। সেদিনের কথা ভেবেই রিদওয়ানকেও এই পরিকল্পনায় অংশ নিতে হয়েছে।
মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে কুহুকে নিয়ে বের হয়েছে। তবে বের যখন হয়েছে আরেকটা কাজ সেরে যাবে। যে কাজের জন্য তাকে এতদূর ছুটে আসতে হয়েছে। অভিমান ভুলে বাবার কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন্ট করতে হয়েছে। মনে মনে আরেকটা পরিকল্পনা সাজিয়ে রিকশা থামিয়ে কুহুকে নামতে বলে, সে নিজেও নামল। কুহু বলল, সবজি বাজারে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে। এখানে নামলে হাঁটতে হবে। তখন যেন তাকে দোষ দেওয়া না হয়। রিদওয়ান তার কথা জবাব দিলো না রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরল। তা দেখে কুহুও নামল। দ্রুত হাঁটা ধরল রিদওয়ানের পিছু পিছু। এই লোকটা এমনভাবে হাঁটে তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। রিদওয়ান কুহুকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে আরেকটা রিকশায় উঠে বসল। কুহুকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না শুধু বলল,

-‘যেখানেই যাচ্ছি সেইভ থাকবে। যেভাবে এনেছি। সেভাবে বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দেবো। শুধু ধৈর্য্য ধরে মুখটা বন্ধ করে বসে থাকো। যতক্ষণ না আমি কিছু জিজ্ঞাসা করবে ততক্ষণে নিশ্চুপ, ওকে?’

কুহু ঘাড় নাড়িয়ে ‘ওকে’ বোঝাল। এখন রিকশা চলছে গলি বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে। এটা আবাসিক এলাকা। রাস্তাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এই লোকটা কোথায় যাচ্ছে কে জানে?
তবে সেখানেই যাক রিকশা চড়ে ঘুরতে তার মন্দ লাগছে না।
অনেকদিন এভাবে ঘোরা হয়নি। ইশ! বৃষ্টি হলে দারুন হতো।
কিন্তু হবে না। আকাশ ফকফকে পরিষ্কার। তখন রিকশাটা
একটা গলি পেরিয়ে তিনতলা বিশিষ্ট একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার সদর দরজাটা নক করল।
দারোয়ান তাকে দেখামাত্র দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলো।
সালাম দিলো। কুশল বিনিময় করল। রিদওয়ান সালামের জবাব নিয়ে কুহুকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির দুই ধারে দুটো বাগান। একটা ফলের। আরেকটা ফুলের। কত রকমের ফুল! কুহু চোখ জুড়িয়ে ফুল দেখছে। ভীষণ সুন্দর বাড়ি। বাড়ির আশপাশ। কেউ যে যত্ন করে এসব লাগিয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তারা আরেকটু সামনে এগিয়ে বাসার দরজায় কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই টুটুল এসে দরজা খুলে দিলো। রিদওয়ানকে দেখে সে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে উচ্চশব্দেই উচ্চারণ করল, ‘আরে ভাইজান!
ওহ চাচাজান বড় ভাইজান আইছে। কই আপনে, তাড়াতাড়ি আহেন।’

তাকে চেঁচাতে দেখে রিদওয়ান ভীষণ বিরক্ত হলো। তারপর টুটুলকে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আদেশ করল বাসার মালিককে গিয়ে খবর দিতে। হাতে সময় নেই৷ জরুরি কথা বলে বেরিয়ে যাবে। একথা শুনে টুটুল তার গলায় ঝুলানো গামছায় হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আর কুহু অবাক হয়ে ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে ঝুলানো ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ ছবিটি রিদওয়ানের। রিদওয়ানের বাম পাশে কিছুক্ষণ আগের দেখা সেই পুতুল মেয়েটি। যার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিল রিদওয়ান। দু’জনের মুখের মিল আছে। এটা তখন খেয়াল না করলেও এখন খেয়াল করল সে। এবং বুঝেও গেল এরা ভাইবোন। ছিঃ! ছিঃ! আর সে কী না গফ টফ ভেবে বসেছিল। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার তাকাল, এবং আরেকদফা অবাক হলো রিদওয়ানের সঙ্গে কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারকে এক ফ্রেমে দেখে। উনার সঙ্গেও খুব মিল
পেল। এতদিন এসব খেয়াল না করলেও ছবিতে পাশাপাশি থাকায় সহজে সমীকরণ মিলিয়ে নিলো। তবে রিদওয়ানকে কিছু বলল না। আশেপাশে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমটা পরখ করে
নিলো। সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে ভদ্র হয়ে বসে রইল। একটুপরে প্রিন্সিপাল স্যার এলেন। রিদওয়ানকে দেখে উনার দু’চোখ
খুশিতে ঝলমল করে উঠল৷ উনি টুটুলকে ডেকে দ্রুত নাস্তা পানি আনার আদেশ করলেন। রিদওয়ান তখনো ফোন স্কল করতে ব্যস্ত। দৃষ্টি তুলে তাকায় নি বাবার দিকে। টু শব্দ করে নি। স্যার এবার তাকালেন কুহুর দিকেও। মেয়েটিকে ভালো করে চিনতে পেরেছেন। এবং কুহুকে রিদওয়ানের সঙ্গে দেখে উনি অবাক হলেন না। যেন রিদওয়ানের পাশে কুহু থাকাটাই স্বাভাবিক। উনি কুহুকে কিছু বললেন না নিঃশব্দে হাসলেন।
কুহুও ভদ্রতাসূচক সালাম দিলো। তখন রিদওয়ান বলল,

-‘আগামী সপ্তাহে ফিরে যাচ্ছি আমি। এসেছিলাম আম্মুর পাঠানো ডিভোর্স পেপার আপনার নিকট পৌঁছে দিতে। এই পেপারে সাইন করুন।’

ছেলের কথা শুনে স্যার হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জবাবে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি। কিয়ৎকাল নিশ্চুপ থেকে বললেন,

-‘তোমার সঙ্গে আমিও যাব। তোমার আম্মুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। যেগুলো সামনাসামনি বলা দরকার।”

-‘এতদিন মনে হয় নি কথা বলা দরকার? মনে হয় নি এই সম্পর্কটাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করার দরকার? মনে হয় নি, ছেলেমেয়ের কথা ভেবে ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার। তবে আজ কেন? আমি এতকিছু জানি না, আম্মুর আদেশ সাইন করিয়ে তারপর এখন থেকে যেতে। উনি এসব থেকে মুক্তি চান। আর ডিভোর্সটা হওয়া খুব দরকার কারণ ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে আম্মু সেকেন্ড বিয়ে দিব। একটা ভুল সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর প্রশ্নই আসে না।’

রিদওয়ানের কথা শুনে কুহু বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। এরা বাবা ছেলের তর্ক যুদ্ধ করছে! একজনের যুক্তিতে আরেক জন পাল্টা যুক্তি ছুঁড়ছে। তাদের সামনে পড়ে আছে ডিভোর্স পেপার। এদের বাবা ছেলের মাঝে সে নীরব দর্শক। কিছু বলা তো দূর এদের কথা শুনে নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে সে। সে অনড় হয়ে বসে থেকে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিদওয়ানকে নিষ্ঠুর বলে জানত সে। কিন্তু সে এতটা
নিষ্ঠুর কল্পনা করে নি। এদের কথা শুনে কুহু মনে মনে বলল,

-‘এই আবার কেমন জাতের ছেলে, বাবা মায়ের ডিভোর্স করাতে উঠে পড়ে লেগেছে?

To be continue…………….!!