#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
নিস্তব্ধ গুমোট পরিবেশ। হৃদস্পন্দনের তীব্র আওয়াজ। জড়ো সরো পরিস্থিতি। ভয়ে জীর্ণ সির্ণ হয়ে বিড়াল ছানার ন্যায় লেপ্টে আছি ইভান ভাইয়ার বুকে। চোখে অবাধ অশ্রু ধারা। হাত জ্বালা করছে। তখন কার ঘটনা, আনমনে কফি ঢালতে গিয়ে বেখেয়ালিতে হাত ফসকে যায়। ভয়ে গগণবাদী এক চিৎকার দিলাম। কফিটা গাঁয়ে পড়ার আগেই কেউ টেনে সরিয়ে ফেলে। তবে ডান হাতের উল্টো পিঠে কিছুটা জায়গায় গরম কফি ছিটকে পড়েছে। টেনে সরিয়ে আনা মানুষটা আর কেউ না স্বয়ং ইভান ভাই। গরম কফি হাতে পড়ায় আমি ছটফট করছি। ইভান ভাই দ্রুত আমার হাত পানির নিচে ধরলেন। জ্বালায় ছটফট করছি। ইভান ভাই এক হাতে জড়িয়ে নিলেন। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছি। ততক্ষনে বাড়ির সবাই এসে ভীড় জমিয়েছে রান্না ঘরে। বড় আম্মু উদিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে রোদ সোনা? চিৎকার করলি কোনো? পড়ে গিয়েছিলি? কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস?”
আমি উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। কাঁদতে কাঁদতে বেহাল অবস্থা আমার। ইভান ভাই আমাকে ধরে নিয়ে সোফায় বসালেন। আমার অবস্থা দেখে শুভ ভাই কোথায় যেন ছুটলেন। মুহূর্তের মাঝে হাতে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ফিরে এলেন। বার্ন ক্রিম কিছুটা হাতে নিয়ে লাগিয়ে দিলেন। হাতের জ্বালা কয়েক গুন বেড়ে গেল। ছটফট করছি আমি। শুভ ভাইয়ের হাত ধরে আটকে দিলাম।
“ক্রিম লাগিও না। জ্বালা করছে। শুভ ভাই প্লিজ লাগিও না। প্লিজ শুভ ভাই”
শুভ ভাই করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ইভান ভাই ইশারা দিলেন বাকি জায়গায় ক্রিম লাগানোর জন্য। তবে শুভ ভাই নির্বাক হয়ে আমার ছটফট করা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। ইভান ভাই আমার হাত থেকে শুভ ভাইয়ের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে তবে পড়েছেন না।
“রোদ ভাইয়ের হাত ছাড়। ছাড় বলছি”
শেষের কথাটা কিছুটা ধমকের স্বরেই বললেন। ধমক খেয়ে শুভ ভাইয়ের হাত ছেড়ে দিলাম।
“বসে আছিস কোনো ভাই? তাড়াতাড়ি ক্রিমটা লাগা। নাহলে ফোস্কা পরে যাবে”
ইভান ভাইকে এখন নিজের শত্রু মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে উস্টা দিয়ে কয়েক মাইল দূরে ফেলে দেই। ইভান ভাইয়ের কথায় শুভ ভাই আবারো ক্রিম লাগানো শুরু করলেন। ফুঁ দিচ্ছেন আর ক্রিম লাগাচ্ছে।
“কাঁদে না পাখি। এইতো শেষ। ক্রিম লাগালে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে। ফোস্কাও পড়বে না। পাখি না ভালো কাঁদে না”
শুভ ভাইয়ের সান্তনার বাণীও কোনো কাজে দিলো না। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছি। সবার মুখেই বেদনার ছাপ। বড় আম্মু অপর পাশে বসে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও খেয়াল নেই।
ঘুম ভাঙলো রাত দশটা নাগাদ। পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে নিজের বিছানায় দেখে খানিকটা অবাক হলাম। আমি তো ড্রয়িং রুমের সোফায় ছিলাম। তাহলে বিছানায় কিভাবে এলাম? সকল ভাবনা বাদ দিয়ে হাতের দিকে তাকালাম । এখন আর জ্বালা করছে না। উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। বিছানায় হেলান দিয়ে মুখ ভার করে বসে আছি। কিছুক্ষন পর আম্মু এলো ঘরে।
“উঠে গিয়েছিস? এখনো হাতে জ্বালা করছে?”
মুখ ভার করে জবাব দিলাম,
“না, জ্বালা করছে না”
“দেখেছিস ইভান সেই সময় ধমকে ক্রিম লাগিয়েছিল বলেই এখন জ্বালা করছে না। তুই বস আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি”
ইভান ভাইয়ের প্রশংসা শুনে গাঁ জ্বলে যাচ্ছে। ব*জ্জাত, নির্দয়, পাষান লোক। উনার কারণেই তো হাতের কফিটা পড়লো। না উনি আমায় ধমক দিতো, না আমি তাকে বকতে গিয়ে হাতে কফি পড়তো। সব কিছু হয়েছে ওই লাট সাহেবের জন্য। আম্মু খাবার নিয়ে এলো। খেতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। আম্মু অনেক ক্ষণ জোরাজুরি করলো। তবে লাভ কিছুই হলো না। আমি খাবো না মানে খাবো না। আম্মু চলে যেতেই শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। রাগ লাগছে ইভান ভাইয়ের প্রতি। ইচ্ছে করছে ইভান ভাইয়ের চুলগুলো টেনে একটা একটা করে উঠিয়ে ফেলি। কল্পনায় ইভান ভাইয়ের টাক মাথার চিত্র ভেসে উঠলো। উচ্চশব্দে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি। এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। ভাবলাম আম্মু হয়তো আবার এসেছে।
“কি সমস্যা আম্মু? বললাম তো খাবো না। কেন বারবার জোর করছো। আমি দরজা খুলবো না। তুমি যাও”
অপর পাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো,
“দরজা খোল”
তাহলে দরজার ওপাশে আম্মু না ইভান ভাই।
“আমার খিদে নেই। আপনি এখন এখান থেকে যান। আমি দরজা খুলবো না”
“থা*প্পড় খাওয়ার আগে ভালোয় ভালোয় দরজা খোল রোদ। নাহলে আমি যদি দরজার ভেঙ্গে ভিতরে আসি তবে তোর খবর আছে”
কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। এই লোক যেই ঘাড় তেড়া এখান থেকে নড়বে বলে মনে হচ্ছে না। উল্টো দেখা যাবে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে চলে আসবে। তখন আমার সুন্দর গাল লাল করে দিবে। তার চেয়ে ভালো দরজাটা খুলেই দেই। ভদ্র মেয়ের মতো দরজা খুলে দিলাম। ইভান ভাই খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে খাবারটা টেবিলে রেখে বলল,
“কি সমস্যা? খাবার খাবি না কোনো? ছোটো মা এতবার সেধে গেল খেলিনা কোনো?”
“খিদে নেই তাই”
“আমি এতো কিছু শুনতে চাচ্ছি না। চুপচাপ খাবার শেষ কর”
আমি যেয়ে বিছানায় বসে রইলাম। খাবো না মানে খাবো না। ইভান ভাই রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাতে আমার কি?
“কি হলো? কথা কানে যাচ্ছে না। খাচ্ছিস না কোনো?”
আমি একবার খাবারের দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার নিজের পোড়া হাতের দিকে তাকাচ্ছি। ইভান ভাই হয়তো আমার অবস্থা বুঝত পারলেন। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে সোফায় বসলেন। খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,
“পাশে এসে বস”
আমি কোনো কথা না বলে ভদ্র মেয়ের মতো তার পাশে গিয়ে বসলাম। ইভান ভাই খাবার মুখের সমানে ধরলেন। আমি অবাক। রাগী,ঘাড় তেড়া, বজ্জাত ইভান ভাই আমাকে খাইয়ে দিবেন এটাও ভাবা যায়। যে কিনা সবাইকে গিফট দিলো কিন্তু আমাকে দিলো না। বাড়ি আসার পর ঠিক মতো আমার সাথে কথাও বলেনি সে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি ইভান ভাইয়ের দিকে।
“আমাকে দেখার জন্য সময় পরে আছে। এখন আগে খাবার মুখে নে”
ইভান ভাইয়ের কথায় কিছুটা লজ্জা পেলাম। ইভান ভাই খাইয়ে দিচ্ছেন আমিও ভদ্র মেয়ের মতো খেয়ে নিচ্ছি। খায়ানো শেষে ইভান ভাই উঠে দাঁড়ালেন।
“ভদ্র মেয়ের মতো এখন ঘুম দিবি। আমি যেন জেগে থাকতে না দেখি”
ইভান ভাই চলে গেলেন। দরজা আটকে দিয়ে ভাবছি সত্যিই কি এটা ইভান ভাই ছিলো নাকি তার ওপর কিছু ভর করেছে। তিনি এতো ভালো হলেন কবে থেকে? ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে পারি জমালাম।
নতুন এক স্নিগ্ধ সকাল। নতুন দিনের সূচনা। ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি ঘড়িতে সময় সকাল ছয়টা বেজে বিশ মিনিট। উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরে শীতলতা ছুঁয়ে গেল। বাগানে হরেক রকমের ফুল ফুটেছে। দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে করছে আলতো করে ছুঁয়ে দেই। যেই ভাবা সেই কাজ। দৌড়ে ছুটলাম বাগানের উদ্দেশ্যে। নিচে নামতেই আম্মুর ডাক,
“এভাবে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিস। আসতে যা। নাহয় পরে যাবি”
কে শুনে কার কথা। এক দৌড়ে বাগানে চলে এলাম। বাড়ির একপাশে ছোটো খাটো একটা বাগান। বড় আম্মুর খুব শখের এই বাগান। এখানের বেশির ভাগ গাছই বড় আম্মু লাগিয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটা আমার লাগানো। ফুল আমার খুবই পছেন্দের। বড় আম্মু আর আমি মিলেই বাগানের দেখাশোনা করি। এটা আমারও খুব পছন্দের জায়গা। বাগানে এদিক থেকে ওদিক ছুটে চলেছি। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলাম গোলাপ ফুল। কি সুন্দর ফুটে আছে। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মুগদ্ধ নয়নে চেয়ে আছি ফুল গুলোর পানে।
ব্যালকনিতে ধোয়া উঠা কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। পাশে ধোয়া উঠা কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে যে মজে রয়েছে কিশোরী মেয়ের চঞ্চলতায়। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে কিশোরীর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠা মিষ্টি হাসির পানে। বিরবির করে বলে উঠলো,
“আমার স্নিগ্ধফুল”
#চলবে?
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে যাবেন। ধন্যবাদ)