বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৯

0
37

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৯

মুর্শিদা বিরক্ত মুখে নিজের আলমারি থেকে শাড়ি আর কিছু গহনা বের করল। সকাল থেকে শুরু হয়েছে মানুষের আনাগোনা। এসব নতুন না। গ্রামে নতুন বউ আসবে আর দু- তিনদিন বাড়িতে বউ দেখার আমেজ থাকবে না, তা কি আর হয়। কিন্তু সমস্যা হয়েছে তার শ্বশুরকে নিয়ে। তিনি হঠাৎ করে সবার উপরে এতো বিরক্ত কেন? অবশ্য তাও ভালো কালকের মতো মুখের উপরে কিছু বলছে না। তবে হাবভাবে ঠিক বোঝাচ্ছে।

অথচ রাগ বিরক্ত হওয়ার কথা তার। তার বোনের মেয়ের সাথে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত ভাবে না হলেও, এই গুষ্টির ওই গুষ্টির সবাই জানতো। তবুও তিনি নিজের মর্জি খাটিয়েছেন। সেটা জোর দিয়ে না, বুদ্ধি দিয়ে। তিনি ভালো করেই জানতেন কেউ তাকে অসম্মান করবে না। আর এই সুযোগ’ই তিনি নিয়েছেন। এটা অবশ্য এ কয়দিন মনে হয়নি। কাল বাড়িতে আসার পর থেকে মুর্শিদার এরকমই মনে হচ্ছে। আর তখন থেকেই তার সব কিছু বিরক্ত লাগছে।

সে শাড়ি আর গহনা নিয়ে আজাদের রুমের দিকে গেল। এই মেয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছে সব কামিজ। বিয়ের পরে এই কামিজের কাম কি? আজাদকে বলে সব আনতে হবে। এই বাড়িতে ছেলেদের বিয়ে করিয়ে মেয়েদের বাড়ি থেকে যৌতুক তো দূরের কথা একটা সুতাও এই পর্যন্ত কেউ আনেনি। তারা যেমন এসেছে তাদের পরের পিড়িও সেভাবেই আসছে। অবশ্য তাদের শাশুড়ি সুযোগ পেলে তাদের কম কথা শোনাতো না। তবে শ্বশুরের সামনে সে থাকতো খুবই নম্র, ভদ্র হয়ে। স্বামীকে তিনি পীরের মতো ভজতেন। তবে মুর্শিদা অন্য সব ব্যাপারে যাই থাক, এই বিষয়ে কখনোও এমন কিছু করেনি। কেননা সে যৌতুকের ভারে পিষ্ট হওয়া তার নিজের বাবাকে দেখেছে। তাই তার বড় ছেলেকে বিয়ের আগেই সব গুছিয়ে বিয়ে করিয়েছে। আজাদের টায় আর সময় পেল কই?

আর এদিকে তার গুণধর ছেলে। বিয়ের কোন রং ঢং তিনি এই ছেলের মধ্যে দেখলেন না। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের মতো খেয়ে নিজের মতো বেরিয়ে গেল। রুমে যায় নি, কাপড়ও বাদলাই। কালকে যা গায়ে ছিল তাতেই বেরিয়ে গেছে। শুধু বেরিয়ে যাওয়ার আগে বিথীর মাথায় ঢেলে গেছে একগ্লাস পানি। বিথী হাত পা ছুড়ে শুরু করেছে চিৎকার। তিনি তখন একচোট চেঁচালেন। এই গরুর কানে গেছে কিনাও সন্দেহ।

মুর্শিদা সেই বিরক্ত মনে মনে চেপে রুমে পা রাখলো। আনতারার সামনে শাড়ি আর গহনা রাখল। রেখে চোখ তুলে তাকাতেই হায় হায় করে বলল, — তোমার নাক কানের ফোটা কই? এতো বড় মাইয়া হইছো নাক কান ফুঁড়াও নাই?

আনতারা তাকিয়ে রইল। মারুফা চাচি একবার এসেছিল। সেই সুই দেখে দিল এক চিৎকার। বাবা আর দেয়নি। মারুফা চাচি হেসে বলেছিল, — মেয়ে মানুষের নাক, কান ফুটা না করলে কেমন হইবো?

বাবা হেসে বলেছিল, — এমনিই হইবো। বিয়ে তো আর দিচ্ছিনা, তাই সমস্যা ও নেই। “ব্যস এর পরে আর ফুটো করা হয়ই নি।

মুর্শিদা বিরক্ত মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বাপ মরছে, এর মধ্যেই বিয়া। এই বাড়ির বেটারা সব বিদ্যার জাহাজ। কোন কিছুরে তারা গনায় ধরে না। গুরুদশা বলেওতো কথা আছে। গুরুদশার মধ্যে বিয়ে হলে জীবনে সুখ শান্তি থাকে না। কে বুঝাইবো এদের। সুখ, শান্তি না থাকলে রুপ ধুয়ে পানি খাইবো। তার মধ্যে নাক কান কিছুই ফুরাইনা নাই। তার ছেলের কপালে কি আছে একমাত্র আল্লাহই জানে।

সে বিরক্ত মুখেই আবার গয়না গাটি তুলে নিলো। নাক কানে ফুটোই নাই দিবো কিসে? শুধু হাতের চুড়ি আর গলার জন্য একটা মোটা চেইন রেখে সোহাগীর উদ্দশ্যে বলল ,– তোর করিমন চাচিরে আইতে ক। বউ মানুষ নাকে নাকফুল নাই। দেখতে কেমন দেখায়। সব জ্বালা আমার ঘাড়েই এসে পড়ে। বলতে বলতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন।

তখনি শবনম এলো। আনতারা অবশ্য সেই দিকে তাকালো না। সে তাকিয়ে রইল জানালা দিয়ে বাইরে। এই বাড়ির পেছনে একটা বড় পুকুর। দেখেই বোঝা যায়, কোন কাজে আসে না। পানা, টানা দিয়ে ভরপুর। আর আশে পাশে জঙ্গল, দেখার মতো কিছু নেই। তবুও সে, সেই জঙ্গলের দিকেই তাকিয়ে রইল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

— তুমি কাপড় পরতে পার?

আনতারা ঘুরে তাকালো। তার চোখ, মুখ শুকনো। এই আশে পাশের কোন কিছু যে তাকে ছুঁতে পারছে না, এই মানুষগুলো জানে না। তারা শুধু দেখছে নতুন বউ। নতুন বউয়ের রুপ, খুঁত আরো কত কি?

শবনম কাপড়ের ভাজ খুলছে। লাল টকটকে সুতির শাড়ি। সোনালি পাড়। আনতারা ভাবলেশহীন ভাবেই দু- সাইডে মাথা নাড়লো।

শবনম হেসে বলল,– সমস্যা নেই, আমি পরিয়ে দিচ্ছি। এই যে ব্লাউজ, ছায়া। পরে ফেল। এগুলো আমার! তোমার হবে না, তবে কাজ চলবে। এখনও তো তোমার জন্য কিছু কেনা হয়নি।

আনতারা কিছু বলল না। সে উঠে দাঁড়ালো। ব্লাউজ, ছায়া হাতে নিলো। এখানেই পরবে না অন্য কোথাও যাবে, সে বুঝতে পারল না।

শবনম বুঝলো! বুঝে হেসে ফেললো। হেসে এগিয়ে দরজা, জানালা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, — ছোট ভাইয়ের সম্পদে আমি ভাগ বসাবো না। নাও ঝটপট পর ।

আবসার এসে দেখলো আনতারা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বসে আছে। সে যতবারই তাকায় ততবারই তার বুক ধক করে উঠে। তার মনে হয় এটা আনতারা না,আনজুম। এখনি ঘুরে বলবে, — আর তো সহ্য করতে পারি না ভাইজান। আপনার রাইফেল দিয়ে এই মাথা বরাবর একটা গুলি করেন। আমি মুক্তি চাই।

সে বড় একটা শ্বাস ফেলে গলা খাঁকারি দিলো। দিয়ে ভেতরে আসলো। আসতেই আনতারা ফিরে তাকালো। এই অচেনা মানুষের ভিড়ে এই একটা মানুষকেই তার আপন মনে হলো। সে সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে উঠল।

আবসার এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো। মমতা মাখা হাত মাথায় রেখে বলল, — কি সমস্যা আমার বুবুর?

আনতারা কিছু বলল না। তবে তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।

আবসার হাসলো। হেসে বলল, — নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতে হয় বুবু।

আনতারা এবারো কিছু বলল না। তবে আবসারের হাত মাথায় থেকে টেনে তাতে ছোট বাচ্চার মতো মুখ গুজলো। তার ভালো লাগছে না। কিচ্ছু না। কোথায় গেলে মিলকে একটু শান্তি?

আবসার আবারো একটু হেসে বলল, — বাবার কথা মনে পড়ছে?

আনতার হাতে মুখ গুজেই উপর নিজে মাথা নাড়লো।
— কারো বাবা, মায়ই সারা জীবন বেঁচে থাকে না। আগে পরে সবাইকেই যেতে হবে। তোমার বাবার হায়েত এই পর্যন্তই ছিল। এটা যত তাড়াতাড়ি মানতে পারবে, কষ্ট ততই কম হবে। তাই তাদের জন্য না কেঁদে আল্লাহর দরবারে দু- হাত তুলে দোয়া কর বুবু। তোমার চোখের পানি তাদের কাছে পৌঁছাবে না । তবে তোমার দোয়া অবশ্যই পৌঁছাবে।

আনতারা আর কিছু বলল না। তবে আবসারের হাতও ছাড়ল না। আবসার হাসলো। রমিজ দরজার পাশেই দাঁড়ানো। তাকে ডেকে বলল, — কালকে বাসায় দোয়া পড়াবো, জাহিদের নামে। আহমাদকে সব ব্যবস্থা করতে বলো।

রমিজ শুনেই বেরুলো। বড় চাচাজান এখন কোথায় আছে কে জানে। এর দিনরাত যায় ছোট বাচ্চাগো মতো এখানে ওখানে টইটই করতে করতে ।

আজাদ ক্লিনিকে এসে দেখলো হইচই হচ্ছে। এটা নতুন না। বেশ কয়েকটা গ্রাম মিলে একটা সরকারি হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসা নেই বললেই চলে। স্বল্প মূল্যে মোটামুটি ভালো চিকিৎসা বলতে গেলে এখানেই। তার মধ্যে আজ রবিবার। রবিবারে ঢাকা থেকে মহিলা ডাক্তার আসে। আজকে আসতে পারেনি। তাই এসে সবাই গেঞ্জাম করছে।

গ্রামের মানুষ মা, বউ, মেয়েদের নিয়ে একটা রক্ষনশীল মনোভাব থাকে। হাজার সমস্যা থাকলেও ছেলে ডাক্তারের কাছে সহজে আনতে চায় না। তাই বাবা বিশেষ করে এই ডাক্তারটা আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশ্য এখন যে আছে সে আজাদের পরিচিত। তবুও খরচা একটু বেশি। রাস্তা -ঘাট না থাকায় এখানে ভালো কোন ডাক্তার আসতেই চায় না। তাই রাস্তা বাবদ সকল খরচ দিয়ে আনতে হয়। অবশ্য সব সময়ের জন্য ডিউটি ডাক্তার আছে। ডিউটি ডাক্তারের নাম পরিমল বাবু! তিনি হিন্দু, ক্লিনিকের পাশেই তার পরিবার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।

সে এগিয়ে গেল। তাকে দেখে এক ওয়ার্ড বয় বলল, — বিরাট ঝামেলা স্যার। দু- পক্ষের মারামারি। মাথা বরাবর কোপ। এখানে কাজ হবে না। শহরের দিকে নিতে হবে।

আজাদ লোকটাকে দেখলো। বেঁচে আছে না মারা গেছে বোঝার উপায় নেই। তার মধ্যে অবশ্য তেমন কোন ভাবান্তর হলো না। সরকারি হসপিটালের চেয়ে মোটামুটি ভালো চিকিৎসা হলেও,এখানে বড় কোন অপারেশন করা যায় না। সে রকম ব্যবস্থাও নেই। ব্যবস্থা করলেও এতো ভালো ডাক্তার পাবে কোথায়? নদী পেরিয়ে সারা দিন রাত কাবু করে কোন বড় ডাক্তার, কোন দুঃখে এই অজোপাড়া গায়ে আসবে।

সে পরিমল বাবুর কেবিনের দিকে গেল। পরিমল বাবুর বয়স ষাটের মতো। তিন মেয়ে তার। বড় দু- টো থাকে শ্বশুর বাড়ি। বাকি একটা আর স্ত্রী নিয়েই তার এখানের সংসার। তাকে দেখে এক গাল হেসে বলল, — কি খবর নতুন বর। শুনলাম আকাশের চাঁদ নাকি তুলে নিয়ে এসেছো?

আজাদ সব সময়ের মতো হাসলো! আকাশের চাঁদের ব্যাপারে সে কিছু বলল না। সে লোকটার ব্যাপারে জানতে চাইল।

পরিমল বাবু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষাদ মাখা কন্ঠে বলল, — বাঁচবে না। মাথা পুরো দু_ ভাগ। তাছাড়া অর্ধেক রক্ত বের হয়ে গেছে। বাকিটুকু ঢাকায় যেতে যেতে শেষ।

আজাদ চেয়ার টেনে বসলো! বসতে বসতে বলল — সবাইকে মরতে হবে। আমরা সবাই মৃত্যুর পথযাত্রী। তবুও আরেক জনের যাত্রা দেখলে এতো হায়, হুতাশ, বিষাদ। ব্যাপারটা আমার হাস্যকর মনে হয়।

পরিমল বাবু সিগারেট বের করে আজাদের দিকে এগিয়ে দিলো। দিতে দিতে বলল — তারটাও মনে হয় নাকি?
আজাদ সিগারেট নিলো। তবে কিছু বলল না। সে নির্বিকার ভাবে সিগারেট ধরালো।

— ব্রেইনের সাথে আরেকটা জিনিস আমাদের ভেতরে আছে। ব্রেইন দেখা গেলেও, সেটা বুক চিরে ফেললেও চোখে দেখতে পারবে না। তবে সেটার ক্ষমতা ব্রেইনের চেয়ে দশগুণ। সেটার কাছে কোন যুক্তি নেই। সেখানে শুধু আবেগ,ভালোবাসা । তাই এতো বিষাদ। তোমার নেই তো, তাই হাস্যকর মনে হয়।

আজাদ সিগারেটে লম্বা টান দিলো। তবে এবারো কিছু বলল না।

— তবে এই আবেগ, ভালোবাসা ছোঁয়াচে রোগের মতো। তোমার নেই তো কি হয়েছে, এমন একজন নিশ্চয়ই আসবে যার ছোঁয়ায় তোমার হ্নদয় থমকে যাবে। ব্রেইন কাজ করা বন্ধ করে দেবে।

আজাদ এবার হেসে ফেললো! পরিমল বাবুও হাসলেন। হেসে নিজে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, — এমনও হতে পারে সে অলরেডি এসে গেছে।

আজাদ ঘাড় কাত করে পরিমল বাবুর দিকে তাকালো। আগের মতোই হেসে বলল, — রক্ত, শরীর কাটা- ছেঁড়া করা মানুষের মুখে এসব কথা শোনাও হাস্যকর।

— হাস্যকর মনে হলে হাসো। তোমার জীবনে তো এই একটা জিনিসের অভাব কোনদিনও দেখিনি।

আজাদ আবারো হাসলো! এবার হো হো করা হাসি। হেসে বলল, — কখনোও দেখবেনও না কাকা।

— সময় বলবে। ভালো কথা ইব্রাহিম খলিল যে এসেছে শুনেছো?

আজাদ নির্বিকার ভাবে বলল, — হুম।

— সে নাকি এখানে আরেকটা ক্লিনিক খুলবে। এখনো অবশ্য সে ভাবে কিছু হয়নি। জমি দেখা হচ্ছে।

আজাদ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সে জানে। তবে কিছু বলল না।

— চেয়ারম্যানের লোকেরাই এই কাজ করেছে। লোকটার জমি ছিল। সে বিক্রি করবে না। অযথা গেঞ্জাম লাগিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করল।

— পুলিশ জানে?

— জানবে না কেন? তুমি আসার আগেই তো গেল এখান থেকে। ঈদের আগে ভালোই পকেট গরম হবে।

আজাদ মুক বাঁকিয়ে হাসলো ! হেসে বলল, — এই গ্রামে ক্লিনিক একটাই হয়েছে কাকা। আর সেটা আশা ক্লিনিক।

পরিমল বাবুও হাসলেন। হেসে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, — কথা সত্য ।

চলবে…….