#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৬
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আরিশ বাইরে থেকে বাড়ি ফেরে, ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি নিয়ে রুমে এসে দেখে মেঘ পড়ছে। আজ দুপুর থেকেই একটানা পড়ছে মেঘ, মাঝে এক বিশ্রাম নিয়েছিলো। এতদিনে প্রথমবার মেঘকে এতো গুরুতরভাবে পড়তে দেখলো আরিশ। রুমের মধ্যে কিছুক্ষন পায়চারি করে কফি শেষ করলো আরিশ, এরপর মেঘের কাছে এসে ওর টেবিলে ভর করে উবু হয়ে দেখে নিলো কোন টপিক পড়ছে…
‘এতো সিরিয়াস হয়ে কি পড়ছো?’
‘ কিছু পড়া বাকি ছিলো তাই রিভাইস করছি, রুমের মধ্যে তখন থেকে পায়চারি করছো যে? কিছু লাগবে নাকি?’
‘ আমার কিছু লাগলে নিজেই নিয়ে নেবো, তোমাকে বলতে যাবো না’
‘ তাহলে তো আমার জন্যেই ভালো’
আরিশ লক্ষ্য করলো মেঘের আজ অন্য কোনো দিকেই খেয়াল নেই, পড়া নিয়ে ভীষন ব্যস্ত, অবশ্য ব্যস্ত হবারই কথা, আগামীকাল পরীক্ষা। আরিশও সময় নষ্ট না করে পড়তে বসার কথা ভাবছে। মেঘ টেবিলে বসে পড়ছিলো, আরিশের আবার এই টেবিল ছাড়া পড়ায় মন বসেনা।
‘ মেঘনা, আমি পড়তে বসবো ‘
‘ বসো, আমি মানা করছি নাকি?’
‘ তুমি আমার টেবিলে বসে পড়ছো ‘
‘ ওহ হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম। এটা তো তোমার টেবিল!’
মেঘ আজ কোনো তর্ক না করেই বই – নোটখাতা নিয়ে বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়লো, আরিশ কিছুটা অবাক হলো বটে! দুজনেই নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়তে শুরু করলো, প্রায় ঘণ্টাখানেক পড়ার পর রেহানা বেগম দুজনকেই রাতের খাবারের জন্যে ডাকলেন। শাশুড়ির ডাক শুনে মেঘ বইখাতা সরিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো।
‘ তুমি যাও, আমি একটু পর আসছি। পিঠটা একদম ব্যথা হয়ে গেছে’
‘ আজকে ক্লাস ব্রেকে কোথায় গেছিলে তুমি? তোমার বান্ধবীকে দেখলাম ক্যান্টিনে একা বসে ছিলো ‘
‘আমি ক্যাম্পাসেই ছিলাম। আসলে আজকে নিহানের কাছে এক্সট্রা সময় ছিলো তাই আমাকে স্টাডির ব্যাপারে হেল্প করছিলো’
‘ ওহ! আচ্ছা মেঘনা, তোমার মনে হয় না নিহান আজকাল তোমাকে একটু বেশীই হেল্প করছে? আগে তোমাকে শুধু নোটস দিতো, এখন আবার নিজেই…’
‘ ক্লাসমেট হিসেবে সাহায্য করতেই পারে, এতো অবাক হওয়ার কি আছে? নিহান অনেক হেল্পফুল একটা পারসন, জানো?আমাকে কঠিন বিষয়গুলো কয়েকবার এক্সপ্লেইন না করলে বুঝতে পারিনা আর নিহান একটুও বিরক্ত না হয়ে আমাকে বারবার বুঝিয়েছে। হি ইজ ভেরি কাইন্ড’
মেঘের মুখে নিহানের এতো প্রশংসা শুনে বিরক্ত হলো আরিশ…
‘ তুমি ওর ফ্যানগার্ল নাকি?’
‘ মানে ! ‘
‘ ফ্যানগার্লরা যেভাবে তার প্রিয় আইডলদের প্রশংসা করে তুমিও তাই করছো! শোনো, ওসব হেল্প টেপ কিছুনা। এতোই যদি হেল্পফুল হওয়ার শখ, তাহলে অন্য কেউ সাহায্য চাইলে পাত্তা কেনো দেয় না?’
আরিশের দিকে মুখ করে শুয়ে মেঘ বললো..
‘ তা তো তুমিও দাওনা! তুমি নিজের হাতে গোনা কিছু বন্ধু ছাড়া কারো সঙ্গে সেভাবে কথা বলো না, নিহান অন্তত সবার সঙ্গে কথা তো বলে’
‘ আমি আর ও এক হলো? তুমি আমাকে ওর সঙ্গে কম্পেয়ার করছো? আই কান্ট বিলিভ দিস!’
‘ কম্পেয়ার কোথায় করলাম? যা সত্যি তাই বলেছি। তুমি টপার বলে সবার সঙ্গে ভাব দেখিয়ে চলো, এরকম ছেলেমানুষ আমার পছন্দ নয়’
‘ ওহ রিয়েলি? তো তোমার কেমন ছেলেমানুষ পছন্দ শুনি?’
‘কেনো বলবো? পরে দেখা যাবে তুমি আমার পছন্দের ছেলের মতো হয়ে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করবে’
‘ হোয়াট রাবিশ! আমি তোমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করবো? আজকাল এসব ডে ড্রিমিং করছো নাকি?’
‘ তোমাকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখতে আমার বয়েই গেছে!’
কথাটা বলেই খেতে চলে গেলো মেঘ, আরিশ এখনো নিজের জায়গায়ই বসে আছে। অন্য কারো সঙ্গে নিজের তুলনা শুনতে পছন্দ করেনা ও আর একটু আগে মেঘ সেটাই করলো!
‘ পড়ায় একটু সাহায্য করেছে বলেই এতো প্রশংসা করছে? এজন্যেই ছেলেরা সহজেই মেয়েদের মন গলাতে পারে!
কিছুক্ষন বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে রুম থেকে বাইরে পা রাখতেই আনিশা এসে হাজির!
‘ কি চাই তোর?’
‘তোকে যেটা বলেছিলাম করেছিস?’
‘ কালকে আমাদের পরীক্ষা!’
‘ তো? আমি কখন বললাম তোদের পরীক্ষা চলাকালীন আমাকে পড়াতে হবে? তোদের পরীক্ষা শেষ হলে পড়াবে ‘
‘ আমি থাকতে তুই অন্যের কাছে পড়ার জন্য পাগল হয়েছিস কেনো? আমি যখন ফ্রী থাকি তুই তখন আমার কাছেই পড়তে বসতে পারিস ‘
‘ দরকার নেই আমার তোর কাছে পড়ার! তুই পড়ার নাম করে আমাকে ধুম ধাম মা’রি’স। তাছাড়া অয়ন ভাইয়া একটা বিষয় সহজভাবে বোঝায়, আর তুই কঠিন ফর্মুলা ইউজ করিস। সবদিক বিবেচনায় আমার জন্যে অয়ন ভাইয়াই বেস্ট ‘
‘ বাহ! আমার বন্ধুর এতো প্রশংসা?’
‘ যে ভালো তার প্রশংসা করবো না?’
‘ থাক! অনেক হয়েছে, তুইও এখন মেঘনার মতো প্রশংসা করতে শুরু করিস না ‘
‘ মানে! ভাবী কার প্রশংসা করেছে?’
‘ কিছুনা! আমি অয়নকে বলে দেবো ‘
‘ ঠিক আছে, কিন্তু ভাবী কার যেন প্রশংসা করেছে বললি..’
‘ বাদ দে তো, খিদে পেয়েছে। চল ‘
আনিশার সামনে একটা কথা উঠলে সেটার আগাগোড়া না জানা অব্দি মেয়েটা শান্ত হয় না। মেঘ কার প্রশংসা করেছে সেটা জানার জন্যে আরিশকে প্রশ্ন করা থামায়নি আনিশা কিন্তু আরিশ বললে তো! টানা তিনটা লিখিত পরীক্ষা হওয়ার পর চারদিন বন্ধ পড়েছে। পরীক্ষা শেষে দুটো কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে ক্যাম্পাসে বসলো আরিশ ও অয়ন…
‘ আমার বোনকে এক ঘন্টা পড়াতে পারবি? তোর কাছে পড়ার জন্য জেদ করছে’
‘ আমার কাছেই কেনো? তোর বাবাকে বললে তো আমার থেকেও ভালো টিচার এনে দিতে পারবে ‘
‘ বলেছিলাম, কিন্তু ওর তোর পড়ানোর স্টাইল ইজি মনে হয় তাই তোর কাছেই পড়বে বলছে। এক ঘন্টা একটু সময় বের করে রাতে আমাদের বাসায় আসতে পারবি?’
‘ ওকে, সন্ধ্যার পর যেতে পারবো যদি তোদের কোনো সমস্যা না থাকে ‘
‘ আমাদের আর কি সমস্যা থাকবে? তোর যখন সময় হয় গিয়ে পড়িয়ে আসিস’
‘ ঠিক আছে, তা তোর বিবাহিত জীবন কেমন চলছে বল! কিছুই তো বলিস না এসব নিয়ে, আমি ভাই সিঙ্গেল মানুষ। কোথায় তোর বিবাহিত জীবনের কথা শুনে নিজেও বিয়ের জন্যে ইনস্পায়ার্ড হবো ‘
‘ আমি নামে বিবাহিত, কাজে সিঙ্গেল। আর শোন, বিয়ের কথা এখন ভাবার দরকার নেই বুঝেছিস? মেয়েদের সঙ্গে রুম শেয়ার করা কষ্টের কাজ ‘
তখনই কোত্থেকে মেঘ এসে হাজির হলো আরিশের সামনে…
‘ আরিশ, তুমি কি এখন বাসায় যাবে?’
‘ হ্যা, কেনো?’
‘ আমাকেও নিয়ে চলো, আজকে আমার বাসে যাওয়ার শক্তি নেই। প্লীজ!’
আরিশ উত্তর দিলো না দেখে মেঘ আবারও অনুরোধ করে বললো…
‘ আমি জানি আমাদের শুধু মাঝরাস্তা অব্দি একসাথে আসার কথা, কিন্তু আজকে আমি নিরূপায় হয়ে লিফট চাইছি। আজকেই, প্লীজ?’
মেঘের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, কি ভেবে আরিশ যেনো আর না করতে পারলো না।
‘ ওকে! তুমি যাও, আসছি আমরা ‘
‘ থ্যাংক ইউ! তুমি আমাকে লিফট দিলে আমি তোমাকে ট্রিট দিবো ‘
‘ তোমার ট্রিট মানে ওই চা – ফুচকা হবে, ওরকম ট্রিট লাগবে না আমার ‘
আরিশ রাজি হলো না দেখে মেঘ এবার অয়নকে অফার করলো…
‘ অয়ন! তুমি খাবে? তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমাকে খাওয়াতে পারি ‘
‘ ইয়াহ শিওর! আমার ভাবী যদি ট্রিট দেয় সেটা নিতে আমার আপত্তি নেই, আর আমি সবই খাই!’
হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে আরিশের দিকে তাকাতেই অয়নের হাসি যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো, আরিশ এমনভাবে চোখ গরম করে আছে যেনো এখনই খেয়ে ফেলবে। অয়ন বেচারা ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে উঠে গেলো! মেঘ একটু সামনে হাটছে পেছনে অয়ন আর আরিশ, তখনই নিহান ডাক দিলো মেঘকে…
‘ মেঘনা, আমার একটা হেল্প করতে পারবে?’
‘ হ্যা বলো ‘
‘ আমি একটা ছোটো কোচিং সেন্টার চালাই, তোমাকে সেদিন বলেছিলাম হয়তো। কিছু ব্যক্তিগত কারণে আমার সেন্টারের এক টিচার কয়েকদিন ক্লাস নিতে পারবে না, তুমি কি তার ক্লাসটা পারবে?’
‘ ইয়াহ শিওর! আমার টুকটাক টিউশনি করানোর অভিজ্ঞতা আছে, জেনারেল সাব্জেক্ট হলে ক্লাস নিতে পারবো ‘
‘ হ্যা জেনারেল সাব্জেক্ট!’
ওরা দুজনে কথা বলছিলো, ওদের কথা সবই শুনেছে আরিশ। অয়ন বললো…
‘ নিহান মেঘনাকে ওর কোচিংয়ের টিচার হিসেবে নিতে চাইছে? দেখেছিস দুজনের কত ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে?’
‘ ইদানিং মেঘনা নিহানকে নিজের আইডল ভাবে। পড়াশুনায় হেল্প করছে তাই নিজেও নিহানের হেল্প করতে চাইছে ‘
‘ আর তুই চেয়ে দেখছিস? বলবি না কিছু?’
‘আমি কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাইনা। ওর যা ইচ্ছা করুক’
নিহানের সঙ্গে কথা শেষে আরিশের সঙ্গে বাসার উদ্দেশে রওনা দেয় মেঘ, আসার পথে মেঘ জিজ্ঞাসা করে…
‘ তোমার সঙ্গে এখন শুধু অয়ন কেনো থাকে? সুহানা কোথায়?’
‘ ওর বাড়িতে একটু সমস্যা চলছে, সেটা সামলাচ্ছে ‘
‘ কি হয়েছে?’
‘ লাভ লাইফ আর ফ্যমিলি প্রবলেম!’
‘ ওহ! তাহলে তো সামলাতে দেরি হবে ‘
‘ তুমি কিভাবে জানলে? অভিজ্ঞতা আছে নাকি?’
‘ আমার নেই তবে আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে একজনের ছিলো, দেখার অভিজ্ঞতা আছে’
মেঘের কথা শুনে আরিশ বুঝলো ওর কোনো পাস্ট লাভ ইস্যু নেই, কথাটা বুঝেই স্মিত হাসলো আরিশ যদিও মেঘ তা দেখেনি। কিছুক্ষন পর বাড়ি ফিরতেই আরিশ বললো…
‘ তুমি কিছু না ভেবেই নিহানের কোচিংয়ে পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে গেলে কিভাবে?’
‘ মানে?’
‘ তুমি এখন নিজের বাড়িতে নেই যে যখন ইচ্ছে যা ইচ্ছে করবে, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে সেটা মনে আছে তো?’
মেঘ ভুলেই গেছিলো যে আগের আর এখনকার পরিস্থিতি আলাদা, কিছু না ভেবেই নিহানকে হ্যা বলে দিয়েছে। এখন কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছে না মেঘ! এরপর অনেক ভেবে ঠিক করলো শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে দেখবে। রাতে আফজাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে মেঘ, উনি অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু রেহানা বেগম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বাড়ির বউর সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা চলবে না। যদিও শ্বশুরের থেকে অনুমতি পেয়েছে কিন্তু মেঘের এই সিদ্ধান্তে ওর শাশুড়ি কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে বটে!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]
#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৭
সরাসরি না বললেও মেঘের এই সিদ্ধান্তে ওনার আপত্তি আছে বুঝে মেঘ ঠিক করলো দ্রুত ক্লাস শেষ করে সন্ধ্যার আগে যেভাবেই হোক বাসায় ফিরে আসবে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে কথা শেষে নিজের রুমে ফিরলো মেঘ, এসেই আরিশকে জানালো…
‘ অনুমতি পেয়ে গেছি ‘
‘ আমার অনুমতি নেবে না?’
‘ বাসার যে প্রধান উনি অনুমতি দিয়েছেন, আবার তোমার অনুমতি কেনো লাগবে?’
‘ আম্মুর মুখে শুনেছি ওয়াইফরা কিছু করতে চাইলে সবার আগে হাসবেন্ডের অনুমতি নিতে হয়, কিন্তু তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে সোজা বাবার কাছে চলে গেলে!’
আরিশের কথায় অবাক হয়ে মেঘ প্রশ্ন করলো…
‘ তুমি নিজেকে আমার হাসবেন্ড ভাবো নাকি?’
উত্তর দিলো না আরিশ, মেঘের মন খারাপ হয়ে গেলো। কোথায় আরিশের কথা শুনে একটু খুশি হয়েছিলো। ভেবেছিলো হয়তো আরিশ একটু হলেও ওর কথা ভাবে কিন্তু নাহ! তুরাগের কথাটা জানাবে আরিশকে, কিন্তু বলবে বলবে করেও বলতে পারছেনা। যেখানে আরিশ এই বিয়েটাই ঠিকমতো মানে না সেখানে স্ত্রীর সাহায্য কি করবে?
‘ আচ্ছা, কোচিং সেন্টারে পড়াতে গেলে কি কি প্রিপারেশন নিতে হবে? আমি টিউশন পড়িয়েছি, কিন্তু ওখানে তো অনেক ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থাকবে ‘
‘ আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছো? তোমার বসকে কল করে জিজ্ঞাসা করো, সে তো আবার তোমাকে সব বিষয়েই সাহায্য করে ‘
‘ ইউ আর রাইট! ওর থেকেই জানতে হবে, আগেই প্রিপারেশন না নিয়ে গিয়ে যদি কোনো গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলি’
মেঘ আর দেরি না করে ফোন হাতে তুললো, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো কনট্যাক্ট লিস্টে কয়েকবার খুঁজেও নিহানের নাম্বার খুঁজে পেলো না..
‘ নিহানের নাম্বার কোথায় গেলো! আমি তো নাম দিয়ে সেভ করে এনেছিলাম ‘
মেঘ নাম্বার খুঁজে হয়রান, আর আরিশ ওর পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে। তৎক্ষণাৎ ওর দিকে তাকালো মেঘ, থতমত খেয়ে গেলো আরিশ
‘ হোয়াট? আমার দিকে তাকাচ্ছো কেনো?’
মেঘ হতাশ কণ্ঠে বললো…
‘ নাম্বার কোথায় গায়েব হয়ে গেলো! পাচ্ছি না’
‘ তুমিই হয়তো ঠিকঠাক সেভ করোনি, বাদ দাও ‘
‘ তোমার কাছে নাম্বার আছে?’
‘ না!’
আরিশের কাছে নাম্বার আছে, কিন্তু ইচ্ছে করেই মেঘকে দিলো না। কেনো দিলো না সেটা ওর নিজেরও জানা নেই! পরদিন সন্ধ্যায় আনিশাকে পড়াতে এসেছে অয়ন, ওকে দেখে আনিশার সে কি আনন্দ। অয়নকে নিজের ঘরে বসিয়ে নিজের হাতে ওর জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এলো আনিশা…
‘ অয়ন ভাইয়া! আপনার জন্যে চা, আমি নিজে হাতে বানিয়েছি ‘
‘ এখন এগুলোর দরকার ছিলো না, পরেও করতে পারতে ‘
‘ না না, আপনি এতদিন পর আমাদের বাসায় এলেন তাও আমার স্যার হিসেবে। ছাত্রী হিসেবে আপনার এইটুকু অ্যাপায়ন আমি করতেই পারি।’
‘ থ্যাংক ইউ!’
‘ আপনি কত্তদিন পর আমাদের বাসায় এলেন, আগে মাঝে মাঝেই আসতেন আর এখন? কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া আপনাকে দেখাই যায়না। মাঝে মাঝে আসবেন, আমাদেরও ভালো লাগবে ‘
‘ তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে নাকি?’
অয়নের আকস্মাৎ প্রশ্নের কিছুটা ভরকে গেলো আনিশা…
‘ ন..না তো!’
‘ আগের কথা বাদ দাও, এখন তো তোমাকে পড়ানোর জন্যে রোজ আসতে হবে। বাই দ্যা ওয়ে, আরিশ বললো তুমি নাকি আমার কাছে পড়ার জন্যেই খুব জেদ করছিলে?’
হাসিমুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো আনিশা…
‘ হুমম! আপনি আমাকে পড়ানো বাদ দেওয়ার পর আরো কতোজনের কাছে পড়েছি কিন্তু আপনার মতো সুন্দর করে কেউ পড়াতে পারে না’
‘ ওয়াও! ছাত্রীর মুখে এতো প্রশংসা শুনে ভালো লাগলো। তাহলে আজকের পড়া শুরু করা যাক?’
অতি উৎসাহের সহিত অয়নের দিকে বই এগিয়ে দিলো আনিশা, সিলেবাসের কোন অংশ কতটুকু পড়ানো হয়েছে সেটাও বললো। সব দেখে নেওয়ার পর অয়ন পড়ানো শুরু করলো। সন্ধ্যার নাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে এসেছিলেন রেহানা বেগম, চুলার অবস্থা দেখে অবাক হলেন উনি। চুলায় দুধ চা পড়ে আছে, আর কিচেন সিংকে সসপ্যান। মেঘও ওখানে উপস্থিত!
‘ এ কি অবস্থা, কে করেছে এগুলো!’
‘ আনিশাকে দেখলাম রান্নাঘর থেকে বেরোতে, হয়তো চা বানাতে গিয়ে হয়েছে। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি ‘
‘ এই মেয়েকে তো টেনেও রান্নাঘরে আনা যায়না, আজ হঠাৎ চা বানাতে এসেছিলো? অয়ন এসেছে তাইনা?’
‘ হ্যাঁ আম্মু, আমি অয়নকে নাস্তা দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। রান্নাঘরে এসে দেখলাম এই অবস্থা, হয়তো অয়নের জন্যেই আনিশা চা বানিয়ে নিয়ে গেছে ‘
‘ মেয়েটাকে ধরে এবার ভালোভাবে রান্নাবান্না শেখাতে হবে, সামান্য চা বানাতে গিয়ে রান্নাঘরের এই করেছে না জানি পুরো রান্না করতে গেলে কি করবে ‘
মেঘ দ্রুত একটা কাপড় ভিজিয়ে চুলা পরিষ্কার করে নিলো, এদিকে রেহানা বেগম দাড়িয়ে মেয়ের ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে হা হুতাশ করছেন। এ অবস্থায় নিজের প্রথমবার চা বানানোর ঘটনা মনে পড়লো মেঘের। আনিশার মতো মেঘও অপটু হাতে চা বানাতে গিয়ে ফুল আঁচে চুলা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, ফলশ্রুতিতে বলগ এসেছে বেশি চা চুলার ওপর পড়েছিলো। ওর মা ও সেদিন এভাবেই বকেছিলো। পুরোনো স্মৃতিচারণ করে হাসলো মেঘ।রান্নাঘর পরিষ্কার করে মেঘ ভাবলো একেবারে রাতের রান্না বসিয়ে দেবে। তবে তার আগে শ্বশুর শাশুড়ির জন্যে চা ও আরিশের কফি বানিয়ে নিলো। শ্বশুর শাশুড়িকে চা দিয়ে এসে আরিশের জন্যে কফি নিয়ে এলো। কিন্তু রুমের দরজার সামনে আসতেই থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো মেঘ! আরিশ শার্ট খুলে টি – শার্ট পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখনই মেঘের আগমন। আরিশকে শার্ট খোলা অবস্থায় দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে মেঘ, লজ্জা পেয়েছে বটে তবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দ্বিধা বোধ করেনি! বিয়ের কয়েকটা দিন কেটে গেছে বটে তবে প্রথমবার আরিশকে এভাবে দেখছে, ও সবসময় বাথরুমে গিয়েই ড্রেস চেঞ্জ করে কিন্তু আজ কি ভেবে রুমে করছিলো। মেঘ তো ওকে এভাবে দেখে থ হয়ে গেছে, কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখেও নিয়েছে। নিজের বরকে দেখতে লজ্জার কি আছে? তবুও একটু লজ্জা লাগছে মেঘের, আরিশ তাকিয়ে দেখলো মেঘ কফি নিয়ে এখনও দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ও ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো..
‘দাঁড়িয়ে আছো কেনো ওখানে?’
‘ তোমার আক্কেল নেই নাকি! এভাবে দরজা খুলে জামা চেঞ্জ করছেন কেনো? দরজা আটকে নেবে তো, নইলে বাথরুমে যাও ‘
‘আমার রুমে দাড়িয়ে ড্রেস চেঞ্জ করেছি তাতে কি সমস্যা? বাইরে দাঁড়িয়ে তো আর করছি না’
‘হুট করে কেউ রুমে ঢুকে পড়লে? এইযে যেমন আমি এলাম, দরজাটা একটু চাপিয়ে তো রাখবেন। তাহলে আমি নক না করে…’
‘কেনো? তোমার লজ্জা লাগছে?’
‘এমন কিছুনা!’
যে মেয়েটা সবসময় ফড়ফড় করে কথা বলে সেই মেঘকে এত নিচু স্বরে কথা বলতে দেখেই আরিশ বুঝে গেছে মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে। আরিশও এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলো না, ও ইচ্ছে করেই টি শার্ট না পড়ে ওই অবস্থাতেই মেঘের দিকে এগোতে এগোতে বললো…
‘আমার তো এমন কিছুই মনে হচ্ছে, ওখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে কেনো আসছো না?’
‘আ..আমার নিচে কাজ আছে! রাতের রান্না বসাতে হবে, আমার রান্নার সময় গিয়ে যাতে বিরক্ত না করতে পারো তাই ভাবলাম কফি তোমার ঘরেই দিয়ে যাই ‘
কাপটা ওয়াড্রবের ওপর রেখেই মেঘ দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলো কিন্তু পারলো না, আরিশ এসে ধরে ফেললো। এক টানে মেঘকে ঘরের ভেতর এনে দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে দিলো। ধরে ভালোভাবে মেঘের মুখটা পর্যবেক্ষণ করলো, মেয়েটার মুখ হালকা লাল হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে ভালোই লজ্জা পেয়েছে! আরিশ মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো…
‘ ওহ মাই গড! মেঘনা, এ আমি কি দেখছি? তুমি লজ্জা পেয়ে পালানোর চেষ্টা করছো?’
উত্তর দিলো না মেঘ, চোখ নিচু করে আছে…
‘চোখ নিচু করে আছো কেনো? আমার দিকে তাকাও ‘
‘কিছু বলার থাকলে এমনিই বলো ‘
‘ নো! ইউ হ্যাভ টু লুক অ্যাট মি!’
‘না তাকালে বলবে না?’
‘না!’
মেঘ এবার কৌতূহলবশত আস্তে আস্তে চোখ তুলে আরিশের চোখের দিকে তাকাতেই আলতো হাতে মেঘের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিলো আরিশ…
‘তুমি জানো তোমাকে এই মুহূর্তে কতো সুন্দর লাগছে? তোমার চোখের পাঁপড়িগুলো মাশা আল্লাহ, কিন্তু লজ্জাটাও যে তোমায় এতো স্যুট করবে আগে বুঝতে পারিনি। জানো আমার এই মুহূর্তে ঠিক কি করতে ইচ্ছে করছে?’
‘কি?’
আরিশ মেঘের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো…
‘ সামথিং ভেরি স্টিমি! কাপল বাথ ওর সামথিং লাইক দ্যাট, ইউ নো হোয়াট আই মিন?’
মেঘ বড় বড় চোখ করে আরিশের দিকে তাকায়, আরিশের ঠোঁটের বাঁকা হাসি দেখে মেঘ বেশ বুঝতে পারছে ও কি বোঝাতে চাইছে। ছেলেটা নির্ঘাত মজা করছে, সেদিনও এমন করেছে। মজা করে জেনে মেঘের তো রাগ করার কথা, কিন্তু রাগ করতে পারছে না। আরিশ যখনই কাছে আসে মেঘ চাইলেও যেনো সরে যেতে পারেনা। কিন্তু আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না, আরিশকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মেঘকে পালাতে দেখে আরিশ রুমের মধ্যে দাঁড়িয়েই হাসলো, বেডের পাশ থেকে টি শার্টটা তুলে গায়ে দিয়ে মনে মনে বললো…
‘মনে হচ্ছে আমাকে মাঝে মাঝে এভাবে ওর সামনে আসতে হবে, মেয়েটাকে লজ্জা পেলে দেখতে বেশ কিউট লাগে!’
এদিকে মেঘের এই অবস্থা দেখে বেশ মজা পেয়েছে আরিশ, ওদিকে হুড়মুড় করে সিড়ি দিয়ে নেমে ড্রইং রুমে গিয়ে দু হাতে বুক চেপে ধরে দাড়িয়ে পড়ে মেঘ। হার্টবিট ভীষণ বেড়ে গেছে, নিঃশ্বাসও কিছুটা ভারী হয়ে এসেছে তার ওপর আরিশের বলা কথাটা কানে কানে বাজছে। আরিশ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এমন কথা বললো, মেঘ জানে ও মজা করছে। তবুও প্রতিবার আডরিশের মজার ছলে বলা কথাগুলোই সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলে মেয়েটা। ওর শ্বাশুড়ি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো। মেঘকে ড্রইং রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়ানো দেখে উনি প্রশ্ন করেন…
‘কি ব্যাপার মেঘনা? কিছু হয়েছে নাকি?’
‘হ.. হ্যা? কিছুনা মা!’
‘তাহলে এভাবে হাপাচ্ছো কেনো?’
‘না মা, আসলে সিড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নেমে এলাম তো তাই একটু হাপিয়ে গেছি। আমি একদম ঠিক আছি ‘
‘ সিড়ি দিয়ে সাবধানে চলাচল করো, পা পিছলে গেল কিন্তু বিরাট ক্ষতি হবে। যাই হোক, রান্না বসিয়েছ?’
‘ হ্যা, আম্মু। আমি এখুনি রান্নাঘরে যাচ্ছি ‘
রেহানা বেগম রান্না করবেন, মেঘ সব রেডি করে দেবে। শুরুতে সব সবজি একসঙ্গে কে’টে নেবে বলে সবজিগুলো ধুয়ে নিলো। সব্জি কা’টতে গিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে আরিশের কথা ভাবতে শুরু করে মেঘ, তখনই কিচেন নাইফে লেগে আঙ্গুল অনেকটা কে’টে যায় ওর! কিন্তু রেহানা বেগমকে বুঝতে দেয়নি ভাবলো এইটুকু চোটে কিছুই হবেনা। রান্না করতে গেলে এমন টুকটাক চোট তো লাগেই!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]