দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৭

0
3

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

শ্বশুর বাড়ির মধুর হাড়ি খেয়ে আমি আর মাহফুজ ফেনী চলে আসলাম। শাশুড়ী মা চেয়েছিলেন আরো দুটোদিন থাকি। কিন্তু দাদীমার কাছে শুনেছিলাম শ্বশুরবাড়ি মধুরহাড়ি তিনদিনপর ঝাঁটার বাড়ি। আমাকে যদিও উনারা প্রচুর আদর ভালোবাসা দিয়েছেন তারপরও আমার মনে হয় উনাদের আমার আরো একটু বুঝে নেওয়া দরকার। আম্মু বলতেন নিজের কাছের মানুষগুলোর পালস বুঝে চলতে পারলে জীবনের গতিপথ অনেক সহজ হয়। আসার সময় শাশুড়ী মা আমায় বললেন,
—-ফারাহ্ তোমার ব্যাংক একাউন্ট আলাদা করবে। কারণ স্ত্রী হিসাবে তোমার ভরণ পোষনের পুরো দায়িত্ব ইসলামী শরিয়ামতে মাহফুজের উপর বর্তায়। তাই তুমি চাকরি করলেও তোমার ভরণ পোষণ দেখভাল করা মাহফুজের কর্তব্য। সুতরাং তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী খরচপাতি করবে। বাধ্যতামুলকভাবে নয়।
শাশুড়ীমায়ের কথাগুলো শোনার পর আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। যদিও মাহফুজের সাথে আমার এ বিষয়ে আগেই কিছুটা বোঝাপড়া আছে। তারপরও শাশুড়ী মায়ের মতামত জানার জন্য বললাম,
—–মা, সংসারে খরচপাতি না করলে আপনার ছেলে যদি আমায় চাকরি করতে না দেয়?
—-কেন দিবে না? স্ত্রী হিসাবে তোমার দায়িত্ব স্বামীর খেয়াল রাখা। যেমন রান্না করা, ওর জিনিসগুলো ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে রাখা।
মনে মনে বললাম শাশুমা ঝামেলা তো ওখানেই বাঁধিয়ে রেখেছি। মাহফুজকে দিয়ে তো আমি ঘরের কাজও ফিফটি পার্সেন্ট করিয়ে নেই। এখন যদি স্বামী বেচারা আমার বেতনের ফিফটি পার্সেন্ট চেয়ে বসে তাহলে তো মহাক্যাঁচাল হবে। তখন অবশ্য শাশুমায়ের থিউরি এপ্লাই করে ফেলবো। আসলেই তো আমার ভরণ পোষনের পুরো দায়িত্ব তো মাহফুজের।

শাশুড়িমা আসার সময় গরুর মাংসের ঝাল কারি, রুই মাছের ভুনা, লইট্টা শুটকি, চ্যাপার ভর্তা প্যাকিং করে দিয়েছিলেন। আমার ননদও শাশুড়ী মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। এসব দেখে আমার জা আমাকে ডেকে এক ফাঁকে বললেন,
—-তোমার কপাল ভালো,মা তো হজ্জ্ব করে এসে অনেক ভালো হয়ে গিয়েছেন। আমি যখন বউ হয়ে এসেছি তখনকার মায়ের রুপ তো তোমার দেখা হয়নি। যাক অবশেষে নিজেকে যে পরিবর্তন করতে পেরেছেন এটাকে সাধুবাদ জানাই। আর আপু তো তোমার ননস হলেও আমার তো ননদ। উনি তো ছিলেন আর কাটি উপরে। এক মেয়ে হওয়াতে আদরের কমতি নাই।সবার মাথার শিরোমনি। আপুর যেহেতু আমার আগে বিয়ে হয়েছে তাই আমি আসার পর সবকিছুতে আমার সাথে তুলনা করতো।যেমন আপু কাজে কর্মে খুব পটু। কোনো কাজ করতে গেলে আপু এসে আমাকে শুধু পরামর্শ দিয়ে যাবে। আমি তখন ভালোমতো রাঁধতে পারতাম না। এজন্য শাশুড়ী মা বলতেন,”তোমার মা কি তোমাকে কিছুই শেখাননি। আমার মেয়েকে দেখো সবকিছু শিখেয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছি। কারো পক্ষে এতোটুকু ভুল ধরা সম্ভব নয়।”
আসলে আমি মাঝে মাঝে একটু গোলক ধাঁধার চত্বরে পড়ে যাই। কেননা আমার বিয়ের সময় ঢাকায় আমি যে কয়দিন ছিলাম মাকেই রান্না করতে দেখেছি। তারপর মা যেদিন আমার বিয়ের শাড়ি কিনেছিলো সেদিন ভাবির জন্য আমার শাড়ির দামের কাছাকাছি একটা মিরপুরের বেনারশী কাতান কিনে দিয়েছিলেন। ভাবির কথাগুলো আম্মুকে কিছুটা শেয়ার করেছিলাম। আম্মু বলেছিলেন,কার সাথে উনি কি ব্যবহার করেছেন সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তোমাকে যেহেতু উনি আদর ভালোবাসা দিয়ে আপন করতে চাইছেন তুমিও উনাকে ভালেবাসবে, শ্রদ্ধা করবে। একতরফা ভালোবাসা কখনও শান্তি বয়ে আনে না। ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসা দিতেও হয়। এজন্য আমি কারো কথাতেই কান দেই না। কারন আমি তো নিজেই সব দেখছি। এজন্য কে কি বললো সেটা আমার কাছে কোনো ম্যাটার করে না।
যাইহোক শাশুড়ী মা তরকারী রান্না করে দেওয়াতে আমার লাইফটা ইজি হলো। মাহফুজ আমাকে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গিয়েছে। আমি খালাকে ফোন দিয়ে এনে ঘরটা পরিস্কার করে নিলাম। দু,দিন না থাকাতে বেশ ধুলো পড়ে গিয়েছে। খালা চলে যাওয়ার পর ভাতটা রান্না করে নিলাম। যোহরের নামাজ আদায় করে মাহফুজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মাসখানিকের মধ্যেই আমার পোস্টিং হয়ে গেল। সপ্তাহখানিকের মধ্য জয়েনিং লেটারটা পৌঁছাতে হবে। জয়েন করার পর এক সপ্তাহ ছুটি পাওয়া যাবে। তখন আবার ফেনীতে এসে গরুর মাংস আর রুই মাছ ভুনা করে ফ্রীজে রাখতে হবে। না রাখলেও সমস্যা নেই। মাহফুজ ডাল,ডিমভাজি,সবজি ভালোই রান্না করতে পারে। রংপুর সরকারী সিটি কলেজে আমার পোস্টিং হয়েছে। মাহফুজ অবশ্য আব্বুকে ফেনীতে আমার পোস্টিং ব্যাপারে তদবীর করতে বলেছিলো। কিন্তু আমার বাবা হান্ড্রেড পার্সেন্ট অনেস্ট পারশন। উনি তো এসবের ধারে কাছে নেই। আর মাহফুজের চাকরি খুব বেশিদিন হয়নি। তাই ওরও পক্ষে তদবির করা সম্ভব হলো না। আমার অবশ্য এসব ব্যাপারে মাথা ব্যথা নেই। নতুন নতুন জায়গায় চাকরি করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সমস্যা হচ্ছে মাহফুজের। ওকে বউ ছাড়া থাকতে হবে। যাক ওকে ছুটি নিতে বলেছি। ঢাকায় যেতে হবে। আব্বুর ওখানে দু,দিন থেকে তারপর ওকে নিয়ে রংপুরে চলে যাবো।

অগত্যা ছুটি নিয়ে আমি আর মাহফুজ ঢাকায় রওয়ানা হলাম। আমার বাবা মায়ের বাসায় দু,দিন থেকে রংপুরে রওয়ানা হলাম। এই প্রথম আমি উত্তরবঙ্গের দিকে যাচ্ছি। নভেম্বর মাস। কলেজে ফোন দিয়ে জানলাম ওখানে নাকি ভালো ঠান্ডা পড়েছে। নাবিলের স্ক্যানিয়ার বাসে করে রাত এগারোটায় রওয়ানা দিলাম। যমুনা সেতু পার হবার সাথে সাথে কুয়াশার আস্তরণ গাড়ীর জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতে পেলাম। গাড়ির ভিতর থেকে বুঝা যাচ্ছে এখানে ভালোই শীত পড়েছে। মাঝখানে গাড়ি ফুড ভিলেজের সামনে থামালো। যাত্রীরা শরীর গরম করতে বাস থেকে নেমে চায়ের দোকানে ভীড় জমাতে লাগলো। আমি আর মাহফুজ দুটো মাটির কাপে চা নিয়ে এসে বাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাপে চুমুক দিয়ে উষ্ণতা খোঁজার চেষ্টা করছি। একটু পরে সুপার ভাইজার এসে দরজা খুলে দেওয়াতে সবাই গাড়িতে উঠতে শুরু করেছে। আমি আর মাহফুজ গাড়িতে উঠে কোমর থেকে পা পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলাম।

ভোর সাড়ে ছ,টায় আমরা রংপুর কামারপাড়া বাস স্টান্ডে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে সোজা সার্কিট হাউজে পৌঁছে গেলাম। নাস্তা করে ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে আমার কলেজের দিকে রওয়ানা হলাম। জয়েনিং লেটারটা জমা দিয়ে এক সপ্তাহের ছুটির দরখাস্ত জমা দিলাম। মাহফুজও আমার সাথে ছিলো। ঐ আমাকে ছুটি নিতে ইনসিস্ট করলো। আসলে এখানে যে প্রচন্ড শীত পড়েছে। সামবে নাকি আরো পড়বে। কম্বলটা সাথে করে নিয়ে এসেছি।তবে মনে হচ্ছে এতে শীত মানানো যাবে না। কুইল্টাও আনতে হবে। তারপর ডাকবাংলোতে একটা সরকারি ডরমেটরি ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম। আসলে মহিলা মানুষ আমি। তাই পাবলিক ঘরগুলো ভাড়া নিতে চাইছিলাম না। সিকিওরিটির বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। আমার কিছু কলিগ তিনজনে মিলে একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে বাস করছে। সেটাও মন্দ না। তবে কিছুদিন ডাকবাংলোতে থেকে চারপাশের পরিবেশটস বুঝা দরকার। যাইহোক ওর সাথে জাহাজ কোম্পানির মোড়ে গিয়ে একটা ইলেক্ট্রী চুল্লী সাথে কিছু হাড়ি পাতিল কড়াই থেকে শুরু করে ঝাড়ু পাপস বালতি সবই কিনলাম। মোটামুটি সব গুছিয়ে রেখে মাহফুজের সাথে ঢাকায় চলে আসলাম। আব্বু আম্মু দু,জনেই খুব খুশী। যদিও আব্বুর ইচ্ছা ছিলো আমি প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করি। আমার অবশ্য ভালো লাগে না। কারণ এখানে সিনিয়রদের খুব তৈল মর্দন করতে হয়। নিজের পরিচিত যারা চাকরি করছে তাদের কাছ থেকে শুনেছি। আর আমার ঘরের মানুষই তো আছে। সিনিয়ররা ফোন দিলে স্যার স্যার করতে করতে মুখে ফেনা তোলে। যাই হোক আব্বু আম্মুর খুশীতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমার ছোটো বোন সারাহ্ ঢাকা ভার্সিটিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সারাহ্ পিএইচডি করতে দেশের বাইরে চলে যাবে। যতটুকু জানি ওর সেরকমই প্লান। আর শাদাফের প্লান জানি না। বেচারা বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। একদিন থেকেই ফেনী চলে আসলাম।

আসার সময় আম্মু কিছু মাছ মাংস রান্না করে দিয়েছিলেন। তাই জার্ণির ধকল সামলাতে দু,দিন শুধু ঘুমালাম। আমাকে তো আবার চলে যেতে হবে। তাই ভাবলাম মাহফুজের জন্য কিছু রান্না করে রেখে যাই। এরপর মাহফুজের সাথে বাজার করতে গেলাম। মাহফুজ শাক, ছোটো মাছ কিনতে চাইছে। আমার অবশ্য ক্লান্ত থাকার কারনে এই মুহুর্তে এসব জিনিস কিনতে ইচ্ছা করছে না। তখন মাহফুজ একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—তুমি তো দু,দিন পর রংপুরে চলে যাবে। তখন তো আর এসব খাওয়ার জন্য বায়না করতে পারবো না।
আমারও মেজাজটা একটু খারাপ হলো। তাই ওকে বললাম,
—-এগুলো খেতে হয় যখন হাতে প্রচুর সময় থাকে।
—-তোমার কাছে নতুন শুনলাম।
—-শোনো, আমরা যখন ছোটো ছিলাম, তখন পরীক্ষা কিংবা পড়াশোনার চাপ থাকার সময় আব্বু এসব জিনিস আনলে আম্মু খুব রেগে যেতো। কারণ আমাদেরকে নিয়ে তখন আম্মুকে প্রচুর ব্যস্ত থাকতে হয়। স্কুলে আনা নেওয়া করা আবার কোচিং এ নিয়ে যাওয়া,এছাড়া জয়েন পরিবার হওয়াতে আমাদের বাসায় মেহমান অতিথি সবসময় লেগেই থাকতো। তাই আম্মুর কথা ছিলো এসব খুচরো খাবার খেতে ইচ্ছা হলে আব্বু যেন আগে থেকেই আম্মুর অনুমতি নেয়। হুটহাট করে এসব জিনিস ঘরে আনা যাবে না।
আমার কথা শুনে মাহফুজ খুব দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বললো,
—-আহা, আমার শ্বশুরের তো না জানি কতো কষ্ট হয়েছে। তবে আমার কাছে মনে হয়,মায়ের এটা একটু বাড়াবাড়ি ছিলো।
মনে মনে বললাম, চান্দু বাড়াবাড়ি ছিলো কিনা আজই তোমাকে বুঝিয়ে ছাড়বো। তখন আমি বললাম,
—তোমার নিতে ইচ্ছা হলে নাও। তবে শর্ত একটা এসব তোমাকে কুটে বেছে দিতে হবে। রান্না আর ধোয়ার দায়িত্ব আমার।
মাহফুজ খুশীতে ডগমগ হয়ে এককেজি পাঁচমিশালী ছোটো মাছ আর তিনমুটো লালশাক কিনলো। এরপর বাড়ি চলে এসে ওকে বললাম,
—–আমার মাথাটা ধরেছে। আমি একটু শুয়ে থাকি। তোমার মাছ আর শাক কুটা হলে আমাকে ডেকে দিও।

ও সানন্দে রাজি হলো। আমি এসে শুয়ে পড়লাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল এগারোটা বাজে। ভাবলাম ঘন্টাখানিক ঘুমিয়ে নেই। হঠাৎ দেখি আমার পাশে মাহফুজ শুয়ে আছে। আমি শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তোমার মাছ আর শাক কুটা হয়েছে?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুপুর একটা বাজে। ও একটু মন খারাপ করে বললো,
—-মাছ অর্ধেকটা কুটেছি। আর শাক শুধু একআটি বেছে রেখেছি।
—বাকি গুলো কি করেছো?
—-ফ্রীজে ঢুকিয়ে রেখেছি।
—-এবার বুঝেছো,আম্মু কেন আব্বুকে অনুমতি নিতে বলতো?
—-হুম,হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
আমি যদিও কাজের খালাকে ডেকে কুটিয় নিতে পারতাম। ইচ্ছে করেই ডাকিনি। ও নিজে করে এটার শ্রমটা আগে উপলব্ধি করুক। কারণ আমি আমার পরিচিতমহলে অনেক পুরুষ মানুষকে দেখেছি ঘরের বউকে যখন প্যারা দিতে মন চায় তখন তারা একগাদা ছোটো মাছ কিনে আনে। আর বউ বেচারার পুরোটা দিন এসব করতে গিয়ে আরাম আয়েশ সব মাথায় উঠে যায়। তাই আমি আগে থেকেই সাবধান। আর যাই হোক সাবধানের তো মার নেই।

চলবে