আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-৩১+৩২

0
9

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_একত্রিশ


ঘড়িতে তখন সাড়ে আট টা। নিলুফা ইয়াসমিনের রান্না প্রায় শেষ। তিনি
নীরবে কাঁদছে আর দ্রুত হাতে অন্যান্য কাজগুলো সারছেন। মেয়েটা না খেয়ে চলে গেল। ছেলেটাও বারণ শুনল না অসুস্থ একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলো। একজন নারীর জীবনে স্বামীর সন্তান ছাড়া আর কি আছে! এদের নিয়েই একজন নারী বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। স্বামীর
অনুপস্থিততেও ছেলে মেয়েকে নিজ হাতে আগলে রেখেছেন। কষ্ট করে হলেও তাদের যাবতীয় চাহিদা, ইচ্ছে ও স্বপ্ন পূরণের সর্বদা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অথচ সেই ছেলেই গতকাল উনাকে আদেশ অবজ্ঞা করেছে।
মুখের উপরে এটাও বলেছে, ‘বিয়ে করতে হলে ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করবে। তাকে যেন বাঁধা দেওয়া না হয় আর বাঁধা দিলেও শুনবে না সে।’
এরপর আর কোনো কথা থাকে না। বলা মতো রুচিও থাকে না। জীবনে বন্ধুরা হচ্ছে অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই বলে বন্ধুর অসুস্থ বোনকে বিয়ে করে বন্ধুতালি করতে হবে?

রিদওয়ান ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে রান্নাঘরে দরজার কাছে এলো। নীরবে দাঁড়িয়ে মায়ের কান্নারত মুখে থেকে কিছুক্ষণ চুপ তাকিয়ে রইল।নিলুফা
ইয়াসমিন তার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও ঘুরে তাকাল না। কথাও বললেন না। যে মায়ের মন বোঝে না তার মত ছেলের প্রয়োজন নেই। উনি উনার অশ্রু লুকানো প্রয়াস চালালেন কিন্তু পারলেন না। রাগে দুঃখে অশ্রুগুলো বেহায়া হয়ে ঝরে পড়ছে। রিদওয়ান মায়ের অভিমান বুঝে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর সুন্দর করে ডাকল,

-‘আম্মু।’

নিলুফা ইয়াসমিন নিরুত্তর। ঘুরেও তাকালেন না। শুধু আঁচলে চোখ মুছে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াতে মনোযোগী হলেন। রিদওয়ান এবার পেছনে থেকে তার মাকে সন্মানের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘কাঁদছো কেন? আমি কি মারা গেছি?’

-‘রিদ যাও এখান থেকে। কাজ করতে দাও আমাকে।’

-‘কাজ তো করবে তার আগে আমার কয়েকটা কথা শোনো।’

-‘না। তুমি যা বলার কিংবা করার করেছো। আমি তো কিছু বলি নি তাই তোমারও উচিত হবে এখন আমাকে আমার মতো থাকতে দেওয়া। ‘

-‘আম্মু, তোমরা সবাই যদি এমন অভিমান করো তাহলে আমি কোথায় যাব? আমার কথাও ভাবো, প্লিজ। বাবা মুখ ভার করে আছে। তুমি রাত থেকে কাঁদছো। ওইদিকে ইসমত আন্টি কাঁদছে, রুপক কাঁদছে। তোমরা সবাই শুধু কাঁদছো। অভিমান করছো। একটাবার আমার কথাও ভাবো।
তোমাদের কান্না সহ্য করতে পারছি না আমি।’

-‘সহ্য করতে কে বলেছে, চলে যাও। বিয়ে করেছো, ভালো ইনকামও করো। বাঁধা কিসের?’

-‘আম্মু প্লিজ! এভাবে কেন কথা বলেছো? আমি সেটা বলেছি?’

-‘ বলতে হবে কেন? ঘাসে মুখ দিয়ে তো আর চলি না। এইটুকু বোঝার মতো জ্ঞান আমার আছে।’

-‘কুহু খুব ভালো মেয়ে। ওকে একটু ভালোবেসে দেখো দেখবে তোমার মনের মতো হয়ে উঠেছে।’

-‘ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? সে অসুস্থ। আজকের কথা দুদিন পরে ভুলে যাবে। সারাজীবন একটা অসুস্থ মেয়ের ভার বহন করতে হবে তোমাকে।’

-‘আমি তো ভয় পাচ্ছি না। তাহলে তোমরা কেন ভয় পাচ্ছো?’

-‘কেন পাবো না? বলো, কেন পাবো না? আমার ছেলেটাকে সুখে দেখতে চাওয়া কি আমার অপরাধ? মা হয়ে তার ভালো মন্দ চিন্তা করতে পারব না? এইটুকু অধিকারও কি আমার নেই?’

-‘আছে, অবশ্য আছে। আর তোমার ছেলে তোমারই আছে। তাছাড়া ওর চিকিৎসা চলছে। আল্লাহ চাইলে কতকিছুই তো ঘটে, তাই না? আমি তো নেগেটিভ কিছু ভাবছি না। কেন ভাববো? আমার আল্লাহ উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। নিজের উপর আস্থা আছে। চেষ্টার কোনো ত্রুুটি’ই রাখব না আমি। এরপরেও যদি কুহু আর সুস্থ না হয় তাহলে মেনে নেবো সৃষ্টিকর্তার এমনই ইচ্ছে। আমার তকদিরে এমন কিছু ছিল। ‘

-‘নিজের খামখেয়ালিপণার দায়ভার তকদিরের উপর দিলে দিয়ে হয় না।’

-‘ সৃষ্টিকর্তার আদেশ ছাড়া গাছে পাতাও নড়ে না। সেখানে বিয়েটা হচ্ছে তকদিরের লেখা। এই নিয়ে আমার মনে আফসোসের ছিঁটেফোঁটা নেই।
আমি স্বজ্ঞানে ওকে মেনে নিয়েছে। ওয়াদা করেছি বাকিটা পথ ওর হাত ধরেই পাড় করব।’

-‘(…)’

-‘আম্মু কুহুর জায়গায় রিমিকে বসাও। একবার ভাবো তোমার মেয়েটা যদি কুহুর জায়গায় থাকতো তুমি কি পারতে ফেলে দিতে? নাকি পারতে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে? কোনোটাই পারতে না। তেমনি রুপক কিংবা ইসমত আরা আন্টিও পারছে না। এমনকি তারা কিন্তু আমাকে বারবার বারণ করেছে। বিয়ের আগ মুহূর্তেও সুযোগ দিয়েছে ভেবে দেখতে বরং আমিই শুনি নি। আমার মনের কথাকেই প্রাধান্য দিয়েছি। এখানে তারা নির্দোষ।’

-‘তারা নির্দোষ হলে কে দোষী, তুমি?’

-‘ঠিক। আমিই দোষী কারণ আমি তাকে ভালোবেসেছি। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি বলেই ছেড়ে রাখতে/ ছেড়ে দিতে পারি নি।’

-‘(……..)’

-‘আম্মু? একটাবার সুযোগ দাও। ওকে একটু কাছে টেনে নাও। তুমি রাগ করে থাকলে তার মন দূর্বল হয়ে যাবে। আমার থেকে দূরে সরার অপ্রাণ চেষ্টা করবে। এতে ওর চিকিৎসাও ফুলফিল হবে না। প্লিজ আম্মু, একটু ইজি হও। অন্তত আমার কথা ভেবে ওর সঙ্গে সহজ হও।’

-‘আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি যাকে তাকে অপছন্দের লিস্টে রাখি না। আর যাকে অপছন্দ করি তাকে পছন্দের ধারে কাছেও আসতে দেই না।’

-‘কুহুর সমস্যা তার অসুস্থতা তাই তো? এছাড়া তাকে অপছন্দের আর কোনো কারণ দেখাতে পারবে? যদি পারো তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নেবো।’

-‘ যাও এখান থেকে।’

-‘ যাচ্ছি। আর হ্যাঁ,জেনে বুঝে দায়িত্ব যখন নিয়েছি এড়িয়ে যেতে পারব না। পারার প্রশ্নই আসে না। এ নিয়ে কোনো কথাও বলব না তোমাকে। আমারই ব্যর্থতা তোমাকে সঠিকটা বোঝাতে পারলাম ন।। শুধু লাস্ট একটাই অনুরোধ ওর সঙ্গে মিসবিহেভ করিও না, প্লিজ।’

একথা বলে রিদওয়ান প্রস্থান করল। বাসা থেকে বেরিয়ে নেইবার হুডের রাস্তা পেরিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তা টা ফাঁকা। মাঝে মাঝেই দু’একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রিদওয়ান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছে। এই যন্ত্রণায় শেষ কোথায় সেও জানে না।
শুধু জানে, থামলে চলছে না। এটা তার নিজের লড়াই। ভালো থাকার লড়াই। ভালোবাসাকে জয়ী করার লড়াই। এসব ভেবেই সে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। তখন এক যুবক হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-‘আর ইউ ওকে ব্রাদার?’

-‘ইয়াহ্, আ’ম ফাইন।’

-‘সিওর?’

-‘ইয়াহ্।’

-‘ওকে।’

একথা শুনে ছেলেটা হাসিমুখে বিদায় নিলো। রিদওয়ানও বাসার দিকে পা বাড়াল। একটুপরেই ডেইজি আসবে। শুরু হবে তার আরেকটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা হবে তার সহধর্মিণীকে সুস্থ করার যুদ্ধ। এখানে ঢাল তলোয়ার নেই,আছে শুধু মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা। সে জানে না এই যুদ্ধে জয়ী হবে না কী না। তবে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে।

কুহু ফ্রেশ হয়ে পরিপাটি সাজে নিচে নেমেছে। সে খেয়াল করেছে, তার শাশুড়ী মা ভীষণ স্মার্ট। রিমির থেকেও শুনেছে উনি এলোমেলো থাকা কিংবা কিছু অগোছালো কিছু পছন্দ করেন না। অথচ সে আগে বাসায় থাকত কাজের মেয়ের বেশে। হুট করে কেউ এসে তাকে কাজের মেয়ে ভাবার রেকর্ডও আছে।এতেই যেন শান্তি। কিন্তু এখন সেসব চলবে না। স্মার্ট শাশুড়ীর মন জয় করতে তাকেও স্মার্ট হতে হবে। সে আশেপাশে কাউকে না দেখে ভয়ে ভয়ে রিদওয়ানের আম্মুর কাছে গেল। মুখটা বেশ থমথমে। তারমানে পরিস্থিতি গরম। এ গরম পরিস্থিতিতে বিড়াল সেজে থাকায় উত্তম। ইসমত আরার রেগে গেলে সে তাই করত। শুধু সে না তার বাবা, ভাইও তাই করত। নয়তো তার মা একে একে সবার গুষ্টি উদ্ধারের কাজে লেগে পড়ত। সে পেছন থেকেই উঁকি মেরে দেখল রান্না করা শেষ, এখন বেড়ে টেবিলে দিতে হবে। উনি সেসব’ই করছিলেন। কুহু বার বার ঢোক গিলছে। কিছু বলতে চায় কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না।তারপর নিশ্চুপ থেকে ভয়কে জয়কে করে একপর্যায়ে সে মিনমিন করে বলল,

-‘আম্মু! আমাকে দিন আমি খাবারগুলো টেবিলে রেখে আসছি।’

-‘রান্না করতে যখন পেরেছি রাখতেও পারব।’

-‘তাহলে আমি ঝটপট কফি/চা বানিয়ে ফেলি?’

-‘না।’

-‘বাবা কি উঠেছেন? নাস্তা করতে আমি ডেকে আনি?’

উনি এ কথার জবাব দিলেন না। কুহুও আর কোনো কথা খুঁজে পেল না।
সে গিয়ে শশুরকে ডেকে রুপক রিমিকেও ডাকতে গেল। রিমি কলেজে চলে গেছে। রুপক এলো। তিনজন পুরুষই চেয়ার টেনে বসেছে। তখন রিদওয়ান চেঁচিয়ে বলল অফিসে যাবে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে। এ কথা শুনে উনি টেবিলে খাবার সাজিয়ে চুলাতে কফির পানি বসালেন। তখন কুহু তোতলাতে তোতলাতে বলল,

-‘আম্মু, আ আম আমি সরি।’

-‘কেন?’

-‘উঠতে লেট করে ফেলেছি। এমন আর হবে না।’

-‘যাক বোধশক্তিটুকু সচল আছে।’

গুরুগম্ভীর কন্ঠে একথা শুনে কুহু কি করবে বুঝতে পারল না। দিশেহারা বোধ করল। অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখন কি বলবে বোধগম্য হলো না। একথার প্রেক্ষিতে কি বা বলা যায়?সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। উনি যে কথা বলতে আগ্রহী নন সে তাও বুঝল। একটা মানুষ যদি কথা বলতেই না চায় তাহলে রাগ ভাঙাবে কিভাবে? নিজের মা হলে এতক্ষণে সেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে ফেলত। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিতো।
ধরাম করে স্বজোরে রুমের দরজা আঁটকে চুপ করে বসে থাকত। তখন একটুপরে তার মা’ই এসে উল্টে তার রাগ ভাঙাতো। নিজ হাতে খাইয়েও দিতো। মায়ের কথা মনে পড়াতে সে কেঁদে ফেলল। কান্নার চাপাতে গিয়ে ফোঁপাতে লাগল। এভাতে ফোঁপানোর শব্দ শুনে নিলুফা ইয়াসমিন ঘুরে তাকালেন। চোখে মুখে বিষ্ময়ভাব কাটিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।
এদিকে চেয়ারে বসা তিনজন পুরুষের দৃষ্টিও এদিকে নিবদ্ধ। রিদওয়ান কুহুকে কাঁদতে দেখে উঠতে গেলে রুপক তার হাত ধরে ফেলল। এরপর ঝকঝকে কাঁচের পানিভর্তি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ওদেরটা এবার ওদেরকেই বুঝে নিতে দে। ওদের মধ্যে তোর আমার না যাওয়াটাই ভালো।

To be continue……..!!

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_বত্রিশ


-‘ওদেরটা এবার ওদেরকেই বুঝে নিতে দে। ওদের মধ্যে তোর আমার না যাওয়াটাই ভালো।’

রুপকের কথা শুনে রিদওয়ানের বাবারও সহমত পোষন করলেন। তিনি
এটাও বললেন মেয়েলি সব ব্যাপারে ঢুকতে নেই। কিছু কিছু জিনিস না দেখার ভাণ করতে চলতে হয়। এতে সংসারে শান্তি বজায় থাকে। বাবার কথায় রিদওয়ান একমত হতে পারল না। তবুও কথা বাড়াল না। শুধু সে
জানাল খেতে দিতে অফিসে জরুরি মিটিং আছে। তাকে বের হতে হবে।
ছেলের কথা শুনে নিলুফা ইয়াসমিন এসে খেতে দিলো। কুহুও পিছু পিছু এসে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। তা দেখে নিলুফা ইয়াসমিন একপল দেখে রুমে চলে গেলেন। উনাকেও বের হতে হবে। শপে যাবেন। আজকে ভীড় হবে বেশি। উনাকে যেতে দেখে আতিকুর রহমান বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কুহুকে বললেন,

-‘মায়েরা বকলে মন খারাপ করতে নেই। তুমিও বসো খেয়ে নাও।’

-‘পরে খাব।’

-‘কেন?’

-‘এমনিই।’

-‘ঠিক আছে।’

-‘স্যার, একটা কথা বলি?’

-‘স্যার না বাবা বলো।’

-‘বলছিলাম যে, বাবা আমার একটা হেল্প লাগবে।’

-‘হেল্প? কেমন হেল্প?’

-‘আপনাদের সঙ্গে আমিও দেেশে ফিরে যেতে চাই।’

কুহুর কথা শুনে রুপক রিদওয়ান খাওয়া থামিয়ে দু’ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এ আবার কেমন কথা? আজ থেকে তার ফুল ট্রিটমেন্ট শুরু আর বলে কি না দেশে যাবে। তাদেরকে এভাবে তাকাতে দেখেও কুহু পাত্তা না দিয়ে চেয়ার টেনে বসল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,

-‘ আপনি বলেছেন এই সপ্তাহে চলে যাবে। এদিকে আম্মু আমার উপরে খুব রেগে আছে। রাগ না ভাঙালে এই রাগ দূরত্ব সৃষ্টি করবে। আমি এমন কিছু চাই না। এজন্য বলছি আমিও আপনাদের সঙ্গে দেশে ফিরতে চাই।
চিকিৎসা না পরে করাব।’

-‘কথাটা কিন্তু মন্দ বলো নি। ওর পিছু ঘুরলে দেখলে কয়েকবার বকবে ঠিকই কিন্তু বকার আড়ালে ভালোবাসবে। কিন্তু মা তোমার ট্রিটমেন্ট যে পরে করানো যাবে না। জ্বর থাকতেই সবাই জ্বরের মেডিসিন খাই তাই না?’

-‘দেশে গিয়ে চিকিৎসা করব নাহয়৷’

-‘আরেকটা কাজ করানো যায়। ‘

-‘কি কাজ?’

-‘তোমার আম্মুর পাসপোর্ট রিনিউ করার বাহানা দেখিয়ে আরো কিছুদিন থাকুক। সেই ব্যবস্থা নাহয় আমিই করে দেবো কিন্তু কথা হচ্ছে আমি যে আর থাকতে পারব না মা। আমার ছুটি শেষ।’

-‘ঠিক আছে বাবা, তাহলে তাই করুন।’

-‘হুম।’

-‘টিকিট কনফার্ম করা হয়ে গেছে?’

-‘ না আজ করব।’

-‘আচ্ছা।’

এরপর সে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করল। কিছু যে বলতে চাচ্ছে সেটা বুঝে রিদওয়ান একপল তাকিয়ে বলল,

-‘কিছু বলবে?’

-‘আমিও যাই?’

-‘কোথায়?’

-‘শপে।’

-‘শপিং করতে?’

-‘না। আম্মুর সঙ্গে।’

-‘আম্মুর ফিরতে রাত হবে। আমি অফিস থেকে ফিরে তখন নাহয় নিয়ে যাব তোমাকে।’

-‘আপনি কখন ফিরবেন?’

-‘সন্ধ্যা নাগাদ।’

-‘রিমিও বাসায় নেই, আপনিও অফিসে যাচ্ছেন, মা যাচ্ছে শপে, বাবাও যাবে কোন ফ্রেন্ডের বাসায়, ভাইয়াও এখন ঘুমাবে, আমি একা একা কি করব? এরচেয়ে শপে গেলে সময়টাও কেটে যেতো।’

-‘আজ অনেক ভিড় হবে। গিয়ে তুমি গিয়ে নিজেও বোর হবে।’

-‘হব না, আমি বসে বসে মানুষ দেখব।’

-‘ঠিক আছে যাও।’

-‘থ্যাংক ইউ।’

কথা শেষ করে কুহু তাদের খেতে বলে চলে গেল শাশুড়ির রুমের দিকে।
যার শপ তার থেকেও তো পারমিশন নিতে হবে। সে যদি এলাও না করে তখন? সে দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখল নিলুফা ইয়াসমিন এ্যাশ কালার শাড়ি পরেছেন। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে। ড্রেস সেন্সের প্রশংসা না করলেই নয়। উনি উবু হয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা করছেন। একা একা কাজের কাজ হচ্ছে না দেখে সে’ই ধীর গতিতে রুমে প্রবেশ করল। তারপর নিলুফা ইয়াসমিনের পায়ের কাছে বসে হাসি মুখে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিলো। এহেন কাজে নিলুফা ইয়াসমিন ভ্রু কুঁচকে তাকালেও
কিছু বললেন না চুপ করে নিজের কাজে মন দিলেন। তখন কুহু বলল,

-‘আম্মু আমিও যাব।’

-‘কোথায়? ‘

-‘শপে। আপনার সঙ্গে।’

-‘না।’

-‘বাসায় একা থাকতে ভালো লাগে না আমার। ভয় লাগে, এজন্য….. ।’

-‘তো, আমি কি করতে পারি? আমি কি বেড়াতে যাচ্ছি যে সঙ্গে নিয়ে যাব?’

-‘আমি চুপটি করে বসে থাকব, প্রমিস।’

-‘ খবরদার বলছি আমাকে বেশি বকাবে না। তোমার মতো শুয়ে বসে থেকে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। না যখন বলেছি তখন, না।’

একথা বলে উনি পার্স নিয়ে চলে গেলেন। কুহুর এবার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল। মনে পড়ল তার মায়ের কথা। তার মা তো এমন করে না।
সে কোনো কিছু নিয়ে জেদ করলেও এভাবে বলে না। অনেকের মুখে সে শুনেছে, শাশুড়ি নাকি মা হয় না। কেন জানি তখন তার বিশ্বাস হতো না। মনে হতো শাশুড়িদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা জানতে হয়।ভালোবাসা
আদায় করে নিতে হয়। এখন মনে হচ্ছে শাশুড়ির মন জয় করা এতটাও সহজ নয়। এসব ভেবে সে চোখ মুছে বের হতেই দেখে একটুদূরে রুপক দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো তাদের কথোপকথন শুনেছে। ভাইকে মনের ব্যথা বুঝতে না দেওয়ার প্রয়াস চালালো সে। এজন্য চট করে মুখে টানল এক অনিন্দ্য হাসির রেখা। তারপর এগিয়ে গেল।জিজ্ঞাসা করল কিছু লাগবে
কি না। তখন রুপক বোনের মুখের দিকে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,

-‘আমি ঘুমাব না। রিদওয়ান চলে গেলে তুই আর আমি ঘুরতে বের হব। তারপর আমরা দুই ভাই বোন মিলে দুপুরে রান্না করব। সময় এমনিতেই কেটে যাবে। এখন রুমে যা গিয়ে দেখ রিদওয়ানের কিছু লাগবে নাকি।’

-‘সমস্যা নেই তুমি ঘুমাও।’

-‘ঘুম আসছে না। আর শোন, আম্মুর সঙ্গে কথা বলেছিস?’

-‘না। একটু পরে বলব।’

-‘মেডিসিন খেয়েছিস?’

-‘একটুপরে খাব।’

-‘মার খেতে না চাইলে নাস্তা করে মেডিসিন খা।’

ভাইয়ের কথা শুনে কুহু ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়ে চলে গেল। রুপক তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রুমে ঢুকে গেল। মাকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে চুপ করে বেলকনিতে বসে থাকল। সকাল থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। বিশেষ করে সকালে নিলুফা ইয়াসমিনের কথাগুলো শোনার পর থেকে। এ কঠিন পরিস্থিতি কিভাবে সামলে উঠবে সেও ঠিক বুঝতে পারছে না। পারিবারিক সমস্যার কারণে কুহুর অসুস্থতা আবার বেড়ে না যায়! এই ব্যাপারে রিদওয়ানকেও কিছু বলা ঠিক হবে না। কারণে তার হাতেও কিছু নেই। মেয়েটা কত আনন্দ নিয়ে শপে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সঙ্গ পেলো না। বোন পাগল ছাগল যাই হোক কেউ তাকে অবজ্ঞা করলে তার ভীষণ কষ্ট হয়।মনে হয় সেই মানুষকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিতে।
তার বোন ভুলে যায় কিন্তু একেবারে পাগল তো নয়। তাহলে তাকে কেন অবজ্ঞা করবে? কেন খোঁচা মারা কথা বলবে? নিলুফা ইয়াসমিন তখনো বোনকে অযথা কথা শুনাল। আবার এখনো তাই। সে আহামরি কোনো আবদার করেছে? নাকি কোনো অপরাধ করেছে? এর কোনোটাই তো না। শুধু সঙ্গ চেয়েছে। শাশুড়ির সঙ্গে এই দূরত্ব কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
মেয়েটা নিজেই অসুস্থ। তাও যে সে এইটুকু করছে এটাই কি বেশি নয়?
সত্যি বলতে,সকাল থেকে বোনের নীরব কান্না তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। কষ্টে বুক ভার হয়ে আসছে। আজ শুধু নিলুফা ইয়াসমিনের জায়গায় অন্য হলে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। তার বোনকে অযথা কথা শোনানোর দায়ে চরম শাস্তি দিতো। শুধু বন্ধুর মা বলে সে নিজেকে বার বার সামলে নিচ্ছে। সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে।

এইদিকে কুহু রুমে গিয়ে দেখে রিদওয়ান রেডি হয়ে বসে আছে। আকাশ নীল রঙা শার্টে চমৎকার দেখাচ্ছে। তাকে দেখে রিদওয়ান উঠে দাঁড়াল। কয়েকপল তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে বলল,

-‘রেডি হও।’

-‘কেন?’

-‘ বাইরে যাব তাই।’

-‘অন্যদিন যাব।’

-‘উহুম এখনই যাবে। দ্রুত রেডি হও, আমার লেট হচ্ছে। ‘

-‘আপনার লেট হচ্ছে আমি যান।’

-‘আমি তো যাবোই সঙ্গে তুমিও যাবে।’

-‘ আজ শরীর টা ঠিক ভালো লাগছে না। প্লিজ জোর করিয়েন না।’

-‘করব। পারলে আঁটকাও।’

-‘বললাম তো ভালো লাগছে না আমার।’

রিদওয়ান আর কথা বাড়াল না সে নিজেই কুহুর ড্রেস বের করে হাতে ধরিয়ে দিলে। তারপর ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে গেল খাবার আনতে। কুহু বের হতেই কুহুর মুখে খাবার তুলে দিলে বলল, ‘খেতে খেতে চুল টুল ঠিক করে নাও।’

-‘তা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন শুনি?’

-‘প্রেম করতে।’

-‘এটাও বিশ্বাস করতে হবে?’

-‘না করার কারণ আছে নাকি?’

-‘অবশ্যই আছে।’

-‘বলো শুনি কি কারণ?’

-‘আপনি কাঠখোট্টা মানুষ। আর কাঠখোট্টা মানুষরা প্রেম করতে জানে না।’

-‘সময় বলে দেবে।’

-‘সময় অপেক্ষা করতে হবে না। আমিই এখন বলে দিচ্ছি। ‘

-‘ধন্য করেছেন। এবার মেডিসিন গুলো খেয়ে নিন।’

-‘আপনি তো সেদিন বললেন আপনার সবকিছু আমার। আর আমার সবকিছু আপনার। আমাদের মধ্যে ‘আমার’ বলে শব্দটা থাকবে না।’

-‘এখনো তাই বলছি।’

-‘তাহলে আমার মেডিসিন গুলো আপনিই খান। রুলস অনুযায়ী আমার জিনিস আপনার। যুক্তি অনুযায়ী আমার মেডিসিনও আপনার তাই না?’

একথা শুনে রিদওয়ান ভ্রুজোড়া কুঁচকে তাকাতেই কুহু খিলখিল করে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে ঝলমলিয়ে গেল পুরো রুম। সঙ্গে সামনে
দাঁড়ানো পুরুষটির মনেও ঢেউ খেললো খুশির ঝুম। তারপর তারা রেডি হয়ে একসঙ্গেই বের হতে হলো। রুপক তখনো বেলকনিতেই বসে ছিল।
হঠাৎ ভাইয়া বলে কুহুর ডাক শুনে তার নজর গেল নিচের দিকে। দেখে
রিদওয়ানের গাড়ি বের হচ্ছে। কুহু’ও জানালা দিয়ে হাত বের করে তাকে টাটা দিচ্ছে। বোনের মুখে হাসি। হাসছে তার চোখও। তাদের একসাথে দেখে সেও হাত নাড়িয়ে টাটা দিলো। সাবধানে যেতে বলল। রিদওয়ান তখন মেসেজ করে জানিয়ে দিলো ডেইজির সঙ্গে দেখা করে একেবারে সন্ধ্যায় ফিরবে। টেনশন যেন না করে৷ ততক্ষণে রিদওয়ানের গাড়ি তার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেছে। সে বেলকনিতে থেকে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। তার চোখের কোণা বেয়ে কয়েকফোঁটা জল। কেন কাঁদছে সেও জানে না। শুধু জানে ভীষণ খুশিও হয়েছে সে। খুশির কারণ হতে পারে
বোনের মুখে হাসি। এজন্য রিদওয়ানকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু সে জানে, ধন্যবাদ দিতে গেলেই রিদওয়ানের ঘুষি জুটবে ঠিক নাক বরাবর।
এরচেয়ে মনে মনে তাদের জন্য দোয়া করা উত্তম। তাছাড়া সে মনেপ্রাণে
বিশ্বাস করে গাছের মতো সম্পর্কের যত্ন নিতে হয়। ভালোবেসে আগলে রাখতে হয়। বন্ধন দ্বারা গোড়া মজবুত করতে হয়। তাহলে ফলও সুমিষ্ঠ হয়। আর এই ব্যাপারে রিদওয়ান সর্বেসবা।

শাঁ শাঁ করে গাড়ি চলছে ঝকঝকে এক রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। গাছের নাম জানে না সে। দেশে এমন ধরনের গাছ দেখেও নি।
আজকে আকাশটা স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় ঝকঝক করছে। রোদের তীব্রতাও সহনশীল।গাড়ির জানালা খোলা বিধায় তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে বৈরী বাতাস। পাগলাটে বাতায়নে উড়ছে তার ওড়না। সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ, মুখে উপচে পড়ছে খুশি।
রিদওয়ান ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাকেই দেখছিল। কিছুক্ষণ
আগে কুহুর মলিন মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। আর তার মুখ দেখে বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছিল। সেই ব্যথা তাকে সজাগ করে দিলো, এই মলিন মুখের মালকিনকে রেখে অফিসে গেলে কাজ করতে পারবে না একদন্তও। শান্তও হবে না বক্ষপাশ। এরচেয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া উত্তম। যেই ভাবা সেই কাজ। তার মা সঙ্গ না দিক সে তো আছে।
তাই সে কুহুকে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে মিটিং সেরে তারপর যাবে ডেইজির কাছে। এরপরের প্ল্যান নাহয় এর পরেই জানা যাবে।

আজ শপে প্রচুর ভিড়। নিলুফা ইয়াসমিন নিজেও ভীষণ ব্যস্ত। স্টার্ফরাও তাই। ঘন্টা দু’য়েক পর ভিড় কিছুটা কমতেই নিলুফা ইয়াসমিন আতিকুর রহমানকে ফোন দিলেন। টুকটাক কাজের কথা বলার পর দ্বিধান্বিত সুরে বললেন,

-‘আজ শপে আসবে না?’

-‘আজ আর যাচ্ছি না। কেন কিছু লাগবে, ফেলে গেছো কিছু?’

-‘না তেমন কিছু না। যদি আসো তাহলে তোমার পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে
এসো। এটা শুধু আমার শপ না ওর স্বামীরও শপ। আসতে যখন চাইল এসে ঘুরে যাক নাহয়।’

-‘মেয়েটা তোমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল নিলু। আমার সঙ্গে না।’

-‘ আমার সঙ্গেই আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’

নিলুফা ইয়াসমিনের কথা শুনে আতিকুল রহমান মুচকি হাসলেন। সেই আগের মতোই রয়েছে উনার অভিমানী সহধর্মিণী। সকালে মেয়েটা কত করে যেতে চাইল নিয়ে গেল না। অথচ এখন ছলেবলে ঠিক নিয়ে আসার কথা বলল। রাগ দেখাবে ঠিকই আবার রাগের আড়ালে ভালোবাসার বীজও বুনবে। তাই উনিও জানালেন রিদওয়ান কুহুকে অফিসে নিয়ে গেছে। অফিস থেকে তারা ডাক্তারের কাছে যাবে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে। আজ আর যাওয়া হবে না অন্যদিন নাহয় যাবে। একথা শুনে খট করে কল কেটে গেল। আতিকুল রহমান এতবার কল করলেন নিলুফা ইয়াসমিন আর রিসিভই করলেন না।

To be continue……..!!