বিষাদ_বৃক্ষ পর্ব-১৮

0
44

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৮

আজাদ ক্লিনিকে এসে দেখলো দুনিয়ার মানুষের সরগরম। হওয়ার’ই কথা। আজ রবিবার। ঢাকা থেকে ডাক্তার আসার কথা। ডাক্তারের নাম রাফিয়া সুলতানা। রাফিয়া এখানে আসছে এক বছরের মতো। আগে অন্য ডাক্তার ছিল। বয়স্ক মহিলা। তবে ডাক্তার হিসেবে খুবই ভালো ছিল। বয়স হয়েছে, এতো লম্বা সফর করতে পারে না বলে, সে নিজেই নিষেধ করেছে। রাফিয়া তার পরিচিত। তার এক বন্ধুর বোন। তখন ডাক্তারের খুব প্রয়োজন ছিল। তাই সে নিজেই বলেছিল। অবশ্য সে ভাবেনি রাজি হবে। কিন্তু তাকে অবাক করে সে রাজি হয়েছে এবং গত একবছর খুব ভালে নামও করেছে।

সে ভিড় ঠেলে যেতেই শুনল। ডাক্তার রোগী দেখছে না। গ্রামের মানুষ হট্টগোল করছে। বিরক্ত মুখে বলছে” না দেখলে বলে দিক। বসিয়ে রেখেছে কেন? আজাদ নিজেও বিরক্ত হলো। এ আবার কোন ঢং। সে বিরক্ত চেপে রাফিয়ার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।

কেবিনের সামনে রোগীদের সিরিয়াল। সবাইকে অনুরোধ করে বলল, — দুপুরের পরে আসেন। আমি দেখছে কি সমস্যা। সবাই সরতেই সে কেবিনে ঢুকলো। ঢুকতেই রাফিয়া ছলছলে চোখে তাকালো।

তার ছলছলে চোখে আজাদের মধ্যে অবশ্য তেমন ভাবান্তর হলো না। সে বিরক্ত চেপে বলল, — এভাবে রোগী বসিয়ে রাখার মানে কি?

রাফিয়া অন্য পাশে চোখ ফেরালো। ফেরাতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে ফিরিয়েই বলল, — শুনলাম বিয়ে করেছ।

আজাদ নির্বিকার ভাবে বলল, — হ্যাঁ!

— কিভাবে পারলে তুমি?

— যেভাবে সবাই পারে, সে ভাবেই।

রাফিয়া এবার ফিরে তাকালো। চোখ, মুখ কঠিন করে বলল, — আমি তোমার জন্যই এখানে এসেছিলাম আজাদ।

আজাদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার কপালে কয়েকটা বিরক্তির ভাজ স্পষ্ট। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে বলল, — কিন্তু যতদূর মনে পরে আমি এই ক্লিনিকের জন্যই তোমাকে এনেছিলাম। আর তার জন্য তোমাকে মোটা অঙ্কের একটা টাকাও দেওয়া হয়। তাহলে এতো কাহিনী কোথা থেকে আসছে আমার মাথায় ঢুকছে না।

রাফিয়া উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে আজাদের কলার চেপে ধরল। ধরে বলল, — এরকম মোটা অঙ্কের টাকা রাফিয়া তুড়ি বাজিয়েই কামাতে পারে। তার জন্য এই অজোপাড়া গায়ে পা মাড়াতে হত না।

আজাদ কলার ছাড়ালো না। রাফিয়ার হাতও স্পর্শ করল না। ঘাড় ঘুড়িয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিলো। তার ঠোঁটে কোণে অবজ্ঞার হাসি। সে হেসেই বলল,– অবশ্যই পার। সুন্দরী মেধাবী ডাক্তার। তার জন্য টাকা কামানো কোন বড় ব্যাপার না।

রাফিয়া কলার থেকে হাত সরিয়ে আদ্র কন্ঠ বলল, — আজাদ।

— মিথ্যা বলেছি?

— আমি তোমাকে ভালোবাসি আজাদ।

আজাদ বাঁকা হাসলো। হেসে বলল, — নিজের কাজে মন দাও রাফিয়া। এসব পাগলামীর কোন মানে হয় না। আর যদি করতে না চাও। তুমি স্বাচ্ছন্দে যেত পার। তবে যতক্ষণ এখানে আছ কাজ নিয়ে কোন টালবাহানা করবে না।

তখনি দরজায় টোকা পড়ল। রাফিয়া সরে দাঁড়ালো। চোখ মুখ মুছে অন্য পাশে তাকালো। আজাদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। খুলতেই রমিজ হন্তদন্ত হয়ে বলল — ভাই ছোট ভাবি অজ্ঞান হয়ে গেছে। মাথায় পানি টানি ঢালা শেষ। জ্ঞান তো আহেনা।

আজাদ প্রথমে বুঝল না। অবাক হয়ে বলল, — কি আসে না ?

— ভাবি বেহুশ হয়ে গেছে। করিমন চাচি নাকে দিলো সুঁই। সাথে সাথে দিলো এক চিৎকার। চিৎকার দিতে দিতেই শ্যাষ।

আজাদ ভ্রু কুঁচকালো। রাফিফার দিকে তাকিয়ে বলল, — আমার সাথে একটু যেতে হবে ।

রাফিয়া তার মতই বলল, — যদি না যাই।

আজাদ হেসে ফেললো! রাফিয়া নিশ্চুপ কিছুক্ষণ সেই হাসি দেখল। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলল।

আজাদ যখন রাফিয়াকে নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছালো তখন পানিতে উঠান ভেসে গেছে। এরা মাথায় পানি ঢালেনি বরং গোছল করিয়ে ফেলেছে। আজাদ এগিয়ে গেল।

বারান্দায় চুল ছড়িয়ে গোলাপি শাড়ি পরা মেয়েটাকে দেখে রাফিয়া থমকে গেল। কোথাও যেন ভেঙে চুরে নিস্তেজ হলো। নিজের সৌন্দর্য আর মেধা নিয়ে তার ছিল খুব অহংকার। এই অহংকারেই আজাদকে একদিন আঙুল তুলে বলেছিল, — তোমার মত ছেলের সাথে আমার যায়? অজোপাড়া গায়ের গেছো ভূত। আবেগী ছিলাম তাই আবেগে একটু ভুল করেছি। তাই বলে জীবন ভর টানতে হবে নাকি?

সেই থমকে যাওয়া মুখেই সে আজাদের দিকে তাকালো। সব সময় নির্বিকার থাকা আজাদ চোখে মুখে দুশ্চিন্তা নিয়ে মেয়েটা সামনে সে হাঁটু মুড়ে বসেছে। সে নিশ্বাস বন্ধ করেই দাঁড়িয়ে রইল।

আজাদ বসতেই করিমল চাচি বলল, — দেখো বাপু, আমার কোন দোষ নেই। দুনিয়ার মাইনষের নাক কান ফুটাইলাম। কোন সমস্যা নাই। আর এরে সুঁই ছোঁয়াতেই দিলো এক চিৎকার। যেন তেন চিৎকার নি। কানের পর্দা শেষ। কানের পর্দা ফাটাইয়া দপাস করে পড়ল। যেই পড়া পড়ল উঠার আর নাম গন্ধ নাই। এহন কিছু হইলে আমার গলায় পাড়া দিতে পারবা না। আমি আগেই কইলাম।

আজাদ এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এখন দেখলো। নাকে গোল করে সুতো বাঁধা। টকটকে লাল হয়ে আছে। তার হাসি পেল। এতো ভীতু এই মেয়ে। সে হেসেই পাঁজাকোলে তুলে নিলো। শাড়ি প্রায় অর্ধেক ভেজা। চুলে থেকে এখনো টপটপিয়ে পানি পড়ছে। সেই পানিতে আজাদের শার্টও ভিজে গেল।

মুর্শিদা বসে আছে বিরক্ত মুখে। যত ঢংয়ের ঢংঙ্গী সব তার ঘাড়ে এসেই পড়ে। বউ মানুষ নাক, কান ফুটা না থাকলে কেমন দেখায়? গ্রামের মানুষও যেই দেখে সেই বলে। তাই সে ভাবলো ঝামেলা শেষ হোক। তাই তো করিমনরে খবর দিয়ে আনলো। তাদের অত্র এলায় নাক, কান ফুরানোতে তার হাতই ভালো। এখন দেহো কি কান্ড। এক নাক ফুরাতে গিয়েই এই অবস্থা। বাকি দু- কান নিয়ে করবেটা কি? তাও ভালো তার শ্বশুর বাড়িত নাই। তা না হলে পুরো বাড়ি মাথায় করে নিয়ে নাচত। সে বিরক্ত মুখেই বলল, — চুলে গামছা পেঁচাইয়া ল। খাট, তোষক তো ভিজা শেষ হইবো।

আজাদ সে কথা শুনলো বলেও মনে হয় না। সে নিজের মতোই রুমে নিয়ে গেল। খাটে আস্তে করে শুইয়ে নিজেই মাথায় গামছা পেঁচালো। গায়ে কাঁথা টেনে শাড়ি যেটুকু ভেজা কাঁথার নিচে হাত দিয়ে আস্তে করে টেনে গা থেকে সরিয়ে রাখল। রেখে বাইরে আসলো।

ভাবি, মা রাফিয়ার সাথে কথা বলছে। রাফিয়াকে তারা চেনে। বেশ কয়েকবার এসেছেও এ বাড়িতে। সে কথার মাঝে আসতে বলল। সময় কম। দুপুরের পরে আবার তাকে রোগীও তো দেখতে হবে।

রাফিয়া চোখমুখ কঠিন করে আনতারাকে দেখলো। তেমন কিছু না। ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। নাকের জন্য শুধু হালকা পাতলা ওষুধ লিখলো। জ্বর আসতে পারে। সে কথাও বলল।

আনতারাকে দেখে সে এক সেকেন্ডও বসলো না। মুর্শিদা, শবনম থাকার জন্য অনেক বলল। সে রোগীর দোহাই দিয়ে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার শুধু আজাদের দিকে তাকালো। সে সব সময়ের মতো নির্বিকার দাঁড়ানো। শুধু বাড়ির এক কামলা কে ডেকে বলল, — ভালো ভাবে ম্যাডামকে ক্লিনিকে পৌঁচ্ছে দিতে।

আনতারা জ্ঞান ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই। জ্ঞান স্বাভাবিক ভাবে ফিরলেও, সে বসে আছে মুর্তির মতো। এমনিতেই সে কথা বলে মিহি সুরে। তার গলার শব্দ আরো কমে গেলে। তার এমন ভাব কথা বলতে গেলেও সে নাকে ব্যথা পাবে।

আবসার এসেছে সবে মাত্রই। রমিজ, আসাদকে নিয়ে সে গিয়েছিল পাশের গ্রামে। কামালউদ্দিনের বাড়িতে। তার উপরেই পুরো সংসারটা ছিল। এখন ভেসে যাবে। শুনেই আবসারের ভেতরটা ভেঙে এলো। দুনিয়াতে দিন দিন লোকসংখ্যা বাড়ছে। এই লোকসংখ্যার মাঝে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না কেন?

সে এসেই শুনলো। মুর্শিদা ভেবেছিল, নতুন নাটক দেখবে। তবে সেরকম কিছুই হলো না। আবসার আনতারাকে দেখে শান্ত ভাবে বলল, — এই দুনিয়াতে সবচেয়ে সাহসী কে জানো বুুবু? মেয়েরা। তারা সাহসী বলেই এই দুনিয়া এক পিরি থেকে আরেক পিরি যাচ্ছে। তা না হলে কবেই শেষ হয়ে যেত এই দুনিয়া। আর এটা তো সামান্য সুঁই। এউ সামান্য সুঁইয়ে কুপোকাত হলে চলবে?

আনতারা ঠোঁট ফোলালো! আবসার হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, — সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয় নেই।

আবসার যেতেই আজাদ হাসলো! হেসে বলল, — নানাভাইয়ের নাতনী খেয়ে ঔষুধ খান। ব্যথা কমে যাবে।

আনতারা উত্তর দিলো না। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না দমালো। তার অবস্থা কেউ বুঝল না। এই দুঃখ সে কোথায় রাখবে।

আজাদ নিজেই বেরিয়ে গেল। গিয়ে নিজেই খাবার নিয়ে এলো। আনতারার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, — আমি খারাপ মানুষ। এই খারাপ মানুষ কি আপনার পাশে বসতে পারে?

আনতারা অন্য পাশে তাকালো। তাকাতেই চোখ থেকে টুপ করে গাল বেয়ে পানি পড়ল। এ রকম অবস্থায়ও এই লোকটা তার মজা নিচ্ছে। আনতারারও ভেতর ভেঙে চুরে এলো। শুধু নাকের দুঃখে না। গত দুদিন সে নিচে ঘুমাচ্ছে। মশার কামড় খাচ্ছে। আর এই লোক আরামছে হাত- পা ছড়িয়ে খাটে ঘুমাচ্ছে।

আজাদ আনতারার সামনে বসলো। বসে বলল, — ঠিক হয়ে যাবে আপনার মহা মূল্যবান নাক। একবার ফাটিয়ে ডাক্তারখানা পর্যন্ত দৌড় লাগালো, আরেকবার ডাক্তারকে দৌড়ে বাড়িতে আনলো। আরো কত কিছু করাবে কে জানে। এবার খেয়ে দেয়ে শুধু একটা ব্যথার টেবলেট নিন । দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক।

আনতারা আগের মতোই কিছু বলল না। ফিরেও তাকালো না। আজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ফেলে বলল, — কি হয়েছে?

আনতারা এবারো কিছু বলল না। আজাদ হাসলো! হেসে নরম সুরে বলল, — আনতারা..

আনতারা সাথে সাথেই ফিরে তাকালো। তাকাতেই আজাদ বলল, — রাগ করে আছো কেন?

— আমি রাগ করিনি।

— তাহলে ডাকলে কথা বলো না কেন?

— আপনি ভালো মানুষ না ।

— তাহলে ভালো মানুষ কে? তোমার ইব্রাহিম নানা ভাই? দেখলাম তো। কথার খই ফুটেছিল।

আনতারা হা হয়ে তাকালো। কত খারাপ লোক। এমন বয়সি একটা লোককে নিয়ে কেমন বাজে কথা বলছে। তাছাড়া খই ফুটল কোথায়? লোকটা বাবার ছোট বেলার গল্প বলছিল। সে তো কখনো বাবার ব্যাপারে কিছু জানে না। তাই শুনতে এত ভালো লাগছিল। তাই কথা বলেছে।

— এভাবে হা করে বসে আছ কেন? তুমি জানো এভাবে হা করলে তোমাকে বোয়াল মাছের মত লাগে।

আনতারা সাথে সাথে মুখ বন্ধ করল। করে খাট থেকে নামতে চাইল। কোন দরকার নেই এরকম লোকের সাথে কথা বলার। আজাদ আনতারার হাত মুঠো করে ধরল।

আনতারা অবাক হয়ে তাকালো! সেই অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে আজাদ বলল, — কাছে যেতে চাইলে দোষ, দূরে থাকলেও দোষ। করবো টা কি?

আনতারা চোখ ফিরিয়ে নিলো। হাত ছাড়াতে চাইল। মুড়াতে মুড়াতে বলল, — কোনটাই না।

আজাদ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে বলল, — আমি খুবই নাদান মানুষ। যদি একটু বুঝিয়ে দিতে এই কোনটাই না কিভাবে করে।

আনতারা আবারো গাল ফুলিয়ে তাকালো। আজাদ মধ্যে অবশ্য এবারো কোন হেলদোল দেখা গেল না। তবে হাত ছাড়ল। ছেড়ে আনতারাকে আরেক দফা আবাক করে, উঠে এগিয়ে ধরাম করে দরজা লাগালো। লাগিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আবার আনতারার সামনে বসল। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে মাখতে মাখতে বলল, — জানোই তো খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষেরা আবার কখন কি করে ঠিক ঠিকানা নেই।

বলেই ঠেলে আনতারার মুখে ভাতের লোকমা ঢুকিয়ে দিল। আনতারা স্তব্ধ হয়ে আছে। একবার তার মুখ দিয়ে বেরুতে চাইলো। নানা ভাইকে সব বলে দিব। সাথে সাথেই সেই দিন রাতের কথা মনে পড়ল। পড়তেই সে লক্ষী মেয়ের মত সব ভাত খেল। খেয়ে ঔষুধও খেল। খেয়ে চুপচাপ কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়ল।

আজাদ হাসলো! হেসে বলল, — আজাদের তারা বেগমের আর কিছু লাগবে?

আনতারা কথাই বলল না। সে গাল, মুখ ফুলিয়ে পুরোপুরি কাঁথার ভেতরে ঢুকে গেল। গিয়ে হালকা করে নাকে হাত ছোঁয়ালো। ছোঁয়াতেই কুঁকিয়ে উঠল।

চলবে…..