বিষাদ_বৃক্ষ পর্ব-৩০

0
27

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩০

আনতারা নিজের হাতেই মিথিকে খাওয়ালো। সে ভেবেছিল মিথি জেদ করবে, রাগ দেখাবে। তবে সে তেমন কিছুই করেনি। আনতারা যখন খাবার সামনে নিল সে চুপচাপ খেল। খাইয়েই নিজেই হাত, মুখ ধোয়ালো, মাথা পরিপাটি করে বাঁধলো। একদিনেই মেয়েটার চেহেরা অন্য রকম লাগছে। আবার সে এক গাধামি করেছে। এসেছে এসেছেতো খালি হাতে। মিথির টুকটাক জামা কাপড় থেকে দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে আসার দরকার ছিল। তার গোবর মাথায় এসব কিছুই আসে নি। সে বাঁধতেই দরজায় টোকা পড়ল।

আনতারা নিজেই উঠল। দরজা সামনে যেতেই দেখল, জহির দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে জামা কাপড়। সে বাড়িয়ে বলল, — এগুলো আমার ছোট বোনের। আপাতত নিন আমি সব ব্যবস্থা করছি।

আনতারা কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল। তারপর তার স্বভাব মতো কোমল সুরে বলল, — মিথির জায়গায় যদি আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী বিথীই থাকতো তাহলে আজকে কি বিথীর জন্যও এমন ব্যবস্থা করতেন?

জহির চমকে উঠল! আনতারা উত্তরের জন্য তাঁকিয়ে রইল। জহির কথা বলতে পারল না। আনতারা বড় একটা শ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে কাপড় নিল। নিতে নিতে বলল, — জহির ভাই আমি খুবই স্বল্প বুদ্ধির মানুষ। এত প্যাঁচ আমি ধরতে পারি না। তবে আমার বাবা বলত ” আমরা যাকে সত্যিই ভালোবাসি তার ক্ষতি আমরা কখনো চাইতে পারি না।

জহির নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। এক ভুল তার পুরো জীবনে কলঙ্ক মাখিয়ে দিল। সে কি কখনো আর এই কলঙ্কের দাগ মুছতে পারবে?

মিথি জহিরের দিকে তাঁকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। তার বোনের সম্মান নষ্ট করে মৃত্যুর পরিকল্পনা করা লোকের সাথে তাকে সারা জীবন থাকতে হবে, তার দেওয়া খাবার খেতে হবে, তার দেওয়া কাপড় গায়ে জড়াতে হবে। একই ঘর, একই ছাদ, একই বিছানায় ঘুমাতে হবে। এতো বড় শাস্তি কি তার পাওনা ছিল। সে হেসেই বলল, — দরজাটা লাগিয়ে দাওতো ভাবি। আমার গা গুলিয়ে আসছে।

আনতারার বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যায় হয়ে গেল। রমিজ ভাই কোথায় আছে কে জানে? সে বেরিয়ে আশে পাশে তাঁকালো। এই বাড়ির চারপাশ বিশাল দেয়াল ঘেরা। জায়গাও অনেক। বাহিরের হাবভাব বোঝা যায় না। তবে পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। সন্ধ্যা যে হয়েছে বোঝার উপায় নেই।

সে একটু এগুলো। গেইটের সামনে ইব্রাহিম লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তাকে দেখে হালকা হেসে বলল, — ভালো আছ আনতারা?

আনতারা দাঁড়িয়ে গেল। লোকটার ব্যবহার অমায়িক,তবুও কেন জানি আনতারার ভয় হলো। আজাদ বলেছিল” মানুষের চোখ কখনো মিথ্যা বলেনা।

সেই অন্ধকারেও সে আজাদের চোখ দেখেছিল। এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই চোখ ছিল স্বচ্ছ। কোন ভয় নেই, অপরাধ বোধও নেই। আর এই লোকের চোখের দিকে তাঁকালেই আনতারার কেন জানি ভয় হয়। কেন? এই যে এখন তার গলা শুকিয়ে আসছে।

আনতারা অভিনয় জানে না, অনুভূতি আড়াল করতে পারে না। পারে না বলেই তার ভয় তার চোখে মুখেই ফুটে উঠল।

ইব্রাহিম সেই ভয়মাখা মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল। তারপর হালকা হেসে বলল, — সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চলো তোমাকে এগিয়ে দেই।

আনতারা ভয় মাখা কন্ঠেই বলল — রমিজ ভাই কোথায়?

— আছে সামনেই এসো?

আনতারা ঢোক গিললো। গিলে ধীরে ধীরে এগুলো। ইব্রাহিমও তার সাথে এগুলো। এগুতে এগুতে বলল, — তোমার শরীর ঠিক হয়েছে?

আনতারা হালকা করে শুধু মাথা নাড়ল। তার ভালো না লাগলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কারো সাথেই না।

— তোমাদের বাড়ির অবস্থা কি? ভাইজান ঠিক আছে?

আনতারা এবারো শুধু মাথা নাড়ল। ইব্রাহিম আবারো হাসলো। হেসে বলল, — একটা গল্প শুনবে আনতারা?

আনতারা কোন ভণিতা ছাড়াই দু- পাশে মাথা নাড়ল। সে শুনবে না। নেড়ে আশে পাশে তাঁকালো। রমিজ ভাই কই?

— সেইদিন তোমার বাবার গল্প বলেছি, আজবে দাদির। শুনবে না?

— আসলে আমাকে বাড়ি যেতে হবে। নানা ভাই তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে।

— আমিতো তোমাকে ধরে রাখছি না। চলো যেতে যেতে বলি।
— আপনার কষ্ট করতে হবে না। শুধু রমিজ ভাইকে একটু ডেকে দিলেই হবে।

ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে গেল। তার চোয়াল শক্ত হয়েছে। আনতারা অবশ্য ফিরেও তাঁকায়নি। তবে ইব্রাহিমের সাথে সেও দাঁড়িয়েছে। দাঁড়ালেও তার চোখ আশে পাশে ঘুরছে। রমিজ ভাই কই?

ইব্রাহিম শান্ত চোখে আনতারার সেই চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত ভাবেই বলল, — ঠিক আছে দাদির গল্প না শুনতে চাও, রুপার গল্প শুনো।

আনতারা সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকালো। মনে মনে একবার নামটা আওড়ালো। কোথায় যেন এই নামটা শুনেছে? তখনি সে চমকালো। সেই বেদেনী বৃদ্ধ মহিলা।

সে চমকেই ইব্রাহিমের দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই ইব্রাহিম বলল, — তুমি কি জানো আনতারা? যেই বাড়িকে তুমি থাকছো, নিজের বলে ভাবছো, যেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার এতো তাড়া তোমার। সেই বাড়ি থেকেই তোমার দাদিকে শুধু জীবনটা বাঁচানোর জন্য রাতের আঁধারে পালিতে যেতে হয়েছিল। কেন হয়েছিল জানো? শুধু তোমার বাবা তাঁর গর্ভে ছিল বলে।

আনতারা নিজেকে শক্ত করে বলল — আমি জানি! নানা ভাই বলেছে। তারা তো আমার দাদা- দাদিকে তেমন ভাবে চিনতো না। তাই ভুল বুঝেছিল।

— কি ভুল, তুমি তোমার নানা ভাই জিজ্ঞেস করোনি?

আনতারা উত্তর দিতে পারল না। সে জিজ্ঞেস করেনি। ইব্রাহিম বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, — অথচ তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো। আর আমিই সেই ব্যক্তি যে একমাত্র তোমার দাদিকে বাঁচিয়ে নিয়েছি, আগলে রেখেছি, আমার জন্যই তোমার প্রাণ প্রিয় বাবা এই পৃথিবীর আলো দেখেছে।

— এটা সত্য না।

— এটাই একমাত্র সত্য আনতারা।

— সেই দিনতো আপনি অন্য কথা বলেছিলেন।

— বলতে হয়েছিল। কেননা তোমার নানা ভাই যেমন চাইনি আনজুমের বাচ্চা দুনিয়াতে আসুক। তেমনি এটাও চায় না। তুমি সব কিছু জানো।

— আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না।

— না করলে নেই। তুমি না করলেই তো সত্য বদলাবে না। তো এক কাজ করো না কেন? তুমি না হয় তোমার নানা ভাইকে জিজ্ঞেস করো। তাকে তো আবার খুব বিশ্বাস করো।

আনতারা কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল! তার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠতে চাইছে। সে আর দাঁড়ালো না, নিজের মতোই এগুতে থাকলো। ইব্রাহিম হাসলো! তখনি ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে রমিজ বেরুলো। বেরুতে বেরুতে কঠিন চোখে ইব্রাহিমের দিকে তাকালো।

ইব্রাহিম বাঁকা হেসে বলল — কষ্ট হয়নিতো রমিজ?
রমিজ উত্তর দিল না। আনতারা যেই দিকে গেছে সে সেই দিকে দৌড়ে গেল।

আনতারা বাড়িতে পা রাখতেই থমকে গেল। তাকে দেখেই মুর্শিদার মুখের প্রতিটা শব্দ তীরের ফলার মতো তাঁর হ্নদয় ভেদ করে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অলক্ষী, অপয়া, জন্মের সময় মাকে খাইছে, বিয়ের আগে বাপেরে, এখন খাইতেছে তার সংসাররে। তা না হইলে তার ভরা সংসার এভাবে ডুববো কেন? তাগো ডুবাইয়া হে হাওয়া লাগাইয়া ঘুরে বেড়াইতেছে। বাড়ি আসছে সন্ধ্যা বেলা। ওরে কে কোথায় আছিস? পটের বিবির পা ধোয়ার পানি আন।

আনতারা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শাড়ির আঁচল শক্ত করে মুঠো করে ধীরে ধীরে নিজের রুমে এলো। সে চলে এলেও, মুর্শিদার বিলাপ চলতেই থাকলো। তাকে মদন দিতে লাগলো, তাদের বাপের বাড়ির মানুষ। যেই বোন বিয়েতে আসেনি। সে বিকেলে এসে হাজির। মনে কষ্ট পেয়েছে তবে বোনের বিপদে বাসায় মুখ গুঁজে পরে থাকবে নাকি? আর সে এসেই বোনের মাথায় যা ঢালার ঢেলেছে। সেগুলো’ই এখন মুর্শিদা আগুন রুপে বের করছে।

আনতারা রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে রইল। সব সময় অল্পতেই থরথরিয়ে কাঁপা আনতারা এই প্রথম খুব সহজেই যেন সব হজম করে ফেলল। মুর্শিদা অবশ্য এখন থেমেছে। থামতেই সে চোখ বন্ধ করল। কতক্ষণ এভাবে ছিল কে জানে। তার ধ্যান ভাঙলো দরজার শব্দে। আনতারা চোখ খুলল না। চোখ না খুললেও সে জানে কে এসেছে।

আজাদ রুমে এসে খাটে বসলো না। সে বসলো নিচে আনতারার পায়ের কাছে। বসে পা ছড়িয়ে বলল — আজকে বলবে না সব ঠিক করে দিন।

আনতারা চোখ খুললো না। সেও তার মতো আস্তে করে বলল — একদিন পরে এসে বুঝি তা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো।

— আমার ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কি, কিছু আসে যায় আনতারা?

— যায় না?

— তুমি বলো?

— আপনি বলুন?

— উঁহু! আজকে আমি না। তুমি বলো আনতারা। আমি তোমারটা শুনতে চাই।

আনতারা চোখ খুললো! খুলে অবশ্য আজাদের দিকে তাঁকালো না। নিজের মতো ধীরে ধীরে উঠে বসলো। বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকিয় বলল, — আপনি ভালো না খারাপ?
— খারাপ।

— আমার কাছে সত্য বলেন না মিথ্যা?

— খারাপ মানুষ! মিথ্যাই তো বলবো।

— আমি শুধু একটা প্রশ্ন করবো। উত্তরটা সত্য চাই। সেটা ভালো হোক খারাপ। বলবেন না?

— তুমি বলেছো সেখানে দ্বিতীয় কোন কথা নেই।

আনতারা ফিরে তাঁকালো। তাঁকাতেই চোখে চোখ পড়ল। আনতারা অবশ্য না তাঁকিয়েই বুঝেছে। সে উঠা মাত্রই আজাদ তার দিকে তাঁকিয়েছে । আর তাঁকিয়েই আছে। সে আজ চোখ ফেরালো না। চোখে চোখ রেখেই বলল, — আমি যা দেখেছি তা সত্য না মিথ্যা?

— আমি বললে তুমি বিশ্বাস করবে?

— হ্যাঁ করবো।

— কেন?

— কারণ আমার মন বলেছে। মানুষ মিথ্যা বলে মানুষের মন কখনো মিথ্যা বলে না।

আজাদ হাসলো! হেসে পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, — আমি যত খারাপই হই। তবে মেয়ে ঘটিত কোন দোষ বা বদনাম আমার নেই। যা দোষ, যা বদনাম, আর যা করার একজনের সাথেই করেছি। আর সেটা তুমি।

আনতারা সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো। যতই হজম করা শিখুক। এই লোকের মতো তো আর ঠোঁট কাটা হওয়া সম্ভব না। সে চোখ ফিরিয়েই বলল, — আপনি কি আমার দাদির ব্যাপারে কিছু জানেন?

— প্রশ্ন তো একটা হওয়ার কথা ছিল।

— খারাপ মানুষের বউ আমি। কথার খেলাপ তো হবেই।

আজাদ আবারো হাসলো! হেসে বলল, — জানি।

— আমাকে বলবেন?

— না।

— কেন?

— সব কিছু জানতে নেই।

আনতারা বড় একটা শ্বাস ফেলল। ফেলে বলল — মিথি সাথে কি হয়েছে?

— সব ঠিক হয়ে যাবে। জহির ভালো ছেলে।

— ভালো তো বিথীর সাথে এমন করতে গিয়েছিল কেন?

— যেই কারণে তুমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছো সেই কারণে।

আনতারা অবাক হয়ে আবার ফিরে তাঁকালো। আজাদ নিজের মতোই বলল, — খারাপ মানুষের অতি সহজেই অন্যর মাথা ধোঁলাই করতে পারে।

— উনি খারাপ মানুষ?

— উঁহু! খারাপতো আমি আনতারা।

— কি বলছেন?

— চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। দশদিন হোক তারপরে বলবো।

আনতারা হা হয়ে তাঁকিয়ে রইল। তার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। আজাদ সিগারেট পায়ে পিষলো। তখনি সোহাগী দৌড়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো। বাড়িতে পুলিশ আইছে, বড় মামি পুলিশ আইছে।

সবাই দৌড়ে বেরুলো। রাফিয়া ক্লিনিকে আত্মহত্যা করেছে। তার লাশ তার কেবিনে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মরার আগে সে চিঠি লিখে আজাদকে দায় করে গেছে। তার সাথে আজাদের নাকি দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্কে ছিল। তাকে ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করায় সে মানতে পারে নি। তাই আত্মহত্যা করেছে।

আনতারা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। আর আজাদ সব সময়ের মতো হাসলো।

চলবে…….