মন সে কথা শোনেনা পর্ব-০২

0
1

#মন_সে_কথা_শোনেনা
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
পর্ব:২

জৈষ্ঠ্যের দুপুর হলো বাংলার গ্রীষ্মকালীন একটি বিশেষ সময়। জৈষ্ঠ্য মাসের এই সময়টাতে দিনের তাপমাত্রা বেশ উষ্ণ থাকে, আর সূর্যের তেজ অত্যন্ত বেশি হয়। দুপুরের সূর্য প্রখর এবং ঘাম ঝরানো , যা গ্রীষ্মের আগমনকে অনুভব করায়।

এই সময়ের প্রকৃতি বেশ স্বতন্ত্র। পুকুর, হাওর বা নদী শুকিয়ে যায় এবং কৃষকেরা নতুন ফসলের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
চৈত্রের দুপুরে কাঠফাটা রোদের মধ্যে মায়া চলে গেছে মাঠের মধ্যের বিল থেকে শাপলা তুলতে সাথে রয়েছে প্রাণপ্রিয় সখী সুহী। মায়া প্রায় বিলের মাঝে চলে গেছে শাপলা তুলতে সুহী মানা করতে যেতে তবুও মায়া শুনেনা বারণ। অনেক গুলো শাপলা তুলে নিয়ে বিলের পাড়ে ওঠে আসছে তখনি লাঠি হাতে এসে দাঁড়ায় মায়ার মা।

তোর কি আক্কেল জ্ঞান নেই রে কাল বিয়ে আর আজ বিকেলে গায়ে হলুদ আর তুই এই কাঠফাটা রোদের মধ্যে বিলে এসেছিস শাপলা তুলতে? আজ বাদে কাল শশুড় বাড়ি যাবি সেখানে কি এসব ধিংঙ্গিপনা করবি? বলে ওর মা মারতে আসলে মায়া দৌড় লাগায় বাড়ির পথে পিছু ছোটে ওর মা। মায়াকে ধরতে না পেরে সুহীকে বলে তোদের এখানে কতবার আসতে না করেনি? বলিনি এই জায়গাটা ভালোনা দুপুর বেলায় ভূত পেতের আসর থাকে।

আমি মায়াকে আসতে মানা করেছিলাম চাচি কিন্তু ও আমার করা শোনেনি উল্টো আমায় জোর করে এনেছে।

দুটোতে আমার জীবন শেষ করবে কালকে বিদায় হলে বাঁচি যাই ভাবছিলাম কিন্তু না চিন্তা বেড়ে গেল এমন ধিঙ্গিপনা শশুড় বাড়িতে করলে দুইদিন বাদেই দিয়া যাবে এসব বলতে বলতে বাড়ি ফিরে আসে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো ধরণীতে আলো ফুরিয়ে নেমে আসলো আধার রূপে। ছোট মাটির বাড়ির বারান্দায় গায়ে হলুদের জন্য সাজিয়ে আয়েজন করেছে পাশের ঘরে মায়াকে হলুদ শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে সুহী সে আবার সুন্দর করে শাড়ি পড়াতে জানে মায়ের থেকে শিখেছে।

মায়াকে শাড়ি পরিয়ে বসিয়ে দিলো বারান্দার পাশটাতে যেখানে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। কয়েক মিলে মায়াকে কাঁচা হলুদ লাগিয়ে দিলো সুন্দর চামড়ায় কাঁচা হলুদ লেগে আরো সুন্দর লাগছে।
সুহী কানে কানে বলে ফেলে,
সখী লো কাঞ্চা শরীরে কাঁচা হলুদ লেগে যে তুই আরো সুন্দরী হয়ে যাচ্ছিস তোর এই রুপ দেখিয়া দুলাভাই না বেহুস হইয়া যায়।

মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। মনে মনে বলে,
রুপ দিয়ে কি সব পাওয়া যায়? রুপ দিয়ে হয়তো কাউকে মোহিত করা যায় কিন্তু আসল ভালোবাসা পেতে যে ভাগ্য লাগে মনের মতো মানুষ লাগে।

আজ শুক্রবার বিয়ের দিন চলে আসলো।
বিয়েতে গ্রামের কয়েকজন কে মাত্র ওদের সামর্থ্য নেই এতো মানুষ কে বলার তাই ছোট করে আয়োজন করে বিয়ে দিচ্ছে। রফিক সাহেব ও পরিস্থিতি বুঝে বলেছেন বরপক্ষ আসবে কয়েকজন শুধু বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবে পারলে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে বড় করে অনুষ্ঠান করবে।

বিকেল বেলায় বরযাত্রী আসলো পাড়ায় ধুম পড়ে গেল বর এসেছে এই কথা মায়ার কানেও গেল কিন্তু মনে নেই কোনো আনন্দ আজ নিজের মা, সখী নিজের গ্রাম নিজের ভালোবাসার মানুষ গুলোকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবে চোখে পানি টলমল করছে। মায়ের সে ছাড়া আর কেউ নেই তাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? যদি নিজে কিছু করতে পারতাম তাহলে মাকে নিজের কাছে রেখে নিজের উর্পাজনে খাওয়াতাম এই স্বপ্ন কি স্বপ্ন রবে? একদিন ঠিক পূরণ করবো মা কে নিয়ে যাবো নিজের নীড়ে।

সন্ধ্যায় তিন কবুল বলে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। তাসফির গম্ভীর মুখে কবুল বলেছিলো দেখে গ্রামের মানুষের কানাগোসা শুরু হয়েছে বর কি রাজি না বিয়েতে?যদি রাজি হয় তাহলে বিয়ে করতে এসে মুখ গম্ভীর কেন?আর এতো সময় নিয়ে কবুল তো মেয়েরাও বলে না এসব শুনে মায়ার
মনে প্রশ্ন জাগে আর বলে,
নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম অবহেলার নৌকায়
যদি মাঝি কোনোদিন ভালোবেসে আপন করে নেন সেই অপেক্ষায়।

বিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ বউ নিতে যেতে তাগদা দেয় বরযাত্রী বেশি রাত হলে গ্রামের রাস্তায় যাওয়া বেশ মুশকিল গ্রামের তিন কিলো ভাঙ্গা কাঁচা পেরিয়ে যেতে হবে। তাসফির আর মায়াদের বাড়ি এক জেলায় হলেও দূরত্ব অনেকটা মায়াদের বাড়ি গ্রামের কোনে আর তাসফিরদের বাড়ি শহর মুখে।

শেষ বিদায়ে মাকে জড়িয়ে ধরে করছে মায়া কান্বা থামার জো নেই পাশে দাড়িয়ে থাকা তাসফিরের মুখে বিরক্তের ছাপ স্পষ্ট।
এতো সময় কথা না বললেও এবার বলে ফেলে কান্না শেষ হলে গাড়িতে ওঠে আসতে পারো নয়তো গাড়িতে ওঠার পর কান্না কইরো এখন আসো বলে গাড়িতে বসে পড়ে তাসফির।
মায়া মিজের মা কে ছেড়ে দিলো ওঠে বসলো তাসফিরের পাশের সিটে বসতে গিয়ে এক ঝামেলা বাঁধে পিছন থেকে কেউ একজন ধ্বাক্কা দেয় হুড়মুড় করে গিয়ে ওড়ে তাসফিরের গায়ে মাথা সিটের কোনে লাগতে গেলে নিজের হাত দিয়ে বাঁচিয়ে নেয় মায়াকে। পাশের সিটে বসিয়ে দেয় জিজ্ঞেস করে ঠিক আছো?

তাসফিরের কথায় মায়া তাকায় মানুষটার মুখপানে সেদিন একটু খানি দেখলেও আজ বিয়ের সময় ও তাকায়নি কেবলমাত্র তাকিয়ে দেখছে বিয়ের শেরওয়ানিতে বেশ লাগছে মানুষটাকে। শ্যামারঙা পুরুষটা তার নিজের মানুষ হলেও দূরত্ব আছে আগে থেকে ছিলো না পরিচিয় বিয়ের আগে দেখেছে আর আজ দেখছে হয়তো বিয়ের পর হয়ে ওঠবে মনের মানুষ আর নয়তো অবহেলার মানুষ হয়ে পড়ে রবে ঘরের এক কোনে।

গাড়ি এসে থামায় একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে তাসফির নেমে পড়ে পিছনে মায়া ও নেমে আসে তাকিয়ে দেখে বাড়িটা সুন্দর এমন ডুপ্লেক্স বাড়ির স্বপ্ন ছিলো তার যখন স্কুলে পড়তো তখন বান্ধবীদের বলতো কোনো একদিন বিয়ে করবো সংসার হবে একটা ডুপ্লেক্স সুন্দর বাড়িতে থাকবো দুজন যার মনে থাকবে আমার জন্য ভালোবাসার অথই সাগর।
ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখলাম বাকি স্বপ্ন গুলো কি পূরন হবে?বাড়ির থেকেও যে মানুষটা মনের হওয়া বেশি প্রয়োজন।

কি হলো মা দাঁড়িয়ে কি ভাবছো?বাসার ভিতরে আসো।
রফিক স্যারের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে মায়ার। পাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই সামনে শুধু এই মানুষটা দাড়িয়ে আছেন যিনি আজ থেকে আমার শশুড় হলেন।

বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার আগে মিষ্টি হাতে নিয়ে আসে একটা সুন্দরী মেয়ে যার বয়স আমার মত হবে নয়তো আমার থেকে একটু বড় হবে। কে এই মেয়েটা শুনেছিলাম স্যারের একটাই ছেলে তাহলে এ কে?

মায়া মা এ হলো সুরাইয়া আমার বোনের মেয়ে তোমার থেকে হয়তো একটু বড় এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আজ তোমার শাশুড়ী থাকলো মিষ্টি খাওয়াতো কিন্তু ও তো বেঁচে নেই তাই রত্নাকে বলছিলাম তোকে ঢ়েন মিষ্টি খাওয়ায় কিন্তু রত্না বললো ও পারবে না ওর মাথা ব্যাথা করছে তাই সুরাইয়া বললো ও তোমায় মিষ্টি খাওয়াবে।

মায়া বুঝতে পারলো এ ওর ফুফু শাশুড়ীর মেয়ে। সুরাইয়া মিষ্টি চামিচে নিয়ে মায়ার মুখের সামনে ধরলো মিষ্টি মুখে দিয়ে চিবোতেই কাঁশি ওঠে নাকে মুখে লেগে যায় ঝাল বলে হাঁফাতে থাকে মায়া।

কি বলছো ভাবি মিষ্টির মধ্যে তুমি ঝাল কই পেলে?তুমি নিশ্চয়ই মজা করছো তাই না?

মায়া ঝাল লাগার কারণে কথা বলতে পারছে না শুধু হা হু করছে।

সুরাইয়া কথা পরে বলো আগে পানি দেও।

আমি তো পানি নিয়ে আসিনি! আচ্ছা নিয়ে আসছি বলে যাওয়ার আগে মায়ার সামনে পানির গ্লাস ধরে মায়া পানিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে নেয় কিছুটা সস্তি পায় চোখ মেলে দেখে নিজের মানুষটা তার সামনে যে পানি নিয়ে এসেছিলো। মানুষটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ না।

তাফফির প্রশ্ন করে সুরাইয়া মিষ্টির মধ্যে ঝাল আসলো কিভাবে?

আমি কিভাবে বললো তাসফ…সরি তাসফির ভাইয়া আমি তো জানিনা এখানে তো মিষ্টি ছিলো বিশ্বাস না হলে খেয়ে দেখো বলে একটা মিষ্টি তাসফিরের মুখের সামনে ধরলো তাসফির খেলো কিন্তু মিষ্টির মধ্যে কোনো ঝাল ছিলো না ও মায়ার দিকে তাকালো কিছু না বলে উপরে চলে গেল।
মায়া সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ও মায়াকে দেখে শয়তানি হাসি দিলো। মায়া বুঝতে পারলো মিষ্টিতে ইচ্ছে করে ঝাল মিশিয়েছে কিন্তু কেন?তার সাথে তো আমার কথাও হয়নি এই প্রথম দেখলাম তাহলে শত্রুতা কিসের?কিছু রহস্য তো আছে পরে জানতে হবে।

চলবে…………..?