উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-২৫+২৬

0
173

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৫
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

ভোরের আলো চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিকষ কালো আঁধার কাটিয়ে ধরিণীতে সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে। গভীর ঘুমে বিভোর আমি। মাথায় কেউ উষ্ণ হাতের ছোঁয়া দিচ্ছে। কারো হাতের অস্তিত্ব মাথায় টের পেতেই চট করে উঠে গেলাম। আদ্র ভাইয়ের ঘুম কি তবে ভেঙ্গে গেল? উনি কি উঠে গেছেন? চোখ কচলে সামনে তাকাতেই নজরে এলো আদ্র ভাইয়ের মলিন চেহারাটা। মাথা শুভ্র ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বুকের মাঝে ঢক করে উঠলো। আমার আদ্র ভাইয়ের এমন করুণ রূপ যে সহ্য সীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে। সারা কেবিনে আদ্র ভাই আর আমি ছাড়া কেউ নেই। তাহলে কে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো? আদ্র ভাই? কিন্তু উনার হাতে তো ক্যানোলা পড়ানো। উনি কিভাবে মাথায় হাত বুলাবেন। খেয়াল করে দেখলাম আদ্র ভাইয়ের হাত উঁচু করে রাখা। তার মানে উনিই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। কাল রাতে উনার হাত ধরে কান্না করতে করতে কখন যে উনার হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়াল নেই। তবে ভালো লাগার বিষয়টা হচ্ছে মানুষটা এই অসুস্থ শরীর নিয়েও আমার খেয়াল রাখছেন। এতে মন কিছু টা ভালো হয়ে গেল। শুভ ভাই বলেছিলো আদ্র ভাইয়ের ঘুম ভাঙলে তাকে ডাকতে। আদ্র ভাইকে একবার ঠিক করে দেখে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

——

শুভ ভাই আদ্র ভাইয়ের চেকআপ করছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। চেক আপ শেষে শুভ ভাই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে বলল,
“ওকে ফ্রেশ করিয়ে খাবার খাইয়ের ওষুধ গুলো ঠিক মতো দিয়ে দিবেন”

নার্স মাথা নেড়ে সায় জানালো। আমি চোখ ছোটো ছোটো করে শুভ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি থাকতে আমার আদ্র ভাইকে অন্য কেউ ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দিবে সাহস কতো তার? শুভ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝতে পারলো। নার্স কে বলল,
“থাক আপনার কিছু করা লাগবে না। আপনি শুধু ওকে পেসেন্ট এর ওষুধ গুলো বুঝিয়ে দেন তাহলেই হবে”

নার্স আমাকে আদ্র ভাইয়ের ওষুধের টাইম, কখন কোনটা খাওয়াতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। শুভ ভাই ও চলে গেলেন। তার রাউন্ডে যেতে হবে। আমি সাবধানে আদ্র ভাইকে ফ্রেশ করিয়ে তার জন্য সুপ নিয়ে এলাম। উনার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে মুখের সামনে চামচে করে সুপ ধরলাম। তবে আদ্র ভাই মুখ খুলছেন না। কেমন অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
“কি সমস্যা হা করছেন না কেন? আপনার ওষুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি মুখ খুলুন”

আদ্র ভাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। উনি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তার মুখে চামচ পুড়ে দিলাম। আদ্র ভাই কিছু বলার চেষ্টা করছে আমি তাকে কোনো সুযোগই দিচ্ছি না। সুপ শেষ হলে ওষুধ খাইয়ে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলাম। আদ্র ভাইকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না।
——

ক্লান্ত শরীরে কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখে শরীর এলিয়ে দিলাম। পরপর চারটা ক্লাস করে অবস্থা খারাপ। ঘাড় ব্যথা করছে। ফুপ্পি পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্লান্ত লাগছে? ক্লাস শেষ করে বাড়ি গেলেই তো পারতি। একেবারে খেয়ে দেয়ে রেস্ট নিয়ে আসতি”

“আমার কথা বাদ দাও তো। তোমার ছেলে খাবার খেয়েছো?”

“হ্যাঁ মাত্র খাওয়ালাম”

“ওষুধ দিয়েছো?”

“না। দিতে যাচ্ছিলাম তুই চলে এলি”

“ঠিক আছে। তুমি বসো আমি দিয়ে দিচ্ছি”

আদ্র ভাই হসপিটালে আছে দুই দিন হয়ে গেল। এখন উনার অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। বিগত দুই দিনে আদ্র ভাইয়ের কাছেই ছিলাম আমি আর শুভ ভাই। ক্লাস শেষ করে সোজা এখানে চলে আসতাম। তাই রুদ্র ভাই এসে আমার আর শুভ ভাইয়ের খাবার দিয়ে যেত। সারাদিন এখানেই আমার কেটে যেত। হাইপাওয়ারের ওষুধে দেওয়ায় আদ্র ভাই খাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমের দেশে হারিয়ে যেত। আর আমি এক ধ্যানে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই মানুষটার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো? ভাবলেই বুকে হাহাকার নামে আসে। দম আটকে যায়। কি জঘন্য সেই অনুভূতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদ্র ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। তিনি করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার কি? কথা বলবো না উনার সাথে। রাগ করেছি। রাগের চেয়েও অভিমানে মাত্রা বেশি। বিগত দুই দিন ধরে আদ্র ভাই আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও আমি তার সাথে কথা বলিনি। কেন বলবো উনার সাথে কথা? আদ্র ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দিতেই কিছুক্ষনের মাঝে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। শরীর ক্লান্ত থাকায় ধপ করে সোফায় ফুপ্পির পাশে বসে পড়লাম। ফুপ্পির ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছি। ফুপ্পি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“রোদ সোনা আমার কথাটা শোন। তুই বাসায় যা। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে রেস্ট নিয়ে আয়। আদ্রর কাছে আমি আছি। আর এমনিতেও ও তো ঘুমাচ্ছে”

“আমার কথা বাদ দাও। আমি ঠিক আছি”

“তুই যাবি নাকি না? আমি কিন্তু এখন তোর ওপর রাগ করবো। যা রেস্ট নেওয়া লাগবে না। তুই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আয়। ভাবি তোর জন্য চিন্তা করছে”

ফুপ্পি অনেক করে রিকোয়েস্ট করছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় যাবো। যাওয়ার আগে ফুপ্পিকে বললাম,
“তোমার ছেলেকে দেখে রেখো। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি”

ফুপ্পি হাসতে হাসতে বলল,
“তুই যা পা*গলী মেয়ে। আমি আছি”

বাসায় ঢুকতেই সামনে পড়লো রোশনি। আমায় দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চেঁ*চিয়ে উঠলো।
“আম্মু, বড় আম্মু, মেঝ আম্মু দেখে যাও কে এসেছে”

আমি এসেছি এতে সবাইকে ডাকার কি দরকার? আম্মুরা ছুটে এলো রান্না ঘর থেকে। বড় আম্মু গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“অবশেষে এলি তুই?”

“হ্যাঁ। এখন রুমে যেতে দাও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে হসপিটালে যেতে হবে”

ওদের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে চলে এলাম। এক সেট কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। টেবিলে বসতে বসতে হাক ছাড়লাম,
“আম্মু তাড়াতাড়ি খাবার দাও আমায় হসপিটালে যেতে হবে”

আম্মু খাবার বেড়ে দিলো। ঝটপট খেয়ে রুমে আসে বিছানায় বসলাম। শরীর ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম।
——

গোধূলি লগ্ন স্বল্প হিলেম হাওয়া বইছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে পশ্চিমে। আকাশে স্বল্প মেঘেদের আনাগোনা। আদ্র ভাইয়ের পাশে বসে রয়েছি। বসে রয়েছি বললে ভুল হবে উনি আমায় বসিয়ে রেখেছে। আমার হাত ধরে আটকে দিয়েছে। উঠতেও পারছি না। বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে জানি না। ঘুম ভাঙলো বিকেল নাগাদ। উঠে কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আম্মুকে বললাম,
“আমি ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। তোমরা আমায় ডেকে দাওনি কেন?”

“আমি ডাকতে বারণ করেছি তাই”

সোফায় বসে শুভ ভাই উত্তর দিলেন। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন?”

“তোর রেস্ট দরকার আছে। বিগত দুই দিনে যেভাবে আদ্রর সেবা করছিস দেখা যাবে কখন তুই নিজে অসুস্থ হয়ে যাস। তাই আমি মেঝ আম্মুকে ডাকতে বারণ করেছি”

শুভ ভাই উঠে পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বলল,
“আমি তোর জন্য বসেছিলাম। এখন চল দুই ভাইবোন মিলে একসাথে যাই”

দুজন একসাথে আদ্র ভাইয়ের কেবিনে ঢুকলাম। আদ্র ভাই আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। ফুপ্পি আদ্র ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন । উনিও বসে বসে মায়ের আদর খাচ্ছেন। শুভ ভাই আদ্র ভাইয়ের চেকাপ করে চলে গেলেন। ফুপ্পি উঠতে উঠতে বলল,
“তুই ওর কাছে থাক আমি একটু বাসায় যাই”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ফুপ্পি চলে গেল। আমি আদ্র ভাইয়ের বেডের পাশে রাখা প্রেসক্রিপশন নিতে হাত বাড়াতেই আদ্র ভাই খপ করে হাত ধরে ফেলল। আমি উনার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। চোখ নামিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে পারছি না। বাধ্য হয়ে মুখ খুললাম,
“হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়ুন”

“কি সমস্যা তোর? কথা বলছিস না কেন আমার সাথে? আর আপনি আপনিই বা করছিস কেন?”

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কথা বলবো না ওনার সাথে। আদ্র ভাই থুতনি ধরে আমায় তার দিকে ফিরালেন।
“কি হলো কথা বল”

“কথা বলবো না তোমার সাথে”

“কেন? আমি কি করেছি?”

“তুমি নিষ্ঠুর মানুষ। তোমার সাথে কথা নেই। তুমি একবার ভেবেছো তোমার কিছু হলে আমার কি হতো? পা*গল হয়ে যেতাম আমি। যখন শুনলাম তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে তখন আমার মাঝে কি ঝড় বইছিলো জানো তুমি? তোমার নিস্প্রাণ চেহারা দেখে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। হাহাকার কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো আমায়। তোমার এই অবস্থা দেখে পা*গল প্রায় হয়ে দিয়েছিলাম। আমি যেন নিজের মাঝে ছিলাম না। তুমি আমার কথা একটুও ভাবো না আদ্র ভাই, একটুও না”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্না করে দিলাম। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। অবলীলায় গড়িয়ে পড়ছে। কান্না করতে করতে এক সময় হামলে পড়লাম আদ্র ভাইয়ের বুকে। আদ্র ভাই আমায় আগলে নিলেন তার বুকের সাথে। আমি কেঁদেই চলেছি। থামাথামির নাম নেই। আদ্র ভাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আবেশে।
“বিশ্বাস কর রৌদ্রময়ী সেদিন কি থেকে কিছু হয়ে গেল আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। রাতে তোর সাথে কথা হওয়ার পর মনে শান্তি পাচ্ছিলাম। তোকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। সারারাত চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারিনি। সকালে অফিসে গিয়েও শান্তি মিলেনি। ভেবেছিলাম হয়তো আমিই বেশি বেশি ভাবছি। তাই আমার এমন মনে হচ্ছে।কাজের মাঝে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি পারিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তোর সাথে দেখা করবো। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তোর টেনশনে অমনোযোগী থাকায় কখন যে সামনে এক খাম্বা এসে পড়েছে আমি নিজেও খেয়াল করিনি। চোখ বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে তোর আর আম্মুর মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগছিলো ‘তবে কি আমি ম*রে যাচ্ছি’। একটু একটু করে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হাত বাড়িয়েও কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না”

আদ্র ভাইয়ের মুখে হাত রেখে বললাম,
“ভুলেও ম*রার কথা মুখে আনবে না। নাহলে আমি নিজে তোমায় খু*ন করে ফেলবো”

“রৌদ্রময়ীর হাতে খু*ন হতে পারলে যে আমি ধন্য হয়ে যাবো”

আমি চোখ রাঙিয়ে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আদ্র ভাই মুখে আঙ্গুল দিয়ে বললেন,
“রাগ করছিস কেন? এমনি বলছিলাম আরকি”

কিছু বললাম না। নিঃশব্দে মিশে রইলাম তার বুকের সাথে। এতদিনে বোধ হয় একটু শান্তি খুঁজে পেলাম। এই গোটা মানুষটাই তো আমার মানসিক শান্তির জায়গা। আমার ‘ভালোবাসা’। হ্যাঁ, আদ্র ভাই আমার ভালোবাসা। এই কয়েকদিনে আমি এটা বুঝে ফেলেছি আদ্র নামক মানুষটাকে ভালোবাসে ফেলেছি। তাকে ছাড়া আমার চলা সম্ভব না। আমার তাকে চাই, সব সময়ের জন্য চাই। আমার ভালো থাকার জন্য হলেও উনাকে আমার চাই। আদ্র ভাই ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
“ভালোবাসি রৌদ্রময়ী”

#চলবে?

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৬
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

গোধূলি বিকেলে স্বল্প মেঘেদের আনাগোনা। হিমেল হাওয়া মুহূর্তেই এক রাশ ভালো লাগা ছুঁয়ে দেয় মনের কোণে। উষ্ণ আলিঙ্গনের আবেশে জড়িয়ে রয়েছি একে অপরের সাথে। চোখ বুঝে দুজন দুজনকে অনুভব করছি। এ যেন বহুদিনের জমিয়ে রাখা তৃষ্ণা। এভাবেই নিবিড় আলিঙ্গনে কতটা সময় চলে গেছে তার খেয়াল কারোই নেই। হটাৎ কেউ কেবিনের দরজার নক করতেই হুস এলো। আদ্র ভাইকে ছেড়ে দূরে সরে গেলাম। শুভ ভাই ভিতরে ঢুকলো। সোফায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন লাগছে আদ্র? ওষুধ ঠিক মতো খাচ্ছিস? বেটার ফিল হচ্ছে?”

আদ্র ভাই সম্মতি জানিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ আগের চেয়ে বেটার”

“বেটার তো হবেই। কেউ একজন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে যে তোর সেবায় মগ্ন ছিলো। সুস্থ না হয়ে যাবি কোথায় বল? তুই সুস্থ না হলে যে তার সকল পরিশ্রম বৃথা যেত। তার জন্য হলেও তোকে সুস্থ হতে হতো”

“এটা ঠিক বলেছো। তার জন্যই তো আমায় এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হলো। নাহলে ভেবেছিলাম কয়েকদিন সবার সেবা যত্ন নিবো। তা আর হলো কই”

আদ্র ভাই আর শুভ ভাইয়ের কথা শুনে লজ্জা লাগছে। দুজন মিলে যে আমার লেগপুল করছে এটা তো বুঝতেই পারছি। এই আদ্র ভাই একটা যাচ্ছে তাই। সাথে যোগ দিয়েছে শুভ ভাই। মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। সেদিন যখন আদ্র ভাইয়ের হাত ধরে আহাজারি করছিলাম তখন পিছন থেকে হটাৎ কেউ কাঁধে হাত রাখলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি শুভ ভাই। শুভ ভাইয়ের চোখে প্ৰশ্ন। অতঃপর শুভ ভাই জিজ্ঞেস করেই বসলো,
“ভালোবাসিস আদ্রকে?”

হটাৎ এভাবে শুভ ভাইকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। তার প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষন নিরুত্তর রইলাম। শুভ ভাই আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”

মনের মাঝে দোটানায় ভুগছি। সত্যিই কি আমি আদ্র ভাইকে ভালোবাসি? নাকি বাসি না? শুভ ভাইয়ের সামনেই বা কিভাবে বলবো? কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মনের মাঝের সকল দোটানা দূর করলাম। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সাহস জুগিয়ে বলেই দিলাম,
“হ্যাঁ! আমি ভালোবাসি আদ্র ভাইকে”

শুভ ভাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো ভাবতে পারেনি আমার উত্তর ইতিবাচক হবে। নিজেকে স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করলো,
“আদ্র জানে?”

মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম,
“না”

এরপর কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে র্নিরবতা বিরাজ করলো। দুজনেই নিশ্চুপ। শুভ ভাই বলল,
“একটা কথা বলি শোন, আদ্র তোকে অনেক ভালোবাসে। ওর কিশোর বয়সের ভালোবাসা তুই। যেই বয়সে ছেলেরা প্রতিদিন নতুন নতুন রমণীর প্রেমে পড়ে সেই বয়সের ছেলেটা তোর প্রেমে পড়েছে বারবার। তোর মনে ওর জন্য অনুভূতি নেই জেনেও ও তোকে পা*গলের মতো ভালোবেসে গেছে। প্রতিদানে কিছুই চায়নি। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যাকে বলে। সেই কিশোর বয়স থেকে ভালোবেসে গেছে, এখনো ভালোবাসে। আমি নিজে ওর চোখে তোর জন্য আকাশ সম ভালোবাসা দেখেছি। তোর জন্য ওর হাহাকার দেখেছি। তাই ভাই হিসেবে বলবো ওকে হারাতে দিস না। অবহেলা করিস না। ভালোবেসে আগলে রাখিস”

আমি মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে শুভ ভাইয়ের কথা শুনছি। নিজেকে বড্ড বোকা আর অভাগিনী মনে হচ্ছে। সবাই জানে তার ভালোবাসার কথা আর আমিই কিনা বুঝতে পারলাম না। কেন পারলাম না? শুরুতেই যদি তার ভালোবাসা বুঝতে পারতাম তাহলে জীবন অনেকটা সুন্দর হতো। খারাপ লাগছে আদ্র ভাইয়ের জন্য। মানুষটা কতোটাই না কষ্ট সহ্য করেছে। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষ কে অন্য কাউকে ভালোবাসতে দেখার অনুভূতি যে জঘন্য। নিজের ভালোবাসার মানুষেই চোখে অন্য কারো জন্য ভালোবাসা দেখা বড্ড কষ্টকর। আমি তো পারবো না সহ্য করতে। শেষ হয়ে যাবো তিলে তিলে। আদ্র ভাইয়ের কথা ভেবে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। শুভ ভাই আরো কিছু কথা বলে চলে গেল। আদ্র ভাইয়ের হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নিলাম। আমি প্রতিবার এই মানুষটার ভালোবাসার কথা শুনে মুগ্ধ হই। প্রেমে পড়ে যাই তার। মানুষ এভাবেও কাউকে ভালোবাসতে পারে?
——-

মাঝে কেটে গেছে আরো কয়েকটা দিন। আদ্র ভাই এখন প্রায় সুস্থ। গতকাল বিকেলে উনাকে বাসায় নিয়ে আশা হয়েছে। ফুপ্পি আদ্র ভাইকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেও বড় আব্বু যেতে বারণ করেছে। ওই বাড়িতে দিনে ফুপ্পি আর আরু থাকে। ফুফা চলে যায় অফিসে। আরু চলে যায় কলেজে। পুরো বাড়ি সামলে আদ্র ভাইয়ের সেবা করতে গিয়ে ফুপ্পি হিমশিম খেয়ে যাবে। তাই ওদের আমাদের বাড়িতেই রাখা হয়েছে। আমার আর শুভ ভাইয়ের মাঝের রুমটা আদ্র ভাইকে দেওয়া হয়েছে। আদ্র ভাইয়ের দেখাশোনা ফুপ্পি আম্মু এদের চেয়ে আমিই বেশি করি। বাসায় থাকা কালীন পুরোটা সময় তার আশেপাশেই আমার কেটে যায়। উনাকে একা ছাড়তেও ভয় হয় যদি তার কিছ প্রয়োজন পরে। কেউ না কেউ সব সময় আদ্র ভাইয়ের কাছেই থাকে।

মেডিকেল থেকে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে সোজা আদ্র ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম। ফুপ্পি আদ্র ভাইয়ের পাশে বসে আছে। মা ছেলে মিলে গল্প করছে। আদ্র ভাইয়ের সাথে ফুপ্পি বন্ডিং টা খুবই ভালো। একদম বন্ধুর মতো।
“ফুপ্পি তোমার ছেলে কেমন আছে? সব ঠিকঠাক তো?”

“তুই নিজেরই দেখে নে”

আদ্র ভাই বলল,
“তোমরা আমাকে নিয়ে যা শুরু করেছো মনে হচ্ছে আমি মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত। আরে বাবা আমি এখন ঠিক আছি। অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছি”

আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে ফুপ্পি চোখ রাঙিয়ে তাকালো। আদ্র ভাই চুপ হয়ে গেলেন। ফুপ্পি সামনে যে তার জারি জুড়ি চলবে না এটা উনি ভালো করেই জানেন।
“ফুপ্পি তোমার ছেলে দুপুরের খাবার খেয়েছে? ওষুধ দিয়েছো তাকে?”

আমার কথা শুনে ফুপ্পি মাথায় হাত দিলো। জিভ কেটে বলল,
“দেখলি আমি কি মন ভুলো? এসেছিলাম ওকে খাবার খাওয়াতে। এরপর মা ছেলে মিলে গল্প করা শুরু করলাম খাওয়ানের কথা বেমালুম ভুলে গেছি”

ফুপ্পি কথা গুলো বলে বিছানায় পাশে টেবিলে রাখা খাবার হাতে নিলো। এমন সময় নিচ থেকে আরুর ডাক। আরু ফুপ্পিকে অনবরত ডেকেই চলেছে।
“আম্মু তোমার মেয়ের আবার কি হলো? এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে কেন? তুমি যাও ওর কাছে”

“তোকে খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছি”

“তুমি যাও আমি খেয়ে নিব”

“তুই খেতে পারবি না”

আমি ফট করে বলে উঠলাম,
“ফুপ্পি তুমি যাও। আমি খাইয়ে দিচ্ছি”

“তুই সবে মাত্র এলি, ফ্রেশও হোস নি”

“আরে সমস্যা নেই। তুমি যাও”

ফুপ্পি চলে গেল। হাত ধুয়ে এসে খাবারের প্লেট নিয়ে বসেছি। খাবার মাখিয়ে আদ্র ভাইয়ের মুখের সামনে ধরলাম। আদ্র ভাই আমার দিকে কেমন করে চেয়ে আছে।
“কি হলো ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? হা করো”

“দেখছি”

“কি?”

“নতুন রূপে নতুন রৌদ্রময়ীকে”

“মানে?”

“যেই মেয়ে অলসতায় খাইয়ে না দিলে খায় না। ঠিক মতো নিজের যত্ন নেয় না। তার যত্ন নেওয়ার জন্য কাউকে না কাউকে লাগে। সে কি সুন্দর করে আমার খেয়াল রাখছে। আমার সেবা করছে। যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে। এ যেন তার নতুন রূপ আমার কাছে”

“কথা না বাড়িয়ে হা করো তো”

আদ্র ভাই হা করতেই মুখে খাবার পুরে দিলাম। আমি উনাকে খাইয়ে দিচ্ছি আর উনি আমার দিকে তাকিয়ে খাচ্ছেন। বিষয়টা কেমন লজ্জার লাগছে এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়ানো যায়? আদ্র ভাইয়ের মুখে খাবার দিতে গেলে ওনার ঠোঁটের সাথে হাতের স্পর্শ লাগলো। মুহূর্তেই শিউরে উঠলাম। শিরদাড়া বেয়ে শীতলতা ছেয়ে গেল।মনের মাঝে অদ্ভুত এক অনুভূতি। আদ্র ভাই খাওয়ার মাঝে আঙুলের ডগায় কামড় বসেচ্ছেন। উনি যে ইচ্ছে করে এমনটা করছেন বুঝতে পারছি। চোখ রাঙিয়ে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ওনার কোনো হেলদোল নেই। উনি ওনার ভাবে আছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু। কিছুই বোঝে না। খাওয়ানো শেষ করে উঠে যাবো এমন সময় আদ্র ভাই ওড়নার কোণ টেনে ধরলেন। পিছু ফিরে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি?”

“রৌদ্রময়ীর এতো সেবা যত্ন পাবো জানলে আমি সেই কবেই অসুস্থ হয়ে বসে থাকতাম। তার আমার প্রতি আকুলতা, যত্ন, টেনশন দেখার জন্য হলেও এই এক্সিডেন্ট টা হওয়ার দরকার ছিলো”

আমি চোখ রাঙিয়ে উনার দিকে তাকালাম। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তার এই অবস্থায় আমি দিশেহারা আর উনি কিনা নিজে নিজে অসুস্থ হতে চাচ্ছে। ইচ্ছে করছে উনার মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। খেয়াল হলো ওনার তো আগে থেকেই মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো। থাক আপাদত এই চিন্তা বাদ। আদ্র ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে নিজের রুমে এলাম।
——

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটু একটু করে চারপাশ থেকে আলো বিলীন হয়ে ছেয়ে যাচ্ছে অন্ধকার আঁধারে। এই আলো ছায়ার খেলা দেখতেও নিদারুন সুন্দর। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আশপাশ দেখছি। কিছুই ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে আড্ডা দিতে। যেই ভবা সেই কাজ। রুম থেকে বেরিয়ে ইভার রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। মাঝে উঁকি দিলাম আদ্র ভাইয়ের রুমে। আদ্র ভাই ঘুমাচ্ছেন। ঢুকে পড়লাম তার রুমে। একটা মানুষ ঘুমালেও তাকে কেন এতটা সুন্দর লাগতে হবে? আদ্র ভাইয়ের চোখের পাপড়ি গুলো বড্ড সুন্দর। ঘন বড় বড় পাপড়ি। কালো মিচমিচে ভ্রু জোড়া। দেখে মনে হয় ভ্রু প্লাগ করা। একটা ছেলের ভ্রু কেন এতো সুন্দর হবে ভাই? আমরা মেয়েরা ভ্রু প্লাগ করেও ভ্রু ঠিক করতে পারি না আর ওনার ভ্রু এমনিই এতটা সুন্দর। আদ্র ভাইয়ের মুখের ওপর এক গোছা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। হটাৎ ইচ্ছে হলো আদ্র ভাইয়ের চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে। উনার পাশে বসে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলাম তার সিল্কি সিল্কি চুল গুলো। কিছুক্ষণ আদ্র ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে এলাম। ইভার রুমে আসতেই দেখতে পেলাম ইভা রানী কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। কাছে যেয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কার সাথে ও এভাবে হেসে হেসে কথা বলছে। ওর মুখ থেকে হাসি যেন সরছেই না । মনে সন্দেহ জাগলো। ইভা ইদানিং আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না। ক্লাসে সারাদিন পাশের বেঞ্চে বসা তিয়াসের সাথে সারাদিন কি যেন গুজুর গুজুর করতেই থাকে। কান বাড়িয়ে শুনার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
“কিরে বনু কার সাথে কথা বলছিস?”

আমার শব্দ পেয়ে ইভা যেন চমকে গেল। তড়িৎ গতিতে পিছু ফিরলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে আমতা আমতা করছে।
“কি হলো বল কার সাথে কথা বলছিলি?”

“ফ্রেন্ড”

“ফ্রেন্ড? নাম বল”

“তুই চিনবি না”

“তোর এমন কোন ফ্রেন্ড আছে যার নাম আমি জানি না”

ইভা কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উঁকি মেরে দেখে নিলাম নাম্বার টা। আমার ধারণাই ঠিক হলো। ইভা পিয়াসের সাথে কথা বলছিলো। আমায় না জানিয়েছি প্রেম করা হচ্ছে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। ইভা মিনিমিন করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছ বলবি?”

“হ্যাঁ। আসলে বড় আম্মু আমাকে পাঠিয়েছিলো তোকে ডাকার জন্য। রিহান ভাই নাকি তোকে কল দিচ্ছে তুই রাগ করে তার কল রিসিভ করছিস না। বেচারা তার হবু বউয়ের টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে”

“রিহান, হবু বউ এগুলো কি বলছিস?”

“ছি! ছি! রাগ করেছিস ভালো কথা তাই বলে হবু জামাইকেই অস্বীকার করবি? এটা কোনো কথা বল। বেচারা রিহান ভাই। আমার তার জন্য আফসোস হচ্ছে”

ইভা অবাক চানিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারি নিশ্চই কিছু বুঝতে পারছে না। ততক্ষনে ফোন কেটে গেছে। আমি ইভাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি বনু কিছু বুঝতে পারছিস না?”

ইভা মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝালো। আমি ওকে চোখ টিপ দিয়ে বললাম,
“আমায় না জানিয়ে প্রেম করবি ভেবেছিস? সেটা কোনো দিনও হবে না। তাই প্রেম হওয়ার আগেই ব্রেকাপ করিয়ে দিলাম”

ইভা একটু সময় নিয়ে বুঝতেই চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“রোদের বাচ্চা”

#চলবে?